নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মণীন্দ্র ছেলেটির বয়স হবে চোদ্দ । তার বুদ্ধি খুব তীক্ষ্ণ কিন্তু পড়াশুনায় বিশেষ মনোযোগ নেই । তবু সে স্বভাবতই মেধাবী বলে বৎসরে বৎসরে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় । কিন্তু অধ্যাপকেরা তার কাছে যতটা প্রত্যাশা করেন সে-অনুরূপ ফল হয় না । মণীন্দ্রের পিতা দিব্যেন্দু ছিলেন এই বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ । কর্তব্যে ছেলের শৈথিল্য দেখে তাঁর মন উদ্বিগ্ন ছিল ।
অক্ষয় মণীন্দ্রের সঙ্গে এক ক্লাসে পড়ে । সে বড়ো দরিদ্র । ছাত্রবৃত্তির ' পরেই তার নির্ভর । মা বিধবা । বহু কষ্টে অক্ষয়কে মানুষ করেছেন । তার পিতা প্রিয়নাথ যখন জীবিত ছিলেন তখন যথেষ্ট উপার্জন করতেন । লোকের কাছে তাঁর সম্মানও ছিল খুব বেশি । কিন্তু ব্যয় করতেও তিনি মুক্ত হস্ত ছিলেন । তাঁর মৃত্যুর পরে দেখা গেল যত তাঁর ঋণ , সম্পত্তি তার অর্ধেকও নয় । অক্ষয়ের মা সাবিত্রী তাঁর যত কিছু অলংকার , গাড়ি ঘোড়া বাড়ি গৃহসজ্জা প্রভৃতি সমস্ত বিক্রয় করে ক্রমে ক্রমে স্বামীর ঋণ শোধ করেছেন ।
সাবিত্রী অনেকপ্রকার শিল্প জানতেন । কাপড়ের উপর রেশম ও জরির কারুকার্যে তাঁর নৈপুণ্য ছিল । দরজিরা তাঁর কাছে কাপড় রেখে যেত , তিনি ফুল কেটে পাড় বসিয়ে তার মূল্য পেতেন । তা ছাড়া তাঁর মোজা-বোনা কল ছিল , তিনি পশমের মোজা গেঞ্জি প্রস্তুত করে দোকানে বিক্রয়ের জন্যে পাঠাতেন । এই নিয়ে তাঁকে নিরন্তর পরিশ্রম করতে হত । এক-একদিন রাত্রি জেগে কাজ করতেন , নিদ্রার অবকাশ পেতেন না ।
সাবিত্রীর স্বামীর এক বন্ধু ছিলেন , তার নাম সঞ্জয় মৈত্র । একসময়ে ব্যবসায়ে যখন তাঁর সর্বনাশ হবার উপক্রম হয়েছিল তখন প্রিয়নাথ নিজের দায়িত্বে অনেক টাকার ঋণ সংগ্রহ করে তাঁকে রক্ষা করেন । সঞ্জয় সেই উপকারের কৃতজ্ঞতা কখনো বিস্মৃত হন নি । প্রিয়নাথের মৃত্যুর পরে তিনি বারংবার সাবিত্রীকে অর্থসাহায্যের প্রস্তাব করেছিলেন । সাবিত্রী কিছুতেই ভিক্ষা নিতে স্বীকার করেন নি । তা ছাড়া তাঁর প্রতিজ্ঞা অর্ধাশনে থাকবেন তবু কখনো ঋণ করবেন না ।
সঞ্জয়ের পুত্রের উপনয়নে একদিন তাঁর বাড়িতে সাবিত্রীর নিমন্ত্রণ ছিল । তাঁর বেশভূষা নিতান্ত সামান্য ছিল ; এক থার্ড ক্লাসের গাড়ি ভাড়া করে অক্ষয়কে নিয়ে যখন তিনি এলেন দ্বারের লোকেরা কেউ তাঁদের লক্ষ করলে না ।
আজ সাবিত্রীর সকাল-সকাল বাড়ি ফেরা চাই । দরজিকে কথা দিয়েছে বিকেল তিনটের মধ্যে একটা জামার কাজ শেষ করে তাকে ফিরিয়ে দেবেন ।
অন্তঃপুরে সঞ্জয়ের স্ত্রী নৃত্যকালীকে গিয়ে বললেন , “ আজ আমাদের দুজনকে সকাল-সকাল খাইয়ে বিদায় করে দাও । ”
নৃত্যকালীর ধনের অহংকার বড়ো তীব্র , তিনি সাবিত্রীর অনুরোধ গ্রাহ্যই করলেন না । ধনীঘরের কুটুম্বদের আহারের ব্যবস্থা করতে তখন তিনি ব্যস্ত ছিলেন । সাবিত্রীকে তাদের সঙ্গে একত্রে বসবার তিনি উপযুক্ত মনে করেন নি ।
সাবিত্রী বাড়ির উজ্জ্বলা দাসীকে অনুনয় করে বললেন , “ কাউকে আমার জন্যে একখানা থার্ডক্লাস গাড়ি ডেকে দিতে বলে দাও , এখনি বাড়ি যাওয়া আমার বড়ো প্রয়োজন । ”
উজ্জ্বলা বললে , “ আচ্ছা , দেখছি । ” ব'লে চলে গেল । কিছুই করলে না ।
অক্ষয়ের বয়স তখন খুব অল্প ছিল । সে বললে , “ মা , আমি গাড়ি ডেকে আনছি । ”
সাবিত্রী তাকে নিষেধ করে মুখের উপর ঘোমটা টেনে পথে বেরিয়ে গেলেন । ঘরে কিছু মুড়ি ছিল তাই গুড় দিয়ে মেখে অক্ষয়কে খাওয়ালেন । নিজে কিছুই খেলেন না । অক্ষয় সেইদিন প্রথম তার মায়ের চোখে জল দেখেছিল । সে কথা কোনোদিন সে ভুলতে পারে নি । সেদিন থেকে তার মনে এই প্রতিজ্ঞা ছিল , যে , বড়ো হয়ে সে তার মায়ের দুঃখ এবং অসম্মান দূর করবে । দিন রাত্রি একমনে সে পড়া করে , আর বৎসরে-বৎসরে পরীক্ষায় পুরস্কার পায় ।
ক্লাসে অক্ষয় ছিল সর্বপ্রথম । মণীন্দ্রের বুদ্ধি তার চেয়ে বেশি ছিল কিন্তু পরীক্ষায় কোনোদিন তাকে অতিক্রম করতে পারে নি ।
এ বৎসর পরীক্ষার সময় উপস্থিত হল । মণীন্দ্র অন্যসকল বিষয়েই ভালো উত্তর দিয়েছিল , কেবল অঙ্কের প্রশ্ন তার কঠিন ঠেকল ।
অক্ষয় তার সঙ্গে এক জায়াগাতেই পরীক্ষা দিতে বসেছে । একটার সময় জলখাবারের আধঘণ্টা ছুটি ছিল । অক্ষয় দ্রুত পরীক্ষার উত্তর লেখা শেষ করে একটার কিছু আগেই বেরিয়ে গেল । ডেস্কের উপর ছিল তার কাগজগুলি । মণীন্দ্র তার থেকে দুখানা কাগজ চুরি করে নিয়ে চলে গেল , কেউ জানতে পারল না ।
এবার অক্ষয়ের পরীক্ষার ফল ভালো হল না । সে বৃত্তি পাবে নিশ্চিত আশা করে ছিল কিন্তু যখন পেল না তখন সকলেই বিস্মিত হল । এবার মণীন্দ্র পেলে পুরস্কার । তার পিতা দিব্যেন্দু সকলের চেয়ে আশ্চর্য হলেন । কেন যে এমন হল তার কারণ বুঝতে পারলেন না ।
হঠাৎ একদিন বুঝতে পারলেন । মণীন্দ্রের পড়বার ঘরে তার দেরাজের মধ্যে অক্ষয়ের হাতের লেখা দুখানা পরীক্ষার পত্র দিব্যেন্দুর হাতে পড়ল । মণীন্দ্র তার দুষ্কর্মের কথা স্বীকার করলে ।
বিদ্যালয়ে প্রাইজ দেবার দিন উপস্থিত হল । প্রথম প্রাইজের জন্যে মণীন্দ্রের ডাক পড়ল । সে প্রাইজ হাতে নিয়ে বললে , “ এ আমার প্রাপ্য নয় — এ প্রাইজের [অধিকার] অক্ষয়ের । আমি অপরাধ করেছি । ”
বাড়ি এসে দিব্যেন্দু মণীন্দ্রকে বললেন — “ যে অপরাধ করেছ তার দণ্ড তোমার শোধ হয় নি । মণীন্দ্রের [অক্ষয়ের ] ছাত্রবৃত্তি মাসিক পনেরো টাকা নিজে থেকে তোমার দেওয়া চাই । ”
মণীন্দ্র ভেবে পেল না কী উপায়ে সে দিতে পারে । দিব্যেন্দু বললেন , “ এক বৎসর তোমাকে পায়ে হেঁটে বিদ্যালয় যেতে হবে । গাড়িঘোড়ার যে খরচ প্রতি মাসে লাগে তারি থেকে অক্ষয়ের বৃত্তির টাকা শোধ হতে পারবে । ”
©somewhere in net ltd.
১| ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ১২:৩৩
খেয়া ঘাট বলেছেন: চমৎকার গল্প।