নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নানা দেশ কত কথা

শোভন শামস

আমার দেখা নানা দেশের কথা সবার জন্য - পাঠকের ভাল লাগাতেই আনন্দ

শোভন শামস › বিস্তারিত পোস্টঃ

কেজিবির আদেশে গুপ্ত হত্যা-২

১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ২:০২

গিয়র্গি মার্কভ ও টুডোর জিভকভ দুজন দুই মেরুর এবং দুই সামাজিক অবস্থানের হলেও এই বৈপরিত্যই তাদের দুজনকে কাছে এনেছিল । মার্কভ ছিল নাট্যকার ও সাহিত্যিক, সমাজের কর্মজীবী সম্প্রদায়ের লোক জিভকভ ছিল কৃষক পরিবারের এবং বুলগেরিয়ার কমুনিষ্ট পার্টির নেতা। মার্কভ এর লিখা নাটক ও বই সরকারী ভাবে প্রকাশের অনুমতি পেয়েছিল ও প্রশংসিত হয়েছিল । জিভকভের সাথে বন্ধুত্বের সুবাদে তাকে সীমিত আকারে সরকারের সমালোচনা করার স্বাধীনতাও দেয়া হয়েছিল। মার্কভ সরকারের কৃপা লাভ করেছিল এবং একজন বিশ্বাসযোগ্য গুনীব্যক্তি হিসেবে সরকারের ভেতরে ঢুকতে সক্ষম হয়েছিল।

মাউন্ট ভিটোসাতে জিভকভের এবং অন্যান্য উচ্চপদের নেতাদের সুন্দর অবকাশ কেন্দ্র এ গুলো সাধারণ মানষের ধরাছোয়ার বাইরে । এ ধরণের অভয়াশ্রম ও বিনোদনের জায়গা কমুনিষ্ট পার্টির সব হর্তাকর্তার জন্য নির্মিত । এর চারিদিকে নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা । ২৪ ঘন্টা নিরাপত্তা প্রহরী এখানে কাজ করে যাচ্ছে। এখানে সর্বসাধারনের প্রবেশ ও আগ্রহ দেখানো নিষিদ্ধ । অবকাশ কেন্দ্রে পাইনের গভীর বন ও সুন্দর সুন্দর পাহাড়ী ঝর্নার ধারে ছোট ছোট কেবিন বানানো হয়েছে সব উচ্চপদস্থ কমুনিষ্ট কর্মকর্তাদের জন্য । এগুলো শিকারের জন্যও ব্যবহার করা হয়। ঝর্নার পানি এত স্বচ্চ ও পরিস্কার যে তা থেকে তখনি পানি খাওয়া যায়। মার্কভ এখানে শিকারের উদ্দেশে আসত না। সে এখানকার কর্তাব্যক্তিদের সাথে গল্প গুজব করত আর উচ্চ পদস্থ কমুনিষ্ট কর্তাদের জীবন যাত্রা সম্বন্ধে ধারণা পেতে চেষ্ট করত । সে মানুষের কাছে তাদের লোক দেখানো জীবন ও আগোচরে যাপিত আড়ম্বর পূর্ণ জীবন এর মধ্যে ফারাক টা অনুভব করার চেষ্টা করত।

সেখানে শোফার চালিত কার সর্বক্ষণের জন্য প্রস্তুত রয়েছে যে কোন জায়গায় যাওয়ার অপেক্ষায় । রান্নাঘর ও রিফ্রিজারেটর গুলো বিভিন্ন ধরণের বিদেশী খাবার ও মদে পূর্ন থাকত । যা সোফিয়ার শুন্য খাবারের দোকান গুলোতে কখনোই দেখা যেত না। অনেক খাবার ও মদের নাম দেশবাসী কখনো শোনেনি এবং শুনতে পারারও কোন সুযোগ নেই । সে বুঝল যে কোন মানুষকে প্রয়োজনে দলে আনা এবং উচু পদের লোকের জন্য যে কোন ধরণের বিনোদন সামগ্রী যোগাড় সম্ভব যা কিনা সাধারণের জন্য নয় ।আলেক জান্ডার ডুবেক ১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভিয়াকে রাশিয়ার কঠোর ও দমন পীড়ন মূলক অবস্থা থেকে উদ্ধার করার জন্য একটা অসফল প্রচেষ্টার নেতৃত্ব দিয়েছিল। রাশিয়ানরা ১২ বছর আগের সেই হাঙ্গেরীর মতই তা নৃশংস ভাবে দমন করেছিল।

সোভিয়েত ট্যাংকের চাকার নীচে চেকের স্বাধীনতার ইচ্ছার ও আরো অনেক বেশী কিছু পিষ্ট করা হয়েছিল। এরপর সোভিয়েত দলভুক্ত দেশগুলোতে এ ধরণের বিপ্লব বা স্বাধীনতার কোন ধরণের উদ্দ্যোগ না নেয়ার জন্য সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছিল। বুলগেরিয়া মস্কোর একটা অনুগত দেশ হিসেবে নিজেকে দেখত । মার্কভ এই সম্পর্ককে পরবর্তীতে বর্ণনা করেছিলেন ঠিক এভাবে “ একজন ব্রিটিশ লর্ড ও তার বার্টলারের মধ্যে যে ধরনের সম্পর্ক থাকে মস্কোর সাথে সোফিয়ার সম্পর্ক ঠিক তেমনি” । রাশিয়া এ ধরনের বিরুপ মন্তব্যের প্রতি তীব্র নিন্দা জানায় এবং এর প্রেক্ষিতে দ্রুত জিভকভ মার্কভের প্রতি তার আচরণ পরিবর্তন করে ফেলে। মাউন্ট ভিটোসাতে মার্কভ এর যাতায়াত ও আমন্ত্রন বন্ধ করে দেয়া হয়। দেশের অতীত বিষয়ক কোন নাটক লেখার জন্য তার পূর্বের পাওয়া অনুমতি বাতিল করা হয়। এছাড়াও বুলগেরিয়ার সমসাময়িক কালের জীবনযাত্রা সম্বন্ধেও তার লিখার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এমনকি তার একটা লেখার তীব্র সমালোচনা করে জিভকভ সোফিয়ার পত্রিকাতে নিবন্ধ প্রকাশ করে।

মার্কভ স্বপক্ষ পরিত্যাগ করে এবং সে জানত যে সে কি ঝুকি নিচ্ছে। তার মত একজন সুপরিচিত ও প্রসিদ্ধ লেখকের এ ধরণের পক্ষত্যাগের অপরাধে অনায়াসে তার অবর্তমানে তাকে সাড়ে ছয় বৎসরের জেল দন্ড দেয়া হবে। এছাড়াও জিভকভের একজন বন্ধু এবং বিভিন্ন মন্ত্রী ও বিখ্যাত লোকদের সান্নিধ্য প্রাপ্ত এবং মাউন্ট ভিটোসার জাঁকজমকপূর্ণ জীবনের স্বাধ ও সন্ধান জানায় তার পক্ষত্যাগের অপরাধের মাত্রার তীব্রতা বেড়ে যায় । এর সাথে জিভকভ এর ব্যক্তিগত আক্রোষ ও যোগ হয় ফলে তার অপরাধের গুরুত্ব ও শাস্তির পরিমান বেড়ে যায়।

এ সব কাজের পরিনতির কথা ভেবে মার্কভ বসে থাকেনি। ইটালীতে তার আগে পক্ষত্যাগ করে আসা এ্বং বর্তমানে স্থায়ী ভাবে বসবাসরত তার ভাই নিকোলার কাছে কিছুদিন থেকে মার্কভ লন্ডনে চলে আসে। এখানে সে বিবিসির বুলগেরিয়ান সেকশন এর প্রোগ্রাম এসিষ্ট্যান্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে থাকে । ষ্টান্ড এবং ফ্লিট স্ট্রীটের ত্রিকোন দ্বীপের মত জায়গায় অবস্থিত বিবিসির সদর দপ্তর বুশ হাউজ থেকে সে দিনে তিনবার বুলগেরিয়ার বার্তা সম্প্রচার করা শুরু করে। সে সেখানে বুলগেরিয়ার জন্য সম্প্রচারিত খবর পড়ত এবং বিবিসিতে কর্মরত থাকা অবস্থায় শেষ দিন পর্যন্ত একাজে নিয়োজিত ছিল। এছাড়াও সে বিবিসির সাপ্তাহিক সাংকৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য ও নিয়মিত লিখত। এখানে থাকা অবস্থায় সে অ্যানাবেলের সাথে পরিচিত হয় এবং প্রেমে পড়ে। পরবর্তীতে তারা বিয়ে করে। অ্যানাবেলের বাবা ক্রিষ্টোফার বিবিসির এক সময়কার ইংরেজী বিভাগের প্রধান ছিলেন। তারা লন্ডনের উপক›েঠ ক্লাপহাম এর লিনেট অ্যাভিনিউতে বসবাস করত। একমাত্র মেয়ে সাসাকে নিয়ে তাদের জীবন ভালই কাটছিল লন্ডনের থিয়েটার এর জন্য মার্কভ আবার লেখালেখি শুরু করে । লেখার বিষয়বস্তু ছিল তৎকালীন কমুনিষ্ট শাসিত বুলগেরীয় জীবনের প্রতি কটাক্ষ মূলক ।

১৯৭৭ সালে মার্কভ এর পিতা গুরুতর অসস্থ হয়ে পড়ে। তিনি একজন সেনা কর্মকর্তা ছিলেন । মার্কভ এবং তার ভাই রোমের বুলগেরিয়ান দুতাবাসে তাদের পিতাকে বুলগেরিয়া থেকে বের করে আনার অনুমতি চেয়ে আবেদন করে। এ আবেদনের প্রেক্ষিতে তাদের মাকে সে বছরের শেষ দিকে রোমে আসার অনুমতি দেয়া হলেও তার বাবাকে আসার অনুমতি দেয়া হয়নি। সোফিয়াতেই তাদের বাবা মারা যান এবং তারা আর কখনো বাবাকে দেখতে পায়নি। মার্কভের কাছে বুলগেরীয় প্রশাসনের নেতৃবৃন্দের এই ধরনের প্রহসন মূলক ও প্রতারনা তার ব্যক্তিগত ক্ষোভের তিক্ততা আরো বাড়িয়ে দেয়।

‘রেডিও ফ্রি ইউরোপ’ থেকে মার্কভ তার বুলগেরিয়াতে থাকাকালীন মাউন্ট ডিটোসার আনন্দময় জীবনের কথা, জীভকভ এবং মন্ত্রীদের সাথে তার আলাপ চারিতা এবং অন্যান্য স্মৃতিময় ঘটনা গুলো একে একে প্রচার করতে শুরু করে। ১৯৭৫ সাল থেকে বিবিসির পাশাপাশি এই সংস্থায় মার্কভ তার সম্প্রচারকার্য চালিয়ে আসছিল। দুই বছর ধরে তার সেই স্মৃতিচারণ সম্প্রচার হয়েছিল। তার অনুষ্ঠানগুলোতে সাধারন বুলগেরিয়ানদেরকে কিভাবে রাজনীতিতে জোর করে সম্পৃক্ত করা হতো তা তুলে ধরা হয়েছিল এবং এ ব্যাপারে তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞান ছিল। কারণ মার্কভ এক সময় একটা ক্যামিকেল প্রস্তুতকারক কারখানার দায়িত্ব প্রাপ্ত ছিল। শ্রমিকের সাথে রাজনীতির যোগসুত্রতা তার ভালই জানা ছিল। নির্বাসিত এই ক্যামিকেল ইঞ্জিনিয়ার লেখক হিসেবে বেশ অভুতপূর্ব সাড়া পেয়েছিল। তার শ্রোতার সংখ্যা যদিও খুব বেশী ছিল না

তবে তা একদম কমও ছিল না। সোফিয়াতে থেকে লেখক হিসেবে সে এতো শ্রোতা পেত কিনা সন্দেহ। অ্যানাবেলের মতে ৮০ লক্ষ মানুষের দেশে প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষ মার্কভ এর লিখিত এবং লন্ডন থেকে সম্প্রচারিত নাটক শুনত। বুলগেরিয়ান সিক্রেট পুলিশ তার এই সম্প্রচার জ্যাম করার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নিত। তবে তারা নিজেরা এই প্রোগ্রাম শোনার জন্য এবং এটাকে মনিটর করতে একটা চ্যানেল খোলা রাখত । বুলগেরিয়ান জনগন সেই ফ্রি চ্যানেলটির সন্ধান পেয়ে যায় । এতে মার্কভ এর শ্রোতার সংখ্যা কমার সুযোগ আর হয়ে উঠেনি। বুলগেরিয়া ও এর নিয়ন্ত্রক মস্কোর কাছে মার্কভ এর হিসেবের পাতা কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় বিশ্বাসঘাতক হিসেবে তারা তাকে চিহ্নিত করে।

১৯৭১ সাল পর্যন্ত ‘রেডিও ফ্রি ইউরোপ’ সি আই এর ফান্ড দিয়ে পরিচালিত হতো। পরবর্তীতে তা ইউ এস কংগ্রেস মনোনীত একটা পাবলিক বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালিত হতো পরিচালক বদলালেও রেডিও ফ্রি ইউরোপের সম্প্রচারে কোন ব্যাঘাত ঘটেনি এবং মস্কো কিংবা আমেরিকাতেও কেউ বিশ্বাস করেনি যে ‘রেডিও ফ্রি ইউরোপ’ সম্প্রচারে এখন আর সি আই এর হাত নেই ।

মার্কভ এর ‘অনুপস্থিত বার্তার’ একটা অংশের সাব টাইটেল ‘টুডোর জিভকভ এর সাথে সাক্ষাৎকার’ এই সম্প্রচারে মার্কভ বুলগেরিয়ার সাংস্কৃতিক জীবনে জিভকভ এর হস্তক্ষেপের ব্যাপারটা বিশদ ভাবে তুলে ধরে জিভকর্ভ যেভাবে বুলগেরিয়ার সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রন করত ও সুবিধাজনক ভাবে ব্যবহার করত তা চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয়েছিল এই অনুষ্ঠান গুলোতে। মার্কভ বলেছিল যে বুলগেরীয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও শিল্পীদেরকে যে ভাবে জিভকভ নিয়ন্ত্রন ও চালিত করত তা ছিল নজির বিহীন। তাদের স্বাধীনতা হরণ ছিল নৈমিত্তিক । তাদের বাধ্য করা হতো নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে। বুলগেরীয় গুনীজনের প্রতি এ ধরনের নেতীবাচক আচরণ আর কেউ কখনো করেনি। সব ধরনের কর্মকান্ডে কমুনিষ্ট পার্টির অনধিকার চর্চা ছিল সন্দেহাতীত এবং এ সব কাজে অগ্রনী ভূমিকা পালন করত সংস্কৃতির কর্মকান্ডের প্রধান পরিচালক ও আয়োজক টুডোর জিভকভ। জিভকভ এর প্রত্যক্ষ নির্দেশ ছাড়া সুশীল সমাজের মানুষগুলোর জীবনে কোন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের সূচনা হতো না। যে কোন বড় নিয়োগ,বদলী, পদোন্নতি কিংবা পদচ্যুতি তার নির্দেশেই ঘটত। কোন শাস্তি মূলক ব্যবস্থা কিংবা পুরস্কার তার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে হতো। তাকে বাদ দিয়ে এসব ঘটনা ছিল অসম্ভব। যে কোন ধরনের সংগঠনের কিংবা প্রতিষ্ঠানের উপর আক্রমন তার আদেশ অনুযায়ী সংগঠিত হতো। মোটকথা সংস্কৃকিত কর্মী ও বুদ্ধিজীবিদের জীবন যাত্রায় জিভকভ এর ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য । তাই মার্কভ এর সেই সব সম্প্রচার জিবকভ এর ক্ষোভের তীব্রতা বাড়িয়ে দিয়েছিল। একই সাথে মস্কোও তার এ ধরণের কর্মকান্ডে ছিল ক্ষিপ্ত।

মার্কভকে হত্যা করা হবে এ মর্মে ব্যক্তিগত ভাবে তাকে সতর্ক করা হয়েছিল। প্রথমে টেলিফোনে এবং পরবর্তীতে তাদের ক্লাপহাম এর বাড়ীতে এক বুলগেরীয় লোকের মাধ্যমে এ সংবাদ দেয়া হয়। অ্যানাবেল সেই অপরিচিত বুলগেরিয়নকে দেখে বুঝতে পারেনি আসলে সে কি বন্ধু না শক্রু। তাকে সে ঠিকমত খেয়াল করতে পারেনি এবং পরবর্তীতে সনাক্ত করতেও পারত না। গিয়র্গি ভয় পেয়েছিল, যদিও সে জানত যে তাকে যে কোন সময় আক্রমন করা হতে পারে । যে দিন থেকে সে বুলগেরিয়া ত্যাগ করে ইতালী হয়ে লন্ডনে এসেছিল সে দিন থেকেই মৃত্যু তাকে অনুসরণ করছিল। তবে এ সব কিছুই তাকে রেডিও ফ্রি ইউরোপ অথবা বুলগেরিয়ার জন্য সম্প্রচারিত জার্মান সার্ভিস ‘ডয়েস ভ্যালি’ এর জন্য অনুষ্ঠান লিখা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। তার কলম চলছিল অবিরত। স্মৃতিচারনের সময় অ্যানাবেল জানিয়ে ছিল যে তাদের দুজনের কেউই ভাবতে পারেনি যে মার্কভকে আসলেই হত্যা করা হবে। ঠান্ডা মাথায় খুন করা স্পাই ফিকশনে সম্ভব। তথাপিও মার্কভ সব সময় কতর্ক থাকত। অ্যানাবেল দেখত যে সে কখনো অন্ধকার গলিতে কিংবা রাস্তায় যেত না। মার্কভ ধারনা করতে পেরেছিল যে খাদ্যের মাধ্যমে বিষপ্রয়োগে তাকে হত্যা করা হবে। তাই সে কোন কিছু খেতে বা পান করতে সব সময় সতর্ক থাকত। মার্কভ এর টেলিফোন নাম্বার ডাইরেক্টরীতে থাকত না। তার বন্ধু বান্ধব সবই ছিল বুলগেরীয় ইমিগ্র্যান্ট ও পক্ষত্যাগী । এ দলে নতুন কোন মুখ এলে তাকে বিশ্বাস করার আগে সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করা হতো।

১৯৭৮ সালের ৭ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার দিন বুশ হাউজে মার্কভ এর ডগ ওয়াচ ডিউটি ছিল। এটা টানা ১২ ঘন্টার কাজ, মাঝখানে শুধু এক ঘন্টার বিরতী। একই সাথে তাকে রাতের সম্প্রচার ও সকালের খবর পাঠের কাজ করার দায়িত্ব ছিল এ দিনে। সাদা চুলের ছয়ফিট লম্বা, হ্যান্ডসাম ও সুঠামদেহী মার্কভের কাছে বৎসরের প্রথমে পাওয়া হত্যার হুমকীর গুরুত্ব তখন আস্তে আস্তে কমে আসছিল। সে কিছুটা রিল্যাক্স ভাবেই চলাচল করত এবং সতর্কতার মাত্রাও যথেষ্ট কমে গিয়েছিল। সাউথ ব্যাংক কমপ্লেক্স এর কাছে টেমস নদীর দক্ষিণ পাড়ের একটা রাস্তায় সে প্রতিদিন তার সবুজ ও ক্রিম রং এর সিমকা ভ্যানটা পার্ক করে রাখত। এটা চালিয়ে সে ক্ল্যাপহামের বাসা থেকে তার কর্মস্থলে আসত । বিকাল সাড়ে ছটায় সন্ধ্যার খবর পড়া শেষে সে বুশ হাউজ থেকে বেরিয়ে আসত এবং আধা ঘন্টা হেঁটে ওয়াটার লু ব্রিজ পার হয়ে গাড়ীটাকে বুশ হাউজের কাছাকাছি এনে রাখত। বিকেল হয়ে যাওয়ায় পার্কিং এর নিয়ম কানুন তখন শিথিল হয়ে যেত বলে কাছাকাছি পার্কিং এ কোন সমস্যা হতো না।

সেপ্টেম্বরের সেই দিনটিতে আবহাওয়া পূর্বাভাষে বলা হয়েছিল বৃষ্টি এবং মাঝে মাঝে হালকা বর্ষণ হতে পারে। কিন্তু মার্কভ যখন সাদা রং এর বিশাল বুশ হাউজ ছেড়ে বের হয় তখন আবহাওয়া ছিল চমৎকার। সিটি ব্যাংক ও অষ্টেলিয়ান দুতাবাসের মাঝে থাকা বুশ হাউজ এবং এর কাছের রাস্তায় তখনো অনেক মানুষ রেইনকোট নিয়ে এবং কিছু কিছু মানুষ ছাতা হাতে নিয়ে চলাচল করছিল। ওয়াটারলু ব্রিজের দুই পার্শ্বেই বাস ষ্টপেজ আছে। উত্তরের বাস ষ্টপেজ হলবর্ণ যাবার আন্ডার পাসের কাছে এবং দক্ষিণের ষ্টপেজটা ন্যাশনাল থিয়েটার ও ফেষ্টিভ্যাল হলের কাছে মার্কভ ন্যাশনাল থিয়েটারের কাছে যখন দাড়ানো মানুষের লাইন কেবল পার হচ্ছিল ঠিক তখনই সে তার ডান হাটুতে ধারালো কোন কিছুর খোঁচা অনুভব করে। সাথে সাথেই ব্যাথা ও জ্বালা করতে থাকে সেই জায়গাটা। মার্কভ পেছন ফিরে দেখতে পায় একজন পথচারী তার ছাতাটা সরিয়ে নিচ্ছে। তারা দুজনই সামনা সামনি দাড়িয়ে ছিল। বাসের জন্য অপেক্ষারত লোকটা ইংরেজীতে দুঃখ প্রকাশ করে। তবে তার উচ্চারণে বিদেশী টান বুঝা যাচ্ছিল। হঠাৎ থতমত খেয়ে লোকটা তার ছাতাটা উচু করে ধরল এবং রাস্তা দিয়ে যেতে থাকা খালি একটা ট্যাক্সিতে উঠে চলে গেল। মার্কভ এর উরুর ব্যাথাটা সাময়িক ছিল। সে লোকটাকে থামানোর কোন চেষ্টা করেনি এমনকি তার সাথে কথাও বলেনি।

৭ টার পর মার্কভ তার ভ্যানটা নিয়ে এসে বুশ হাউজে আবার ফিরে আসল। বুলগেরিয়ান সেকশনে তার অফিসে ফিরে এসে তারই মত আরেক জন নির্বাসিত বুলগেরিয়ান লিভ লিরকভ সে বলল যে একজন



আততায়ী তাকে একটা ছাতা দিয়ে ধাক্কা দিয়েছে। মার্কভ তার জিন্সের প্যান্টটা নামিয়ে দেখল যে তার উরুতে একটা ছোট কিন্তু বেশ জ্বলজ্বলে লাল দাগ। দেখে মনে হয় যে কোন পোকা কামড় দিয়েছে। রাত ১০-৩০ মিনিটে মার্কভ তার লিনেট অ্যাভিনিউর বাড়িতে এসে তার স্টাডি রুমে রাখা একটা বিছানায় ঘুমাতে গেল। সে অ্যানাবেলকে বিরক্ত করতে চাইছিল না কারণ ভোরে তাকে আবার উঠে বুশ হ্উাজে যেতে হবে। কিন্তু রাত ২ টার দিকে মার্কভ এর হাঁটাচলার শব্দে অ্যানাবেল জেগে উঠে। সে দেখে যে মার্কভ কে অসুস্থ লাগছে এবং তার গায়ে ১০৪ ডিগ্রি জ্বর। তাদের ডাক্তারকে ফোন করা হলে ডাক্তার জানায় যে এটা ইনফ্লুয়েঞ্জা হতে পারে। সে সময় এ ধরণের জ্বরে অনেকে ভুগছিল। অ্যানাবেল তার স্বামীর কাছে বসেছিল । হঠাৎ মার্কভ বলে উঠে আমার কেন যেন মনে হচ্ছে এই জ্বরের সাথে আজকে বিকেলের ঘটনার কোন সম্পর্ক আছে। অ্যানাবেল ঘটনাটা জানতে চাইলে মার্কভ তার কাছে সবকিছু খুলে বলে।

তার অবস্থা এত দ্রুত খারাপের দিকে যায় যে তাকে লন্ডনের বালহাম জেলার সেন্ট জেমস হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। সে অজ্ঞান হয়ে যায় এবং তাকে ইনটেনসিভ কেয়ারে রাখা হয়। ডাক্তাররা মার্কভের অসুস্থ্য অবস্থা দেখে ভড়কে যায়। তার প্রচন্ড জ্বর এবং কোন ধরণের বিষাক্ত পদার্থের বিষক্রিয়ার লক্ষণ প্রকাশ পায়। তার শ্বেত রক্ত কনিকা প্রতি কিউবিক মিলিমিটার ৩৩০০০ হয়ে যায়। একজন স্বাভাবিক মানুষের যা ৫,০০০ থেকে ১০,০০০ হওয়ার কথা।

মার্কভ অজ্ঞান অবস্থাতেই মাঝে মাঝে মারমুখী হয়ে উঠে আবার একটু পরে শান্ত হয়ে যায়। অসুস্থ্য থাকা অবস্থাতেই সে ওয়াটারলু ব্রিজের কাছে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা বলে। তার এক্সরে করা হয়। সেই ছোট ঘার কাছে কোন একটা ধাতব জিনিষ এর ছবি এক্সরেতে ধরা পড়ে।

সোমবার ১১ সেপ্টেম্বর মার্কভ মারা যায়। তার বিষক্রিয়ার কারণ তাৎক্ষণিক ভাবে কোন ডাক্তার বা সার্জন বের করতে পারে নি। মার্কভ এর উরু থেকে ১.৫২ মিলিমিটার ব্যাসের একটা ছোট ধাতব বল বের করা হয়। এটা ৯০ ভাগ প্লাটিনাম ও ১০ ভাগ ইরিডিয়াম এর সংকর ধাতুর তৈরী এর সাথে সামান্য পরিমান রেডিয়াম ও প্যালাডিয়াম এর উপস্থিতি পাওয়া যায়। এটা ছাতার সরু অংশে লাগানো ছিল বলে ধারনা করা হয়। এই বলে দুটো ০.৩৫ মিলিমিটারের ছোট্ট গর্ত ছিল। এই গর্ত গুলো মোম দিয়ে বন্ধ ছিল। মার্কভের শরীরের তাপে মোম গলে যায় এবং গর্তের ভিতর রাখা বিষ বের হয়ে মার্কভ এর মৃত্যু ঘটায়। বল এবং মার্কভ এর টিস্যুর নমুনা সংগ্রহ করে উইলট সায়ারের পোরটন ডাউন এ অবস্থিত ব্রিটিশ সরকারের অতি গোপনীয় ক্যামিক্যাল ডিফেন্স এষ্টাব্লিশমেন্ট এ বিশ্লেষনের জন্য পাঠানো হয়।

এখানে বৈজ্ঞানিকরা সেই বলের ভিতর কি বিষ ছিল তা পরীক্ষা নিরিক্ষা করে বের করে। বলের গর্তে রেসিন নামের বিষ ছিল। এটা ক্যাষ্টর ওয়েল গাছের প্রোটিন থেকে বানানো বিষ যা পৃথিবীর পাঁচ ধরনের তীব্র বিষের একটা। এটা গোখরো সাপের বিষের চেয়ে দ্বিগুন শক্তিধর এবং এক গ্রাম রেসিন দিয়ে ৩৬,০০০ মানুষ মারা যেতে পারে। প্রোটন ডাউনে বৈজ্ঞানিকেরা ধারনা করে যে এই বিষের তীব্রতা আরো বাড়ানোর জন্য এটার সাথে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া মেশানো হয়ে থাকতে পারে যা দ্রুত গ্যাংগ্রিন হওয়ার জন্য দায়ী। বিগত দুটি বিশ্বযুদ্ধেই ব্রিটিশ ক্যামিক্যাল ওয়ারফেয়ার বিশেষজ্ঞরা রেসিনকে শত্র“র বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য সর্বাপেক্ষা বিপজ্জনক বিষ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। এটার কোড ওয়ার্ড ছিল ডব্লিউ ২ । আর দুইটা দেশে রিসিন এর বিষক্রিয়ার উন্নয়নের জন্য গবেষণা চলছিল সেগুলো হলো চেকোস্লাভাকিয়া এবং হাঙ্গেরী। দুটি দেশই ছিল কমুনিষ্ট ব্লকের এবং এগুলোকে নিয়ন্ত্রন করত সোভিয়েত ইউনিয়ন। রেসিনকে রাখার জন্য যে ছোট বল ছিল সে ধরণের জিনিষ রাশিয়াতে উৎপাদন করা হতো।

২ জানুয়ারি ১৯৭৯ সালে মার্কভ এর মৃত্যুর ব্যাপারে ঘোষণা করা হয় যে তাকে অন্যায় ভাবে হত্যা করা হয়েছে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হলোযে মার্কভ এর শেষ নাটক যা তার মৃত্যুর আগে প্রচারিত হয়েছিল এবং যার ফলে তাকে মরতে হলো সেই নাটকের নাম ছিল “ আততায়ী ” । সরকারী ভাবে মার্কবের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান ও আততায়ীকে ধরার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। কিন্তু তিন বছর পরও তার কথিত আততায়ীকে ধরা যায় নি। ধারণা করা হয় যে, আততায়ী একজন পেশাদার খুনী এবং সে কেজিবির নির্দেশে তার কাজ সমাধা করেছিল ।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:৪৩

আল ইফরান বলেছেন: এই ধরনের টেকনিক্যাল এসাসিনেশন প্রাক্তন সোভিয়েত ব্লকে খুবই সাধারন ঘটনা ছিল এবং খুব সম্ভবত এখনো এই ধারার চর্চা করছে এফ.এস.বি।
যার সর্বশেষ শিকার ছিলেন আলেকজান্ডার লিতভিনেনকো।
লেখা ভালো লাগলো, পোস্টে প্রথম প্লাস দিয়ে গেলাম :) :) :)

১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১০:৫৪

শোভন শামস বলেছেন: উৎসাহ দেবার জন্য ধন্যবাদ ++

২| ১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:৩২

মনিরা সুলতানা বলেছেন: আমি আপনার লেখার একজন একনিষ্ঠ পাঠক :)

প্লাস মাস্ট +++++++

১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১০:৫৩

শোভন শামস বলেছেন: উৎসাহ দেবার জন্য ধন্যবাদ ++++

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.