![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বর্তমান সময়ে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কটা অনেকটাই সাপে-নেউলে'র মত। শিক্ষক কারণে অকারণে থাকেন ছাত্রের উপরে বিরক্ত আর ছাত্রও সুযোগ পেলে শিক্ষকের বিরুদ্ধে কটূক্তির ফোয়ারা ছুটিয়ে দেয় যেখানে সেখানে। এর কারণ কী? ইতিহাসের লাল মলাটের ছেঁড়া বইয়ের হলদেটে হয়ে যাওয়া পৃষ্ঠা ঘাঁটলে দেখা যায়, কয়েক যুগ আগেও শিক্ষক এবং ছাত্রের মধ্যে এরকম সম্পর্ক ছিলোনা। শিক্ষকগণ ছিলেন জাতির আদর্শ, ছাত্রছাত্রীরা ছিলো শিক্ষকসম্প্রদায়ের একনিষ্ঠ সমর্থক। হঠাৎ কী এমন হয়ে গেলো যে শিক্ষক-ছাত্রের সহজ, স্বাভাবিক, সুন্দর সম্পর্কটা ১৮০ ডিগ্রি কোণে ঘুরে বিপরীত মুখে দাঁড়িয়ে গেলো? সে রহস্যের উদঘাটন করবো আজ, লিখিত ইশতেহারে।
একবিংশ শতাব্দীর থ্রিজি জামানায় এসে আমরা "শিক্ষক জাতির আদর্শ" কথাটা শুধু বইয়ের পাতাতেই খুঁজে পাই। বাস্তবে এর প্রয়োগ খুবই বিরল। কেন বিরল? সে প্রশ্নের উত্তরও খোঁজা হবে, "মিশনঃ খোঁজ দ্যা সার্চ" এর মাধ্যমে।
শিক্ষকদের বিষয়টায় পরে আসি, আমি যেহেতু ছাত্র, ছাত্রদের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়টা আগে বিশ্লেষণ করা যাক। বর্তমানের ছাত্রসমাজ অনেক বেশি অস্তিত্বসংকটে ভোগে, তারা মনের গহীনে "Ego" নামক এক ভাইরাস সযত্নে লালন করে চলেছে বহুদিন ধরে। কেউ কিছু বললে সহজভাবে গ্রহণ করার ক্ষমতা তারা বহু আগেই হারিয়েছে। "মুই কী হনু রে" ধরণের ভাবভঙ্গি তারা সযত্নে লালন করে চলে মনের অন্দরমহলে। ফলে যা হয়, শিক্ষক যদি কোনো ছাত্রের ভালোর জন্যেও তাকে তিরস্কার করে, তাহলে সে বিষয়টি সহজে হজম করতে পারেনা। "আপ্নে আমাত্তে বেশি বোঝেন" টাইপের একটি ইম্প্রেশন তারা চোখমুখে ঝুলিয়ে বসে থাকে,তিরস্কারকারী শিক্ষক হয়ে যায় তার জনম জনমের শত্রু। চায়ের কাপের আসর থেকে বন্ধুদের সান্ধ্য আড্ডা সবখানে সেই শিক্ষকের ব্যক্তিগত জীবন থেকে সামাজিক জীবন সম্পূর্ণটা রসালোভাবে, নির্মমভাবে ময়নাতদন্ত করা হয়। এভাবে সে ছাত্র মানসিকভাবে পরিতৃপ্তি অর্জন করে। বিকৃতভাবে শিক্ষককে আক্রমণ করে সে পৈশাচিক আনন্দ পায়।
এবারে আসি "জাতির মেরুদণ্ড" শিক্ষকদের প্রসঙ্গে। যে "Ego" নামক ভাইরাসের কথা একটু আগে বললাম, সে সংক্রামক ভাইরাস কিন্তু ছাত্রদের তুলনায় শিক্ষকদের মধ্যে বেশি মাত্রায় প্রকট। ছাত্রের সাথে হালকা হেসে কথা বললে, দুয়েকটা লঘু ধরনের রসিকতা করলে তারা মনে করেন, তাদের সম্মানহানি হচ্ছে। অনেক শিক্ষকই ট্রাকের মত "ছাত্ররা ১০০ হাত দূরে থাকুন" টাইপের অদৃশ্য সাইনবোর্ড শরীরে এঁটে চলাফেরা করেন। এদের সাথে কথা বললে সমস্যা, না বললেও সমস্যা। বেশি বললে সমস্যা, কম বললে সমস্যা, জোরে বললে সমস্যা, আস্তে বললেও সমস্যা। সমস্যা থাকলেও সমস্যা, না থাকলেও সমস্যা।
কিছুদিন আগে জাপান বিষয়ক একটি বই পড়েছিলাম। সেখানে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক বিষয়ক বেশ মজার একটি কাহিনী ছিলো, জাপানে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি এক ছাত্র পার্কে মনমরা হয়ে বসে আছে। তার এক বন্ধু এসে জিজ্ঞেস করলো, "দোস্ত, মনখারাপ কেন?" ছাত্রটি বললো, "স্যারের কাছ থেকে আজ বিশাল বড় এক লজ্জা পেয়েছি। স্যার গত ক্লাসে সবাইকে বলেছিলেন আজকের ক্লাসে জ্যামিতিবক্স নিয়ে আসতে। আমি ভুলে গিয়েছিলাম। ভাবলাম, স্যার বোধহয় বকাবকি করে ক্লাস থেকেই আমাকে বের করে দেবেন। অথচ স্যার আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন 'আসলে আমিই দুঃখিত। জ্যামিতিবক্স আনতে মনে রাখার মত জোর দিয়ে আমিই হয়তো তোমাকে গতক্লাসে বলতে পারিনি, আই এ্যাম এক্সট্রেমলি স্যরি।"
ছাত্রটি আরো বললো, "আমি ভেবেছিলাম স্যার আমাকে বকাবকি করলে আমি মিথ্যে অজুহাত দেখিয়ে দেবো, অথচ স্যার আমাকে পুরোপুরি লজ্জায় ফেলে দিলেন। কেন আজ জ্যামিতিবক্স নিয়ে গেলাম না, এজন্যে নিজেরই খারাপ লাগছে।"
এই ছিলো কাহিনী। জাপানি শিক্ষকের জায়গায় নিজের স্কুল/কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে কল্পনা করুন। স্কুল হলে জালি বেত, কলেজ হলে নীলডাউন, ভার্সিটি হলে "গেট আউট অফ মাই ক্লাসরুম" আপনার জন্যে নির্ধারিত।
আসলে এটাই পার্থক্য। আমাদের শিক্ষকদের আস্ফালন, গর্জনে, হুংকারে ছাত্রসমাজ থাকে প্রতিমুহূর্তে তটস্থ, ভীত, সন্ত্রস্ত। তাই, যতই " শিক্ষকেরা ছাত্রদের বন্ধু" বুলি কপচানো হোক না কেন, বাস্তবে তা অন্তঃসারশূন্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
অথচ, ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে এ বৈরী সম্পর্ক না হয়ে যদি স্বাভাবিক, সুস্থ, নিরাপদ একটি সম্পর্ক থাকতো তাহলে কত পবিত্র একটি বিষয় হতো সেটি। আহমদ ছফার "যদ্যপি আমার গুরু" বইটি পড়ে জেনেছিলাম শিক্ষক জাতির সীমানা কত উঁচু, কত সম্মানজনক তাদের মানদণ্ড। ছাত্রদের সাথে তাদের সম্পর্ক কতটা প্রাসঙ্গিক, কতটা মানবিক। কিন্তু বর্তমান সময়ে তার প্রতিফলন কই?
তবুও স্বপ্ন দেখি, একজন শিক্ষক বিশাল এক বটবৃক্ষের মত ছাত্রকে ছায়া দেবে, আশ্রয় দেবে, একদণ্ড প্রশান্তি দেবে। ছাত্রও ছায়া পেয়ে, আশ্রয় পেয়ে বটবৃক্ষের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে। অকৃতজ্ঞের মত বটবৃক্ষের পাতা ছিঁড়ে, ফল ছিঁড়ে, ছালবাকল তুলে তাকে ক্ষতবিক্ষত করবেনা। শিক্ষক আর ছাত্রের মধ্যে থাকবে অভেদ্য স্বচ্ছ একটি পর্দা, শিক্ষক শিক্ষার্থীকে দেখবেন, শিক্ষার্থীও শিক্ষককে দেখবে, কেউ কারো সীমানা লঙ্ঘন করবেনা। দুপক্ষের মাঝেই একটি সম্মানজনক দূরত্ব অথচ প্রগাঢ় সম্পর্ক বজায় থাকবে সবসময়। অলঙ্ঘ্য সীমানাটা কখনো লঙ্ঘিত হবেনা।
সেদিন হয়তো, আবার সুদিন ফিরবে। ছাত্র-শিক্ষকের মেলবন্ধনে রচিত হবে নতুন কোনো মাইলফলক, পরাজিত হবে অপরাজেয় কোনো বাঁধা, ধূলায় লুটাবে "Ego" নামের বিষবৃক্ষ, ঘুচে যাবে সবরকম জটিল টানাপোড়েন।
বি.দ্রঃ আমি ছাত্র হলেও আমার বাবা এবং বড়ভাই দু'জনেই শিক্ষক। তাই পুরো বিষয়টি লেখা হয়েছে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে। কোনো পক্ষের সাফাই গাওয়ার কোনোরকম চেষ্টা এখানে করা হয়নি।
©somewhere in net ltd.