নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

খাপ খোলা কলমে শাণিত হোক মঞ্চ...

কূপমন্ডূক

জানা ভালো, না জানা খারাপ, ভুল জানা অপরাধ

কূপমন্ডূক › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পঃ সাড়ে তিন লাখ টাকা

১৯ শে জুন, ২০১৬ সকাল ১০:৩৬

১.
আকাশটা আজ কেমন জানি মেঘলা, বৃষ্টি হবে মনেহয়। গুমোট পরিবেশ, বাতাস বন্ধ হয়ে আছে। যেকোনো মুহুর্তে ঝড় বা বৃষ্টি নামবে। মেঘলা দিনে ব্যস্ত রাস্তার পাশের ফুটপাত ধরে হাঁটছে রাশেদ। উদ্দেশ্যহীন হাঁটা নয়, হন্তদন্ত হয়ে হাঁটা। ছোটভাই রাফি কে হাসপাতালে রেখেই রাস্তায় নেমে এসেছে সে। সকাল থেকেই রাফি কেমন যেন করছিলো। মাঝেমাঝেই অসংলগ্ন কথাবার্তা বলে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলো। কেমন যেন ঘোলাটে দৃষ্টি মেলে দেখছিলো চারপাশ। রাশেদ দেরী না করে, যানবাহনের আশা না করে, ছোটভাইকে কোলে করেই হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। ডাক্তাররা সব পরীক্ষানিরীক্ষা করে জানালেন, রাফির ফুসফুসে একটা অপারেশন করাতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব ৩.৫০ লাখ টাকার দরকার। কেবিনের ভেতর ভাইকে একনজর দেখেই বাইরে চলে এসেছে রাশেদ, যত দ্রুত সম্ভব তাকে ৩.৫০ লাখ টাকা সংগ্রহ করতে হবে।

২.
রাশেদ, রাফি দুই ভাই। রাশেদ, বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের শেষবর্ষে আছে। রাফি স্কুলে পড়ে, ক্লাস সেভেন। রাফির যখন বয়স তিন মাস, তখন বাবা-মা রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়। তখন থেকেই রাফির বাবা,মা, বড়ভাইয়ের দায়িত্ব একসাথে পালন করে যাচ্ছে রাশেদ। ছোটভাই রাফিও বড়ভাইয়ের বিশাল ভক্ত। ভাইয়ের সাথে মতের অমিল তার খুব কমই হয়। দুই ভাই থাকে হাজারীবাগের একটু ভেতরে একচিলতে এক ভাড়া বাসায়। বাসার পাশেই চামড়ার ফ্যাক্টরি, তাই বাসাভাড়া তুলনামূলক কম। রাশেদ পার্টটাইম চাকরি করে, সেইসাথে তিনটা টিউশনি পড়ায়। সেখান থেকে যে টাকা পায়, সে টাকা দিয়েই মোটামুটি দুইভাইয়ের সংসার, লেখাপড়ার খরচ মোটামুটি চলে যায়। গ্রামে পৈত্রিক কিছু জমি আছে, খোঁজখবর নেয়া হয়না।

৩.
রাশেদ বসে আছে বনানীর এক বহুতল ভবনের তিনতলার ড্রয়িংরুমের সোফায়। সোফা এত নরম যে মনে হচ্ছে, মাখন দিয়ে তৈরি। রাশেদ আর কিছুক্ষণ বসলেই সোফার মধ্যে ঢুকে যাবে। আচ্ছা, এই সোফাটা বিক্রি করলে এক-দুই লাখ টাকা পাওয়া যাবে না? মনে মনে ভেবে নীরবেই একটু হাসলো সে। কী সব খাপছাড়া চিন্তাভাবনা!
ড্রয়িংরুমটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো রাশেদ। দেয়ালের তিনদিকেই বিভিন্ন জানোয়ারের স্টাফ করা মাথা। যতদূর জানে রাশেদ, বড়চাচা ইঁদুর দেখলেও ভয় পায়। সে ড্রইংরুমে বাঘ, ভাল্লুকের মাথা সাজিয়ে রেখেছে? একটু অবাকই হয় রাশেদ।
ড্রয়িংরুমে বিশাল স্ক্রিণের একটা টেলিভিশনও আছে, ক্রিকেট খেলা হচ্ছে। বাংলাদেশ বনাম নিউজিল্যান্ড এর গতবছরের ম্যাচ। পুরোনো খেলা দেখলে একটা জিনিস হয়, চাপমুক্ত হয়ে খেলা দেখা যায়। কোনো উদ্বেগ থাকেনা।

কিছুক্ষণের মধ্যে ট্রলিতে খাবার এলো। চা, কেক,পেস্ট্রি, বিস্কুট, চানাচুর, মিষ্টি, আপেল, কলা অনেককিছুই আছে। পোর্সেলিনের কাপে চা ঢেলে নিলো রাশেদ, বিস্কুট দিয়ে ভিজিয়ে ভিজিয়ে খেতে লাগলো। বিস্কুটটা সম্ভবত এদেশের না। এদেশের বিস্কুটে এত স্বাদ থাকেনা।

খেতে খেতেই রাশেদের বড়চাচা চলে এলেন। বড়চাচার সাথে দেখা করতেই মূলত সে বনানী এসেছে। বড়চাচা দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতিদের একজন। তিনি কী ভাইয়ের ছেলের জন্যে ৩.৫০ লাখ টাকা দেবেন না? না দেয়ার সম্ভাবনাই বেশি তবুও অকুল পাথারে খড়কুটো ধরার জন্যেই রাশেদের এতদূরে ছুটে আসা।

- তোমার নাম রাশেদ, তাই না? তা, কী খবর তোমার?
-জ্বি, চাচা। ভালো। আপনি কেমন আছেন?
-এই মোটামুটি চলছে। কী মনে করে আজ তুমি?
- রাফি, আমার ছোটভাই, ফুসফুসে ইনফেকশন হয়েছে। ডাক্তার বললেন, অপারেশন করানো লাগবে। সেজন্যে, ৩.৫০ লাখ টাকার দরকার। যদি আপনি কিছু টাকা দিতেন ধার হিসেবে....
-দেখো, হুট করে টাকা চাইলেই তো আর দেয়া যায়না। আর, একসাথে এতগুলো টাকা আগে থেকে না বললে ম্যানেজ করা সম্ভব না। তুমি আমাকে আগে বললে আমি চেষ্টা করে দেখতাম। যাই হোক, তুমি এসেছো, দশহাজার টাকা দিচ্ছি, নিয়ে যাও। দেখো, এতে কিছু হয় কী না।
- থ্যাংকইউ চাচা, লাগবে না। আজ উঠি। পরে আবার আসবো।
-দুপুরে খেয়ে যাও
-না, চাচা। আজ একটু কাজ আছে। আসি আজকে।
-ঠিক আছে, যাও।

তিনতলার কৃত্রিম বিলাসবহুল পৃথিবী থেকে বাস্তবের রোদঝলসানো রাস্তায় নেমে এলো রাশেদ। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। একটা টাকাও জোগাড় হয়নি। ডাক্তারের বলা "যত দ্রুত সম্ভব" কথাটা রাশেদের কানে বুলেটের মত বিদ্ধ হতে থাকে।

৪.
এবারের গন্তব্য ধানমন্ডি। মামার বাসা সেখানে। চাচার মত মামাও বাড়াবাড়ি টাইপের বড়লোক। ধনসম্পদ উপচে পড়ে তাদের, মুসা বিন শমসের টাইপের বড়লোক রাশেদের মামা। সেখানে গেলে হয়তো ভাগ্নের জন্যে ৩.৫০ লাখ টাকা দিয়ে দিতেও পারেন তিনি। আশায় বুক বেঁধে রাশেদ মামার বাসার দিকে রওয়ানা হলো।

মামার ফ্ল্যাট ৭ তলায়। লিফট ছাড়া উপায় নেই। লিফটে ৭ তলায় পৌঁছে মামার ফ্ল্যাটের দরজার নক করতে যাবে তখনই দেখতে পেলো, মামা হাসিমুখে পুরো পরিবার নিয়ে বের হয়েছে। রাশেদকে দেখেই তার মামার ভ্রু দুটি কিঞ্চিৎ উপরে উঠে স্থির হয়ে গেলো, হাসিমুখও মুহূর্তের ব্যবধানে অন্ধকার।

বিরসমুখে মামা বললেন, "আরে রাশেদ যে! কী মনে করে এইদিকে আজ পা পড়লো তোমার? দেখো তো, আমাদের আজ আবার একটা পার্টিতে যেতে হবে। বাই দ্য ওয়ে, কী ব্যাপার, বলো?"
মামার মুখভঙ্গি দেখেই রাশেদের বুকভরা আশা ফাটা বেলুনের মত চুপসে গিয়েছিলো। কথাগুলো শোনার পরে রাশেদ আর কিছু বলতে পারলোনা। "এদিকেই এসেছিলাম একটা কাজে, ভাবলাম, আপনাদের সাথে দেখা করে যাই" টাইপের কথা বলে যতদ্রুত সম্ভব বের হয়ে এলো।

৫.
এই বিশাল, বিরাট, প্রকান্ড ঢাকা শহরে চাওয়ামাত্র ৩.৫০ লাখ টাকা দিতে পারে, এরকম লোক আর নেই, এটা রাশেদ ভালো করেই জানে। রাস্তায় নেমেই হঠাৎ করে রাশেদের চোখে পানি এসে পড়লো। প্যান্টের পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করলো, নীলক্ষেত থেকে ৬ মাস আগে কেনা মানিব্যাগ, জায়গায় জায়গায় ছালবাকল উঠে গিয়েছে। মানিব্যাগের সাইডপকেটে রাফির একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি। ছবির দিকে কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে রইলো সে, চোখ বেয়ে দুফোঁটা পানি টপটপ করে রাফির হাসিমুখের ছবির উপর আশ্রয় নিলো।

আর ভালো লাগছে না, এবার হাসপাতালে ফিরতে হবে। রাস্তার মোড়ে একটা সিএনজি দাঁড়িয়ে ছিলো, বৃদ্ধ ড্রাইভার চালকের আসনে। রাশেদ দরদাম না করেই সিএনজিতে উঠে বসলো। একবার পেছনে ফিরে রাশেদ কোথায় যাবে জিজ্ঞেস করেই, ড্রাইভার সিএনজি স্টার্ট দিলো।

সিএনজি চলছে, রাশেদ অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে। ড্রাইভার বারবার সিএনজির আয়নায় রাশেদকে দেখছে। রাশেদ ব্যাপারটা খেয়াল করে ড্রাইভারকে একটা কড়া ধমক দিলো।
- চাচা, বারবার এদিকে তাকাচ্ছেন কেন? সামনের দিকে তাকিয়ে চালান, এক্সিডেন্ট করবেন তো।
- বাজান কী কোনো কারনে পেরেশান? আপনাকে কেমন যেন চিন্তিত লাগতেছে। আমারে কী ঘটনাটা বলা যায়?
- আপনার কাজ আপনি সিএনজি চালাতে থাকেন। এত প্রশ্নের দরকার নাই।

রাশেদের ঝাঁঝালো উত্তরে ড্রাইভার চুপ হয়ে গেলো। রাশেদ বুঝতে পারলো, ড্রাইভারের সাথে এত রাগারাগি করা ঠিক হয়নি।
রাশেদ তখন বললো, "চাচা, রাগ কইরেন না। আমার ছোটভাইটা হাসপাতালে ভর্তি, ফুসফুসে ইনফেকশন। অপারেশন করা লাগবে, সাড়ে তিন লাখ টাকা দরকার। আমার বিগশট আত্নীয়স্বজনদের কাছে গেলাম, একটা কানাকড়িও পাইনি। মা, বাবা নাই, আমার একটাই ভাই। আমি আর আমার ভাইয়ের মাঝখানে এখন সাড়ে তিন লাখ টাকার দেয়াল..."
বলতে বলতে রাশেদ ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। ড্রাইভার কিছু বললেন না, নিশ্চুপ হয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে সিএনজি চালাতে লাগলেন। সামনের রাস্তাটা ব্যস্ত, সাবধানে চালাতে হবে।

৬.
সিএনজি হাসপাতালের সামনে এসে থেমেছে। রাশেদ সিএনজি থেকে নামতে যাবে, ড্রাইভার হঠাৎ বলে উঠলো, "বাজান, দুইটা মিনিট বসেন, একটু কথা আছে। আমার একটা মাত্র মেয়ে, নাম আয়েশা। খুবই মায়াভরা চেহারা। মেয়ের বিয়ের জন্যে পাত্র ঠিক করলাম। ছেলেপক্ষ যৌতুক চাইছিলো পাঁচলাখ টাকা, আমি চাইর লাখ পর্যন্ত জোগাড় করতে পারছিলাম। আমি সিএনজি চালাই, গরীব মানুষ। গ্রামের ঘর, জমি বেইচা, সিএনজির ডেইলী ইনকাম থেকে কিছু টাকা আলাদা কইরা জমাইয়া জমাইয়া চাইরলাখ পর্যন্ত জোগাড় করলাম। একলাখ দিতে পারবোনা, জানতে পেরে, বিয়ের দিন ছেলেপক্ষ আর আইলোনা। আমার আয়েশাও দরজা আটকাইয়া দিলো। পরে দরজা ভাইঙ্গা দেখি, মাইয়া আমার ফ্যানের লগে ঝুলতেছে। আমার আয়েশার মায়াভরা মুখখান ফ্যাকাশে হইয়া গেছে। এই দৃশ্য দেইখা আমার বউ আর সামলাইতে পারেনাই। এখন সে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি। আমি একলা দুইজনের স্মৃতি লইয়া বাঁইচা আছি। তয়, আমার কাছে এখনো হেই চাইরলাখ টাকা আছে। কিছু মনে কইরেন না, আমি এই টাকাটা আপনেরে দিতে চাই। আপনের ভাই সুস্থ হইয়া যাইবো, টাকাডা আপনেরে আমি ধার দিলাম। পরে শোধ কইরা দিয়েন..."

রাশেদ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলো বৃদ্ধ লোকটির দিকে। হঠাৎ করে, রাশেদের চোখ আবার ঝাপসা হয়ে এলো।

৭.
রাশেদ আর ড্রাইভার চাচা দুজনে ব্যাংক থেকে টাকা উঠিয়ে রুদ্ধশ্বাসে হাসপাতালে চলে এলো। ১২ নম্বর কেবিন, যেখানে রাফিকে রাখা হয়েছে, সেখানে পৌঁছে রাশেদ দেখলো, রাফির বেডকে ঘিরে ডাক্তার, নার্সেরা ভীড় করেছে। সবাইকে ঠেলেঠুলে রাশেদ সামনে এগিয়ে দেখে, রাফির বেডে কাকে যেন সাদা চাদর দিয়ে আপাদমস্তক ঢেকে দেয়া হয়েছে।

সময় যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। চারপাশের কথাবার্তা কিছুই রাশেদের কানে ঢুকছেনা। কাঁপা কাঁপা হাতে সে চাদরের একপ্রান্ত টেনে সরিয়ে দিলো, অতিপরিচিত একটা মুখ চাদরের আড়ালে হাসিমুখে ঘুমিয়ে আছে। রাশেদের চারপাশে হঠাৎ করে যেন গভীর রাতের নৈশব্দ নেমে এসেছে। রাশেদ কাঁদতেও ভুলে গেছে। হঠাৎ করে, ভীষণ এক শূন্যতা এসে তাকে গ্রাস করলো।

৮.
বৃদ্ধ ড্রাইভার হাসপাতালের বাইরে চলে এসেছেন। ভেতরের পরিবেশ সে সহ্য করতে পারেনি, তার হাতের পলিথিনের ব্যাগে চারলাখ টাকার বান্ডিল। টাকাসহ বান্ডিলটা হাসপাতালের কাছেই একটা ময়লার গাড়িতে ফেলে দিয়ে সে সিএনজিতে উঠে ইঞ্জিন স্টার্ট দিলো।

সারাদিনের গুমোট গরমের পরে এখন বৃষ্টি নেমেছে, তুমুল বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। সিএনজির সামনে কিছু দেখা যায়না, প্রবল বৃষ্টিতে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আছে।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৯ শে জুন, ২০১৬ বিকাল ৪:০৩

অশ্রুকারিগর বলেছেন: করুন কাহিনী। ভাবছিলাম টাকাটা কাজে লাগবে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.