নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

খাপ খোলা কলমে শাণিত হোক মঞ্চ...

কূপমন্ডূক

জানা ভালো, না জানা খারাপ, ভুল জানা অপরাধ

কূপমন্ডূক › বিস্তারিত পোস্টঃ

পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ হাজার চুরাশির মা (মহাশ্বেতা দেবী)

০৬ ই মে, ২০১৭ রাত ৮:৪১

পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ হাজার চুরাশির মা
মহাশ্বেতা দেবী
-----------------------------------------------------------------------------------

কিছু কিছু বই শেষ করলে থমকে যাওয়া লাগে কিছুক্ষণের জন্যে। কিছু বই সহজে হজম হয়না। বই শেষে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে হয় অনেকক্ষণ, বইটাকে ঠিকভাবে বোঝার জন্যেই হয়তো। মহাশ্বেতা দেবীর "হাজার চুরাশির মা" পড়ে এই অনুভূতিটাই হলো। বই শেষ করে থমকে গেলাম ক্ষণিকের জন্যে

ব্রতী, সুজাতার ছেলে। ছোটবেলা থেকেই যুক্তিবোধ যার অত্যন্ত প্রখর। শৈশবে যে ছেলে ভিতু ছিলো, মায়ের হাত ধরে রাস্তা পেরোতো, একা পেরোনোর সাহস ছিলো না। একলা ঘরে ঘুমোতে ভয় পেতো। সে ছেলেটাই কৈশোর পেরিয়ে হঠাৎ করে প্রচণ্ড সাহসী হয়ে যায়। বিপ্লবী হয়ে যায়, একসময় যোগ দেয় নকশাল আন্দোলনে। লেখকের ভাষায়ঃ

"ব্রতী শুধু দেয়ালের শ্লোগান লিখতো না, সে শ্লোগানে বিশ্বাসও করতো।"

তবে, বিপ্লবীদেরকে, বিপ্লবকে ধামাচাপা দেয়ার হরেকরকম পদ্ধতিও তো প্রচলিত বহুকাল আগে থেকে। যুগ হয়তো বদলায়, দমন নিপীড়নের টোটকা একই রকম থেকে যায়। বিপ্লবের তাগিদে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে জোর গলার শ্লোগানে রাস্তার মিছিলে যারাই নেমেছে, তাদের সিংহভাগকেই বুকের রক্তে জামা ভিজিয়ে রাজপথ ছাড়তে হয়েছে। ভাষা আন্দোলনের বরকত বা নকশাল আন্দোলনের ব্রতী... রক্তের রঙ লাল হয়ে বিপ্লবকে দিয়ে গেছে আজীবন স্বীকৃতি। অনেককাল ধরেই, বুকের জমাট লাল হয়ে "শ্লোগান" মিশে গেছে আকাশের চিলের দৃঢ় ডানায়, উড়ে গেছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের লাল ইটের দেয়ালের দুটি লাইন আমার খুব প্রিয়।। লাইন দুটিঃ

নির্বোধ ঘাতকেরা জানে না
মৃত্যুতে থামেনা জীবন।

বরকত বা ব্রতীর মৃত্যুতে মিছিলের মানুষ কী কখনো কমেছে? জহির রায়হানের "আরেক ফাল্গুন" উপন্যাসের মত "আসছে ফাগুনে আমরা দ্বিগুন হব"র মত মিছিলের মুখ দ্বিগুণ, ত্রিগুণ হয়েছে। কখনোই কমেনি। মৃত্যুতে কখনোই জীবন থামেনা, জীবন কমেনা। এ চিরন্তন সত্য।

সমাজ সবসময় এক জঙধরা গৎ এ চলতে চায়। এ গৎবাঁধা সমাজ, ভুলেভরা সিস্টেম এর বিরোধিতা যে করবে, সেই তো খারাপ। তার বুকে বুলেট বিদ্ধ করে ছলকে পড়া রক্তকে নগ্ন করাই তো প্রাসঙ্গিক। সেটাই হয়েছে ব্রতীর বেলাতেও। বুকে, পেটে, গলায় তিনটি বুলেট নিয়ে বিপ্লবের দাম চুকিয়েছে ব্রতী। মর্গে পড়ে থাকা একহাজার চুরাশিতম লাশ সে। তাঁর মা, সুজাতা। সে-ই হাজার চুরাশির মা। যে আগে ছিলো ব্রতীর মা, সে-ই এখন হাজার চুরাশির মা।

আমরা বিপ্লবীদের মাঝেসাঝে মনে রাখলেও তাদের মা'দের কখনো মনে রাখিনা। এ গল্পটা তেমনই এক মায়ের, যার ছেলে বাড়ি থেকে মিছিলে গিয়ে বাড়িতে ফেরেনি আর, পথ ভুলে মর্গে গিয়েছে লাশ হয়ে। এ গল্প এক মায়ের, যিনি ছেলের মৃত্যুতে একফোঁটা চোখের জল ফেলেননি কোনোদিন, কাঁদলে যদি বুকের শোক হালকা হয়ে যায়, সে ভয়ে।

এ গল্প শুধু মা-ছেলের না। এ গল্পে উঁচু-নীচু সমাজের সাম্য ও বৈষম্যের সর্পিল টানেল উঠে এসেছে চোখে আটকে পড়া বালির মত, অস্বস্তিকর ভাবে। এ গল্পে এক কাপুরুষ বাবার দ্বিচারিতা উঠে এসেছে চোখের সামনে ঝলসানো রোদের মত, উজ্জ্বলভাবে। এ গল্পে উঠে এসেছে বিশ্বাসঘাতকতার ট্রেন, যে ট্রেনের নীচে কাটা পড়েছে ব্রতীর মত অজস্র বিপ্লবী তরুণ, বুকে বুলেট আর মাথায় "শ্লোগান" নিয়ে "শাসক" নামক বুটের তলায় পিষ্ট হয়েছে যারা।

গতকাল তিনটি বই পড়েছিলাম। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের "বাসকশয়ন", মাহমুদুল হক এর "মাটির জাহাজ", মহাশ্বেতা দেবীর "হাজার চুরাশির মা।" তিনটা বই তিন প্রেক্ষাপটের, তিনটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির। তিনটি বই-ই অসাধারণ। তবুও, এ বইটাই কেন যেন বেশি দাগ কেটে গেলো। বাধ্য হলাম কিছু লিখতে। না লেখার আগপর্যন্ত শান্তি পাচ্ছিলাম না, গলায় বেঁধা মাছের কাঁটার মত অস্বস্তি হচ্ছিলো।

মহাশ্বেতা দেবী "হাজার চুরাশির মা" লিখেছেন বিচিত্র ভঙ্গিতে। লেখা কখনোই সোজা সড়কে হাঁটেনি। লেখার স্টাইল কখনো তীক্ষ্ণ, কখনো সর্পিল, কখনো ঋজু। উপমা, রূপক এর সার্থক প্রয়োগ বইটিকে দিয়েছে ভিন্ন দ্যোতনা। এ ধরণের বইগুলো পড়তে অসাধারণ লাগে। তাড়িয়ে তাড়িয়ে পড়া যায় এ বইগুলো, শীতের সকালের উষ্ণ চায়ের মত। সম্প্রতি ইমতিয়ার শামীমের "আমরা হেঁটেছি যারা" পড়েছি। একই স্টাইলের লেখা। এরকম রূপকধর্মী লেখাগুলো আমাকে বেশি টানে, বরাবরই।

বইয়ের কলেবর হয়তো অতটা বড় না। মাত্র ১১৭ পৃষ্ঠার বই। কিন্তু, ভেতরের দগদগে দাগটা ছোট না, বেশ বড়। এবং বইয়ের শেষ পরিণতিটাও যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে। মাঝেমধ্যে মনে হয়, কেউ যদি কিছু লিখতে চায়, বেশি কিছু লেখার তো দরকার নেই। "হাজার চুরাশির মা"র মত দুয়েকটা বই লিখলেই তো হয়! এই "হাজার চুরাশির মা"ই তো মহাশ্বেতা দেবীকে বইয়ের ভাঁজে বাঁচিয়ে রাখবে সহস্র বছর। এতে কোনো সন্দেহই নেই।

মাঝেমধ্যে, দুনিয়াদারির ওপরে রাগ হয়। এত অজস্র সব বই চারপাশে, এর সিকিভাগও এক জীবনে পড়ে শেষ করে যেতে পারবোনা। মাঝেমধ্যে, "সব কাজকর্ম বাদ দিয়ে সারাদিন বই নিয়ে ঘরের কোনো কোনায় পড়ে থাকলে ভালো হতো" ধরণের চিন্তাভাবনা মাথায় আসে। কিন্তু, "বাস্তবতা" কখনোই রঙিন চশমা পড়ে হাঁটতে দেয় না। চোখে আঙুল দিয়ে গনগনে,রূঢ় পরিস্থিতি বুঝিয়ে দেয় বরাবর। আমারও আর পড়া হয় না অনেককিছু। "হাজার চুরাশির মা"র মত অজস্র বইয়ে ধুলোর স্তুপ শুধু বেড়ে যায়। ধুলোঝাড়ার সুযোগ টা আর হয় না। মাঝেমধ্যে তারাশঙ্করের "কবি" উপন্যাসের কবিয়াল নিতাইয়ের মত আক্ষেপ হয়,

"জীবন এত ছোট কেনে!"

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ০৬ ই মে, ২০১৭ রাত ৯:১৬

আব্দুল মোমেন বলেছেন: অতি চমৎকার!

০৭ ই মে, ২০১৭ বিকাল ৪:৩৮

কূপমন্ডূক বলেছেন: ধন্যবাদ।

২| ০৬ ই মে, ২০১৭ রাত ১০:২২

রাজীব নুর বলেছেন: খুব ভালো একটা বই।

০৭ ই মে, ২০১৭ বিকাল ৪:৪১

কূপমন্ডূক বলেছেন: আসলেই অসাধারণ

৩| ০৭ ই মে, ২০১৭ রাত ৩:২৩

সৌমিক আহমেদ খান বলেছেন: প্রতিক্রিয়া ভাল লাগসে
ধন্যবাদ

০৭ ই মে, ২০১৭ বিকাল ৪:৪১

কূপমন্ডূক বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকেও

৪| ০৭ ই মে, ২০১৭ দুপুর ১:০৬

শরদিন্দু রূপক বলেছেন: আমার লাইফে এত সুন্দর রিভিউ আমি কখনো পড়িনি....ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড,সাহিত্যের স্টুডেন্ট ছিলেন বা আছেন আপনি?কৌতূহল থেকে জানতে চাচ্ছিচাচ্ছি

০৭ ই মে, ২০১৭ বিকাল ৪:৪১

কূপমন্ডূক বলেছেন: না, আমি আইনের ছাত্র। :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.