![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
একদিন এক ঘর-পালানো ‘ক্লাস ফোর’ এসেছিলেন আমাদের বাসায়। ক্লাস ফোর বলছি কারণ, সে কখনোই তার নামটি প্রকাশ করেনি আমাদের কাছে। জিজ্ঞেস করলেই মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যেত, কাঁদতো। এমনিতে থাকতো নিজের মত। হাফপ্যান্টের দুই পকেটে দু-হাত ঢুকিয়ে গম্ভীরভাবে হাঁটতো বাগানে। কি’যে পেয়েছিলো সেখানে কে জানে। আমাদের বাসায় যে পঁনরো-ষোলো দিন সে ছিলো, বেশিরভাগ সময় তার কেটেছে বাগানেই।
তবে, আমাদের বাগানটা ছিলো দারুণ। বাগানে আধিক্য ছিলো সূর্যমুখী ফুলের। গাঁদা আর কিছু কাঠগোলাপও ছিলো, কিন্তু বেশী ছিলো সূর্যমুখীই। সূর্যমুখীর আলোয় আমাদের অফহোয়াইট রঙের বিশাল একতলা সরকারী কোয়ার্টারটি হলুদ হয়ে থাকতো সবসময়।
ক্লাস ফোর যেদিন এসেছিলো, সে দিনটি ছিলো শুক্রবার। বাবা-মা দুপুরের খাবার খেয়ে ঘুমিয়েছেন। আমি নোটস আনতে যাবো এক বান্ধবীর বাসায়। সেবার মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ছিলাম। রেডি হয়ে দরজা খুলতেই চিৎ অবস্থায় আমার পায়ের কাছে পড়তে যাচ্ছিলো একটা বাচ্চাছেলের শরীর। আমি পা দিয়ে কোনমতে তার মাথাটাকে খালি ফ্লোরে পড়া থেকে বাঁচিয়েই চিৎকার করে উঠলাম ভয়ে। বাবা-মা ছুটে এলেন। ততক্ষণে উঠে বসেছে সে। বুঝলাম, দরজায় হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। বাবা তার সামনে বসে হাত ধরে জিজ্ঞেস করলেন ‘কে তুমি ? এখানে বসেছিলে কেন ?’। ক্লাস ফোরের জবাব ‘আমার ক্ষুধা পেয়েছে, খাবো’। বাবা বললেন ‘ঠিক আছে খাবে, কিন্তু তোমার আব্বু-আম্মু কোথায়?’। ‘নেই, আমার ক্ষুধা পেয়েছে’ ক্লাস ফোরের এক’ই সুর। মা ওকে বাবার হাত থেকে ছাড়িয়ে বললেন ‘ছাড়োতো, ওসব পরে হবে’। বলেই ডাইনিংয়ে নিয়ে গেলেন।
নোটস মাথায় উঠলো আমার।
ডাইনিংয়ে খাবার দেয়া হয়েছে ক্লাস ফোর’কে। বাবা তার পাশের চেয়ারে। দাঁড়িয়ে আমি আর মা। ওর খাওয়ার মাঝেমাঝেই বাবা ওকে এক-আধটু প্রশ্ন করতে থাকলেন, কিন্তু ক্লাস ফোর আলোচনা ফলপ্রসূ হতে দিলো না। নিন্মোক্ত প্রশ্নোত্তর হলো তাদের মধ্যে।
বাবাঃ কোন ক্লাসে পড়ো তুমি বাবু ?
ক্লাস ফোরঃ ক্লাস ফোর।
বাবাঃ বাসা কোথায় তোমার ?
ক্লাস ফোরঃ জানি না।
বাবাঃ এ জায়গার নাম জানো ?
ক্লাস ফোরঃ নাহ্ ।
বাবাঃ এটা চট্টগ্রামের আনোয়ারা। তুমি যেখান থেকে এসেছো, তার নাম জানো ?
ক্লাস ফোরঃ জানি না। খাবার সময় কথা বলতে নেই, তোমার আম্মু তোমাকে বলেনি ?
আমি হেসে ফেললাম। মা ওর মাথায় হাত বুলালেন।
খাওয়া দাওয়ার কিছুক্ষণ পর বাবা ওর হাত ধরে বললেন ‘চলো আমরা বাইরে থেকে ঘুরে আসি’। ক্লাস ফোর ‘যাবোনা’ বলেই এক-ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে মায়ের পেছনে গিয়ে লুকোলো। মা বাবা কে বললেন ‘ওকে তুমি কোথায় নিতে চাচ্ছো বলোতো’? বাবা বললেন ‘থানায়’। মা বললেন ‘যেতে চাচ্ছেনা যখন থাক না, পরেই নয় ওসব করবে’। বাবা রেগে গেলেন ‘কে না কে ছেলে হারিয়ে হয়ত পাগলপ্রায়, আর তুমি বলছো পরে’? বলেই ক্লাস ফোর কে ছাড়াই বেরিয়ে গেলেন। বাবা বেরিয়েছিলেন থানার উদ্দেশ্যেই। পুলিশ কে সব খুলে বললেন। বললেন ‘ওর বাবা-মা নিশ্চই থানায় ইনফর্ম করবে, আপনাদের কাছে এই এই বর্ণনার কোনো ছেলের খোঁজ চাইলে আমাকে জানাবেন, আমার টেলিফোন নাম্বার রইলো।
সেই থেকে ক্লাস ফোর আমাদের পরিবারের’ই একজন হয়ে গিয়েছিলো। থানা থেকে ওর খোঁজ চেয়ে টেলিফোন করেনি কেউ। বাবা ওকে জেরা করতে গিয়ে বারবারই অকৃতকার্য। তবে, ওর দেখাশোনা নিয়ে আমার আর মায়ের মধ্যে প্রতিযোগিতা লেগে গেল। আমি ওকে নিজের কাছে রাখতাম, খাওয়াতাম, গোসল করাতাম, গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়াতাম। মা আমায় পরীক্ষার ভয় দেখিয়ে ওকে ভাঙিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতো, আমি দিতাম না।
একদিন ঘুমের ঘোরে ওকে বলতে শুনলাম ‘আমার ঘুড়িটা ছিঁড়োনা মা, ছিঁড়োনা বলছি’। সকালে আদর করতে করতে জিজ্ঞেস করতেই স্বীকার করলো, ওর ঘুড়ি ছেঁড়ার জন্যই বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে সে। নিজের নাম, স্কুলের নাম ছাড়া, ‘রজনীগন্ধা’ নামে একটি গাড়িতে করে এসেছে বলেও বললো। এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে আমাদের বাগানটা পছন্দ হওয়ায় এখানে ঢুকেছে ।
আমার মন খারাপ হলো। কারণ, ওর বলা কথাগুলো বাবা কে বলতে হবে। কথগুলো থেকে পুলিশ ওর সব খোঁজ বের করে ফেলবে, এবং আমি ওকে হারাবো।
কিন্তু আমি কাউকে কিছু বলার আগেই ক্লাস ফোর চলে গেলো চুপিচুপি। আমি বাবা মা পাগলের মত খুঁজেছি আশপাশের সম্ভাব্য সব জায়গায়, পাইনি। আজও খুঁজে যাচ্ছি এক’ই ভাবে।
উপরের লেখাটি প্রখ্যাত লেখিকা আদৃতা চৌধুরীর। ‘দৈনিক খবর’ পত্রিকার শুক্রবারের সাহিত্য সাময়িকী তে ধারাবাহিক স্মৃতিকথা লিখছেন তিনি। স্মৃতিকথার এ-পর্বটি আজ প্রকাশ হলো।
ক্লাস ফোরে অভিমান করে ঘর-পালানো ছেলেটির নাম ‘দোলন’। দোলনের হাতে আজকের ‘দৈনিক খবর’ পত্রিকা। দোলন সাহিত্য-পাতাটি অপ্রয়োজনীয় কাগজের স্তুপে রেখে, মূল পত্রিকা পড়তে বসেছে । সাহিত্য তার পছন্দের বিষয় নয় ।
ফ্লপ খাওয়া একজন লেখক
©somewhere in net ltd.