| নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আঘাত প্রাপ্ত একজন
নিত্যকার প্রয়োজনে নিয়ত অভিযোজনের ক্রমাগত নিষ্পেষণ থেকে পরিত্রাণের ফুরসত খুঁজে ফেরা এক পরিশ্রান্ত প্রাণ।
১
ট্রেন ইটালিয়ার ছয় কামরার এসইউ-২৫৫৯৫ মালপেনসার টার্মিনাল ওয়ানে যখন দাঁড়ালো তখন বুক থেকে এক বিরাট পাথর নেমে গেলো! অনেকটা যুদ্ধ জয়ের আনন্দের মত। ভারেজ এর হোলসিম পাথরখনিতে কি এই পাথর-ই দেখেছিলাম? হয়তো তাই। সিনেমার ক্ষেত্রে 'সাসপেন্স থ্রিলার' আর 'কোর্টরুম ড্রামা' জনরা আমার সবচেয়ে পছন্দ--মিনিটে মিনিটে টুইস্ট! উত্তর ইতালির তুরিন রোমান্টিক এক শহর। শহর না বলে "Museo Torino" বলাই ভালো; এক আস্ত মিউজিয়াম। শান্ত স্নিগ্ধ এক মহানগর, হলুদ ম্যাপেল পাতায় মোড়ানো পো নদীর বুকে এক নিরুত্তাপ জনপদ। সৃষ্টিকর্তা বোধহয় এরকম অতি রোমান্টিক ম্যাড়মেড়ে দিনকাল বেশি দিন চলতে দিতে চান নি; রোমান্স আর কত! এবার তবে রোমাঞ্চের পালা...
আগের রাতে সিদ্ধান্ত ছিলো সকাল সাতটা পাঁচ মিনিটে তুরিনের 'পোর্তো নোভা' রেলস্টেশন থেকে মিলানের ম্যালপেন্সা এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা হবো। মিলান থেকে আমাদের কাতার এয়ারওয়েজের ফ্লাইট বিকেল তিনটা দশ এ। যাবোই যখন, ইতালির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মিলান ঘুরে দেখা যেতে পারে। সেই ভাবনা থেকেই ভোর ছ'টায় মালপেনসার উদ্দেশ্য রওনার নিয়ত করে ফেলি আমরা। একটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণের উদ্দেশ্যে আমরা পাঁচ জনের টিম এসেছিলাম এই তুরিন শহরে। গতকাল তা শেষ হয়। আজ ভোর চারটায় যখন ঘুম ভাঙ্গার এলার্ম বেজে উঠল, আমরা কেউ ই কী জানতাম যে ততক্ষণে থ্রিলারের প্লে বাটন চাপা হয়ে গেছে!
মিটার ডিসপ্লের তেইশ ইউরো কীভাবে তেত্রিশ ইউরো হয়ে যায় সেই 'তুরিনিয়ো ট্যাক্সি ধাঁধা' কাটিয়ে যখন পোর্তো নোভায় পৌঁছলাম তখন ঘড়িতে সাড়ে পাঁচ টা পার। ট্রেন ইটালিয়ার কাস্টমার কেয়ার বন্ধ। অতঃপর টিকেট ভেন্ডর মেশিনই ভরসা। তুরিন পোর্তো নোভা থেকে 'ম্যালপেনসা টার্মিনাল ওয়ান' স্টেশন এ পাঁচ জনের টিকেট কাটা হলো, কিন্তু টিকেট দেখায় দশ টা! ভেন্ডর মেশিন বেশি দিতে চাইলেই বা কী, আমাদের তো লাগবে পাঁচটা। সেই পাঁচটা নিয়েই আমাদের দৌড়; ছয়টা পাঁচে ট্রেন কীনা! এক ভদ্রলোক দেখি মেশিনের মুখে জমা হওয়া বাকী পাঁচ টিকেট দ্রুত এগিয়ে এসে আমাদের হাতে দিয়ে গেল! ইতালিতে বিরল ঘটনা। ছয়টা পাঁচের ট্রেন প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে, সবাই উঠে বসলাম। কিন্তু টিকেটে লিখা ট্রেনরুট মিলেনা! এক ইতালিয়ান ভদ্রলোক টিকেট দেখে জানালো এই ট্রেন সেটি নয়। তখন ছয়টা চার! পড়িমরি করে সবাই নেমে পড়লাম। প্রচন্ড বিভ্রান্ত মন! সাথে সবচেয়ে বড় শত্রু ইতালিয়ান ভাষা! কার কাছে কী সাহায্য চাইবো! পাশে দাঁড়ানো আরেক ট্রেনের ম্যানেজার কে জানালে তিনি ভিন্ন এক ট্রেনে তুলে দিলেন। সেটিতে আমরা যাবো পরবর্তী স্টেশনে৷
২
পোর্তো সুসা-- অদ্ভুত এক ছোটখাটো স্টেশন। তখন ছয়টা বারো হয়ত। অল্প মানুষ, অন্ধকার তখনো জমে গাঢ় হয়ে আছে এখানে ওখানে। দেশে এক আধতলা স্টেশনেই কূল পাইনা, এখানে দেখি প্রায় আড়াই তলা! আমরা তখন নিচতলায়। এখান থেকেই ছ'টা পনেরোর মিলানের 'রো ফিয়েরা' যাবার আমাদের কানেকটিং ট্রেন ইতোমধ্যে ছেড়ে চলে গেছে৷ এখন কী হবে! কোন অফিশিয়াল নাই যে একটু জিজ্ঞেস করে সমাধান খুঁজবো৷ কোনভাবে আমরা জানলাম অফিশিয়ালরা থাকেন ভদ্রপল্লী তে, মানে দোতলায়।
বাংলাদেশী--ইউরোপে এসেছে দিন পাঁচেকের ট্যুরে, আসার সময়ের ভুখা-নাঙ্গা লাগেজ টা ফেরার পথে কী রূপ ধারণ করে তা পাঠক মাত্রই ধরে ফেলার কথা! চাইল্ড বেডরুম(!) সাইজের অন্তত ৬/৭ টা ব্যাগ নিয়ে উঠতে হবে দ্বোতলায়! দু একজন বাদে প্রায় সবাই চল্লিশোর্ধ্ব মানুষ আমরা, খেলা তো জমে গেলো। উঁচুতলায় উঠে এক অতি নিচুদরের ইংরেজি ভাষাজ্ঞানের ইতালিয়ান পুলিশ পেলাম, টিকেট দেখেই বলে " আদোন্নো, তিকেট ওফিস ওপেন তেন মিনিত, তেন মিনিত"( I don't know, টিকেট অফিস ১০ মিনিট বাদেই খুলবে,তারাই সমাধান দেবে)। এবার অপেক্ষা, এই দশ/এগারো মিনিটে আমরা প্যানিক এটাকে কেউ কেউ বাস ধরলাম, কেউ ট্যাক্সি! মনের ট্রান্সপোর্ট ই বড় ট্রান্সপোর্ট কী না! তবে আমাদের টিমের সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্য--একজন নারী; কুল হেডেড, সে সহ আমরা দৃঢ় থাকলাম একটা সমাধান হবেই। ইতালিতে পুরুষরা সস্তা বিয়ার আর দামী টোব্যাকো টেনে সবসময় উন্মাতাল থাকে কীনা জানিনা, কিন্তু নারীরা যে এত হেল্পফুল! পুরো ট্যুরে যত টুকটাক বিপদে পড়েছি, কোন না কোন নারীর থেকেই সাহায্য পেয়েছি। অনেক মেয়েদের ই- সিগারেট টানতে দেখেছি, এটা টানলে মাথা ঠান্ডা থাকে নাকি? হা হা হা, হতে পারে৷ ট্রেন ইটালিয়ার বছর বাইশের সোনালী চুলের স্মিতহাস্য মেয়েটি যখন হাসিমুখে পুরো ট্রেন রুট ম্যাপ প্রিন্ট করে কলম দিয়ে এঁকে এঁকে বুঝিয়ে দিলো...আহ...শান্তি। পরেরবার যদি ইউরোপে আসার সুযোগ হয়, সংশ্লিষ্ট দেশে আগে একটা মেয়ে বন্ধু জোটাতে হবে বোধহয়! আর সাথে ভাষাটা। যাহোক, শান্তির মাঝে অশান্তির লু হাওয়া হলো কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছোতে মোট তিন বার ট্রেন পরিবর্তন করতে হবে! সকাল ৭:০৫ এ 'তুরিনো পোর্তা সুসা' থেকে ছেড়ে যাওয়া ট্রেন 'রো ফিয়েরা'য় পৌঁছাবে সকাল সাড়ে আট টায়। এরপর উনিশ মিনিট ট্রানজিট টাইমে ট্রেন পরিবর্তন করে সকাল আটটা উনপঞ্চাশ মিনিটে নতুন ট্রেনে চেপে যেতে হবে 'বুস্তো আরসিজ' নামক স্টেশনে। সেখানে নয় মিনিটের ট্রানজিট শেষে নতুন ট্রেনে চেপে ম্যালপেনসা টার্মিনাল ওয়ান স্টেশনে নামতে হবে। ভোর চার টায় ঘুম ভাঙ্গা, ইতোমধ্যে একবার ট্রেন পরিবর্তনের হ্যাপা খাওয়া ঢাউস সাইজের কতগুলো লাগেজ বহনকারী গোটা পাঁচেক মানুষের মুখটা এবার কল্পনা করুন। আসলেই করুণ! কী আর করা! গলায় যখন দিয়েছি, গিলতে তো হবেই।
৩
হিন্দি ডেইলি সোপে দুঃসংবাদে যেমন পরিবারের সব সদস্যরা একে অপরের মুখের দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকায়, তেমনি আমরা সবাই সবার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। সময় কম, ৭:০৫ মিনিটে ট্রানজিট থ্রিলারের প্রথম পর্বে নামতে হবে। আমরা ২ নং প্ল্যাটফর্মে ছিলাম, যেতে হবে ৪ নম্বরে। মাঝে মাত্র দুটো লাইন। বাংলাদেশ হলে ইচ্ছেমত নেমে ওপারে উঠে যাওয়া যেত, কিন্তু বড় করে লিখা "Vietato attraversare i binari"। মানে "দাঁড়া ব্যাটা ভুলেও রেললাইন পার হোস না"! সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আবার আরেক সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে যেতে হবে অন্য প্ল্যাটফর্মে। সাথে হস্তি সদৃশ ব্যাগ! মজা আর মজা। মজায় মাজা ভাঙলেও যেতে হবে মালপেনসা!
তুরিন থেকে রো ফিয়েরার পথে ইতালিয়ান গ্রাম- ফসলের মাঠ-ঘন কুয়াশা দেখতে দেখতে যাচ্ছি। পুরো পথে শুধু একটা জিনিস ই মনে হলো, ইউরোপের জমকালো জীবনের বাঁকে জগদ্দল পাথরের মত চেপে আছে শূন্যতা, একাকিত্ব আর বিষন্নতার ভয়াবহতা। যে পাখিটা এই প্রচন্ড শীতে আধা অন্ধকার ফসলের মাঠে খাদ্য খুঁজে হয়রান, তার জন্যও মনের অজান্তে বেদনা জাগলো। আহারে আমার বাংলাদেশে যদি জন্মাতো , অন্তত আরও পাখির সাথে মিলে চকচকে রোদে মনের আনদে উড়ে বেড়াতো। হয়ত তাদের ও আনন্দ আছে, তাদের মতো। আমরা দেখিনা। রো ফিয়েরার ঠিক আগের স্টেশন টার নাম 'ম্যাজেনটা'; মফস্বল শহর কিংবা শহরতলীর মত দেখতে। আমার ঠিক মুখোমুখি বামে বসে ছিলো ২০/২১ বছরের এক যুবক। পুরোটা পথ মোবাইল ফোন থেকে মুখ তোলেনি। দুই হাতের দুই বৃদ্ধাঙ্গুল মেসেজ টাইপে ব্যাস্ত ছিলো পুরোটা পথ। ছেলেটা ম্যাজেন্টা স্টেশনে নামতেই দূর থেকে দৌড়ে এসে এক তরুণী ছেলেটিকে দীর্ঘ আলিঙ্গনে ধরে রাখলো প্রায় আধা মিনিট। হয়ত ছুটিতে ফিরেছে, বহুদিন বাদে দেখা। ইউরোপেও অনুভুতি আছে তাহলে! বহুদিন বাদে কাছে পাবার আনন্দ কিংবা যুগল বিচ্ছেদের! এসব নানান ভাবনা ভাবতে ভাবতে প্রায় ঘন্টা দেড়েক বাদে যখন রো ফিয়েরায় পোঁছলাম তখন আলো ফুটেছে।
৪
রো ফিয়েরায় ঘটলো এক মজার ঘটনা। ভোর সকালের ভুলের ভয়েই কীনা, এবার আমরা অতি সতর্ক হয়ে গেলাম। এসইউ ২৪৫২২ নং ট্রেন যাবে 'বুস্তো আর্সিজ' এ। প্ল্যাটফর্ম ও ঠিক আছে, একজন ইতালিয়ো আমাদের টিকেট দেখে নিশ্চিত করলো এটাই সেই ট্রেন। ট্রেন এসে গেছে কিন্তু আমরা উঠছিনা! যদি ভুল হয়! আর মাত্র বিশ/তিরিশ সেকেন্ড সময়। নার্ভাস ব্রেকডাউন হতে যাচ্ছে, এবং তা থেকেই কীনা; আমাদের একজন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা আরেক ইতালিয়ো কে হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো "ইজ ইট চব্বিশ পাঁচশো বাইশ ট্রেইন?" নিজ ভাষা নিয়ে জাত্যাভিমানী এই ইতালীয়; যে কী না ইংরেজী এমনকি অতি সাধারণ ইংরেজীই বোঝে না, সে "চব্বিশ পাঁশশো বাইশ" শুনে ভ্যাবলা হয়ে রইলো। উপায়ন্তর না দেখে ট্রেনে উঠে পড়লাম। এই ট্রেন যেহেতু 'ভারেজ' যাবে, সুতরাং বুস্তো আর্সিজ হয়েই যাবে--এই ভরসা ছিলো। বুস্তো আর্সিজ নেমে তৃতীয় বারের মত ট্রেন পরিবর্তন করে ২৫৫৯৫ নম্বর ট্রেনে চেপে অবশেষে ম্যালপেনসা টার্মিনাল ওয়ান স্টেশনে নামলাম সবাই। দূর বিদেশ বিভুঁইয়ে এসে এমন না জেনে করে ফেলা ভুল এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা উপহার দিলো। দেশে হলে না বুঝতে পারলে " ভাই এই ট্রেনটা কয়ডায়? কোনদিক দিয়ে যায়? কই যেয়ে আবার ট্রেন পাল্টাবো?" বলে বলে ঠিকই পৌঁছে যেতাম, এখানেও লক্ষ্যে ঠিকই পৌঁছোলাম, কিন্তু কী যেন একটা "নাই-নাই" ছিলো!
সানথেলি-ভারসেলি-নোভারার পথে পথে জনমানবহীন ভোরের অন্ধকারে ডানা ঝাপটিয়ে খাবার খুঁজে ফেরা পাখিগুলোর ও কিছুটা একটা নাই মনে হয়েছে। কি সেটি? প্রাণ? কে জানে, হয়ত অথবা নয়।... Arrivederci Italia, ভালো থেকো।
২|
১৭ ই নভেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৪৯
আঘাত প্রাপ্ত একজন বলেছেন: ঠিক ভ্রমণ কাহিনী বলা যাবেনা বোধহয়, একদিনের বিড়ম্বনার বর্ননা আর কি। অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে।
©somewhere in net ltd.
১|
১৭ ই নভেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৫৫
রাজীব নুর বলেছেন: ভ্রমন কাহিনী লিখেছেন?
লেখাটা পড়ে আরাম পাইনি।