নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সোহেল তারেক

সোহেল তারেক › বিস্তারিত পোস্টঃ

সক্রেটিসঃ “শান্ত হও, সহ্য করো”

১২ ই জুন, ২০১৬ রাত ১:১২

সক্রেটিস (৪৬৯/ ৪৭০ খ্রীঃপূঃ – ৩৯৯ খ্রীঃপূঃ) –এর মায়ের নাম ছিল ফেনারিটি; পেশায় ছিলেন ধাত্রী। সক্রেটিস তাঁর কাজের সাথে মায়ের পেশার তুলনা দিতে পছন্দ করতেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, তিনি তাঁর মায়ের মতই ধাত্রীর কাজ করে থাকেন। তাঁর মা যেমন মানব –শিশু প্রসবে সহায়তা করতেন, তেমনি তিনিও সহায়তা করেন, মানুষের চিন্তা –চেতনা প্রসবের বেলায়।

কেমন মানুষ ছিলেন সক্রেটিস? কি ছিল তাঁর জীবন ও দর্শন? বার্টাণ্ড রাসেল বলছেন, “সক্রেটিস সম্বন্ধে আমাদের কম জানা আছে, না বেশি জানা আছে, সেটা স্থির করাই মুশকিল”। কেননা, সক্রেটিস নিজে কিছু লিখে যান নি; যদিওবা লিখে থাকেন তা কখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। তারপরেও যে সক্রেটিসকে আমরা জানি, তার কারন মূলত প্লেটো; সক্রেটিসের সবচেয়ে প্রতিভাধর শিষ্য প্লেটোর মাধ্যমেই আমরা সক্রেটিসকে আবিষ্কার করি।

সক্রেটিসের বয়স যখন ৩৫, যখন তিনি নিজের জন্য একটা পথ খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তখন তিনি এথেন্সে একেবারে অপরিচিত ছিলেন না, অল্পবিস্তর পরিচিতি তিনি তখন লাভ করেছেন। কিছু তরুন ভক্তও জুটেছে তাঁর চারপাশে; অনেকে আসতো তাদের ভবিষ্যত পেশা, জীবিকা বা অধ্যায়নের বিষয়ে তাঁর কাছে পরামর্শ নিতে। কেউ কেউ তাঁকে পথপ্রদর্শক হিসেবেও দেখতে শুরু করেছে। এদেরই একজন, চেয়ারফেন উতসাহের আধিক্যে ডেলফির মন্দিরে গিয়ে জানতে চাইলো, সক্রেটিসের চেয়ে জ্ঞানী কেউ আছেন কিনা। ডেলফির দেবি পাইথিয়া দৈববাণীতে জানিয়ে দিলেন, সক্রেটিসের চেয়ে জ্ঞাণী কেউ নাই।

এভাবে মন্দিরে গিয়ে জিজ্ঞেস করা, প্রত্যাদেশ পাওয়া এবং সেই অনুযায়ী কাজ করার চল সেই সময় খুব চালু ছিল। এই ধরনের দৈববাণীতে সক্রেটিসের আস্থা ছিল কিনা বলা কঠিন। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, ডেলফির এই দৈববাণীর মধ্য দিয়েই সক্রেটিসের ‘ডায়ালেকটিক পদ্ধতির’ সূত্রপাত ঘটে। এর পরেই তিনি তাঁর জীবনের প্রধান কর্ম কী হবে তা স্থির করে নেন এবং বাকি জীবন সেই কর্মেই উতসর্গ করেন। প্লেটো দেখিয়েছেন সক্রেটিস এই দৈববাণী সহজ বিশ্বাসে গ্রহণ করেন নি। দৈববাণী যে ভুল সেটা প্রমাণ করার জন্য তিনি সঙ্গে সঙ্গে সচেষ্ট হয়েছিলেন। কিভাবে? সেই বয়ানটি সক্রেটিসের জবানীতেই শুনি। অর্থাৎ ‘এপোলজি’ ডায়ালগে সক্রেটিসের জবানীতে প্লেটো যে বয়ান দিয়েছেন, সেই বয়ান-

“আমি যখন উত্তরটা(দৈববাণী) শুনলাম, তখন নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম; দেবতা কি বলতে চান? কিসের ইঙ্গিত করতে পারেন তিনি? কারন ছোট –বড় কোন বিষয়েই নিজেকে আমি কখনো জ্ঞানী ভাবি নি। তাহলে আমিই সবচেয়ে জ্ঞানী এই কথা বলে তিনি বোঝাতে চানটা কি? তিনি তো আর মিথ্যে বলতে পারেন না, অবশ্যই না –সেটা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। …শেষে অনেক চিন্তার পর আমি এইরকম একটা কর্মপন্থা গ্রহণ করলাম। জ্ঞানী বলে ধারনা হয় এমন একজন ব্যক্তির কাছে গেলাম আমি, ভাবলাম দেবতার দৈববাণী এইবার খণ্ডন করা যাবে এবং আমি দেবস্থানে বলতে পারবো, ‘এই লোকটি আমার চেয়ে জ্ঞানী আর তুমি বলেছো আমিই সবচেয়ে বড় জ্ঞানী’। এখন এই যে লোকটি, তাঁর নাম করবার দরকার নেই। এথেন্সের নাগরিকদেরই একজন, এই লোকটির সাথে যখন আমি কথা বললাম, আমার এইরকম অভিজ্ঞতা হলো, আমি ভাবলাম, ‘অনেকের কাছে এই লোকটিকে জ্ঞানী বলে মনে হয়, এই লোকটির নিজেরও তাই ধারনা, কিন্তু সেতো তা নয়’। এরপর সেই লোকটিকে আমি দেখানোর চেষ্টা করলাম যে তিনি নিজেকে জ্ঞানী বলেন বটে, তিনি কিন্তু তা নন। এই চেষ্টা করতেই তিনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন।

…তখন আমি ভাবলাম, ‘আমি অন্তত এই লোকটির চেয়ে জ্ঞানী। সম্ভবত আমাদের দুজনের কেউ সৌন্দর্য সম্বন্ধে বা কল্যাণ সম্বন্ধে কিছুই জানি না, কিন্তু সে মনে করে যে সে কিছু জানে; যদিও বেচারা কিছুই জানে না। অন্যদিকে আমি যদি –বা কিছু না –জানি, অন্তত ভাবি না যে আমি কিছু জানি। কাজেই দেখা যাচ্ছে, আমি এই লোকটির চেয়ে সামান্য জ্ঞানী –অন্তত এই হিসেবে যে আমি যখন কিছুই জানি না, তখন অন্তত কল্পনা করি না যে সে বিষয়ে কিছু জানি। এই ঘটনার পর আমি আর একজনের কাছে গেলাম, যাঁকে আরো বড় জ্ঞানী বলে ধারনা হয় এবং আমার ঠিক একইরকম অভিজ্ঞতা হলো এবং তিনিও আমার উপর মহাখাপ্পা হলেন এবং এইরকম আরো অনেকের বেলায় হলো। এভাবে আমি সকলের কাছে গেলাম, একের পর এক সকলের কাছে যা ঘটেছিলো সে সম্পর্কে সচেতন থাকলাম, দুঃখিত হলাম এবং আশংকা হতে থাকলো যে সকলেই আমাকে ঘৃণা ও ঈর্ষা করতে শুরু করেছেন”।

এরপরে তিনি যে অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছান তা জানার আগে এটা বলা জরুরী যে, সক্রেটিস নিজের অজ্ঞানতা স্পষ্টভাবে স্বীকার করতেন এবং অন্যের কাছ থেকে শেখার জন্য অশেষ আগ্রহ প্রকাশ করতেন; সক্রেটিসের এই ধারনা আদৌ ভড়ংবাজি ছিল না। তিনি প্রকৃতই বিশ্বাস করতেন যে আমাদের জীবন অজ্ঞানতার অন্ধকারের মধ্যেই কেটে যায়, যা জানা প্রয়োজন –যেমন কল্যাণ, সৌন্দর্য, সত্যের স্বরুপ –তা আমাদের সম্পূর্ণভাবে জানা কখনোই হয়ে ওঠে না। অথচ অধিকাংশ লোকই মনে করে, যে সব বিষয় অবলম্বন করে তাঁরা জীবনধারন করছে, সে সব বিষয়ে তাদের স্পষ্ট জ্ঞান আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় তা সত্যি নয়।

যাই হোক, শেষপর্যন্ত দেবতার দৈববাণীকে তিনি ব্যাখ্যা করলেন এইভাবে যে, তিনিও কিছু জানেন না, অন্যেরাও কিছু জানে না, তবু একটি কারনে তিনি অন্যদের চেয়ে জ্ঞানী; তিনি জানেন, তিনি অজ্ঞান; অন্যেরা তা জানে না। এরপরে তিনি ঘোষণা করলেন, আসলে দেবতা আমার(সক্রেটিস) কথা বলতে চান নি, তিনি যে আমার নাম ব্যবহার করেছেন, সেটা উদাহরন দেবার জন্য –আসলে তিনি বলতে চান, “হে মানবগণ, সেই ব্যক্তিই জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ যে সক্রেটিসের মত জানে যে, সে কিছুই জানে না”।

সক্রেটিসের একটা নিজস্ব ধর্মমত ছিল; অথচ তাঁর বিরুদ্ধে অধার্মিকতার অভিযোগ আনা হয়েছিল। এটাও সত্য যে তাঁর ধর্মমত তাঁর অকল্পনীয় ক্ষুরধার বুদ্ধি, তীব্র শ্লেষ ও ব্যঙ্গপ্রবণতা, ভয়ানক বাস্তবমূখীতা ও সমকালীন এথেনীয় সমাজের আপোসহীন সমালোচনার প্রবণতাকে বিন্দুমাত্র আচ্ছন্ন করতে পারে নি। তাঁর বিরুদ্ধে তিনটি অভিযোগ আনা হয়েছিল। এক. তিনি এথেন্সের উপাস্য দেবতাদের মানেন না, দুই. তিনি নতুন দেব –দেবী চালানোর চেষ্টা করছেন, তিন. এথেনীয় তরুনদের তিনি এইসব দীক্ষা দিয়ে বিপথগামী করে তুলেছেন। যে সব অভিযোগ সক্রেটিসের বিরুদ্ধে আনা হয়েছিল তার একটিরও কোন ভিত্তি ছিল না এবং সেগুলির একটিও আদালতে প্রমাণিত হয় নি। বিশেষজ্ঞ জন বার্নেটের মতে, ‘অভিযোগ –গুলির মানে যে কি তা কেউ জানতো না, এমন কি অভিযোগকারীরা নিজেরাও জানতো বলে মনে হয় না’। হেমলক বিষপানে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। আসলে সক্রেটিসের মৃত্যুদণ্ড, একটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ছাড়া আর কিছুই নয়। এই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডেরই অজুহাত ছিলো তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ –গুলি।
ছোট পরিসরে সক্রেটিসের কোনো সুসম্বন্ধ দার্শনিক তত্ত্ব কিংবা জীবনবোধ উপস্থিত করা কঠিন। সক্রেটিসের মৃত্যু হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে। এতটুকু নির্দ্বিধায় বলা যায়, এই মানুষটির যেমন ঈস্পাতকঠিন, দৃঢ়, ঋজু ব্যক্তিত্ব ছিল। তেমনি আশচর্যভাবে মানবিকগুনের উপস্থিতি ছিল –ভোগস্পৃহা থেকে মুক্ত ও সুস্থ অথচ তীব্র জীবনতৃষ্ণা ছিল –জীবনের প্রতি গভীর আকর্ষন এবং নির্ভিকতার সঙ্গে মৃত্যুকে গ্রহন করার ক্ষমতা ছিল –এরকম হাজারটা বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করলেও তাঁর চরিত্রের বর্ণনা সম্পূর্ণ হয় না। সক্রেটিস নামক মানুষটি এই সমস্ত অনায়াসে অতিক্রম করে যান।

আর একারনেই তিনি উচ্চকণ্ঠে ঘোষনা করেন, ‘ভালোত্বের জ্ঞান ছাড়া জীবনে ভালোত্ব অর্জন করা সম্ভব নয়’। শুধু এই কথা বলেই থেমে থাকেন না, তিনি আরো এগিয়ে যান, “ভালোত্বের জ্ঞান ছাড়া যখন ভালোত্ব অর্জন করা যায় না, তখন ‘মন্দ’ যারা করে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে ‘মন্দ’ করে না; ভালোত্বের জ্ঞানের অভাবেই করে। ‘মন্দ’ আসলে একধরনের অজ্ঞানতা”

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ১২ ই জুন, ২০১৬ রাত ২:২৯

অশ্রুকারিগর বলেছেন: সুন্দর লিখেছেন। সক্রেটিসের ব্যাপার-স্যাপারই আলাদা ছিল।
একদম খাঁটি দার্শনিক!
তবে সব যুগে সব কালেই এমন গুণীদের কদর কোন সমাজই দেয়নি।

১২ ই জুন, ২০১৬ রাত ২:৩৮

সোহেল তারেক বলেছেন: ধন্যবাদ।

২| ১২ ই জুন, ২০১৬ রাত ২:৪০

গেম চেঞ্জার বলেছেন: সক্রেটিস বিশ্বের প্রথম সারির মণীষী। তিনি আমার আইডল!!

১২ ই জুন, ২০১৬ রাত ২:৫০

সোহেল তারেক বলেছেন: হুম।

৩| ১২ ই জুন, ২০১৬ ভোর ৫:৩৫

সোজোন বাদিয়া বলেছেন: "‘মন্দ’ যারা করে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে ‘মন্দ’ করে না; ভালোত্বের জ্ঞানের অভাবেই করে।" - একমত হতে পারলাম না। বর্তমান বাংলাদেশে স্বৈরাচার চূড়ান্ত রকমের যেসব মন্দ কাজ করছে সেগুলো জেনেশুনেই করছে। বিশ্বাস না হলে ওদেরকে একবার জ্ঞান দেবার চেষ্টা করে দ্যাখেন। সমস্যাটা জ্ঞানের নয়, মানসিকতার।

১২ ই জুন, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:১৯

সোহেল তারেক বলেছেন: একমত না হলে তো কিছু করতে পারবো না। সক্রেটিসের 'ভালোত্ব' নিয়ে যে চিন্তা, সেটাই এখানে বলেছি। যাইহোক, ভাল থাকবেন। ধন্যবাদ।

৪| ১২ ই জুন, ২০১৬ ভোর ৬:০১

প্রাকৃতিক কসমিক ট্রাভেলার বলেছেন: সুন্দর লিখেছেন

১২ ই জুন, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:১৪

সোহেল তারেক বলেছেন: ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.