| নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সরল মেয়ে
সহজ, সরল আর সাধারণ একজন মানুষ।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর "ছুটি" গল্পে বলেছিলেন, "তেরো চৌদ্দ বৎসর বয়সের বালকের মতো এমন বালাই পৃথিবীতে আর নাই। "
কথাটি বড্ড বেশি সত্যি। তবে এই সত্যিটা শুধুমাত্র বালকের জন্যই নয়, বালিকার জন্যও সমানভাবেই প্রযোজ্য। এই বয়সটা একদম কচি লতার মতো; যা কিনা একটু চিমটি কাটলেই নেতিয়ে পড়বে, আবার একটু যত্ন পেলেই তরতর করে বেড়ে উঠবে। এই কোমল-কচি লতাটিকে নেতিয়ে পড়তে দিবেন, নাকি তরতর করে বেড়ে উঠার মতো যত্ন নিবেন, সেই বোধ-বুদ্ধি, দায়িত্ব একান্তই পরিবারের। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন বালকের গল্প, আমি না হয় আজকে বালিকার গল্প বলি।
যখন নবম শ্রেণীতে পড়তাম, আমাদের শ্রদ্ধেয় বাংলা শিক্ষক বলেছিলেন, "এই বয়সটা খুব বিপদজনক। যারাই এই বয়সটাতে নিজেকে, নিজের আবেগকে ধরে রাখতে পারবে, সেই উঠে দাঁড়াতে পারবে।" এই কথাটি যে কতোটা সত্যি, পরিপক্ব বয়সে পৌঁছে আমরা সবাই তা উপলব্ধি করতে পারি। ঠিক একইভাবে এটাও সত্যি যে, ঐ বয়সে নিজেকে, নিজের আবেগকে ধরে রাখা অগ্নিপরীক্ষার মতোই কঠিন পরীক্ষা। মেন্টাল ম্যাচিউরিটি বলেন, কিংবা আবেগের কথাই বলেন, এসব ক্ষেত্রে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা এগিয়ে। মেয়েরা যতোটাই আবেগপ্রবণ হয়, ঠিক ততোটা ম্যাচিউরড হয়। তারা যতো তাড়াতাড়ি আবেগে মুড়ে যায়, ততোটাই তাড়াতাড়ি বয়সের সাথে সাথে ম্যাচিউরডও হয়ে যায়। কেউ কেউ বয়সের আবেগে বিরাট ভুল করে ফেলে, এতোটাই বিরাট ভুল করে ফেলে যে সারাজীবনেও তার অনুশোচনা শেষ হয় না। কেউ কেউ আবার সেই ভুল শুধরে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়; সেইসব কেউ কেউ মেয়েরা প্রচণ্ডরকম সাহসী। আবার কেউ কেউ সেই কোমল-কচি বয়সে একটু আদর-যত্নে পরিপক্ব হতে হতে এতোটাই দৃঢ় অবস্থানে গিয়ে পৌঁছায় যে পরবর্তিতে বাবা-মায়েরা তাদের নিয়ে সবার সামনে গর্ব করে গল্প করতে পারে; কোন পত্রিকা বা ম্যাগাজিনের আর্টিকেলে হাস্যোজ্জল আলোকচিত্র হয়ে যায়। সেই কেউ কেউ যখন পত্রিকা বা ম্যাগাজিনের কলামে অথবা টিভির পর্দায় নিজের সাফল্যের পেছনের মানুষটার কথা বলে, একবাক্যে কার নাম বলে জানেন? এইসব কেউ কেউ মেয়েরা তাদের মায়ের নামটি গর্ব করে বলে। হ্যাঁ, এর চেয়ে বড় সত্য কি হতে পারে যে মেয়ের সাফল্যের পেছনে মায়ের অদৃশ্য হাত আছে। কী করে এই মেয়েগুলো এতোদূর চলে এলো? ঐ যে, সেই কোমল-কচি লতার মতো বয়সে মেয়েটির যত্ন নেওয়া। বয়সটা যে মন আনচান করা, বুকের ভেতর শূণ্যতা অনুভব করার, পড়ার ফাঁকে মাথায় কারো আলতো হাতের স্পর্শ অনুভব করার, কোন বিকেলে খোলা চুলে প্রাণভরে হাসির ছন্দে মেতে উঠার। এই কিশোরী মেয়েটির মাথায় কে হাত বুলিয়ে দিতে পারে? অবশ্যই মেয়েটির মা। একজন মেয়ের সবচেয়ে ভালো বন্ধু কে হতে পারে? কার হওয়া উচিৎ? অবশ্যই অবশ্যই তার মায়ের। এই বয়সটাতে যেসব কিশোরীরাই সবচেয়ে ভালো বন্ধু হিসেবে তার মাকে পাবে, আমি বলবো জীবনের সেরা প্রাপ্তিগুলোর মধ্যে একটা তারা পেয়ে যাবে। মায়ের সাথে যখন একটা মেয়ে তার মনের কথা নিঃসঙ্কোচে বলতে না পারবে, তখনই সে অন্য একজন শ্রোতা খুঁজতে শুরু করবে; যখনই সে মন খারাপের মুহুর্তগুলোতে মায়ের কাঁধে মাথা রাখার মতো স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে না পারবে, তখনই সে অন্য একটা কাঁধ খুঁজতে শুরু করবে। তাই এই বয়সে একটা কিশোরীর পথপ্রদর্শক বলুন আর বেস্ট ফ্রেণ্ডই বলুন, সেটা হওয়া উচিৎ তার মায়ের। অন্যথায় সেই কিশোরী হয়তো ভুলভাল বন্ধু-বান্ধব খুঁজে নেবে কিংবা বয়সের আবেগে অন্য কোন বিশেষ বন্ধুকে খুঁজে নেবে, যাকে আমরা আধুনিক ভাষায় বয়ফ্রেন্ড বলি। তারপর কিশোরী হয়তো অতি আবেগে গা ভাসিয়ে দিয়ে পড়ালেখায় অমনোযোগী হয়ে যাবে। পরিবারের সবার আকাঙ্ক্ষিত ফলাফল করতে পারলো না, আর ধীরে ধীরে মেয়েটির জীবনের উজ্জ্বল সম্ভাবনার মোরটি ঘুরে যেতে লাগলো। রক্ষণশীল পরিবারে দেখা যায় বয়সের সহজাত বৈশিষ্ট্যগুলোকে অত্যন্ত কঠোরভাবে দমন করার চেষ্টা করছেন মায়েরা। কোন ছেলে সহপাঠী কিংবা অন্য কোন পরিচিত ছেলেদের সাথে কথা বলা, প্রয়োজনে কোন বান্ধবীর বাসায় যাওয়া, বিকেলে খেলতে কিংবা হাঁটতে বের হতে যাওয়াতেও কঠোর দমননীতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে। সময় এগিয়ে যাচ্ছে, যুগ এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমরা যখনি পেছন থেকে টেনে ধরার চেষ্টা করবো, তখনি সেটা হবে কোন স্প্রিংকে পেছন থেকে টেনে ধরার মতো। স্প্রিংকে যখন আপনি সজোরে টেনে ধরবেন, তখন তা ছেড়ে দেওয়ার সাথে সাথে উল্টো এসে আপনাকে আঘাত করবে। তাই যতোটুকু টেনে ধরা প্রয়োজন, ততটুকুই টানুন; বেশি টেনে ধরে ব্যথিত হবার কি প্রয়োজন? আমি বলছি না যে পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুকরণে নারী স্বাধীনতার নামে ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশার স্বাধীনতা দিতে। বরং ঘরের বাইরের পুরুষদের সম্পর্কে ধারণা দিন। ঘরে তার যেমন ভাই আছে, বাইরের ছেলেটিও এরকম অন্য একটি মেয়ের ভাই, তার সহপাঠীও অন্য কারো ভাই। তার ভাইটিকে যে চোখে দেখছে, তার সহপাঠীকেও একই দৃষ্টিতে দেখতে শেখান। বাইরের ছেলেটি বিশেষ কোন মানুষ নয়, এটা ভাবতে শেখান। যখনি আলাদা একটা পর্দা দিয়ে বিশেষ শ্রেণীর মানুষ বানিয়ে দেবেন, তখনি তার প্রতি বেশি আকর্ষণ বোধ কাজ করবে। কারন অল্প বয়স্ক ছেলেমেয়েরা নিষিদ্ধ ব্যাপারেই বেশি আগ্রহ বোধ করে। একটা মানুষের সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনের জন্য যেমন রাতের আঁধার প্রয়োজন, তেমনি দিনের আলোরও প্রয়োজন। তেমনি একটা কিশোরী মেয়ের জীবনের ভিতটা তৈরি করার জন্য যেমনটা শাসনের প্রয়োজন, তেমনি আদরেরও, বন্ধুত্বেরও প্রয়োজন। বরং আমি বলবো শাসনের চেয়ে মায়ের আদর আর বন্ধুত্বটাই বেশি প্রয়োজন। তাই হরলিক্সের বিজ্ঞাপনের আবীরের মায়ের মতোই কিছুটা ছেড়ে দিন, আবার কিছুটা যেতেও দিন। তবেই হয়তো ভবিষ্যতে কোন পত্রিকা কিংবা ম্যাগাজিনের আর্টিকেলে আপনার ছোট্ট কিশোরীর পরিপক্ব হাস্যোজ্জল আলোকচিত্র দেখে আপনার আনন্দের চোখের অশ্রু চিকচিক করবে। এইটুকু না হলেও অন্ততঃ সুখী একজন গৃহকর্ত্রী আর সুখী আর পরিপাটি মা হিসেবে দেখতে পাবেন। আর নয়তো শ্বশুড়ালয় থেকে বেড়াতে আসা মেয়েকে দেখবেন কোন এক বিকেলে প্রচণ্ড দুঃখী দুঃখী আর ব্যর্থ দৃষ্টিতে টিভির পর্দায় কোন এক সফল মেয়ের জীবনকাহিনী শুনছে।
©somewhere in net ltd.