নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চিনিলাম আপনারেআঘাতে আঘাতেবেদনায় বেদনায়;সত্য যে কঠিন,কঠিনেরে ভালোবাসিলাম,সে কখনো করে না বঞ্চনা।

সত্যের সারথি সাদেক

সত্য যে বড় কঠিন, কঠিনেরে বাসিলাম ভালো, যে কখনো করেনা বঞ্চনা !

সত্যের সারথি সাদেক › বিস্তারিত পোস্টঃ

যাদু বাস্তবতা ও গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের লেখনি

২৫ শে অক্টোবর, ২০১৬ রাত ১২:১১

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের এরসাথে আমার পরিচয় একজন নিঃস্বঙ্গ মানুষের কথায় । হামিদ ভাই, আমাকে প্রথম একটি বইয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেছিলেন আমি “নিঃসঙ্গতার একশ বছর” বইটি পড়েছি কি না । সেদিন কাচুমাচু মুখে উত্তর না দিলে সে দিন তিনি আমাকে দিলেন বইটি । সময় দিলেন পরদিন পর্যন্তআ।এরপর তাঁর সম্পর্কে আর আমাকে বলতে হয়নি । এতোটাই ভালো লেগে যায় যে , পড়ে ফেলি তার বিখ্যাত সব রচনা ।
আধুনিক উপন্যাস-সাহিত্যকে মাত্রাতিরিক্ত জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে যেসব মহান ঔপন্যাসিকের অপরিসীম অবদান রয়েছে তাঁদের একজন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কুয়েজ। স্প্যানিশ ভাষায় লেখালেখি করেও পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে তিনি রাজত্ব করেন যে-যাদুমন্ত্রের গুণে তা হল তাঁর উপন্যাস ও ছোটগল্পের যাদু বাস্তবতা। তাঁর একটি ছোটগল্প কিংবা উপন্যাস একবার কোথাও প্রকাশিত হলে সাথে সাথে তা রাষ্ট্র হয়ে যেত এবং অনূদিত হয়ে যেত শতাধিক ভাষায়। ধ্রুপদী সাহিত্যের ক্ষেত্রে এরকমটি ঘটতে দেখা যায়নি কখনও।
গার্সিয়া যে-জগতের কল্পনা করেন তা বাস্তব জগতের গভীরে গ্রথিত। কিন্তু এটা বড়ই প্রতারণাময় কারণ তাঁর বাস্তবতা হলো প্রায়শই যাদু-বাস্তবতা। তাঁর প্রথম উপন্যাসেই এর আবির্ভাব ঘটেছিল। লিফ স্টর্ম-এ বৃদ্ধ ডাক্তার সবাইকে ভয় পাইয়ে দেয় মেইড-সার্ভেন্টকে একথা বলে, ‘দ্যাখো, মিস, দ্রুত ছোট ঘাস সেদ্ধ করা শুরু করো এবং তা আমার কাছে নিয়ে আসো স্যুপের মতো করে।’ সার্ভেন্ট বললো, ‘কোন ধরনের ঘাস, ডাক্তার?’ ডাক্তার বললো, ‘সাধারণ ঘাস, ম্যাম, গাধারা সাধারণত যা খেয়ে থাকে।’ এটা কি যাদু-বাস্তবতা? গার্সিয়ার কাছে অবশ্য তা নয়। গার্সিয়া এসব বিষয়ে খুব কমই বিস্মিত হন। তিনি বলেন, ‘মেক্সিকোর রাস্তায রাস্তায় যাদু-বাস্তবতা ছুটে বেড়ায়। যাদু-বাস্তবতা এসেছে মূলত ল্যাটিন আমেরিকা থেকে।’

কলম্বিয়ান শহরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা সম্পর্কে একবার এক সাংবাদিক গার্সিয়ার প্রতিক্রিয়া জানতে চান। ওই এলাকার একটি স্কুলে এই ঘটনা ঘটে। সকাল দশটার দিকে দু’জন লোক ট্রাকে চড়ে এসে বলে, ‘আমরা ফার্নিচারের জন্য এসেছি।’ কেউ তাদের সম্বন্ধে কিছুই জানতো না। কিন্তু হেডমাস্টার মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে।’ ট্রাকে ফার্নিচার বোঝাই করা হলো এবং ট্রাকটি চলে গেল। অনেক পরে টের পাওয়া গেল ট্রাকের লোকদু’টো চোর ছিলো।

গার্সিয়া হেসে বলে উঠলেন, “স্বাভাবিক ব্যাপার।”

তিনি বলে চলেন, ‘একবার বার্সেলোনায় আমি এবং আমার স্ত্রী ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠলো। আমি দরোজা খুলে দিলাম। একজন লোক আমাকে বললো, ‘আমি আইরনিং কর্ড ঠিক করার জন্য এসেছিলাম।’ আমার স্ত্রী বিছানায় শুয়ে থেকেই বললো, ‘আমাদের আইরনের কোনো সমস্যা নেই।’ লোকটা বললো, ‘এটা কি দুই নম্বর এপার্টমেন্ট?’ আমি বললাম, ‘না। উপরে।’ পরে আমার স্ত্রী আইরন করতে গেল এবং এর কর্ড পুড়ে গেল। আমরা জানার আগেই লোকটা এসেছিল এটা ঠিক করে দেওয়ার জন্য। এ ধরনের ঘটনা সব সময়ই ঘটে থাকে।

প্রায়ই বলা হয়ে থাকে যে, কলম্বিয়ান ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার গ্যাব্রিয়েল মার্কুয়েজের যাদু বাস্তবতার সারনির্যাস হচ্ছে তাঁর সিয়েন এ্যানোস দ্য সোলেদাদ উপন্যাসটি। ল্যাটিন আমেরিকার একটি ছোট্ট গ্রাম মাকোন্ডোর একটি পরিবারের সদস্যদের জীবনকাহিনী এটি, যা একশ’ বছরের লোকজ ইতিহাস ধারণ করে আছে। এর মধ্যে আমরা দেখতে পাই ম্যাজিক কার্পেট উড়ে যাচ্ছে, ভূতে এসে আছর করছে গ্রামের উপর। মার্কুয়েজের উপর আমি যে-লেখকের সবচেয়ে বেশি প্রভাব লক্ষ্য করি তিনি হলেন শেক্সপিয়ার। শেক্সপিয়ারের ট্র্যাজেডি মানেই হলো ভূতপ্রেতের ট্র্যাজেডি। সর্বকালের সেরা নাটকের একটি তাঁর হ্যামলেট। হ্যামলেট শুরুই হয়েছে ভূত দিয়ে এবং ভূতের নির্দেশনাতেই চলেছে হ্যামলেটের পিতৃহত্যার প্রতিশোধ-অভিযান। মার্কুয়েজের উপন্যাস মানেও হলো ভৌতিক-অতিলৌকিক ব্যাপার- স্যাপার। তাঁর উপন্যাসের মনস্তাত্ত্বিক গতিপ্রবাহ আধুনিক মানুষকে আন্দোলিত না করে পারে না। তবে তাঁর উপন্যাসের মাত্রাতিরিক্ত যৌনতা অনেকটাই আরোপিত এবং লেখকের মনোবৈকল্যের বহিঃপ্রকাশ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
সাহিত্যিক সৃষ্টিশীলতা নিয়ে মার্কেস নিজের সম্পর্কে একবার বলছেন La que mas me importa en este mundo es el proceso de la creacion- এ জগতে যা সবচেয়ে আমাকে টানে তা হল সৃজনশীলতা। এটা শুধু গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের হৃদয়োৎসারিত অকপট স্বীকারোক্তিই নয় দীর্ঘ ৮৯ বৎসর জীবনের পরতে পরতে তাঁর অসাধারণ সৃজনশীলতা, জীবন ও সমাজ নিয়ে অসম সাহসী সব সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্যেই তা আমরা দেখতে পাই। শিল্পরীতি হিসাবে জাদু বাস্তবতাকে বেছে নিলেও তিনি আজীবন রহস্যাবৃত স্বদেশ কলাম্বিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার বিশিষ্ট বাস্তবতাকে, তার pastoral simplicity কে তুলে ধরেছেন এক শিল্পী সংগ্রামীর প্রোজ্জ্বল ও মহৎ অনুপ্রেরণায়। জাদু বাস্তবতা মানে বাস্তবতার ভেতরকার লৌকিক ও অলৌকিক জীবন এবং তার কিছু অবিশ্বাস্য এবং আশ্চর্য অনুসঙ্গের এক সৃজনশীল রসায়ন। জাদু বাস্তবতা বাস্তবতার উর্ধ্বে কোন অলীক জগত নয় বরং অলৌকিকতার মিশেলে বাস্তবতাকে মানুষের কাছে গ্রহনীয় করে তোলার এক সৃজনশীল প্রক্রিয়া। দুই আপাত বিরোধী সাহিত্যিক ঐতিহ্য রিয়ালিজম বা বাস্তববাদ ও ফেবুলিজম বা পৌরাণিক কল্পনার মিশ্রণে এই ম্যাজিক রিয়ালিজম বা জাদুবাস্তবতার সৃষ্টি। এই জাদু বাস্তবতার শিল্পরীতির মাধ্যমেই তিনি দক্ষিণ আমেরিকার একটি অঞ্চলের রহস্যঘেরা ক্ষয়িষ্ণু অথচ বাস্তব জীবনের ছবি এঁকেছেন অনন্যসাধারণ রূপদক্ষ শিল্পীর কুশলতায়। কল্পকাহিনী, প্রেম, মৃত্যু, বিচ্ছেদ আর নিঃসঙ্গতার অসাধারণ বুননে তিনি সমগ্র বিশ্বে সাড়া জাগানো কয়েকটি উপন্যাস রচনা করে জাদু বাস্তবতার এই শিল্পরীতিকে বিশ্বসাহিত্যের দরবারে বলতে গেলে একাই প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। “সিয়েন আনিয়োস দে সোলেদাদ” বা “নিঃসঙ্গতার একশ বছর” তাঁর এক মহাকাব্যিক সৃষ্টি। এই উপন্যাসে তিনি ক্যারিবীয় সাগর পাড়ের কলাম্বিয়ার ‘মাকান্দো’ নামে এক গ্রামের একটি পরিবারের কয়েক প্রজন্মের সদস্যদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, জীবন-মৃত্যু, প্রেম-বিরহ আর এসবের সামাজিক রাজনৈতিক অভিঘাত ও ঘটনাপ্রবাহের এক অতুলনীয় ছবি এঁকেছেন যা বাস্তবতা আর কল্পনার মিশেলে, লৌকিক আর অলৌকিক সত্যাসত্যের কুজ্ঝটিকায়, উদারনৈতিক আর রক্ষণশীল রাষ্ট্রশক্তির সাংঘর্ষিক রাজনৈতিক পরিমন্ডলের হিংস্রতার আবিল পরিবেশের বিচিত্র বর্ণে প্রতিভাত। এ উপন্যাস বেরুবার সাথে সাথেই আরেক নোবেল জয়ী ল্যাটিন আমেরিকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী কণ্ঠস্বর পাবলো নেরুদা বললেন “আমাদের সাহিত্যে নতুন যুগের একজন সার্ভেন্টাস এসে গেছেন, যিনি আগামীতে সমগ্র বিশ্ব সাহিত্যকেই শাসন করবেন”। বস্তুত সার্ভেন্টেসের ‘ডন কুইসজোট’ এর পরে এটিই ছিল স্প্যানিশ ভাষার সব চেয়ে বেশি পঠিত ও অনূদিত সাহিত্য কর্ম।

আঁকাবাকা রাজপথে গাড়ী চালাতে চালাতে হঠাৎ ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ উপন্যাসের প্রথম লাইনটি যেন মনের মধ্যে গুঞ্জরিত ও রচিত হয়ে উঠল- ‘বহু বছর পর ফারারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে কর্ণেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার মনে পড়ে যাবে সেই দূর বিকেলের কথা যেদিন তাকে সঙ্গে নিয়ে বরফ আবিষ্কার করেছিল তার বাবা’। এ যেন এক নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ। এভাবে সেই মহাকাব্যিক উপন্যাসের ধারণা তাঁর মধ্যে হঠাৎ চলে আসে। তিনি এরপর তীব্র অর্থ কষ্টের মধ্যেও স্ত্রীর উপর ভরসা রেখে উপন্যাসটি শেষ করেন। ১৯৬৭ সালে এটি প্রকাশিত হবার পরে তাঁকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সারা ল্যাটিন আমেরিকায় তা সাড়া ফেলে দেয়। লাতিন আমেরিকার সাধারণ মানুষের জীবনের সামগ্রিকতা, তার লোক জীবনের সংস্কারাচ্ছন্ন অনুভূতির দোলাচল, উদার আর রক্ষণশীল সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব ও সংঘাত অত্যন্ত নিপুনভাবে গ্রথিত হয়ে এক অখন্ড কাব্যিক সত্তা হিসেবে তা এ উপন্যাসে উঠে এসেছে। হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার অসাধারণ উদ্ভাবনী প্রতিভা যিনি নিজ বুদ্ধিতে আবিষ্কার করেন যে পৃথিবী গোল, তাঁর সর্বংসহা স্ত্রী শত বৎসরের নিঃসঙ্গ কর্মঠ নারী উরুলা, ১৭ নারীর গর্ভে ১৭ সন্তানের জন্মদাতা জনক, উরসুলার পুত্র, উপন্যাসের মূল চরিত্র উদারপন্থী কর্ণেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া সহ কিছু বাস্তব চরিত্র অন্যদিকে ভবিষ্যত দ্রষ্টা জিপসী, অপার্থিব সৌন্দর্যের অধিকারিনী রেমেদিওস যার প্রণয়ানলে অনেকেই আত্মাহুতি দেবার পরে একদিন যে মহাশূন্যে মিলিয়ে যায় এরকম কিছু অলৌকিক ঘটনা ও চরিত্র আর ‘মাকান্দো’র জনজীবনের সামাজিক-রাজনৈতিক সংঘাত, বৈধ অবৈধ যৌন জীবন, অনেক চরিত্রের জটাজাল ও পুরো এক শতাব্দীর এক অনিঃশেষ নিঃসঙ্গ রহস্যাবৃত অথচ সামষ্টিক জীবনের এক দলিল এই উপন্যাস। অনেকটা কোলরেজীয় willing suspension of disbelief মনের মধ্যে পোষণ না করে এই উপন্যাসের নিগূঢ় সত্যে পৌঁছানো, এতে বিধৃত জীবনের মর্মোদ্ধারে সফল হওয়ার যাবে না বলেই মনে হয়। কারণ অলৌকিকতার ইন্দ্রজাল রোমান্টিক মনোভঙ্গিরই আরেক প্রকাশ। উপন্যাসের বাক্য গঠন ও ভাষা প্রাচুর্যময়তায় ঋদ্ধ, সহজ ও সাবলীল। লাতিন আমেরিকার শত বছরের নিঃসঙ্গ, নিপীড়িত জনজীবন ও তার মননের অনতিক্রম্য এলিয়েনেশন বা বিচ্ছিন্নতার, তার তৃষ্ণার্ত আত্মার হাহাকার এ উপন্যাসের মর্মবস্তু। ১৯৮২ সালে এ উপন্যাসের জন্য মার্কেস নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হন। নোবেল কমিটি তার অভিনন্দন পত্রে উল্লেখ করেন He had created a cosmos in which human heart and the combined forces of history time and again burst the bounds of chaos.
গার্সিয়া মার্কেসের আরেক অসাধারণ উপন্যাস The Autumn of Patriarch । এক নাম না জানা স্বৈরশাসকের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার এক অদ্ভুত কৌশল নিয়ে এটি রচিত। চিলির স্বৈরশাসক পিনোচেটকেই পরোক্ষে লক্ষ্য রেখে মনে হয় এটি লিখিত হয়েছে। উপন্যাসে সেই অজানা স্বৈরশাসক যখন জনতার রুদ্ররোষে পতিত হয় দেখা যায় মানুষ তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করে। মাত্র শতাধিক বাক্যের Flashback stayl এ রচিত এ উপনাসিকা মার্কেসের এক জটিল সাহিত্য কর্ম।
Love in the time of cholera (১৯৮৫) তাঁর আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস। তাঁর মা-বাবার পূর্বরাগের উপর আংশিক ভিত্তি করে লিখিত এ উপন্যাসের নায়ক তাঁর হারানো যৌবনের দয়িতাকে ৫০ বছর পর খুঁজে পান। একটি সামান্য ঘটনায় তার স্বামীর মৃত্যুর পর। ফ্রয়েডীয় অনুজ্ঞার আলোকে এখানে তিনি চমৎকারভাবে বলছেন মানুষ বুড়ো হয়ে যায় বলে স্বপ্নের পেছনে ছোটা বন্ধ করে দেয় এটা ঠিক নয় বরং তারা স্বপ্নের পেছনে ছোটা বন্ধ করে বলেই বুড়ো হয়ে যায়। The Chronical of a death fore told (১৯৮১) বা “পূর্বোল্লিখিত এক মৃত্যুর কালপঞ্জী” মার্কেসের আর এক মহৎ উপন্যাস। তাঁর এক পরিচিত বান্ধবীর জীবনে ঘটে যাওয়া বাস্তব ঘটনার সংশয়াচ্ছন্ন ও চোখ ধাঁধানো এ এক গল্পগাথা। বিয়ের প্রথম রাতেই বায়ার্দো স্যান রোমান বুঝতে পারে তার নব পরিণীতা বধূ অ্যাঞ্জেলা ভিসারিও অক্ষতযোনি নয়। সে রাতেই ক্ষোভে দুঃখে রোমান তাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। তার অপমানিত মা তাকে নির্মমভাবে প্রহার করতে থাকেন। তার দুই ভাইয়ের তীব্র জেরার মুখে ভিসারিও স্বীকার করে তার সতীত্ব হরণকারীর নাম সান্তিয়াগো। শহরের সবাই জেনে ফেলে ভিসারিওর ভাইদের হাতে খুন হতে যাচ্ছে সান্তিয়াগো। কিন্তু নির্বিকার সান্তিয়াগো খুন হবার আগ পর্যন্ত কিছুই টের পায়না। প্রথম সংস্করণেই ২০ লক্ষ কপি বিক্রি হয়ে ৮০ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসিকা সাহিত্য জগতে এক অতুলনীয় স্থান দখল করে নেয়। ৬২ বছর বয়সে লিখিত The General in his labyrinth (১৯৮৯) তাঁর একটি সামাজিক রাজনৈতিক উপন্যাস। দক্ষিণ আমেরিকার রাজনৈতিক মুক্তি সংগ্রামী সিমন বলিভারের কর্মকান্ড নিয়ে অতি সযত্নে রচিত এই উপন্যাস । তাছাড়াও of love and other demons (১৯৯৪), Memories of my melancholy whores (২০০৪) তাঁর উল্লেখ যোগ্য লেখা। এছাড়াও লিখেছেন অসংখ্য সব চমৎকার গল্প। সুখের কথা এসবগুলো লেখা বাংলা অনুবাদে আমাদের দেশে পঠিত হচ্ছে।
একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে ক্যারিবীয় অঞ্চলের মত এক জায়গায় এতবেশি নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক পৃথিবীর আর কোথাও নেই। আমাদের দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বিস্তীর্ণ ভূভাগে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া গত একশ বছরে সাহিত্যে আর কোন নোবেল জয়ী নেই। এযেন মনন আর সৃষ্টিশীলতার এক অনতিক্রম্য বন্ধ্যাত্ব। চিলির পাবলো নেরুদা, গুয়াতেমালার এঞ্জেল এসটুরিয়াস, পেরুর ম্যারিও ভার্গাস, কলাম্বিয়ার গার্সিয়া মার্কেস সহ আরো বেশ কয়েকজন নোবেল জয়ী সাহিত্যিক সহ ল্যাটিন আমেরিকার সাহিত্য জগতের বিশ্বখ্যাত অপরাপর লেখকরা মিলে যে এক অসাধারণ নন্দনতাত্ত্বিক জগত সৃষ্টি করেছেন তাতে অনিবার্য ভাবেই গভীরভাবে যুক্ত হয়ে পড়ে সেই অঞ্চলে দীর্ঘদিনের চাপিয়ে দেয়া স্বৈরাশাসন, হত্যা, বিভীষিকাগ্রস্থ দক্ষিণ আমেরিকার বাস্তব সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন। ইউনাইটেড ফ্রুটস্ সহ বহুজাতিক মার্কিন পুঁজির তীব্র শোষণে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া মেক্সিকো থেকে আর্জেন্টিনা পর্যন্ত কোটি কোটি মানুষের দুঃসহ জীবন ও দীর্ঘশ্বাসের পাশাপাশি নিকটতম প্রতিবেশী যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত অত্যুজ্জ্বল সমৃদ্ধির মিথ তাঁদের বিবেককে নিয়তবিদ্ধ করে চলেছে। পেরুর নোবেল জয়ী ভার্গাস ও কয়েকজন ছাড়া প্রায় সবাই সামাজ্যবাদী শোষণের বিরুদ্ধে ল্যাটিন আমেরিকা তথা ক্যারিবীয় মুক্তি সংগ্রামে একাত্ম ছিলেন। ফিদেল ক্যাস্ট্রো, সালভাদের আলেন্দে, হুগো শ্যাভেজ, চে-গুয়েভারার রাজনৈতিক পথ ও ভাবাদর্শের অনুগামী ছিলেন স্বৈরশাসনে নিষ্পিষ্ট কলাম্বিয়ার শিল্পী সংগ্রামী গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস। মার্কিন ও মেক্সিকোর শাসক গোষ্ঠীর চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে আজীবন ক্যাষ্ট্রোর সাথে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব রেখেছিলেন তিনি। এমনকি ভিন্ন মতাবলম্বী কিউবান লেখক হার্বাটো প্যাডিলোকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ল্যাটিন আমেরিকার বুদ্ধিজীবি মহলে যখন বিতর্ক চলছে, অনেকেই যখন ক্যাষ্ট্রোর নিন্দামন্দ করছেন তখন গার্সিয়া মার্কেস দৃঢ়ভাবে ক্যাষ্ট্রোকে সমর্থন করে সবাইকে অবাক করে দেন। এটা নিয়ে তাঁর বন্ধু পেরুর নোবেল জয়ী সাহিত্যিক ভার্গাসের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছেদ হয়ে যায়। কিন্তু তিনি সমস্ত প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করে ল্যাটিন আমেরিকার প্রগতিশীল মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেন। এছাড়াও ১৯৭৩ সালে তাঁর এক বৈপ্লবিক ও অদৃষ্টপূর্ব সিদ্ধান্তে সারা বিশ্বের সাহিত্য জগতে উৎকণ্ঠার ছায়া নেমে আসে। চিলির রাষ্ট্রপতি সালভাদর আলেন্দেকে হত্যা করে পিনোচেটের সামরিক স্বৈরাচার ক্ষমতা দখল করার প্রতিবাদে তিনি তাঁর লেখা লেখির কাজ বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দেন। অবশ্য সবাইকে স্বস্তি দিয়ে সৌভাগ্যবশত পরে তিনি তা প্রত্যাহার করে নেন। ভেনেজুয়েলার বৈপ্লবিক পরিবর্তন ও হুগো শ্যাভেজকে তিনি অকুণ্ঠ সমর্থন জানান। ব্যবস্থাগত ত্রুটি বিচ্যুতি সহ মানুষের সর্বাঙ্গীন মুক্তির পথ হিসাবে সমাজতন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্বকেই বরণ করে নেন মার্কেস। আমৃত্যু তাঁর বিশ্বাসে তিনি স্থির ছিলেন। তাঁর বিশাল সৃষ্টি কর্মকে তিনি মানবজাতির মুক্তির লক্ষ্যে নিবেদন করেছেন। তিনি এদিক থেকে ভাগ্যবান যে বিদ্যমান সমাজতন্ত্র ও সোভিয়েতের পতনের পরে প্রগতিশীল দুনিয়ার সৃষ্ট হতাশা ও শূন্যতার মাঝে দক্ষিণ আমেরিকার বৈপ্লবিক পরিবর্তন ও বামপন্থার অভূতপূর্ব উত্থান প্রত্যক্ষ করে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। তিনি দেখে যেতে পারলেন ব্রাজিল, ভেনেজুয়েলা, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, চিলি সহ দক্ষিণ আমেরিকার সর্বত্র জনগণের ভোটে বিজয়ী হয়ে বামপন্থীরা আজ ক্ষমতায় এসেছে। সাম্রাজ্যবাদী প্রচার যন্ত্র ও মিডিয়ার নীরবতার মধ্যেও এ পরিবর্তনের হাওয়া বিশ্ব বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ায় এক নতুনতর উপাদান যুক্ত করে চলেছে। ইয়াংকি ও স্পেনীয় বেনিয়াদের দ্বারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শাসিত ও শোষিত দক্ষিণ আমেরিকার অভূতপূর্ব এই নব জাগরণের অন্যতম প্রধান সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক কান্ডারী, বিপ্লবী মানবতাবাদী গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ সবার প্রিয় “গ্যাবোর” চির বিদায়ে তাঁর প্রতি আমরা শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। তাঁর জীবন ও কর্মের অনিঃশেষ উত্তরাধিকার কোটি মানুষকে নতুন পৃথিবী বিনির্মাণে চিরদিন উদ্দীপ্ত করবে।


(লেখক, সাংবাদিক ও শিক্ষার্থী,জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ২৫.১০.১৬, ঢাকা,)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.