নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চিনিলাম আপনারেআঘাতে আঘাতেবেদনায় বেদনায়;সত্য যে কঠিন,কঠিনেরে ভালোবাসিলাম,সে কখনো করে না বঞ্চনা।

সত্যের সারথি সাদেক

সত্য যে বড় কঠিন, কঠিনেরে বাসিলাম ভালো, যে কখনো করেনা বঞ্চনা !

সত্যের সারথি সাদেক › বিস্তারিত পোস্টঃ

ঘুড়ে এলাম ভাগ্যকুল থেকে নির্মাণাধীন স্বপ্নের পদ্মাসতু

১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ১১:৩২


সাপ্তাহিক ছুটির দিনের সকালে হঠাৎ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিস্তব্ধ আঙ্গিনায় সকালে সাজ সাজ রব পড়ে গেল । শীতর সকালে সবাই যখন জড়সড় তখন আমরা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ এর দশম ব্যাচ চলছি আমাদের ফিল্ড ওর্য়াকের কাজে মুন্সিগঞ্জে ।আমাদের সাথে রয়েছে সাথে আমাদের প্রায় একশত জনের এক বিশাল টিম আমার আমাদের প্রিয় স্যার সহযোগী অধ্যাপক মনিরুজ্জামান ও বিভাগের আরো কিছু বড় ভাই । আমাদের যাত্রা শুরু হলো সকাল সাড়ে আটটায় । বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি বাস আমাদের নিয়ে সাঁ সাঁ বেগে এগিয়ে চলছে ঢাকা- মাওয়া রুটে । নয়াবাজর মোড় হয়ে বাবু বাজার এরপর বাবুবাজার ব্রীজ পার হয়ে কদমতলী । এভাবে দ্রুতবেগে চলছে আমাদের যাত্রা । পথে যেতে যেতে প্রাকৃতিক নিসর্গ দেখছি , যা খুব কম মানুষের দেখার সৌভাগ্য হয় । পথের পাশে ঝিলমিল প্রকল্প যা দেখলে চোখ জুড়ে যায় বিশেষ করে শরতের কাশবনে যখন চারদিক সাদা হয়ে উঠে ।
আমাদের প্রথম কাজ উদ্দেশ্য ছিল ভাগ্যকুলে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের আবহাওয়া নিয়ে তাদের কাজ হাতে কলমে শেখা ।তাই আমাদের বাস সেদিকেই চলছে । আমারা সাড়ে নয়টার কাছাকাছি সময়ে পৌছে গেলাম আামাদের প্রথম লক্ষস্থলে । সেখানকার কর্মকর্তার সাথে স্যার কথা বলে আমাদের দুটি গ্রুপে ভাগ করে দিলেন যাতে আমারা খুব সহজে সেখানকার কাজ গুলো বুঝে নিতে পারি । প্রথম গ্রুপকে আবহাওয়া বার্তার বিভিন্ন ইন্সট্রুমেন্ট এর কাজ দেখানো হলো দেখানোর এই কাজটি অতীব দক্ষতার সাথে করলেন সেখানকার সহকারী জয়নাল আবেদীন । তিনি দেখালেন ইভাপোরাশন প্যান , যার মাধ্যমে পানির বাষ্পায়নের হিসেব করে বাতাসের আদ্রতা, পানি শোষনের ক্ষমতা হিসেব করা হয় । তিনি বললেন রোদ বেশি হলেই যে, পানি বেশি বাষ্পে পরিণত হবে এমন কোনো কথা নেই । যদি বাতাস বেশি থাকে তাহলে পানি বেশি বাষ্পে পরিণত হবে ।
এরপর দেখালেন রেইন গেজ অর্থাৎ প্রতিদিন কতটুকু পানি হয় তা পরিমাপ করার পদ্ধতি । এক মজার পদ্ধতির মাধ্যমে প্রতিদিনকার বৃষ্টি পাতের হিসেব করা হয় এবং এর গড় করে বাৎসরিক গড় বৃষ্টিপাতের হিসেব করা হয় । আমাদের তিনি দেখালেন গ্রাউন্ড ওয়াটার ম্যাজারমেনট ট্যাবল । যার মাধ্যমে আমরা ঠিক কত নিচে পানির পাব তা জানতে পারব। তিনি জানালেন যে, মুন্সিগঞ্জ বা তার আশে পাশের অঞ্চলে এর গভীরতা মাত্র ৭.৩২ মিটার । তবে ঢাকার বুড়িগঙ্গার আশে পাশে এর গভীরতা ৩০ মিটার হলেও উদ্বেগ জনক কথা হলো নতুন ঢাকা বিশেষ করে বসুন্ধরা , গুলশান ইত্যাদি এলাকায় প্রায় ৮০ মিটার গভীরে ভুগর্ভস্থ পানি পাওয়া যায় । যা আমাদের জন্য হুমকি স্বরুপ ।
এরপর দেখলাম সূর্যের কিরণ মাপার যন্ত্র । যাকে sun shine recorder বলা হয় । এর মাধ্যমে আমরা জানতে পারি দিনের কোন সময়ে রোদ উঠেছিল বা কোন সময়ে রোদ ছিল না । এই যন্ত্রে আতসী কাচের একটি গোলব থাকে । এই গোলবটির নিচে এক ধরনের কাগজ থাকে যার উপর সময়ের দাগ কাটা থাকে । রোদ উঠলেই আতসী কাচের মাধ্যমে রোদ সেই কাগজে গিয়ে পড়ে ফলে সেই কাগজটি পুড়তে শুরু করে। তখন আমরা সময়ের দাগ থেকে বুঝতে পারি দিনের কোন সময় থেকে রোদ উঠেছিল ।
এরপর দেখলাম wind meter যার সাহায্যে আমরা বাতাসের বেগ জানতে পারি । এবং এখানে সবশেষে দেখলাম হাইগ্রোমিটার । হাইগ্রোমিটারের সাহায্যে আমরা বাতাসের আদ্রতা , আবহাওয়ার অন্যান্য খবর জানতে পারি । এই যন্ত্রে দুটি বালব বা থার্মোমিটার থাকে । এর একটি শুষ্ক অন্যটি আদ্র থাকে । এই দুই যন্ত্রেও পাঠের পার্থক্য থেকে আমরা আবহাওয়ার খবর জানতে পারি বা বলতে পারি যে আগামী ২৪ ঘন্টায় কি হতে পারে । আমরা যখন এগুলো দেখছিলাম তখন আরেকটি দল নদীকে কিভাবে পানির উচ্চতা মাপা হয় বা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পানির উচ্চতা কত তা জানার জন্য কাজ করতেছিল । আর এই কাজটি দেখাচ্ছিলেন সেখানকার এক কর্মকর্তা । তিনি আমাদের দেখালেন কিভাবে জোঁয়ার-ভাটার সময় ও জোয়ার আসার সময় আমরা পানির লেবেল মাপতে পারি । সেখাকার কাজ শেষ করে আমরা এসবের বাস্তব অভিজ্ঞতার জন্য নদীর পাড়ে গিয়ে দেখে আসলাম কিভাবে নদীর পানি বেড়ে যাওয়া - কমার হিসেব করা হয় ।
এর পর আমরা সেখান থেকে মাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম । মাওয়া ঘাট এসে প্রথমে আমরা হোটেলে খেয়ে নিলাম ইলিশ ভাজি আর সাথে নানা পদের ভর্তা । অনেকেই আবার খেয়ে নিলেন সর্ষে ইলিশ । সে এক অপূর্ব স্বাদ । যেন এখনো সেই স্বাদ লেগে আছে আমাদের ঠোঁটে ।খাওয়ার পর্ব শেষ করে আগে থেকে ঠিক করা লঞ্চে আমরা পদ্মায় ঘুরতে গেলাম ।
প্রথমে আমরা দেখলাম যে এলাকাটিতে পদ্মা ব্রীজ হচ্ছে সেই এলাকাটি । ব্রীজের কাজের মধ্যে দেখলাম ব্রীজের পিলারের কাজ । দেখলাম পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হ্যামারসহ নানা কিছু ।
প্রসঙ্গত, পদ্মা সেতু হচ্ছে বাংলাদেশের পদ্মা নদীর উপর দিয়ে বহুমুখী সেতু নির্মিত হবে। পৃথিবীর বৃহত্তম সড়ক সেতুগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে বাস্তবায়নাধীন পদ্মা সেতুর অবস্থান ২৫তম। এই সেতু দিয়ে যুগপৎভাবে যানবাহন ও ট্রেন চলাচল করবে। এর মাধ্যমে লৌহজং, মুন্সিগঞ্জ এর সাথে শরিয়তপুর ও মাদারীপুর যুক্ত হবে, ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের সাথে উত্তর-পূর্ব অংশের সংযোগ ঘটবে। পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য হবে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। দ্বিতলবিশিষ্ট এই সেতু নির্মিত হবে কংক্রিট আর স্টিল দিয়ে। যার ওপর দিয়ে যানবাহন আর নিচে দিয়ে ট্রেন চলবে।
মূল পিলারের পাইলিং ৩ মিটার ব্যাসের ৪শ’ ফুট দীর্ঘ পাইলের (৬টির সেট) ৪০ ফুট এরই মধ্যে গভীরে ঢুকেছে। চীনা শক্তিশালী হ্যামার দিয়ে ঢোকানো হচ্ছে ।
৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যেের পদ্মা সেতু ৪২টি পিলারের ওপর নির্মিত হবে। ১৫০ মিটার পরপর পিলার বসানো হবে।
সেতুর নকশা পরিকল্পনা অনুযায়ী, ওপরের অংশের সোনালি রঙের দুটি স্প্যানের মধ্যে ৩৪টি জয়েন্ট হবে। ওয়ার্কশপে এখন পর্যন্ত ৪টি জয়েন্টের কাজ শেষ হয়েছে। একেকটি জয়েন্টের ওজন ৪৮ থেকে ৬০ টন। পদ্মা সেতুর প্রতিটি পিলারে ছয়টি করে মোট ২৪০টি পাইল থাকবে। আর দুই প্রান্তে আরও ১২টি করে ২৪টি পাইল থাকবে।
দেখতে দেখতে আমাদের লঞ্চ ভিড়ল মাঝিকান্দির চরে । এখানে এসে দেখলাম জনমানব শুন্য এক বিশাল চর । তখন মনে হলো রবীঠাকুরের একটি কবিতা-
“নমোনমো নম, সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি!
গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি।
অবারিত মাঠ, গগনললাট চুমে তব পদধুলি -
ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি।”
আসলেই কি অপরুপ দৃশ্য , যা দেখলেই চোখ জুড়ে যায় ।
মাঝিকান্দির চরে আমরা বেশ কিছুক্ষণ ঘুরলাম । চরে অনেক কাশফুল ছিল যদিও তা ছিল প্রায় শুকনা । এখানে সবাই ধুমছে ছবি তুলছিল । চরে স্যারের অনুমতি নিয়ে আামারা বালিতে দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করলাম । বালিতে দৌড় প্রতিযোগিতাটি ছিল অনেক মজার । কেননা অনেকে যথেষ্ঠ ভালো করেও শেষে এসে বালিতে পড়ে যাচ্ছিল ।
মাঝিকান্দির চরে আমরা ঘন্টা খানিক থাকার পর চলে আসলাম আমাদের লঞ্চের কাছে । এবার লঞ্চে করে গেলাম কুন্ডের চরে । পদ্মায় কাটানো গোটা সময়টাতে আমার মনে পড়ছিল পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের সেই মাছ ধরা জেলেদের জীবন যাত্রার মানের কথা ।
তো যাই হোক এদিকে সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে । আমাদের ফেরার সময় হয়ে গেল । ছেলেরা ফেরার পথে লঞ্চে গান গাইছে মনের সুখে । আমার যখন লঞ্চ থেকে মাওয়া ঘাটে নামলাম তখন চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে । আমরা দ্রুত পায়ে আমাদের ভার্সিটি বাসের কাছে চলে আসলাম ।খুব অল্প সময় পরেই আমাদের বাসে করে ক্যাম্পাস অভিমুখে যাত্রা শুরু করলাম । ফেরার পথে বাসে ছেলে -মেয়েদের বাঁধ ভাঙ্গার উল্লাস আর মুহূমুহ গানে বাস মুখরিত । ছেলেদের অনেকেই ফোক গানে মাতিয়ে তুলল আমাদের মন । সমস্ত দিনের ক্লান্তি আর অবসাদ এক নিমিষেই মিটিয়ে চলল গানের আসর । এভাবে কখন যে ক্যাম্পাসে এসে পৌছালাম টেরই পেলাম না । এভাবে কেটে গেল আমাদের ও একটি দিন আর আমাদের জীবনে যোগ হলো কিছু বাস্তব জ্ঞান অভিজ্ঞতা ।
সব মিলিয়ে আমারা বুঝলাম পরিবেশের সাথে মানুষের সম্পর্ক কি ? আমারা ব্যাখ্যা করতে শিখলাম কিভাবে মানুষ পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ায় আর ভৌগলিক পরিবেশে মানুষের কি কি কর্তব্য ।

যেভাবে যাবেন : মিরপুর ১০, ফার্মগেট , শাহবাগ থেকে যেতে পারেন স্বাধীন পরিবহন এ। অথবা গুলিস্থান থেকে ইলিশ/প্রচেষ্টা বা অন্য অনেক বাস পাবেন মাওয়া যাওয়ার জন্য (বি,আর,টি,সি এর এসি বাস ও আছে ) ।
ঢাকার যেকোন স্থান থেকে যাত্রাবাড়ী পোঁছে ফুটওভার ব্রীজের দক্ষিণ দিকের পোস্তা গোলাগামী রাস্তা দিয়ে একটু সামনে গেলেই পাওয়া যাবে মাওয়া বাসষ্ট্যান্ড। এখান থেকে প্রতি ৫ থেকে ১০ মিনিট অন্তর অন্তর বিভিন্ন পরিবহন কোম্পানির বাস ছেড়ে যায় মাওয়া উদ্দেশ্যে। আনন্দ, ইঁলিশ, গুন-গুন ইত্যাদি পরিবহনে মাওয়া যেতে বাস ভাড়া লাগবে কম-বেশী ৫০ টাকা । ৫০ টাকার বিনিময়ে প্রায় ৩৫ কি.মি. পারি দিয়ে মাওয়া ফেরী ঘাটে পৌছতে সময় লাগবে ঘন্টাখানেক। নিশ্চিন্তে চড়ে বসুন যে কোন একটা বাসে। ইচ্ছে করলে সকাল কিংবা দুপুরে রওনা হয়ে বিকেলটা মাওয়ার পদ্মা পায়ে কাটিয়ে সন্ধ্যার পরপরই ফিরে আসা যায় ঢাকাতে। যাত্রাবাড়ি ছাড়া গুলিস্থান থেকেও মাওয়ার সরাসরি বাস পায়া যায়। এখান থেকে ভাড়া একই পরিমান লাগলেও সময় একটু বেশী লাগে।
বাংলাদেশের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী, পদ্মা নদী। ৩৬৬ কিঃমিঃ দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট এই পদ্মার পাড়ে দাঁড়ালে যেন মনে হয় সাগর, কোনো কিনারা দেখা যায় না; কিন্তু নদীর মাঝে নানা জায়গায় জেগে উঠেছে বহু চর। নদীভ্রমণের জন্য পদ্মা একটি উত্তম পছন্দ। তাই ব্যস্ত জীবনের ফাঁকে কম সময়ে ভ্রমণের জন্য ঘুরে আসুন পদ্মার পাড়ে থেকে।

লেখক, শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মী ,জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.