নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চিনিলাম আপনারেআঘাতে আঘাতেবেদনায় বেদনায়;সত্য যে কঠিন,কঠিনেরে ভালোবাসিলাম,সে কখনো করে না বঞ্চনা।

সত্যের সারথি সাদেক

সত্য যে বড় কঠিন, কঠিনেরে বাসিলাম ভালো, যে কখনো করেনা বঞ্চনা !

সত্যের সারথি সাদেক › বিস্তারিত পোস্টঃ

পুরান ঢাকার প্রাণের সাকরাইন উৎসব

১৪ ই জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ১১:২৩

পৌষের শেষ। পুরান ঢাকার প্রানের উৎসব সাকরাইনের কারণে আকাশ আজ ঘুড়িদের দখলে। আকাশ জুড়ে নানান রং আর বাহারের ঘুড়িদের আধিপত্ত। গত এক সপ্তাহ ধরে পুরান ঢাকার বাহান্ন রাস্তা আর তেপান্ন গলির অধিকাংশ গলিতে আর খোলা ছাদে চলছে সুতা মাঞ্জা দেওয়ার ধুম। রোদে সুতা শুকানোর কাজও চলছে পুরোদমে। তাই শীতের উদাস দুপুর আর নরম বিকালে আকাশে গোত্তা খাচ্ছে নানান রঙের ঘুড়ি। ঘুড়িতে ঘুড়িতে হৃদ্যতামূলক কাটা-কাটি খেলাও চলছে। অহরহ কাটা-কাটি খেলায় হেরে যাওয়া অভিমানী ঘুড়ি সুতার বাঁধন ছিড়ে ভাকাট্টা হয়ে যাচ্ছে দূরে।
পৌষ মাসের শেষ দিনে পালন করা হয় পৌষ সংক্রান্তি উৎসব বা আদি ঢাকাইয়াদের ঐতিহ্যের সাকরাইন উৎসব। ভোরবেলা কুয়াশার আবছায়াতেই ছাদে ছাদে শুরু হয় ঘুড়ি ওড়ানোর উন্মাদনা। ছোট বড় সকলের অংশগ্রহনে মুখরিত প্রতিটি ছাদ। বেলা বাড়ার সাথে সাথে বাড়বে উৎসবের জৌলুস। আর শীতের বিকেলে ঘুড়ির কাটা-কাটি খেলায় উত্তাপ ছড়াবে সাকরাইন উৎসব।এক দশক আগেও ছাদে ছাদে থাকতো মাইকের আধিপত্য। আজ মাইকের স্থান দখল করেছে আধুনিক সাউন্ড সিস্টেম। উৎসবের আমেজ থাকবে পুরান ঢাকার সর্বত্র। এ দিন পুরনো ঢাকার দয়াগঞ্জ, মুরগীটোলা, কাগজিটোলা, গেন্ডারিয়া, বাংলাবাজার, ধূপখোলা মাঠ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, শাঁখারী বাজার, সদরঘাট, কোটকাচারী এলাকার অধিবাসীরা সারাদিনব্যাপি রঙ বেরঙের ঘুড়ি উড়ানোর প্রতিযোগীতায় মেতে উঠবেন। আকাশে উড়বে ঘুড়ি আর বাতাসে দোলা জাগাবে গান। মাঝে মাঝে ঘুড়ি কেটে গেলে পরাজিত ঘুড়ির উদ্ধেশ্যে ধ্বনিত হবে ভাকাট্টা লোট শব্দ যুগল।

সন্ধ্যায় আগুন নিয়ে খেলা আর আতশবাজি তো থাকবেই। আতশবাজির লাল নীল আলোয় আলোকিত পুরনো ঢাকাকে দেখতে চাইলে আপনিও হাজির হতে পারেন সেখানকার কোনও বাড়ির ছাদে বা রেস্তোরায়।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, পৌষ মাসের শেষ দিন সাকরাইনে নতুন ধানের চালের পিঠাপুলি খেয়ে, ঘুড়ি উড়িয়ে আনন্দ উৎসব করার রেওয়াজ বহু পুরনো। ঢাকায় এই উৎসব হচ্ছে প্রায় ৪০০ বছর ধরে। বাংলাদেশের পুরানো ঢাকায় ঘুড়ি ওড়ানো বিনোদন শুরু হয়েছিল মুঘল আমলে। এটা বলা হয়ে থাকে, ১৭৪০ সালে নবাব নাজিম মহম্মদ খাঁ এই ঘুড়ি উৎসবের সূচনা করেন। সেই থেকে এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে । দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে পৌষসংক্রান্তির এই উৎসব পালনের রীতি চালু আছে। নেপালে একে বলে মাঘি, থাইল্যান্ডে সংক্রান, লাওসে পি মা লাও, মিয়ানমারে থিং ইয়ান, কম্বোডিয়ায় মহাসংক্রান এবং ভারতে মকরসংক্রান্তি এবং পশ্চিম ভারতের গুজরাটেও পালিত হয়। উত্তর ভারতীয় এ ঘুড়ি উৎসবটিকে স্থানীয়রা 'সাকরাইন' নামে অভিহিত করে।
সেখানে মানুষ সুন্দর সুন্দর ঘুড়ির মাধ্যমে সূর্যদেবতার কাছে নিজেদের ইচ্ছা ও আকুতি প্রেরণ করেন।
অতীতে সাকরাইনে পুরান ঢাকায় শ্বশুরবাড়ি থেকে জামাইদের নাটাই, বাহারি ঘুড়ি উপহার দেওয়া এবং পিঠার ডালা পাঠানো ছিলো অবশ্য পালনীয় অনুসঙ্গ। ডালা হিসেবে আসা ঘুড়ি, পিঠা আর অন্যান্য খাবার বিলি করা হতো আতœীয়-স্বজন এবং পাড়া-প্রতিবেশীদের মাঝে। একটা নীরব প্রতিযোগিতা চলতো কার শ্বশুরবাড়ি হতে কত বড় ডালা এসেছে। আজ এই সব চমৎকার আচারগুলো বিলুপ্ত হতে চলেছে। পুরান ঢাকার আদি বসবাসকারী সকল মানুষ আজও এই ঐতিহ্যগুলোর স্মৃতি রোমন্থন করেন।
সাকারাইন উৎসব এখন আর শুধু ঢাকাইয়াদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সাকরাইন পুরান ঢাকায় বসবাসকারী সকল মানুষের উৎসবে পরিণত হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, পুরান ঢাকার সার্বজনীন উৎসব ঈদ মিছিল, বৈশাখী মেলা আর সাকরাইন উৎসব। আশার কথা এই যে, পুরান ঢাকার ঐতিহ্য পুনরুজ্জীবন, সংরক্ষন এবং জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে বর্তমান প্রজন্ম সচেতন।
সাকরাইন উৎসবের দিন সারাদিন আকাশে উড়ানো হয় নানান রঙের , নানান আকারের বিচিত্রদর্শন সব ঘুড়ি। দেখতে যেমন তাদের নামও তেমন বাহারি- গাহেল, চোখদ্বার, মালাদ্বার, পঙ্খীরাজ, চশমাদ্বার, কাউঠাদ্বার, চাপালিশ, চানদ্বার, নাকপান্দার, ভোয়াদার, কাউঠাদার, চিলা, চাপরাস, মাখখি আরও কত কি!
এমনকি জাতীয় পতাকার রঙেও তৈরি করা হয় ঘুড়ি। তবে ঘুড়ির চেয়েও সুন্দর হয় এর লেজ। লেজ অনেক আকৃতির ও রঙ বেরঙ এর হয়ে থাকে। ঘুড়ির সঙ্গে সঙ্গে নাটাইগুলোর নামও বেশ মজাদার। বাটিওয়ালা, মুখবান্ধা , মুখছাড়া ইত্যাদি।
সময়ের সাথে সাথে সাকরাইন উৎসবেও এসেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। এক সময়ের চকলেট, শলতা আর পাটকার আধিপত্য ছাপিয়ে এখন আতশবাজির জয়জয়কার! মাইকের জায়গা দখল করে নিয়েছে ডিজে। সাকরাইন পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী উৎসব হলেও এই উৎসবটি আর আগের মত জানান দিতে পারছেনা নতুন প্রজন্ম বিশেষ করে তরুণদের মনে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ছোবলে বাংলার প্রাচীন অনেক উৎসবের মতোই সাকরাইও হারাতে বসেছে তার মাধুর্য্য। গুটিয়ে আসছে তার পরিধি।

তবে উৎসবের অনুষঙ্গে পরিবর্তন এলেও আমেজ আর আবেগটা এখনও রয়ে গেছে আগের মত। যান্ত্রিক এই নগরজীবনে তার আবেগ, তার আমেজ নিয়ে বেঁচে থাকুক।


লেখকঃ গণমাধ্যমকর্মী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়,ঢাকা ।১৪।০১।১৬, পুরোনো ঢাকা

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.