![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ক্ষুদে চাকুরে , লড়াই করি জীবনের সাথে
১০ বছর আগের ইরাক যুদ্ধের প্রেতাত্মারা যে মুক্ত বিশ্বের নেতৃত্বের দাবিদার ব্রিটেনকে এভাবে তাড়িয়ে বেড়াবে, তা সম্ভবত কারও পক্ষেই কল্পনা করা সম্ভব ছিল না। সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপের উদ্যোগ থেকে ব্রিটিশ সরকারকে পিছু হটতে পার্লামেন্ট যে বাধ্য করল, তার একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যায় ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফিলিপ হ্যামন্ড বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটিশ সামরিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে জনমনকে বিষিয়ে দিয়েছে ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধ। প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনের প্রস্তাব পার্লামেন্টে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ ও লিবারেল জোটের অন্যতম প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান মেনজিস ক্যাম্পবেল জানান, আধুনিক ব্রিটেনে শেষ কবে একজন প্রধানমন্ত্রী পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে পার্লামেন্টে পরাজিত হয়েছেন, তা তিনি মনে করতে পারছেন না। বিবিসির রাজনৈতিক সম্পাদক নিক রবিনসন জানিয়েছেন, যুদ্ধ ও শান্তির প্রশ্নে সরকার পার্লামেন্টে শেষবার পরাজিত হয়েছিল কবে, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়েছে। কারও কারও মতে তা ১৮৫৫ সালে। আর অন্যদের মতে ১৭৮২-তে। তবে বর্তমান রাজনীতিকদের কারও জীবদ্দশায় নয়।
সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগের পটভূমিতে প্রেসিডেন্ট আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনের উদ্যোগ নিয়ে গত বৃহস্পতিবার হাউস অব কমন্সে টানা ছয় ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে বিতর্ক চলে। ৯৯ জন এমপি আলোচনায় অংশ নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন বলে স্পিকার অধিবেশনের শুরুতে জানিয়েছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত কতজন সুযোগ পেয়েছেন, তা কার্যবিবরণী থেকে জানতে হলে আগামী সোমবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আলোচকেরা অত্যন্ত আবেগপূর্ণ ভাষায় পক্ষে-বিপক্ষে যেসব ধারালো যুক্তি তুলে ধরেন, তা ছিল খুবই উঁচু মানের এবং বিতর্কটি ছিল খুবই উপভোগ্য।
প্রধানমন্ত্রী নিজে প্রস্তাবটির পক্ষে যুক্তিগুলো তুলে ধরে সবার সমর্থন চান। তবে গ্রীষ্মকালীন অবকাশ শেষ হওয়ার চার দিন আগে পার্লামেন্টের জরুরি অধিবেশন আহ্বানের সময় তাঁর যে ধরনের মারকুটে বক্তব্য ছিল, সেসবের সুর পাল্টাতে শুরু করে ৩৬ ঘণ্টা আগে। বিরোধী দল লেবার পার্টি সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের নিন্দায় সোচ্চার হওয়ার পক্ষে থাকলেও গত মঙ্গলবার রাত থেকে তারা বিভিন্ন শর্ত আরোপ করতে থাকে, যেসব শর্তের মধ্যে ছিল হামলার জন্য দায়ী কারা তার পক্ষে সুস্পষ্ট প্রমাণ দাবি, নিরাপত্তা পরিষদের সম্মতি অথবা ন্যূনপক্ষে আন্তর্জাতিক আইন অনুসরণ এবং সম্ভাব্য সামরিক অভিযানের পরিধিকে রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধের মধ্যে সীমিত রাখা। গত বুধবার দুপুরেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম হেগ অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেন, রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের মতো ঘৃণ্য মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের পর বিশ্ব সম্প্রদায় নিশ্চুপ দর্শক হিসেবে বসে থাকতে পারে না। নিরাপত্তা পরিষদে ব্রিটেনের প্রস্তাব উত্থাপনের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, পরিষদের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন না পেলেও আন্তর্জাতিক আইনে মানবিক প্রয়োজনে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব। কিন্তু বিরোধী দল লেবার পার্টি তাদের আপত্তির কথা জানিয়ে দেয়। মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর বুধবার মধরাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দপ্তর থেকে আবারও একটি বিবৃতি আসে, যাতে যেকোনো সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের আগে পুনরায় পার্লামেন্টে ফিরে এসে অনুমোদন নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। উইলিয়াম হেগ বলেন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ব্রিটিশ সরকার পার্লামেন্টে সব দলের মধ্যে একটা সমঝোতা প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী। কিন্তু সকাল হওয়ার আগেই লেবার পার্টি জানিয়ে দেয়, তারা পাল্টা সংশোধনী উত্থাপন করবে।
পার্লামেন্টের অধিবেশন চার দিন এগিয়ে আনায় এমপিদের অনেকের মধ্যেই সন্দেহ দেখা দেয় যে প্রেসিডেন্ট ওবামার সঙ্গে যোগ দিয়ে দ্রুত সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার উদ্দেশ্য থেকেই প্রধানমন্ত্রী তাড়াহুড়া করছেন। বহু এমপি তাঁদের বক্তব্যে সেই সন্দেহ প্রকাশ করেন। রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে অভিহিত করে নৈতিক কারণে সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ করা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব বলে যে যুক্তি ক্যামেরন তুলে ধরেন, তার পাল্টা হিসেবে প্রশ্ন আসে যে গত প্রায় দুই বছরে আসাদ সরকারের শক্তি প্রয়োগের কারণে যেখানে লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, সেখানে নৈতিক দায়িত্ব পালনের প্রশ্নটি আরও আগে কেন উঠল না। ইরাক ও লিবিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপের মধ্য দিয়ে সরকার পরিবর্তনের মাধ্যমে শান্তি ও স্থিতিশীলতা যে অর্জিত হয়নি, সেই ব্যর্থতার কথাও বারবার উচ্চারিত হয় ওই বিতর্কে। এমনকি লেবার পার্টির এমপি জেরাল্ড কফম্যান প্রশ্ন করেন, গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি সেনারা যখন ফসফরাস বোমা ব্যবহার করেছিল, তখন রাসায়নিক অস্ত্রবিরোধী সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে পাশ্চাত্যের নৈতিক দায়িত্ববোধ কোথায় ছিল? মিসরে মুরসি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর বিক্ষোভ দমনে যে শত শত লোকের প্রাণহানি ঘটেছে, সেখানে পাশ্চাত্যের ভূমিকা যথার্থ ছিল কি না, সেই প্রশ্নও করেন অনেকে। শেষ পর্যন্ত যুক্তির লড়াইয়ে প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়।
লেবার পার্টি ও অন্য এমপিরা সম্ভবত জনমতের চাপ ভালোই উপলব্ধি করছিলেন। একাধিক পত্রিকার জনমত সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছিল যে সামরিক অংশগ্রহণের পক্ষে সমর্থন কমছে। গত সোমবার সান পত্রিকায় যে সমর্থন ছিল এক-তৃতীয়াংশের ঘরে, বৃহস্পতিবার টেলিগ্রাফ-এর সমীক্ষায় তা নেমে আসে ২০ শতাংশেরও নিচে।
সিরিয়ায় মানবিক দুর্যোগ ঠেকাতে সীমিত সামরিক পদক্ষেপের পক্ষে পার্লামেন্টের সমর্থন চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর হতাশ ও বিব্রত প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন বলেন, ‘সামরিক বাহিনীর কোনো ভূমিকা ব্রিটিশ জনগণ দেখতে চায় না বলে যে মতামতের প্রতিফলন এই পার্লামেন্টে ঘটেছে, তা আমি বুঝতে পেরেছি এবং আমার সরকার সেই অনুযায়ী চলবে।’ ভোটের ফলাফল ঘোষণার পরপরই বিরোধী নেতা মিলিব্যান্ড প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রতিশ্রুতি চান যে রাজকীয় এখতিয়ার বা রয়াল প্রিরোগেটিভ ব্যবহার করে ব্রিটিশ সেনাদের কোনো অভিযানে পাঠানো হবে না। প্রধানমন্ত্রী সেই প্রতিশ্রুতিও দেন।
অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব পার্লামেন্টে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার আগেই বিষয়টিতে চাপের মুখে পড়ে সরকার যে ধীরে চলার নমনীয় নীতি অনুসরণের ইঙ্গিত দিয়েছিল, তাকে স্বাগত জানিয়ে অনেক সংবাদপত্র সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। এগুলোর মধ্যে ‘টু চিয়ার্স টু পার্লামেন্ট’ শিরোনামে গার্ডিয়ান পত্রিকার সম্পাদকীয়তে পররাষ্ট্রনীতি ও সামরিক শক্তি ব্যবহারের বিষয়ে সরকারকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করায় সফল হওয়ার জন্য পার্লামেন্টকে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয়। বোঝাই যাচ্ছে, সংবাদপত্রগুলোও পার্লামেন্টে এ ধরনের ফল আশা করেনি।
এই ভোটের পর রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর পরিবর্তে বিরোধী দল এবং পেছনের সারির এমপিরা দেশটির পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণের যে দৃষ্টান্ত তৈরি করলেন, তাতে করে ক্যামেরন ও তাঁর জোট সরকারের কর্তৃত্ব অনেকটাই খর্ব হবে। তাঁদের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্রিটেনের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন এবার আস্থা ভোটের সম্মুখীন হন কি না, অনেকে সেই আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন।
এর মধ্যে খুদে ব্লগ লেখার সাইট টুইটারে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন হাফিংটন পোস্ট-এর লন্ডন প্রতিনিধি মেহেদি হাসান। তাঁর মন্তব্য ছিল, ‘যদি ১০ বছর আগে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এভাবে ভোট দিত, তাহলে অগণিত মানুষকে জীবন দিতে হতো না।’ এসব প্রতিক্রিয়ায় মনে হচ্ছে, ইরাক যুদ্ধের প্রেতাত্মাদের তাড়নায় ব্রিটেনের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটল।
©somewhere in net ltd.