নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শ্রাবণ আহমেদ (নিরব)\nট্রেইনার অব \"উই আর স্টুডেন্টস\" ঢাকা।

শ্রাবণ আহমেদ

শ্রাবণ আহমেদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

পরিত্যাক্ত বাড়ি

১৬ ই আগস্ট, ২০১৮ রাত ২:৫৯

পরিত্যাক্ত বাড়ি
পর্ব-১০ (অন্তিম পর্ব)
.
লোকটি আর কেউ নয়, এই গ্রামেরই সেই বেদম সাহসী এবং বড় চতুর ব্যক্তি মুন্সি।
কিন্তু হঠাৎ করে মুন্সি এখানে কেন? আর আমাদের কাছেই বা কি চায়?
- এখানে শ্রাবণ কার নাম?
মুন্সির এমন প্রশ্ন শুনে কিছুটা অবাক হলাম। পাশে থেকে অনুপম আমাকে দেখিয়ে দিয়ে বললো, এ হলো শ্রাবণ। বলুন কি বলবেন? মুন্সি আমাদের দিকে গভীর দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। লোকটির ওভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে লোকটিকে কোনমতেই আমার কাছে সন্দেহভাজন বলে মনে হচ্ছেনা। তার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে সে আমাদের কিছু বলতে চায়।
- তাহলে তুমিই সেই শ্রাবণ?
- জ্বী, কিছু বলবেন?
- হ্যাঁ, তবে প্রথমেই আমি তোমাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। কথাটি শোনার পর আমাকে হয়তো তোমরা ঘৃণা করবে কিংবা আমার উপর রেগে যাবে। তবুও যে আমাকে কথাগুলো বলতেই হবে। আমি মুন্সির কথায় খানিকটা অবাক হলাম। দেখলাম সেও শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারে। তবে সে আগে কখনো শুদ্ধ ভাষায় কথা বলেনি কেন? নাকি আমিই খেয়াল করিনি!
এর মধ্যে দেখলাম রহমান সাহেব উনার বাড়ি থেকে হচ্ছেন। হাতে ব্রাশ। হয়তো রাত জেগেছে অনেক, সেজন্য এতো বেলা করে ঘুম ভাঙছে। রহমান সাহেবকে আসতে দেখে মুন্সির মধ্যে আমি ভয়ের আভাস দেখতে পেলাম। সে বললো, আমি এখন আসি। পরে কথা বলবো। বিকেলে একটু পথের ধারের ঐ আমগাাছটার নিচে থেকো।
মুন্সি যাওয়ার জন্য যেই না পা বাড়িয়েছে, ঠিক তখনই রহমান সাহেব মুন্সির উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, তুমি কাজটা ঠিক করোনি। তোমাকেও এর জন্যে কিছুটা শাস্তি ভোগ করতে হবে।
আমি রহমান সাহেবের কথা শুনে দ্বিতীয়বারের মতো আবার অবাক হলাম। তিনি আরো বললেন, তবে তুমি যে তোমার ভুলটা বুঝতে পেরেছো এটাই অনেক।
আমি মুন্সির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, লোকটি চোখ দুটো বড় করে হা হয়ে তাকিয়ে আছে রহমান সাহেবের দিকে। সে হয়তো মনে মনে ভাবছে, রহমান সাহেব কি তাহলে সব জানে?
মুন্সি চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে গিয়েও থেমে গেলো। আমি আর অনুপম অপেক্ষা করছি দেখি রহমান সাহেব আরো কি কি বলেন। আর মুন্সিই বা কি উত্তর দেয়!
মুন্সি ফিরে এসে রহমান সাহেবের পা ধরে মাফ চাইলো। সে বললো, স্যার আমার ভুল হয়ে গেছে আমাকে মাফ করে দেন। রহমান সাহেব মুন্সির এমন কার্যকমে নিজের মুখের ভাবমূর্তি পাল্টালেন না। তিনি বললেন, আমার ছেলে মেয়েরা কোথায় আছে এখন? মুন্সি ভয়ার্ত কন্ঠে উত্তর দিলো, স্যার আপনার ছেলেমেয়েরা এখনো ঐ বাড়িতেই আছে। ওদেরকে আগামীকাল কিংবা পরশুর মধ্যে ঢাকায় পাঠানো হতো। কিন্তু এই শ্রাবণদের জন্য দিনটা পরিবর্তন করা হয়েছে।
মুন্সির মুখে এ কথা শুনে অনুপম তাকে প্রশ্ন
করে বসলো, আমাদের জন্য মানে? আমরা আবার কি করলাম?
মুন্সি বললো, আমাদের পরিকল্পনা ছিলো তোমরা যারা যারা বেড়াতে এসেছো সবাইকেই শিকার করা। কিন্তু এখনো অনেকেই বাদ পড়ে আছে। অনুপম আমার দিকে চেয়ে বললো, দোস্ত তোর অনুমান তো একেবারে ঠিক ছিলোরে।
রহমান সাহেব মুন্সিকে বললেন, আপনাদের এসব কাজের সাথে আর কে কে জড়িত আছে? মুন্সি খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললো, আকবর সাহেব, থানার হাবিলদার, আকবর সাহেবের বাড়িতে কাজ করে ঐ শামসু আর আমাদের গ্রামের টপ ধান্দাবাজ কালুচোর।
এই কাজের সবচেয়ে বড় অবদান অর্থ্যাৎ সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম দেয় ঐ কালুচোর। আর আকবর সাহেব হলো এই কাজের মূল গোড়া। তার মাধ্যমেই এবং তার কথাতেই আমরা এই পাপ কাজটা করে থাকি।
মুন্সির এসব কথা শুনে আমার মাথায় রক্ত উঠে গেলো। নিজেকে সংযত রাখলাম আমি। অনুপম পাশে থেকে বলে উঠলো, তা আপনি আবার ওসব কাজ ছেড়ে আমাদের ঐ ব্যাপারে বলতে এসেছেন কেন? নাকি আপনাকে গ্রুপ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে?
মুন্সি অনুপমের কথার উত্তর দিতে যাবে ঠিক তার আগেই আমি বলে উঠলাম, অনুপম তোর মনে আছে গতকাল রাতের কথা? সে বললো, হ্যাঁ মনে আছে।
আমি বললাম, আকবর সাহেব আর তার সাথে থাকা ঐ দ্বিতীয় লোকটি কেন তখন ভূত ভূত বলে চিৎকার দিয়েছিলো জানিস?
অনুপম মাথা ঝাঁকিয়ে না সূচক উত্তর দিলো। তখন রহমান সাহেব পরের কথাটা আমাকে বলতে না দিয়ে তিনি নিজেই বললেন, আকবর সাহেব চেয়েছিলো এসব কাজের ভাগ মুন্সিকে না দিতে। মুন্সির সাথে সেদিন আকবর সাহেবের কথা কাটাকাটি হয়েছিলো। মুন্সির দাবি ছিলো, তাকে ফিফটি পার্চেন্ট ভাগ দিতে হবে। কিন্তু আকবর সাহেব সেটা দিতে রাজি না। অার এদিকে মুন্সিও ছাড়বেনা। তাই মুন্সিকে এই পথ থেকে সরানোর জন্য গতকাল রাতে আকবর সাহেব ঐ অভিনয়টা করে। যাতে মুন্সি সত্যি  সত্যি ঐ ভুত প্রেতে বিশ্বাস করে এবং সেখান থেকে কেঁটে পড়ে। আর এই কারণেই মুন্সি এখন আমাদের সাথে আলাপ করতে এসেছে। আমাদেরকে ঐ পরিত্যাক্ত বাড়ি থেকে সবাইকে বাঁচাতে সাহায্য করতে এসেছে।
আমি রহমান সাহেবের কথাতে বারবার অবাক হচ্ছি।  তিনি এতো কথা জানেন কিভাবে? তাহলে কি তিনি শুধু আমার না, বরং অন্য মানুষেরও মনের কথা বুঝতে পারে! আর ঐ ঘটনার সময় তো রহমান সাহেব ওখানে ছিলেন না। তবে তিনি ওসব কথা জানলেন কি করে?
.
কথার বলার এক পর্যায়ে মুন্সি রহমান সাহেবকে উদ্দেশ্য করে এও বললো যে, যতদিন না পর্যন্ত শ্রাবণ এবং তাদের সাথে আসা সকল ছেলেমেয়েদের ঐ বাড়িতে ঢুকানো না হচ্ছে, ততদিন আকবর সাহেব ঐ বাড়ি থেকে একটা ছেলেমেয়েকেও সরাবে না।  যখনই শ্রাবণদের তার পাতানো ফাঁদে ফেলাতে পারবে, ঠিক তখনই তার পরবর্তী উদ্যোগে সে নেমে পড়বে। মুন্সির কথা শুনে ভড়কে গেলাম আমি। তাহলে এই কারণেই এখানে আসার সময় আকবর সাহেব আমাদের ডাক দিয়ে উপদেশ দিচ্ছিলেন।
মুন্সি বললো, ঢাকা থেকে শফিক সাহেব চিঠি পাঠিয়েছেন। সেখানে অন্য এক পার্টির সাথে ডিলের কথা লেখা আছে। আর পঞ্চাশ জন মানুষের কথা চিঠিতে উল্লেখ করেছেন ঐ শফিক সাহেব। এবারের মিশনটা সম্পন্ন করতে পারলে তারা বেশ বড় অংকের টাকা পাবে। যা দিয়ে তাদের আগামী পাঁচ বছর অনায়াশে চলে যাবে।
রহমান সাহেব মুন্সিকে বললেন, আজ পর্যন্ত এ গ্রাম থেকে কয়জনকে পাচার করা হয়েছে? সে উত্তর দিলো, মাত্র দশ জনকে। কিন্তু সেই দশজনকে পাচার করার সময় আমাদের এবারের মিশনের জন্য  অগ্রিম টাকা দিয়েছিলো। তার কথা শুনে আমি বললাম, আচ্ছা ঐ বাড়িতে  তো যে যায় তাকেই আপনারা আটকে রাখেন, তাইনা?
মুন্সি ছোট্ট করে হুম বললো।
আমি বললাম, তাহলে যতগুলো বৃদ্ধাকে আটকে রেখেছেন, তাদেরকেও কি পাচার করে দিয়েছেন?  নাকি তারা এখনো ঐ বাড়িটির মধ্যেই আছে?
মুন্সি বললো, না তাদের পাচার করা হয়নি। আমরা শুধু শিশুদেরই পাচার করি। আমাদের এবারের প্রজেক্টটা ছিলো অনেক বড়। অবশ্য সেটা সম্পন্নও হতো। কিন্তু আকবর সাহেব সেটাতে বুড়ো আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিলো। আমাকে ওভাবে না ঠকালে অবশ্য আমি একাই কাজটা করে দিতাম। কিন্তু আমি আর চাইনা ওসব পাপ কাজ করতে।
রহমান সাহেব মুন্সিকে তার বাড়ির মধ্যে নিয়ে গেলেন। সেখান গিয়ে আমরা সবাই আলোচনা করতে থাকলাম কিভাবে এই পাচারকারীদের একসাথে ধরা যায়! আমাদের কোন মতামতের প্রত্যাশা না করেই মুন্সি বললো, আমাদেরও একটা ফাঁদ পাততে হবে। যেই ফাঁদে এই গ্রুপের সবাই একসাথে ধরা পড়বে।
কিন্তু কি ফাঁদ পাতবো?
রহমান সাহেব বললেন, সেটা আমার উপর ছেড়ে দাও। তুমি শুধু এটুকু বলো যে, একাজে শেষ পর্যন্ত আমাদের সাহায্য করতে পারবে কিনা? আর তুমি এটা পারবে আমি জানি। আমি শুনেছি তুমি খুব সাহসী ব্যক্তি। তোমার দ্বারায় এই জঘন্যতম কার্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া সহজ হবে আমাদের। আর তোমাকে তো এ গ্রামের কমবেশি সবাই ভয় পায়।
মুন্সি বললো, হ্যাঁ সার। আমি সাহায্য করবো। তবে তাদেরকে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দিতে হবে। তাদের কঠিন শাস্তি দিতে হবে।
কথা বলার মাঝখানে অনুপম রহমান সাহেবকে বললো, চাচা আমরা এই কয়েকজন মিলে কি আমাদের অভিযানটা সম্পন্ন করত পারবো? আমরা কি আমাদের গ্রামের কাউকে জানাবো এ বিষয়ে?
রহমান সাহেব একটু ভেবে বললেন, হ্যাঁ জানাতে পারো, তবে সতর্কতার সাথে। আকবর সাহেব যাতে কোন ভাবেই বুঝতে না পারে যে, আমরা তার সব কুটনৈতিক কাজ ধরে ফেলেছি।
আমি রহমান সাহেবের উদ্দেশ্যে বললাম, চাচা তাহলে কি আমরা আজই চিঠি লিখে পাঠাবো আমাদের গ্রামে?
তিনি বললেন, হ্যাঁ পাঠাতে পারো।
আর মুন্সি,  তুমি শোনো..  কখন কি হয় সবকিছু আমাকে জানাবে। এবার যাও, আসতে পারো তুমি।
মুন্সি চলে গেলো। আমি মনে মনে বললাম, হায়রে চোরায় ব্যবসা।  একজন পল্টিবাজি করলে আরেকজন তার পল্টিবাজি মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়। তবে আমাদের জন্য ভালোই হলো। মুন্সি চলে গেলে রহমান সাহেব আমাদের বললেন, তোমরা একটা কাজ করতে পারবে? আমি বললাম, কি কাজ চাচা?
- কাজটা অনেক ঝুঁকির, তবে ভয় নেই আমি আছি।
- হুম বলেন।
- তোমরাই হবে আমাদের টোপ।
পাশে থেকে অনুপম বলে উঠলো, বুঝলাম না চাচা।
- মানে আকবর সাহেব যেহেতু তোমাদেরকে ঐ পোড়া বাড়িতে ঢোকাতে পারলেই তার পরবর্তী কাজটা শুরু করবে। সেহেতু তোমাদেরকে নিজ ইচ্ছায় সেখানে যেতে হবে। আর তার পরের কাজটা আমি করবো। ভয় পেওনা।
রহমান সাহেবের কথা শুনে আমার মনে সন্দেহ জাগলো, এর পেছনে আবার তার কোন হাত নেইতো? না, না, এর পেছনে তার হাত থাকতে যাবে কেন? তাকে দেখে তো আমার কখনো তাকে ওরকমটা মনেই হয়নি। আমার মতে সে আর যাইহোক, আমাদের কোন ক্ষতি করবে না। আর তাছাড়া তো তার ছেলেমেয়েও সেখানে আটকে আছে।
আমি বললাম, জ্বী চাচা যাবো। আর কবে যেতে হবে, সেটা আমাদেরকে জানিয়ে দেবেন।
রহমান সাহেব বললেন, অবশ্যই জানিয়ে দেবো। আর তোমরা সন্ধ্যার পরে একটু দেখা করবে আমার সাথে। কেমন?
আমি আর অনুপম মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম। তিনি বললেন, তোমরা এখন বাড়িতে যাও।
আমি আর অনুপম বাড়িতে যাওয়ার জন্যে পা বাড়িয়েছি মাত্র, ঠিক তখনই রহমান সাহেব আমাদের ডাক দিলেন। আমরা বললাম, আর কি কিছু করতে হবে?
- না তেমন কিছু করতে হবেনা। তবে...
- তবে কি?
- তবে যখন যেখানে যাবে, আমাকে একবার জানিয়ে যাবে। আর আকবরের উপরে নজর রাখবে। সে কখন কি করে, কোথায় যায়, কার সাথে কথা বলে, সবদিকে নজর রাখবে। তার প্রতিটি পদক্ষেপই আমাদের জন্য বিপদজনক। তাই তাকে আমাদের চোখে চোখে রাখতে। আর সেটা যেন সে কোনভাবেই বুঝতে না পারে।
- আচ্ছা চাচা, তাহলে এখন আমরা আসি।
- হ্যাঁ, আসো।
.
আমি আর অনুপম বাড়ির দিকে যাচ্ছি। আমাদের কাছে এখন ঐ বাড়িটাও নিরাপদ নয়। আমি এতোদিনে বুঝতে পেরেছি, আকবর সাহেব আমাদের কেন এতো খাতির যত্ন করেন। কেন আমাদের জন্য তিনি নতুন একটা ঘর তৈরি করে সেখানে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেছেন! প্রথমে তো উনাকে দেখে বেশ ভালোই মনে হয়েছিলো। কিন্তু এই ভালোর অন্তরালে যে কালো বিষধর একটা জঘন্যতম  জন্তু লুকিয়ে ছিলো সেটা আমরা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি। বড় চতুর লোক সে।
হাঁটতে হাঁটতে অনুপম আমাকে বলে ওঠে
- শ্রাবণ শোন।
- হ্যাঁ বল।
- শাহ আলম সাহেবের কাছে আমরা যে চিঠিটা পাঠাবো তাতে আমরা আমাদের গ্রামের পুলিশকেও এখানে আসার কথা জানাবো।  কি বলিস তুই?
- হ্যাঁ জানানো যেতে পারে। আমিও সেটাই ভাবছিলাম। এখানকার যে আইনি ব্যবস্থা তাতে মনে হয়না এখানকার পুলিশ অভিযানটা সম্পন্ন করতে পারবে।
.
আমরা বাড়িতে পৌছে দেখি আকবর সাহেব বাড়ির উঠোনে পায়চারি করছেন। তাকে বেশ উত্তেজিত মনে হচ্ছে। যেন তিনি কোন একটা কাজে বের হবেন আর সে কাজে কাউকে সাথে নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। তার থেকে একটু দূরেই ম্যাডাম আর আর আমাদের বন্ধুরা দাঁড়িয়ে আছে। ম্যাডামের চোখেমুখে একটু খুশির আভাস দেখা যাচ্ছে। হয়তো তিনি হারিয়ে যাওয়া কোন কিছু ফেরত পেয়েছেন কিংবা ফেরত পেতে যাচ্ছেন, এমন একটা ভাব।
আমরা দুজন বাড়ির মধ্যে ঢুকতেই আকবর সাহেব বলে উঠলেন, এসেছো তোমরা?  আমি তোমাদের জন্যই অপেক্ষা করছি।
তার কথা শুনে আমি কিছুটা অবাক হলাম। আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে? কিন্তু কেন?
আমি কিছু একটা আন্দাজ করতে পারলাম, তার এই অপেক্ষা করার কারণটা কি হতে পারে! হয়তো তার উদ্দেশ্যটা বেশ ভয়ংকর হবে। আমাকে আর অনুপমকে দেখে ম্যাডাম আমাদের কাছে এগিয়ে এসে বললেন, চিন্তা করিসনা। আমরা খুব দ্রুতই বাড়ি ফিরে যাবো। আমি আবারও অবাক হলাম ম্যাডামের মুখে এমন কথা শুনে। ম্যাডামকে আজ বেশ হাসিখুশিও লাগছে বটে। কিন্তু আমি সে হাসির পেছনে দুঃখের বন্যা দেখতে পাচ্ছি। ম্যাডাম আমাদের দুজনকে আরো নানান কথা বলতে লাগলেন। কিন্তু আমি সেসব কথা কোনটাই কানে নিচ্ছিনা। কারণ ম্যাডামের পিছে থেকে ফারিয়া আমাকে বারবার ইশারা করে কি যেন একটা বলতে চাইছে। তার চেহারাতে ভয়ার্ত একটা ছাপ দেখতে পাচ্ছি আমি। তাহলে কি ফারিয়াও এ বিষয়ে সবকিছু জেনে গেছে? হয়তোবা!
আমি ম্যাডামকে বললাম, ম্যাডাম আমরা আশিক, সোমা আর ফাহিমকে না নিয়ে কিভাবে বাড়ি ফিরে যাবো? ম্যাডাম এবার মুখে একটু হাসির রেখা ফুটিয়ে বললেন, আরে পিচ্চি আমি তোকে সে কথাটাই তো বলছি। বিকেলে আমারা আকবর সাহেবের সাথে ঐ বাড়িতে যাবো এবং সেখান থেকে ওদেরকে বের করার চেষ্টা করবো।
ম্যাডামের এই কথাটা শুনে আমি এবার একটু আকবর সাহেবকে বাজিয়ে দেখতে ম্যাডামকে বললাম, ম্যাডাম তারা তো অনেকদিন আগে উধাও হয়েছে সেখানে গিয়ে। ভূত প্রেতরা হয়তো এতোদিনে তাদের হাড়গোড় আস্ত রাখেনি কিছু।
আমি এটা বলতেই আকবর সাহেব বলে উঠলেন, না না তাদের কিছুই হয়নি। তারা একেবারে ভালো আছে।
আমি এবার দু'গাল হাসি হেসে উনাকে বললাম, চাচা আপনি বড় মহান। তা, আপনি কিভাবে জানলেন তারা এখনো বেঁচে আছে? ভূতেরা এখনো তাদেরকে খায়নি!
আকবর সাহেব আমতা আমতা করতে লাগলেন। কি যেন একটা বুদ্ধি বের করে তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন, আমি অনুমান করলাম আরকি!
তার কথা শুনে আমার হাসিটা যেন বুক ফেটে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়ে যায়। কি আজব অনুমান! এমন অনুমান আমি জীবনেও কাউকে করতে দেখিনি, বলতে শুনিনি। অবশ্য চোর ডাকাতেরা তৎক্ষণাৎ কোন কিছুর উত্তর দিলে মিথ্যা বলে এবং সাথে সে তার বোকামিরও পরিচয় দেয়। আকবরের ক্ষেত্রেও ঠিক এমন ঘটেছে।
আমি বললাম, তা চাচা আমরা কখন যাবো সেখানে? তিনি খুব উত্তেজিত হয়ে অতি দ্রুত বললেন আজকে বিকেলে। আমি বললাম, চাচা পুলিশকে একটা খবর দিবো?
এবার তিনি আমার দিকে অবাক চোখে চেয়ে বললেন, পুলিশ? পুলিশ কেন? তারা কি করতে যাবে সেখানে?
আমি বললাম, তারা কি করতে যাবে মানে? তারা থাকলে আমরা একটু সাহস পাবো। সেখানে যদি খারাপ কিছু ঘটে তবে তারা আমাদের যথেষ্ট সাহায্য করতে পারবে।
আমি খেয়াল করে দেখলাম, আকবর সাহেব বেশ চিন্তিত। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, আমাদের বলার সাথে সাথেই আমরা সেখানে যাওয়ার জন্য উতলা হয়ে পড়বো! কিন্তু তার ভাবনাটা পুরো ভেস্তে গেলো।
নাহ! ফারিয়া বারবার অমন করছে কেন? সে কি কিছু বলবে আমাকে?
ফারিয়া বারবার আমাকে ইশারা করছে, হয়তো কিছু বলতে চায়। সে যা বলতে চায় সেটা আমি ভালো করেই জানি। তবুও তার মুখ থেকে শুনত হবে। আমি আকবর সাহেবকে বললাম, চাচা আজকে তো যেতে পারবোনা। তবে হ্যাঁ, কিছুদিন পর যাবো। কথা দিলাম। আকবর সাহেব আমার কথায় সম্মতি জানালেও ম্যাডাম জানালেন না। তিনি আশিক, সোমা আর ফাহিম, এদের ফিরে পেতে এতোটাই ব্যাকুল হয়ে পড়েছেন যে, তিনি আর কোনোমতেই  দেরি করতে চান না। আমি ম্যাডামকে বললাম, ম্যাডাম আমরা দু'দিন পর যাই? প্রথমে তিনি না না করলেও পরে আমার কথাকে মেনে নিলেন।
আমি মনে মনে বললাম, বেডা আকবর আমি তো ঠিকই যাবো। তবে তোর কার্যসিদ্ধির জন্য নয়, তোর কার্যকে বিলুপ্তসিদ্ধি করতে। রেডি থাক বেডা।
.
বিকেল বেলা আমি রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ঐ পরিত্যাক্ত বাড়িটির দিকে অপলক চেয়ে আছি। আর ভাবছি, এতো সুন্দর একটা বাড়িতে কি পাপ কাজটাই না হচ্ছে। যদি ভূত প্রেত বলে কিছু থাকতো, তবে ঐ বাড়ির যারা জমিদার ছিলো তাদের আত্মারাই এর একটা বিহিত করে ফেলতো।
- শ্রাবণ... (অনুপম)
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি নানান ভাবনাতে বিভোর ছিলাম। ঠিক সেসময় অনুপম আমাকে ডেকে উঠলো। আমি বললাম, কি বলবি বল?
সে বললো, ফারিয়া তোকে ডাকছে, হয়তো সে কিছু একটা বলতে চায় তোকে। আমি বললাম, সে যেটা বলতে চায় সেটা তুইও জানিস।
অনুপম বিস্ময়ের চোখে তাকিয়ে বললো, আমি জানি মানে?
তখন আমি বললাম, আচ্ছা চল আগে।
অনুপম আমাকে ফারিয়ার কাছে নিয়ে গেলো। আমি লক্ষ করে দেখলাম, ফারিয়ার চোখে হাজারো ভয়ের বসবাস। সে ভয়ার্ত কন্ঠে আমাকে ডাক দিলো। আমি তার কাছে যেতেই সে বললো, শ্রাবণ তুই খবরদার ঐ বাড়িতে যাস না।
আমি একটু মজা করেই তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কেন?  কেন যাবোনা ঐ বাড়িতে? আমার তো ঐ বাড়িতে যাওয়ার জন্য মনটা বড় ব্যাকুল হয়ে আছে। আমি দেখলাম অনুপম আমার দিকে কেমন করে যেন তাকালো। হয়তো সে ভাবছে,  আমি কি আবোল তাবোল বলছি এসব!
ফারিয়া আমার দিকে একটা কাগজ এগিয়ে দিলো। আর বললো, এটা পড়। আমি কাগজটা খুলতেই বুঝতে পারলাম ওটা একটা চিঠি। চিঠিটা হালকা ভিজে যাওয়াতে মাঝে মাঝে বেশ কিছু অক্ষর  এবং শব্দ বোঝা যাচ্ছেনা। তবে চিঠিটা আংশিক  পড়েই আমি পুরো বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। চিঠিটাতে একটা তারিখ দিয়ে লেখা ছিলো, বৃহঃস্পতিবারের দিন রাত নয়টা বাজলে ট্রাক নিয়ে গ্রামে প্রবেশ করবে।
তারিখটা বোঝা যাচ্ছেনা, তবে দিনটা ঠিকই বোঝা যাচ্ছে। চিঠিটার কোন খাম নেই। তবে চিঠির নিচে লেখা আছে, ইতি আকবর। আমার বুঝতে বাকি রইলোনা আকবর সাহেব চিঠিটা কার উদ্দেশ্যে লিখেছেন। আমি ফারিয়াকে বললাম, এটা যেখানে পেয়েছিস সেখানে রেখে আয়।
আমি অনুপমকে জিজ্ঞেস করলাম, দোস্ত আজকে কি বার? সে উত্তর দেওয়ার আগেই ফারিয়া উত্তর দিলো, আজকে বৃহঃস্পতিবার।
আচ্ছা! তাইতো বলি আকবর সাহেব আজকে আমাদের কেন এত দ্রুত তলব করেছেন। আমি ফারিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, এই কাগজে তো তেমন কিছুই লেখা নেই। আমার এ কথাতে সে বললো, হ্যাঁ তেমন কিছু লেখা নেই। তবে আবার অনেক কিছুই লেখা আছে। আমার কেন জানি আকবর সাহেবকে বেশি সুবিধার লোক মনে হয়না। আর এই কারণেই এই চিঠিটাতে লেখা কথাগুলো আমার মনে দাগ কাটে। রাত নয়টায় এ গ্রামে ট্রাক আসবে কেন?
আমি মনে মনে বললাম, বাব্বাহ মেয়েদের মাথায়ও তো বেশ বুদ্ধি আছে! ফারিয়া আমার থেকে চিঠিটা নিয়ে কোথায় যেন চলে গেলো। একটু পরেই সে ফেরত এসে বললো, রেখে এসেছি। আমি বললাম, কোথায় পেয়েছিলি চিঠিখানা। সে বললো, এই বাড়ির ডাকপোষ্টে। প্রতি সপ্তাহে এখান থেকে চিঠি আদান প্রদান করা হয়।
আমি বললাম, চিন্তা করিস না। আজকে কোন ট্রাকই আসবেনা এ গ্রামে। অনুপম বললো, কিন্তু কেন? আসবেনা কেন? আকবর সাহেব তো চিঠি লিখেছেন!
আমি বললাম, চিঠি লিখেছেন তবে পোস্ট তো হয়নি।
আকবর সাহেবের বুদ্ধিটা দারুণ। আজকে যদি তিনি আমাদের সবাইকে ঐ বাড়িতে ঢোকাতে পারেন, তবে তার সকল উদ্যোগই সফল হবে। তিনি হবেন প্রবৃত্তিশালী।
.
সন্ধ্যা হতে আর বেশি সময় বাকি নেই। আমি ফারিয়াকে বললাম, তুই ম্যাডামের দিকে নজর রাখিস। উনি যেন কোনমতেই আকবর সাহেবের পাতানো ফাঁদে পা না দেয়। আমি আর অনুপম একটু আসি। নিজেদের খেয়াল রাখিস।
অনুপম আর আমি বেরিয়ে পড়লাম রহমান সাহেবের বাড়ির উদ্দেশ্যে। উনি কিসের জন্য আমাদের এই সন্ধ্যাবেলা উনার বাড়িতে যেতে বলেছেন সেটা আমার অজানা। যাওয়ার পথে হাবিলদারের সাথে দেখা।
আমি বললাম, কোথায় ছুটে চললেন চাচা এই সন্ধ্যাবেলা? লোকটি সাইকেলটার গতি কমিয়ে বললো, একটা দ্রুত কাজ আছে বাবারা। বলেই সে সাইকেলটা চালিয়ে চলে গেলো।
আমরা রহমান সাহেবের বাড়ির সামনে চলে এসেছি প্রায়। দেখলাম রহমান সাহেবও বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন। আমাদের দেখে বললেন, এসে পড়েছো তোমরা? আমরা বললাম, হ্যাঁ।  তবে কি কাজে ডেকেছিলেন চাচা? তখন উনি বললেন, চলো আমার সাথে। গেলেই দেখতে পাবে।
রহমান সাহেবের কথামতো আমি আর অনুপম উনার পিছু পিছু হেঁটে চলেছি। কিছুদূর যেতেই আমি লক্ষ করলাম তিনি জঙ্গলের পথ ধরেছেন।  আমার আর বুঝতে বাকি রইলোনা যে, তিনি কোথায় যাচ্ছেন। প্রায় আধাঘন্টা হাঁটার পর আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌছালাম। আমাদের গন্তব্যটা ছিলো থানা।
সেখানে পৌছানোর পর অনুপম আমাকে বললো, দোস্ত কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি। আমি বললাম, হ্যাঁ অবশ্যই।  বলে ফেল।
সে বললো, আমি অনুমান করতে পারি পুলিশ বেডা ভুড়িটা টেবিলের সাথে ঠেকিয়ে ভিতরে বেশ আরামে ঘুমাচ্ছে।
তার কথায় আমি খানিকটা হেঁসে বললাম, তোর অনুমান ১০০% ঠিক।
আমরা ভেতরে গিয়ে দেখলাম সত্যিই তাই। পুলিশ বেডা ভুড়িটা উঁচিয়ে ঘুমাচ্ছে। রহমান সাহেব একটা কাঁশি দিলেন। তবু তার ঘুম ভাঙলোনা। এবার তিনি তার সামনের চেয়ারটাতে বসলেন। তারপর পুলিশের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতে লাগলেন, অার কত ঘুমাবেন স্যার? এবার তো একটু উঠুন।
বুড়ো পুলিশটা ধচমচিয়ে উঠে পড়লো। ঘুম ঘুম চোখে বললো, কে? কে?
তখন রহমান সাহেব বললেন, পানি আনবো স্যার?
পুলিশ চোখের ময়লা মুছে বললো, কেন?
তখন আমি বললাম, আপনার বোধ হয় মুখটা একটু ধৌত করা উচিত।
পুলিশটা আমাদের এসব কথাবার্তা শুনে বেশ ভড়কে গেছে, সেটা তার চেহারায় বলে দিচ্ছে।
রহমান সাহেব এবার আর কোন কথা না বাড়িয়ে বললেন, ইন্সপেক্টর গঙ্গারাম একটা মিশনে নামতে হবে। কিছুদিনের মধ্যে শুরু হবে মিশনটা। আপনি আপনার ফোর্স তৈরি রাখবেন।
এটুকু বলেই রহমান সাহেব চেয়ারটা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। এবার তিনি আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন, চলো এবার।
আমরা থানা থেকে বের হচ্ছি আর পেছন পুলিশটা আমাদের বারবার ডাকছে।  সে বলছে,  কিসের মিশন, কার মিশন।
রহমান সাহেব আমাকে বললেন, তুমি চিঠি পাঠিয়েছো? আমি উত্তর দিলাম, না পাঠাইনি এখনো। এখন বাড়িতে গিয়েই লিখতে বসবো। তিনি বললেন, চিঠি লেখা শেষ হলে আমার বাড়ির ডাকবাক্সে রেখে যেও। তাহলে আগামীকালই পৈছে যাবে চিঠিটা।
.
রহমান সাহেবের সাথে কথা বার্তা শেষ করে বাড়িতে ফিরে এলাম। রাত তখন প্রায় সাড়ে আটটা বাজবে হয়তো। আমরা বাড়িতে এসে আমাদের ঘরটার দিকে পা বাড়াতে যাবো, ঠিক সেসময় দেখলাম আকবর সাহেব তার কালো কোটটা কাঁধে নিয়ে বের হচ্ছেন বাড়ি থেকে। এটা দেখে অনুপম আমাকে বললো, দোস্ত পিছু নিবি নাকি। আমি বললাম, থাক সেটার আর দরকার নেই। এখন চল চিঠিটা লিখতে বসি।
পরদিন সকালে গিয়ে চিঠিটা রেখে আসলাম রহমান সাহেবের বাড়ির ডাকবাক্সে।
সেদিনই চিঠিটা পৌছে যায় শাহ আলম সাহেবের কাছে। এদিকে ম্যাডাম আমাকে বারবার বলে, শ্রাবণ আমরা বাড়ি ফিরে যাবো। আশিক, সোমা আর ফাহিমকে নিয়ে আসতে হবে। আকবর সাহেব তো বললেন যে, তিনি আমাদের সাহায্য করবেন। কিন্তু তুই তাতে মত দিলিনা কেন? আমি বললাম, ম্যাডাম আর মাত্র কয়েকটা দিন অপেক্ষা করেন। আপনার এই কথার উত্তর আপনি পেয়ে যাবেন। তবে এখন যদি আপনি আমার কথা না শুনে আকবর সাহেবের সাথে ঐ বাড়িতে যান, তাহলে সেখান থেকে আপনি ফিরে আসবেন হয়তো ঠিকই, কিন্তু অক্ষত অবস্থায় নয়।  একটু ধৈর্য ধরুন।
.
পরদিন রাতে রহমান সাহেব একটি ছেলেকে দিয়ে আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি আর অনুপম বেরিয়ে পড়লাম। রহমান সাহেবের বাড়িতে পৌছে জানতে পারলাম, শাহ আলম সাহেব চিঠিটার প্রত্যুত্তর দিয়েছেন। তিন চিঠিতে জানিয়েছেন, আগামীকাল সন্ধ্যার মধ্যেই তিনি এখানে আসবেন। চিঠিটা পড়ে আমি মনে একটু জোড় পেলাম। রহমান সাহেব বললেন, তো কালকেই কিন্তু আমাদের অভিযানে নামতে হবে। আমরা কথা বলছি। ঠিক সে সময় মুন্সি এসে হাজির হলো। রহমান সাহেব বললেন, বসো মুন্সি বসো। কালকে কিন্তু কাজে নেমে পড়তে হবে। তৈরি থেকো।
মুন্সি জবাব দিলো, আপনি কোন টেনশন করবেন না স্যার। আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। এখন শুধু টোপটা ফেলতে বাকি।
রহমান সাহেব আমাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমরা প্রস্তুত তো? আমি আর অনুপম মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ প্রস্তুত। কিন্তু....
রহমান সাহেব বললেন, কিন্তু কি?
তখন আমি বললাম, কালকেই যদি কাজে নেমে পড়ি তাহলে তো শুধু মাত্র এই গ্রামের সাধুদেরই ধরতে পারবো। ঐ ঢাকার সাধুটারে তো ধরতে পারবোনা। আমার কথাতে মুন্সি বললো, এ নিয়ে টেনশন করোনা। সে কাজ আমি করে ফেলেছি। কালকে রাতে ট্রাক আসবে গ্রামে সব বাচ্চাদের নিয়ে যেতে। তবে সেটা আমার নির্দেশে। আকবর সাহেব এই ব্যাপারে কিছু জানেনা। সে তখন কোন কুল কিনারা খুঁজে পাবেনা।
আমি আর অনুপম বললাম, তাহলে সব ঠিক আছে এখন আসি আমরা, রাত হয়ে গেলো অনেক।
রহমান সাহেব বলো, আচ্ছা তোমরা এখন আসো।  আর শোন কালকে সকাল দশটার দিকে তোমরা টোপ স্বরুপ ঐ বাড়িটিতে ঢুকবে। অার ঢোকার আগে আমাকে অবশ্যই একবার জানাবে।
.
রহমান সাহেবের বাড়ি থেকে ফিরে যখনই আকবর সাহেবের বাড়িতে ঢুকলাম। ঠিক তখনই বড় ধরনের একটা ধাক্কা খেলাম। দেখলাম, আকবর সাহেব, ম্যাডাম, আর বাকিরা ছাত্র ছাত্রীরা সবাই উঠোনে বসে আছে। আমরা বাড়িতে ঢুকতেই আকবর সাহেব বলে উঠলেন, কোথায় গিয়েছিলে তোমরা?
তার মুখে হঠাৎ এমন প্রশ্ন শুনে আমি খানিকটা চমকে উঠলাম। তাহলে কি আকবর সাহেব আমাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে পেরে গেছে? না না, এটা তো কখনো সম্ভব নয়। আমি একটু বুদ্ধি করে উত্তর দিলাম, চাচা ঐযে ঐ তিন রাস্তার ধারে একটা যাদুকর যাদু খেলা দেখাচ্ছিলো। সেটা দেখতে দেখতেই রাত হয়ে গেছে। দেখলাম আকবর সাহেব আমার কথাকেই বিশ্বাস করেছেন।
তিনি আমাদের বললেন, তো কালকে কি যাবে ঐ বাড়িতে তোমার বন্ধুদের ফিরে পেতে? আমি একটু আমতা আমতা করতে লাগলাম। ঠিক তখনই ম্যাডাম বলে উঠলেন, হ্যাঁ  হ্যাঁ আমরা কালকেই যাবো।  ম্যাডামের  মুখে এই কথা শুনে আকবর সাহেবের মুখে তখন ভুবন ভোলানো হাসি। তাকে দেখে মনে হলো যেন তিনি অলরেডি কার্যটা সম্পন্ন করে সফল হয়েছেন। কিন্তু তিনি জানেন না তার জন্য সামনে আরো বেশি সফলতা অপেক্ষা করছে। যেই সফলতা তাকে কখনো ছোট করবেনা। বরং উচ্চ স্থানে পৌছে দেবে।
.
ঘুমানোর সময় অনুপমকে বললাম, ভোর বেলাতে একটু ডাক দিস। আমাদের হাতে বেশি সময় নেই। সকালে গিয়ে রহমান সাহেবকে জানাতে হবে কথাটা।  যে, আমরা কাল সকাল দশটার দিকেই ঐ বাড়িতে ঢুকবো।
গভীর রাতে কে যেন এসে খবর দিয়ে গেলো ,  সব ঠিকঠাক করা আছে। এখন শুধু আমাদের সেখানে ঢোকার পালা।
একটু ঘুমিয়েছি মাত্র। আর তখনই অনুপম আমাকে ডাকতে লাগলো, দোস্ত ওঠ ওঠ। ভোর হয়ে গেছে। ওর কথাতে আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ডাকিস না তো যা। কেবল মাত্র ঘুমালাম আর এখনই সকাল হয়ে গেছে? সে বললো, দোস্ত কালকে রাতের কথা তোর মনে আছে? তুই না বললি যে, তোকে যেন ভোরবেলাতে ডেকে দেই! রহমান সাহেবের ওখানে নাকি যাবি?
আমি অনুপমের কথাতে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। হ্যাঁ, এখন গেলে কেউ আমাদের দেখতে পাবেনা। আমরা ওখানে গিয়ে রহমান সাহেবকে কথাটা বলেই চলে আসবো। অনুপমকে বললাম মুখ ধুয়ে নে। বের হবো এক্ষণই।  সে মুখ ধুয়ে এসে বললো চল।
আমরা দুজন বেরিয়ে পড়লাম। চারিদিকে এখনও ভোরের আলো ফোটেনি। হালকা আলোতে আমি আর অনুপম হেঁটে চলেছি। দূরের একটা মসজিদ থেকে আজান শোনা যাচ্ছে। আজানের কিছুক্ষণ পরেই ভোরের আলো ফুটবে। আমরা হাঁটার গতি বাড়ালাম।
যখন আমরা রহমান সাহেবের বাড়িতে পৌছালাম, তখনও আধাঁর ছিলো চারিদিকে। রহমান সাহেবকে একটা ডাক দিতে উনি বাইরে চলে এলেন। আমরা বেশি কথা না বাড়িয়ে উনাকে আমাদের ঐ বাড়িতে যাওয়ার কথাটা বলেই চলে আসলাম।
বাড়িতে এসে দুজন আবার সেই পূর্বের ন্যায় শুয়ে পড়লাম। যেন আমরা কোথায়ও যাই-ইনি। শুয়ে পড়ার একটু বাদেই ফারিয়া এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, কোথায় গিয়েছিলি তোরা? আমি ওর কথা শুনে খানিক্ষণ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তাহলে ও কি আমাদের দেখে ফেলেছিলো?
আমি বললাম, চুপ থাক। সময় হলে সব বলবো। সে চুপ করে গেলো।
.
সকাল সাড়ে নয়টার দিকে আকবর সাহেব আমাদের সবাইকে বললেন তোমরা এখন ঐ বাড়িতে যেতে পারো। আমি ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ম্যাডামের মুখটা বেশ হাসি খুশি। আমরা চললাম সেই বাড়িটার দিকে।  আকবর সাহেব আমাদের বললেন, তোমরা হাঁটতে থাকো আমি একটু পরেই আসতেছি। আমরা হাঁটতে হাঁটতে বাড়িটির কাছে পৌছে গেলাম। যখন আমরা বাড়িটির দিকে যাচ্ছিলাম, তখন পথে ঘাটে একটা মানুষজনকেও দেখলাম না। বাড়িটির গেটের সামনে গিয়ে আমরা দাঁড়িয়ে পড়লাম। আকবর সাহেবের জন্য  অপেক্ষা করতে থাকলাম আমরা। কিন্তু ঘন্টা খানেক সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও যখন তিনি আসলেন না তখন ম্যাডাম বললেন,  চলো আমরাই যাই। আমি ম্যাডামকে অনেকবার বললাম, ম্যাডাম আপনার ওখানে যেতে হবেনা। আমরাই যাচ্ছি ওখানে। তবুও ম্যাডাম আমার কথা শুনলেন না। তিনি যাবেনই।
আমরা বাড়িটির ভেতরে প্রবেশ করতেই একটা শীতল হাওয়া বয়ে গেলো চারপাশে। কিছুদূর এগোতেই ফারিয়া চেঁচিয়ে উঠলো। আমরা সবাই তার দিকে তাকাতেই দেখলাম তার সামনে একটা কঙ্কাল। আর ঠিক তার সামনেই এক পায়ের একটা জুতা। জুতাটাকে চেনা চেনা মনে হলো। কোথায় যেন দেখেছি জুতাটাকে। আমি অনুপমকে জুতাটা দেখাতেই সে বললো,  এটাতো আশিকের জুতা। দেখলাম ম্যাডামও ভয় পেয়ে গেছে।
আমরা ক্রমেই বাড়িটির ভেতরের দিকে এগোচ্ছি। আর বাড়িটিও ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসছে। বাইরের কোন শব্দই আর বাড়ির মধ্যে আসছেনা। যখন আমরা বাড়িটির একেবার ভেতরে গিয়ে পৌছালাম, তখন কোথথেকে যেন ধোঁয়া আসতে শুরু করলো। প্রথমে সেটাকে তেমন কোন গুরুত্ব দিলাম না। কিন্তু ধীরে ধীরে ধোঁয়ার পরিমাণ বেড়েই চললো। একসময় চারিদিক অন্ধকারে ডুবে গেলো। আমরা কেউ কাউকেই দেখতে পাচ্ছিলাম না। ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ ম্যাডামের কন্ঠ শুনতে পেলাম, ম্যাডামকে হয়তো কেউ ধরে নিয়ে যাচ্ছে আর ম্যাডাম চিৎকার করছেন। ক্রমেই ম্যাডামের চিৎকারটি মাটির নিচে চলে গেলো। আমরা খুব ভয় পেয়ে গেলাম। তাহলে সত্যি সত্যিই কি এখানে ভূত প্রেত আছে? না না,  ভূত প্রেত থাকবে কেন? খানিক পর আবার কিছু আওয়াজ শুনতে পেলাম। এবার একাধিক কন্ঠের আওয়াজ হলো। ঠিক আগের মতো এবারও আওয়াজগুলো মাটির নিচে চলে গেলো।
আমি অন্ধকারে "অনুপম" বলে ডাক দিতেই কেউ একজন আমার মুখ চেপে ধরলো। আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেও ছাড়াতে পারলাম না। আমাকে ক্রমেই নিচের দিকে টেনে নিচ্ছে কেউ। তবে আমি এটা বুঝতে পারলাম যে, যে আমাকে মুখ চেপে ধরে নিয়ে যাচ্ছে সে কোন প্রেতাত্মা নয়। বরং একজন শক্ত সামর্থ মানুষ। টানতে টানতে একসময় আমাকে এক জায়গায় দাঁড় করানো হলো। তারপর কেউ একজন এসে আমার হাত দুটো পেছন দিক করে বেধে দিলো। হাত বাধার পরে আমাকে দুজন মিলে মাটির নিচে অর্থ্যাৎ পাতাল পুরি যাকে বলে, সেখানে নিয়ে যেতে থাকলো। ধীরে ধীরে যখন ধোঁয়ার পরিমাণটা কমে এলো, তখন আমি দেখলাম একটা কালো করে লোক আমাকে ধরে রেখেছে। আমি নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম একটা বড় বদ্ধ জায়গাতে প্রায় শতাধিক মানুষ পরে রয়েছে। কেউ বা অসুস্থ হয়ে কেউবা ঘুমিয়ে।  আবার কেউ কেউ দেখলাম খাবারও খাচ্ছে। আমাকে সরু একটা সিড়ি দিয়ে নিচে নামিয়ে নিচ্ছে ঐ কালো লোকটি। আমি মনে মনে ভাবলাম, তাহলে এই লোকটিই কি সেই কালুচোর? হয়তোবা!
আমাকে যেতে দেখেই আশিক চেঁচিয়ে ডেকে উঠলো আমাকে। সাথে সোমা, ফাহিম আর অন্যরাও। ম্যাডামের চোখে বিস্ময়ের ছাপ। তিনি কখনো ভাবতেই পারেন নি যে, এমন কিছু একটা হবে। আমি চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। দেখলাম কয়েকজন বুড়ো মানুষও আছে সেখানে।
হঠাৎ আমার চোখ দুটো দুজন মানুষের দিকে গিয়ে থেমে গেলো। এরা দুজন যে রহমান সাহেবের ছেলে আকাশ আর মেয়ে মেঘা। আমি তাদেরকে ডাক দিতে যাবো। ঠিক সেই মুহূর্তে ম্যাডাম আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, শ্রাবণ চুপ থাক। আমি চুপ করে রইলাম।
খানিক পর একটা পরিচিত কন্ঠ শুনে আমি পেছনে তাকাতেই লোকটি বলে উঠলো, ওয়েলকাম ওয়েলকাম। ভূতের রাজ্যে সবাইকে স্বাগতম। লোকটিকে দেখে ম্যাডামের চক্ষুচড়ক গাছ। তিনি কখনো কল্পনাতেও ভাবেননি এই আকবর সাহেব আমাদের সাথে এমনটা করতে পারে। আকবর সাহেব আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার পিঠে দুইটা থাপ্পড় দিয়ে বললো, তুই বেশি পাকনা ছেলে। একমাত্র তোর জন্যই আমার এতো দেরি হলো কাজটা করতে।
তারপর তিনি আর কোন কথা না বলে সবার সামনে থাকা লাঠির সাথে দুইটা করে রুটি ঝুলিয়ে রেখে চলে গেলেন।
সবাই চলে গেলে আমি ম্যাডামকে বললাম, ম্যাডাম দেখেছেন আমি কেন নিষেধ করেছিলাম এখানে আসতে! তবে চিন্তা করবেন না। এখান থেকে বাঁচার উপায় আমি করেই এসেছি।
তবে রহমান সাহেব আর পুলিশেরা তো এই বাড়িতে ঢুকে আমাদের খুঁজে পাবেনা। এখান থেকে একজনকে যেমন করেই হোক  বের হতে হবে।
আমি দ্বিতীয়বারের মতো আরেকবার চারিদিকে চোখ বুলালাম। আর পুরোনো সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললাম, এখন ঐ লোকগুলো কোথায় গেলো। তখন ফাহিম আর সোমা বলে উঠলো। প্রায় ঘন্টা দুই তারা এখানে আর আসবেনা। আমি মনে মনে বললাম, তাহলে এটাই মোক্ষম সময়। যা করতে হবে খুব দ্রুত। আমি অনুপমকে বললাম,  দোস্ত আমি পেছন দিকে ঘুরছি তুই আমার কোমরের কাছে থেকে ছুড়িটা বের করবি। আমি জানতাম এমন কিছু একটা ঘটতে পারে। তাই পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলাম। আমি  পেছনে ঘুরলাম। অনুপমও পেছনে ঘুরলো। তারপর সে ধীরে ধীরে আমার কোমর থেকে ছুড়িটা বের করতে থাকলো। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো আরেক জায়গায়। ছুড়িটা বের হলো ঠিকই। তবে মাটিতে পড়ে গেলো। শেষে অনেক কষ্টে সেখান থেকে তোলার পর অনুপমকে বললাম, দোস্ত আমার হাত থেকেকে বাধনটা কেটে দেওয়ার ব্যাবস্থা কর। অনুপম আমার হাতের বাধনটা কাটতে থাকলো। এটা দেখে সবাই আমাদের উৎসাহ দিতে লাগলো। সবার চোখে মুখে বিজয়ের আভাস।
আমার বাধনটা কাটা হলে আমি অরুপমের বাঁধনটা খুলে দিলাম। পরে দুজন মিলে আমরা এক এক করে সবার বাধন খুলে দিয়ে আমি সবার উদ্দেশ্যে বললাম, এক এক করে সবাই বের হয়ে যাবে এখানে থেকে। আর যারা বৃদ্ধরা আছেন তারা থাকবেন। আমরা অতি দ্রুতই আবার ফিরে আসবো। আমরা সকলেই এক এক করে সেখান থেকে বের হয়ে এলাম সাথে আকাশ আর মেঘাকেও নিয়ে এলাম। অতি সতর্কতার সাথে সবাই  লোকচক্ষুর আড়ালে বেরিয়ে এসে একে একে সবাই রহমান সাহেবের বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলাম।
আমাদের কাজটা খুব ভালোভাবেই সম্পন্ন হলো। রহমান সাহেবের বাড়িতে পৌছিয়ে আমরা সবাই অবাক হয়ে গেলাম। দেখলাম শাহ আলম সাহেবসহ আমাদের গ্রামের দুই ফোর্স পুলিশ এসে পড়েছে। সাথে এখানকার পুলিশও আছে। রহমান সাহেব তার ছেলেমেয়েকে কাছে পেয়ে যেন অমৃত হাতে পেলেন।
.
ম্যাডাম শাহ আলম সাহেবকে দেখে কেঁদে ফেললেন। আমরা উনাকে কিছু বলতে যাবো। কিন্তু উনি আমাদের থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমি সব শুনেছি।
আর তোমরা তো ওখানকার পরিবেশটা দেখে এসেছো। এবার তোমাদের উপর নির্ভর করবে আমাদের মিশনটা। কিভাবে ওদের উপর আক্রমণ করলে আমরা সবাইকে একসাথে ধরতে পারবো সেটা এখন তোমরা বলবে।
আমি শাহআলম সাহেবের উদ্দেশ্যে বললাম, আংকেল আমরা কয়েকজন ঐ বাড়িতে আবার ফিরে যাবো। সাথে যাবে আপনার এই ফোর্স। আর এখানকার থানার কয়েকটা পুলিশ যাবে আকবর সাহেবের বাড়িতে। সেখানে তাদের একটা কাজের লোক আছে, যার নাম শামছু। তাকে ধরতে হবে। আর শামছু ছাড়া বাকি সবাইকে আমরা ঐ পোড়াবাড়িতেই পাবো। পোড়া বাড়ি থেকে যখন সবাইকে ধরা শেষ হবে তখন তাদের হেফাজতে রেখে টোপ হিসেবে তাদের ব্যবহার করতে হবে। আজ কিংবা কাল রাতে ঢাকা থেকে এদের দলের বড় ডিলার আসবে। ওকে ধরতে পারলেই আমাদের অভিযান সম্পন্ন।
আমার বুদ্ধি অনুযায়ী আমাদের গ্রাম থেকে আসা দুইটা ফোর্স  আর এখানকার তিনটা ফোর্স মিলে পোড়া বাড়িতে ঢুকে পড়লাম। আমার সাথে পুলিশেরা সহ রহমান সাহেব, অনুপম এবং ঐ মুন্সিও আসলো। সবাই অতি সাবধানতা অবলম্বন করে নিজ নিজ স্থান বুঝে লুকিয়ে পড়লো। বাড়িটির বাইরে চারটা ফোর্স এমন ভাবে লুকিয়ে থাকলো যেন কেউ ঘুণাক্ষরেও টের না পায় যে, কেউ আছে সেখানে। ভিতরে অর্থ্যাৎ যেখানে আমাদের বেঁধে রাখা হয়েছিলো সেখানে একটা ফোর্স তাদের নিজ অবস্থান বুঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো। আর আমি ওখানে থাকা প্রতিটা বৃদ্ধকে সরিয়ে ফেললাম।
আমার পরিকল্পনানুযায়ী সবকিছু করা হলো। এখন শুধু অপেক্ষার পালা। কখন তারা এখানে ফিরবে!
.
দুপুর পেরিয়ে বিকেলে পদার্পন করবে সময়টা। ঠিক তখন তারা সবাই একসাথে পোড়া বাড়িতে ফিরে এলো। থানার হাবিলদার, আকবর, কালুচোর আর শামছু এরা সবাই খুব হাসিখুশি ভাবে পাতাল পুরিতে ঢুকতেই একেবারে শকড্ হয়ে গেলো। আকবর সাহেব কালুচোরকে বলছে, বাচ্চাগুলো গেলো কোথায়?  কালুচোরের মুখেও একই প্রশ্ন। হাবিলদার আর শামছু এরা দুজন অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে। আমি জানতাম কালুচোরের কাছে পিস্তল আছে। সেজন্য তার ব্যবস্থাও আগেই করে রেখেছিলাম। আমি পুলিশদেরকে বলে রেখেছিলাম যখন আকবর সাহেব এবং তার সহপাঠীরা ফিরে আসবে তখন আমি তাদের সামনে হাজির হবো। আর হাজির হওয়ার সাথে সাথেই যখন তারা আমাকে বাকি বাচ্চাগুলোর কথা জিজ্ঞেস করবে, তখন দুইটা পুলিশ বেরিয়ে আসবে। কালুচোর নিজেদের রক্ষার জন্য আমার দিকে পিস্তল ধরতে পারে। তবে ধরলেও সমস্যা নেই। কারণ সে গুলি করবেনা এটা আমি সিওর। কালুচোর দুইজন পুলিশকে তাদের বন্দুক নামাতে বলার সাথে সাথে তারা বন্দুক নামানো মাত্রই পেছনে থাকা পুলিশ গুলো কালুচোরকে পাকরাও করবে। আর তাতেই খেল খতম।
যা যা পরিকল্পনা করা হয়েছিলো। ঠিক হলোও তাই। পুলিশেরা কোন ঝামেলা ছাড়ায় ওদেরকে ধরে ফেললো।
.
বিকেলে রহমান সাহেবের বাড়িতে গ্রামবাসীদের আমন্ত্রণ জানালাম। সেখানে পুরো গ্রামবাসীরা জড়ো হলো। ম্যাডাম আমাকে জড়িয়ে ধরে আছেন।  ম্যাডামের চোখে পানি চিক চিক করছে। ম্যাডাম কখনো ভাবতেই পারেন নি এসব ঘটবে। কি থেকে কি হয়ে গেলো ম্যাডাম এখনো কিছুই বুঝে উঠতে পারেন নি। আমি অনুপমকে ইশারা দিয়ে কাছে ডাকলাম। সে এগিয়ে এলো। এসেই সে আমাকে বলে উঠলো, দোস্ত তুই তো কামাল দেখিয়ে দিলিরে। আমি বললাম, যদি কখনো ডিটেক্টিভ হতে চাস তাহলে কখনোই মিথ্যাকে,  অন্যায়কে প্রশ্রয় দিবিনা। মনে সাহস রাখবি। তবেই সফলতা অর্জন করতে পারবি।
রহমান সাহেব এবার সকল গ্রামবাসীর সামনে পরিত্যাক্ত বাড়িটির আসল রহস্যটি উদঘাটন করলেন। তিনি দেখিয়ে দিলেন ভূত,প্রেত বলতে কিছু নেই। সব এসব মানুষভূতের কার্যক্রম। গ্রামের ছোট থেকে শুরু করে বৃদ্ধ অব্দি সবাই কুসংস্কার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো তখন।
.
শাহ আলম সাহেব তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু আকবরকে বললেন, ছিঃ তুই এতোটা নিচ,  আমি আগে কখনো ভাবিনি। তুই বলেছিলি আমার স্কুলের বাচ্চারা তোর এখানে বেড়াতে আসবে। আর তুই কিনা সেই বেড়ানোটাকে নিজের কার্যসিদ্ধিতে পরিণত করতে চেয়েছিলি?
সেই ছোটবেলাতেই আমার বোঝা উচিত ছিলো, তোর মতো চোরের সাথে বন্ধুত্ব না করা। ছোটবেলার কথা তোর মনে পড়ে? যখন তুই খাবারের অভাবে পাবলিকের পকেট মেরেছি প্রাণ ভয়ে দৌড়াচ্ছিলি, তখন কিন্তু এই আমি তোকে বাঁচিয়েছিলাম। আমার বাবা অবশ্য সেদিন আমাকে বলেছিলো, আলম তুই এসব মিচকা চোরের সাথে বন্ধুত্ব করিস না। কিন্তু সেদিন আমি তোর শুকনা মুখখানা দেখে বড্ড কষ্ট পেয়েছিলাম। তোর থাকা খাওয়ার একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম, তোকে লেখাপড়া শিখিয়েছিলাম। বাবা আমাকে বলেছিলো, দুধভাত দিয়ে কাল সাপ যেন না পুশি আমি। সেদিন বাবার কথাতে আমি তোর পক্ষ নিয়ে কথা বলেছিলাম। কিন্তু জানতাম না যে বাবা সেদিন সব ঠিকই বলেছিলেন।
এবার শাহআলম সাহেব পুলিশদের উদ্দেশ্যে বললেন, একে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে আসল ডিলারকে ধরে সবাগুলোকে হাজতে পুরে দাও। এদের কঠিন শাস্তি পাওয়া উচিত। এদেরকে না মেরে যাবতজীবন জেলের ভাত খাওয়াতে হবে। যেন এরা মারা না যাওয়া অব্দি জেলখানা থেকে বেরোতে না পারে।
মাঝখানে মুন্সির শাস্তির কথা উঠলে আমি তাকে শাস্তি না দেওয়ার জন্য রহমান সাহেবকে অনুরোধ জানালাম।
.
আমাদেরকে পরবর্তী শিকারের জন্য আর অপেক্ষা করতে হয়নি। সেদিন সন্ধার সময়ই ঢাকার সেই শফিক সাহেব ট্রাক নিয়ে গ্রামে ঢুকলে পুলিশ তাকে আটক করে।
সব রহস্যের জাল উন্মোচন হয়ে যায় তখন। গ্রামবাসীরা সবাই কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে সত্যকে জানতে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
আমাদেরকে নিয়ে কটুক্তি করা মানুষগুলোও তখন আমাদেরকে ধন্যবাদ জানায়। পুরো গ্রামে যেন উৎসবের রোল পড়ে যাই। গ্রামবাসীরা আমাদেরকে আসতেই দিবেনা। তারা বলে, আমরা যেন একটা দিন তাদের সাথে কাটিয়ে যাই। তবু আমাদের চলে আসতে হলো। সেদিন রাতেই আমরা ব্যাগপত্র গুছিয়ে চলে আসি আমাদের গ্রামে। আসার সময় রহমান সাহেবকে উনার সেই "মানুষের মনের কথা বোঝার" কথাটা জিজ্ঞেস করলে উনি শুধু একটা মুচকি হাসি দিলেন। আর ছোট্ট করে বললেন সবই অনুমান।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.