নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শ্রাবণ আহমেদ (নিরব)\nট্রেইনার অব \"উই আর স্টুডেন্টস\" ঢাকা।

শ্রাবণ আহমেদ

শ্রাবণ আহমেদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

অচেনা বালক

২১ শে আগস্ট, ২০১৮ বিকাল ৩:০৩

অচেনা বালক
লেখক: Srabon Ahmed (অদৃশ্য ছায়া)
.
হামিদ মিয়া গ্রামের একজন জমিদার। নাজিরপুর গ্রামে তার জমিদারিত্ব। তবে মানুষ হিসেবে তিনি মন্দ নন। লোকমুখে শোনা যায় জমিদারেরা নাকি দুঃচরিত্রের হয়। তারা নাকি গ্রামের সকল মানুষের উপর জোড় জবরদস্তি করে খাজনার টাকা আদায় করে। রাতে মেয়ে মানুষ নিয়ে আনন্দ ফুর্তি করে। গ্রামে যে তাদের বিশাল একটা ক্ষমতা আছে, সেটা নাকি তারা দেখিয়ে বেড়ান।
তবে হামিদ মিয়া সেসব দিক দিয়ে খুব ভালো এবং উদার মনের মানুষ। তার পূর্বে যে জমিদার নাজিরপুর গ্রামে রাজত্ব করেছিলেন, তিনিও নাকি অনেক ভালো ছিলেন। গ্রামের কেউ না খেয়ে থাকলে তিনি তাকে খুঁজে বের করতেন এবং তাদের খাবারের ব্যবস্থা করতেন।
হামিদ মিয়ার জমিদারিত্বটাও ঠিক তার আগের জমিদারের মতোই। সবাই ধীরে ধীরে তাকে ভালোবাসতে শুরু করে। বিস্তীর্ণ ফসলের জমির প্রায় অর্ধেকাংশ জমিই গ্রামের অসহায়, গরীব মানুষের জন্য রেখে দিয়েছেন তিনি। সেখানে যা যা ফসল ফলে তা ছয়মাস অন্তর অন্তর তিনি গ্রামবাসীদের মাঝে বিলিয়ে দেন।
আজ থেকে দুই যুগ আগের জামিদারের কথা মনে পড়লে গ্রামবাসীরা এখনো থু থু ফেলে।
সেই জমিদারটি ছিলো স্বার্থন্ধ। নিজের স্বার্থ ছাড়া সে কখনো পরজনের উপকার করেনি। তার গ্রামে থাকতে হলে নিয়মিত খাজনার টাকা দিতে হবে, এমন আইন সে জারি করেছিলো। কেউ যদি খাজনার টাকা দিতে একটু বিলম্ব করতো, তবে তাকে বেত্রাঘাত করে রক্তাক্ত করতো সেই জমিদারটি।  তার মৃত্যুটাও বেশ রহস্যজনক ছিলো। একদিন সকালে গ্রামের এক চাষী কাজের জন্য মাঠের দিকে যাওয়ার  পথে দেখতে পায় পথের ধারে যে বড় বটগাছটি রয়েছে, সেখানে কেউ একজন ঝুলে আছে। কাছে গিয়ে ভালো করে লক্ষ করতেই সে দৌড়ে পালিয়ে যায় সেখান থেকে।
কি বিশ্রী তার মুখাকৃতি। বিশ্রী গন্ধ বের হচ্ছে শরীর থেকে। চাষীটি গ্রামের সব লোকজনকে খবর দিলে সবাই সেখানে গিয়ে জড়ো হয়।  কিন্তু কারো মুখেই কোন প্রশংসা শোনা যায়নি সেদিন। বটগাছে ঝুলতে থাকা নিকৃষ্ট জমিদারের লাশ দেখে সেদিন  সবাই বরং বেশ খুশিই হয়েছিলো।
আসলে, যে দুঃচরিত্রের অধিকারী হয়, নিকৃষ্ট মনের মানুষ হয়, তার চলে যাওয়াতে মানুষ কখনো দুঃখ পায়না। বরং খুশিই হয়।
সেদিন সবার মুখে মুখে হাসির রেখা ফুটে ওঠে, যেন তারা অমৃত পান করেছে এমনটা।  কেউ কেউ বলছে, উপরওয়ালা আমাদের উপর মুখ তুলে তাকিয়েছেন। আমরা এখন একটু হলেও শান্তিতে বসবাস করতে পারবো। কেউ কেউ আবার জামিদারের লাশ দেখে থুথু ফেলছে। আর তার নামে অতি ভক্তি সহকারে প্রশংসা করছে। একজন আরেকজনকে বলছে, দেখেছো আমি বলেছিলাম না যে, একদিন আমাদের এ দুঃখ কষ্ট ঘুচবে।  আমরাও একদিন স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারবো। আজ সেদিনটি এসেছে।
.
গ্রামবাসীরা বটগাছটিতে ঝুলতে থাকা জামিদারের লাশটিকে ঘিরে তাদের মূল্যবান মন্তব্য প্রকাশ করছে। হঠাৎ  গ্রামবাসীদের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠলো, চলো আমরা একে দাফনের ব্যবস্থা করি।
এই কথা শুনে বাকি লোকগুলো তার উপর ক্ষেপে গেলো। তারা বললো, কিসের দাফন, কার দাফন? এর দাফন করাতে হলে একে আমাদের স্পর্শ করতে হবে। আর আমরা চাইনা কোন পাপি, জঘন্যতম ব্যক্তিকে স্পর্শ করতে। একে স্পর্শ করলে আমরা অপবিত্র হয়ে যাবো। একে এখানে এভাবেই রেখে দেওয়া হোক। মাঠের শেয়াল কুকুর একে খেয়ে তাদের আশ মেটাক।
সবাই ঐ জমিদারের মৃত্যুতে এতোটাই খুশি হয়েছিলো যে, তা ভাষায় প্রকাশের বাইরে। কিন্তু একটা বিষয় তাদের কাছে স্পষ্ট না। এই সুঠাম দেহি, শক্তিশালী, অত্যাচারী জামিদার মরলো কিভাবে? নাকি তাকে কেউ মেরে ফেলেছে?
না না, তাকে আবার কে মারবে? তাকে মেরে ফেলার মতো এমন কেউতো এই গ্রামে আছে বলে মনে হয়না! তাহলে কি সে ফাঁস লাগিয়ে নিজের ইচ্ছাতেই মারা গেছে? নাহ, এটাও তো কখনো সম্ভব না।  সবাই একে অপরকে বলাবলি করছে,  জমিদার মরলো কিভাবে?
জমিদারের আত্মহত্যা করার কোন কারণও ছিলোনা। আর আরেকটা বিষয় গ্রামবাসীর কাছে বিস্ময়কর। তারা ভাবছে যদি জমিদার আত্মহত্যাই করবে, তবে সে এই মাঠে এসে করবে কেন।  তার বাড়িতেও তো এর চেয়ে ভালো জায়গা আছে। আর সে যদি আত্মহত্যাই করবে তবে তার শরীরে রক্ত কেন? তার শরীর থেকে গন্ধ বের হচ্ছে কেন?
তাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন সে প্রায় সপ্তাহ খানেক আগে মারা গেছে। কিন্তু সে তো গতকালও আমাদের থেকে খাঁজনার টাকা নিলো। খাঁজনার টাকা না দিতে চাওয়ায় সে সবুর মিয়াকে কি মারটাই না দিলো। বেচারা সবুর মিয়া কত আকুতি মিনতি করলো। তবুও সে তাকে ছাড় দিলোনা। খাঁজনার বদলে তাকে মেরে রক্তাক্ত করে দিলো।
গ্রামবাসীরা সবাই হতবাক। কেউ জানেনা কিভাবে মরলো জমিদার। সবাই সবাইকে বলছে, কিভাবে মরলো সে।  কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারছেনা।
ঠিক তখনই একটা ছোট ছেলে, এই ১৩-১৪ বছর বয়স হবে হয়তো।  ছেলেটা গ্রামবাসীর ভীড় ঠেলে উঁকি দিলো।  সে দেখতে চেষ্টা করছে,  কি হয়েছে সেখানে। কিন্তু গ্রামবাসীদের পর্যাপ্ত পরিমাণ ভীড় থাকায় সে দেখতে পারছিলোনা। ব্যাপারটা আব্দুল আলী খেয়াল করলেন। তিনি ছেলেটাকে কাঁধে নিয়ে উঁচু করে ধরলেন। যাতে করে ছেলেটি দেখতে পারে। ছেলেটি কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো জমিদারের লাশের দিকে।  একেবারে মর্মান্তক মৃত্যু হয়েছে জমিদারের।ছেলেটা আব্দুল আলীর কাঁধে বসে মৃত জমিদারকে দেখছে আর মিটিমিটি হাসছে। তার সে হাসিটা সবার চোখ এড়ালেও আব্দুল আলী ঠিকই বুঝতে পারলো ছেলেটা হাঁসছে। তার সে হাসিতে আব্দুল আলীর পুরো শরীর কম্পিত হচ্ছে।
মনে হচ্ছে  যেন আব্দুল আলীর শরীরে ভূমিকম্প হয়ে যাচ্ছে। তিনি বুঝতে পারছেন না কি হচ্ছে এসব! নাকি সত্যি সত্যিই ভূমিক্ম্প হচ্ছে? তিনি তার পাশের একজনকে জিজ্ঞেস করলেন ভূমিকম্প হচ্ছে কিনা! লোকটি উত্তর দিলেন, কই নাতো ভূমিকম্প হবে কেন?
আব্দুল আলী এবার একটু হকচকিয়ে গেলেন। তিনি ভাবছেন ভূমিকম্প যদি নাই হবে, তাহলে তার সর্ব শরীরে কম্পন ধরেছে কেন? তার একবারের জন্যও মনে হচ্ছেনা যে, তার কাধে থাকা ঐ ছেলেটির জন্য তার এরকম হচ্ছে। তিনি নিজের শরীরের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পেতে ছেলেটিকে কাধ থেকে নামাতেই তার সমস্ত কম্পন থেমে গেলো। বিষয়টি তার কাছে তেমন কিছুই মনে হলোনা। তিনি একটুও ভাবার চেষ্টা করলেন না যে, তার কাঁধে ঐ ছেলেটি থাকার কারণেই তার সমস্ত শরীর জুড়ে কম্পন শুরু হয়েছিলো।
ছেলেটি এখনো হেঁসেই চলেছে। তার হাসির কারণ কারো জানা নেই। কেউ তার হাসিকে তেমন খেয়ালই করছেনা। কিন্তু আব্দুল আলী ঠিকই খেয়াল করছেন বিষয়টা। তিনি ছেলেটিকে এর আগে কোথায়ও দেখেছেন বলে মনে করতে পারছেন না। ছেলেটিতো এই গ্রামের নয়। তাহলে সে কোথা থেকে এলো। আর এমন হাসছেই বা কেন। নানান প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে তার মনে। কিন্তু প্রশ্নের উত্তরগুলো অপ্রাপ্তি।
ক্রমেই  ছেলেটির হাসার পরিমাণ বেড়ে চলেছে। আকাশ পাতাল ভারি হয়ে আসছে। ধু ধু করে ধুলি উড়ছে চারিদিকে। ক্রমান্বয়ে বাতাসের গতিবেগ বাড়ছে। আকাশটা কালো হয়ে আসছে। যেন খানিক বাদেই তূফান হয়ে যাবে।
সবাই পরিস্থিতি বেগতিক দেখে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরেছে। কিন্তু আব্দুল আলী ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। তিনি ভেবে পাচ্ছেন না,  হঠাৎ করে আবহাওয়াটা এমন পাল্টে গেলো কিভাবে। কিছুক্ষণ আগেও তো আকাশটা পরিষ্কার ছিলো। নীল নীল মেঘে ছেয়ে ছিলো আকাশের প্রতিটা অঙ্গ।  পাখিরা উড়ে বেড়াচ্ছিলো মনের আনন্দে। গাছের পাতাগুলোতে ছিলো স্বানন্দের নাচ। বটগাছটি থেকে খানিক দূরের কড়ই গাছের ফল গুলো শব্দ করে বেজে চলেছিলো। কিন্তু হঠাৎ কি হচ্ছে এসব? এখন বাতাসের গতিবেগ বৃদ্ধির পরেও কড়ই গাছের ফলগুলো বাজছেনা কেন? তবে আকাশের পাখিগুলো তো ঠিকই উড়ে বেড়াচ্ছে। তাদের দেখে মনে হচ্ছে যেন, কিছুই ঘটছেনা।
চারিদিকে তূফানের মতো পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার পরেও আব্দুল আলীর কাছে মনে হচ্ছে  যেন তার শরীরটা স্বাভাবিকই আছে। কেননা তার শরীরের উপর আশেপাশের বিরুপ আবহাওয়ার কোন কিছুই প্রতিফলিত হচ্ছেনা। তিনি আগের মতোই আছেন, তবে চোখে মুখে বিস্ময়ের ছাপ। তাহলে কি তার আশেপাশে ঘটে চলা এই সবকিছুই দৃষ্টির ভুল!  হয়তো হবে তাই।
.
আব্দুল আলীর মধ্যে খটকা লাগতে শুরু করে তখন, যখন তিনি দেখতে পান ঐ অচেনা ছেলেটি এখনো তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আর এখনো ছেলেটি ঠিক আগের মতোই হেসে চলেছে। আব্দুল আলী ভাবেন, ছেলেটি কি কিছুই বুঝতে পারছেনা? ঝড়ের মতো বাতাস বইছে চারাদিকে, এটা কি সে দেখতে পারছেনা? তিনি আবার ভাবেন, ছেলেটি পাগল নয়তো?
ভাবাভাবির অন্তে হঠাৎই বাতাসের পরিমাণ আগের থেকে বহু অংশে বেড়ে যায়। চারিদিক ঘনকালো অন্ধকারে ঢেকে যায়। আব্দুল আলী চোখ বন্ধ করে ফেলেন। কারণ পথের ধুলাবালি ততক্ষণে উড়া শুরু করেছে।
এরকম প্রায় মিনিট পাঁচেক পর হঠাৎ করেই চারিদিকটা শান্ত হয়ে ওঠে। আব্দুল আলী চোখ খোলেন।  তিনি দেখেন, সবকিছু একদম স্বাভাবিক। ঠিক আগের মতো। যেন কিছুই হয়নি। ছেলেটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে আব্দুল আলী ভাবতে থাকেন, ছেলেটি হয়তোবা বাক প্রতিবন্ধী।  তা না হলে এতো কিছু হওয়ার পরেও সে কিছু টের পেলোনা কেন?
আবার ভাবেন, না না প্রতিবন্ধী হতে যাবে কেন? সে তো হাঁসছে। তার হাঁসি দেখে তো মনে হচ্ছেনা সে বাক প্রতিবন্ধী!
তিনি ছেলেটিকে কিছু বলতে যাবেন,  ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি খেয়াল তার সামনে থাকা বটগাছটিতে জমিদারের যে লাশ ঝুলে ছিলো, ওটা আর নেই। ভড়কে যান তিনি।
কেবলই তিনি লাশটাকে এখানে বটগাছের সাথে ঝুলতে দেখলেন, তবে এখন গেলো কই?
তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখেন, আকাশটা আবার তার আগের রুপে বিচরণ করেছে। অন্ধকারের ঘনঘটা সব বিলীন হয়ে গেছে। কিছু সময়ের জন্য তার আশেপাশে এসব কি ঘটলো, সবই তার অজানা। কেমন যেন একটা অদ্ভুত কার্যক্রম, ভূতুরে বিদ্যা।
ছেলেটির মধ্যে কোন পরিবর্তন নেই। সে আগের মতোই হাসিখুশি। আব্দুল আলী এবার ছেলেটির কাছে এগিয়ে গেলেন। তিনি ছেলেটিকে কিছু একটা বলতে যাবেন, ঠিক সেই মুহূর্তে ছেলেটিই তাকে বলে উঠলো, আপনি পারবেন তো এ গ্রামটার দেখাশোনা করতে?
কথাটা শোনা মাত্রই আব্দুল আলী যেন আকাশ থেকে পড়লেন। এসব কি বলছে এই ছেলেটি! মাথা টাথা ঠিক আছেতো তার? ছেলেটির মাথায় হয়তো গন্ডগোল আছে। না হলে এসব আবোল তাবোল কি বলে সে? তিনি ছেলেটির কথাটা ঠিক ভালোভাবে বুঝতে না পেরে,(অবশ্য তিনি শুনেছেন যে, ছেলেটি তাকে কি বলেছে!) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কি বললে তুমি?
ছেলেটি নির্লিপ্ত কন্ঠে মুখে কিছুটা হাসির রেখা ফুটিয়ে উত্তর দিলো, আপনি হতে যাচ্ছেন এ গ্রামের নতুন জমিদার। তা, আপনি পারবেন তো সুষ্ঠুভাবে শাসনকার্য চালাতে?
কথাটা শুনে আব্দুল আলী অবাক থেকে অধিকতর অবাক হচ্ছেন। সে কিনা এই গ্রামের নতুন জমিদার হতে যাচ্ছে! কিন্তু কিভাবে কি?  ছেলেটি বললো এটা রাখুন। আব্দুল আলী দেখলেন ছেলেটি তার দিকে একটা নীল পাত্র এগিয়ে দিয়ে ওটা তাকে নিতে বলছেন। তিনি বললেন,  কি এটা?
ছেলেটি বললো, এই পাত্রটি যখন লাল রুপ ধারণ করবে, তখন আপনি বুঝে নিবেন আপনার মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে। আর সেই মৃত্যুকালেও যদি  সুষ্ঠুভাবে জামিদারিত্ব করতে পারেন, তবে আপনার মৃত্যুর মুহূর্তে নিজের ইচ্ছামতো ভালো কাউকে জমিদারিত্বটা দিয়ে যাবেন। আর যদি তখন কাউকে খুঁজে না পান, তবে তো আমি আছিই। আমি আবার ফিরে আসবো। ভালো থাকবেন, চলি।
আব্দুল আলী ছেলেটির কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যান। তিনি বড় চিন্তায় পড়ে যান। কিভাবে এখন তিনি ঐ জমিদারের বাড়িতে গিয়ে উঠবেন? লোকে দেখলেতো জিজ্ঞেস করবে, তুমি আবার ঐ জমিদারের চেয়ারে কি করছো। ওটাতো জমিদারের আত্মীয়দের জন্য প্রযোজ্য। 
তিনি ছেলেটিকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবেন।  কিন্তু একি! ছেলেটি কোথায় হারিয়ে গেলো? মাত্রই তো দেখলাম আমার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলো। তবে চোখের পলকে সে কোথায় চলে গেলো?
.
অচেনা এক বালক আব্দুল আলীর কাছে নাজিরপুর গ্রামের দায়ভার দিয়ে বাতাসে মিলিয়ে যায়। বিষয়টা আব্দুল আলীর কাছে অদ্ভুত লাগে। বালকটি কে, কোথায় থাকে, কি পরিচয় তার, এসব সকল প্রশ্নের উত্তরই তার কাছে অজানা। তবে তার কাছে নিজেকে এখন একজন জমিদার জমিদারই মনে হচ্ছে। তিনি এখনো দাঁড়িয়ে আছে ঐ বটগাছটির সামনে। হঠাৎ পেছন থেকে একজন বলে উঠলো, কি জমিদার সাহেব, এখানে আনমনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি ভাবছেন। আপনার প্রাসাদ থেকে আপনার ডাক এসেছে। আপনার বেগম আপনাকে ডাকছেন।
আব্দুল আলী ক্রমেই অবাক হচ্ছেন, এসব কি হচ্ছে তার সাথে! তার বেগম মানে তার স্ত্রী ঐ জমিদার বাড়িতে কি করছে? সবকিছু তার কাছে উল্টাপাল্টা মনে হচ্ছে। হঠাৎই তিনি লক্ষ করলেন যে, চারিদিকের পরিবেশটা কেমন পাল্টে গেছে। রাস্তাঘাটের উন্নতি হয়েছে। মাঠে মাঠে প্রচুর ফসলের সমাহার। দূর থেকে চাষী মতিন মিয়া ভাটিয়ালি গান গাইছেন। আর তার থেকেও বেশি অবাক করার মতো দিকটি হচ্ছে, তার নিজের শরীরের পোশাক আশাকের পরিবর্তন ঘটেছে। জমিদারি পোশাক তার গায়ে লাগানো। আব্দুল আলীর হাতে এখনো সেই নীল পাত্রটি রয়েছে। পাত্রটি আগের থেকে আরো অধিক নীল বর্ণ ধারণ করেছে।
তিনি গুটি গুটি পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছেন। যখন তিনি জমিদার বাড়ির সামনে গেলেন তখন দেখলেন, সেখানে আরো বড় চমক অপেক্ষা করছে তার জন্য। এতো সুন্দর একটা জমিদার বাড়ির কথা তিনি কল্পনাতেও ভাবেন নি। আর জমিদার হওয়ার ব্যাপারটা তো তিনি কখনো স্বপ্নেও দেখেন নি।
.
প্রথম প্রথম জমিদারিত্ব করতে তিনি কিছুটা হিমশিম খেলেও কিছুদিন যেতেই তিনি সব কিছু তার আয়ত্তে নিয়ে আসলেন। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি পুরো জমিদারিত্বটা শিখে গেলেন। কিভাবে কি করতে হবে, জনগণের পাশে কিভাবে দাঁড়াতে হবে, গ্রামটা কিভাবে সুষ্ঠুতার সাথে পরিচালনা করতে হবে, সবকিছুই তিনি শিখে গেলেন। আব্দুল আলীকে জমিদার হিসেবে পেয়ে গ্রামবাসীদের যেন সুখের সীমা নেই। আব্দুল  আলী কোন লোকের উপর অত্যাচারের কথা স্বপ্নেও ভাবেন না। কারণ ঐ অচেনা বালকটি তাকে বলে গিয়েছিলো, সেও যদি তার পূর্বের জমিদারের মতো হয়, তবে বালকটি আবার ফিরে আসবে।
আব্দুল আলী মাস খানেক পরপরই বালকটির দেওয়া নীল পাত্রটা দেখেন। কারণ সেই নীল পাত্রটা লাল বর্ণ ধারণ করলেই যে তার মৃত্যুর বার্তা চলে আসবে। 
দিন যায়, আর গ্রামের উন্নতি হতে থাকে। গ্রামের মানুষেরা সুখের হালে দিন কাটাতে থাকে। কষ্ট কি,  তারা একটিবারের জন্যও উপলব্ধি করেনা। তারা ভুলেই গেছে যে এর আগে একটা অত্যাচারী জমিদার ছিলো এই গ্রামে। 
.
সবমিলিয়ে খুব স্বাচ্ছন্দ্যেই দিন কাটছিলো আব্দুল আলী এবং তার গ্রামের মানুষদের।
এভাবে প্রায় বছর দশেক যাওয়ার পর একদিন আব্দুল আলী হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। কোন অসুখ বিসুখ কিচ্ছু নেই তার। ভরদুপুরে আড্ডাখানায় বসে থাকাকালীন সময়ে তিনি হঠাৎ করে মাটিতে পড়ে যান। পরে তাকে ধরে রুমে নেওয়া হয়। যখন তার একটু একটু জ্ঞান ফিরে, তখন তিনি তার স্ত্রীকে বলেন, শেফালী দেখো ঐ পশ্চিমের ঘরে একটা ছোট বাক্স আছে। ওটা একটু নিয়ে এসোতো। শেফালী বেগম ছুটে গেলেন বাক্স আনতে।
এদিকে আব্দুল আলী ভাবছেন, বাক্সের মধ্যে থাকা নীল পাত্রটা যেন লাল না হয়। তাহলে যে সর্বনাশ হয়ে যাবে। কিছুক্ষণ বাদে শেফালী বেগম ছুটে এলেন বাক্সটা হাতে নিয়ে। আব্দুল আলী বাক্সের দিকে একবার তাকাচ্ছে আর একবার ভাবছে নীল পাত্রটা লাল হয়ে যায়নি তো?
তিনি শেফালী বেগমকে বাক্সটা খুলতে বলেন। শেফালী বেগম বাক্সটা খুলে দেখে তার ভেতরে অনেক সুন্দর একটা লাল পাত্র। দেখে মনে হচ্ছে যেন রক্ত রাঙা কোন লাল পদ্ম। কিন্তু শেফালী বেগম জানেন না যে, পাত্রটা লাল বর্ণ ধারণ করা মানে তার স্বামীর মৃত্যুর বার্তা আসা। তিনি তার স্বামীর দিকে পাত্রটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, দেখো দেখো কত সুন্দর একটা লাল পাত্র এই বাক্সের ভেতরে।  স্ত্রীর মুখে লাল পাত্রের কথা শোনা মাত্রই আব্দুল আলীর কলিজা শুকিয়ে যায়। তাহলে কি  তার মৃত্য ঘনিয়ে এসেছে? তিনি তাড়াতাড়ি করে পাত্রটা হাতে নেন এবং দেখেন সত্যিই তাই। পাত্রটা ডুবন্ত সূর্যের রক্তিম লাভার ন্যায় বর্ণ ধারণ করেছে।
তার মনে ভয় জাগতে শুরু করে, সে কোন ভুল কাজ করেনি তো? ভুলবশত কারো মনে কষ্ট দেয়নি তো! আবার ভাবে, না না আমি তো কাউকেই কষ্ট দেইনি। আর কষ্ট দিলে তো এতদিনে তার অবস্থাটাও পূর্বের ঐ জমিদারের মতো হতো। আজ তার ঐ অচেনা বালকটির কথা বারবার মনে পড়ছে। ছেলেটা কে ছিলো? আর কি বার তার পরিচয়? কোথা থেকে এসেছিলো ছেলেটা? এসব প্রশ্নের কোন উত্তরই খুঁজে পান না তিনি। তিনি ধরে নিয়েছেন তার মৃত্যু নিশ্চিত। কিন্তু কোন একজনকে তো এখন এই জমিদারিত্বটা দিয়ে যেতে হবে! কিন্তু কাকে দেবে সে এই জমিদারিত্ব?  আশেপাশের কেউই তার বিশ্বস্ত নন। সবাই স্বার্থন্ধ, ঠিক পূর্বের ঐ অত্যাচারী জমিদারের মতো।
.
আব্দুল আলী অসুস্থতায় কাতর হয়ে লাল পাত্রটা হাতে নিয়ে বিছানায় শুয়ে অাছেন। বড় অস্বস্তি লাগছে তার। শুয়ে শুয়ে তিনি মৃত্যুর জন্য প্রহর গুনছেন। কিন্তু তার কাছে নিজেকে খুব স্বাভাবিক এবং সুস্থময়ই লাগছে। তবুও নীল পাত্রটা লাল পাত্র হয়ে যাওয়াতে তার ঐ স্বাভাবিকতা অস্বাভাবিকতায় পরিণত হয়েছে।
শুয়ে শুয়ে তিনি অতীতের কথা মনে করছেন। এইতো সেদিন তিনি জমিদারের দায়ভার নিজের কাঁধে নিলেন আর তাকে এতো দ্রুত কেন সে দায়ভার কাঁধ থেকে নামাতে হবে। তিনি আরো ভাবছেন, তিনি যদি চলে যান তবে গ্রামবাসীদের উপর সুবিচার হবে তো? গ্রামবাসীরা পরবর্তী জমিদারের জমিদারিত্বে তৃপ্ত হবে তো?
সব ভাবাভাবির অন্তে হঠাৎ দ্বারপ্রহরী এসে খবর দিয়ে যায় বাইরে একটা অপরিচিত লোক দাঁড়িয়ে আছে। মুখ ভর্তি দাঁড়ি, মাথা ভর্তি উস্কুখুস্কু চুল, পুরোনো একটা পাঞ্জাবি পড়া।
আব্দুল আলী লোকটিকে ভেতরে আসার জন্য আহ্বান করে। প্রহরী গিয়ে লোকটিকে ভেতরে নিয়ে আসে। লোকটি ভেতরে আসলে আব্দুল আলী বুঝতে পারেন যে, লোকটি না খেয়ে আছেন। তিনি শেফালী বেগমকে খাবার আনতে বলেন। খাওয়া দাওয়া শেষ করে আব্দুল আলী লোকটিকে জিজ্ঞেস করেন, আপনার জন্য কি করতে পারি বলুন? লোকটি মুচকি হেঁসে বলেন, শুনলাম এই গ্রামে নাকি একজন জমিদার দরকার।
এটুকু বলেই লোকটি চুপ করে রইলেন। আর এদিকে আব্দুল আলী কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি ভাবছেন, এই লোকটি জানলো কি করে এখানে একজন জমিদার দরকার? আর লোকটিকে এই সংবাদটাই বা দিল কে?
কৌতুহলবশত তিনি জিজ্ঞেস করেই ফেললেন,  আপনাকে কে বললো এই কথাটা  যে, এখানে একজন জমিদার লাগবে? লোকটি ভ্রু কুচকিয়ে আব্দুল আলীর দিকে তাকিয়ে বললেন, কেন লাগবেনা তাহলে? না লাগলে আমি আসি।  লোকটি বেড়িয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই  আব্দুল আলী তাকে ডাক দিলেন। তিনি বললেন, আপনাকে কে বললো এই কথাটা একটু বলবেন কি?
লোকটি এবার বললেন, আমি ঐ পথটা ধরে হেঁটে যাচ্ছিলাম, পেটে প্রচুর ক্ষিদে আমার। খাবারের জন্য এ গ্রাম ও গ্রাম ছুটে বেড়িয়েছি। তবু  খাবারের কোন সন্ধান মিলছিলো না। ঠিক তখন পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা একটা বালক আমাকে আপনার কাছে আসার কথা বললো। বালকটি এও বললো যে, আপনার এখানে নাকি জমিদার লাগবে। আর  তাই বালকটি আমাকে বললো, আপনার কাছে আসতে।
লোকটির মুখে এইসব কথা শুনে আব্দুল আলীর চোখদুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো। তিনি অতি দ্রুততার সাথে বললেন, এখন কোথায় আছে সেই বালকটি?
লোকটি বললো, সে মাঠে মাঠে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। গান গাইছে, খেলাধুলা করছে।
আব্দুল আলী আর কোন প্রকার দেরি না করে বেরিয়ে পড়লেন সেই বালকটির খোঁজে, সাথে লোকটিও। লোকটি তাকে যথাস্থানে নিয়ে গিয়ে দেখলো সেখানে কেউ নেই। প্রচন্ড খড়ার মধ্যে বিস্তীর্ণ মাঠ ধুলোবালিতে ধু ধু করছে। মাঝে মাঝে হঠাৎ করে একটু আধটু বাতাস বইছে।
আব্দুল আলী লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন, কই সেই বালক? লোকটি ভয়ার্ত কন্ঠে আমতা আমতা করে উত্তর দিলেন, আমি তো তাকে এখানেই দেখেছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে কই গেলো সে?
আব্দুল আলীও বুঝতে পেরেছেন ব্যাপারটা, আসলে কি হয়েছে!  তার মনে কোন সন্দেহই নেই যে ঐ ছেলেটিই হলো দশ বছর আগের সেই ছেলেটি। তবে তার মনে হঠাৎই একটা প্রশ্ন জাগে, ছেলেটি কি এখনো সেই ছোটই রয়ে গেছে? ছেলেটিকে দেখতে তার মনে স্বাদ জাগে। কিন্তু সেটা যে কেবলই কল্পনা, কেবলই আকাঙ্খা।
.
মাঠ থেকে নীড়ে ফেরার পথে হঠাৎ করে আব্দুল আলীর মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে। নিজেকে সংযত রাখতে না পেরে তিনি তার সাথে থাকা লোকটির উপর ভর করে সামনের দিকে এগোতে থাকে। তবুও তিনি নীড়ে ফিরতে পারেন নি সেদিন। সেদিন মাঠেই তিনি তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
লোকটি গ্রামের মানুষদের খবর দিলে তারা সবাই ছুটে আসে। পরে তাকে দাফন কাফন করানো হয়।
আর তিনি মারা যাওয়ার পরেই ঐ লোকটি গ্রামটির জামিদারিত্ব পান। আর ঐ লোকটিই হলো গল্পের প্রথমে বলা সেই হামিদ মিয়া।
হামিদ মিয়াও বেশ ভালো লোক। তিনিও আব্দুল আলীর মতোই সত্যনিষ্ঠা।  গ্রামবাসীদের যেকোন প্রয়োজনে তিনি এগিয়ে যান।  গত ১৪ বছর ধরে তিনি নাজিরপুর গ্রামের জমিদারিত্ব করছেন। তার জমিদারিত্বে গ্রামের সকল মানুষই তৃপ্ত। তিনি মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য নিজের জমিদার বাড়িতে কয়েকজন লোক রেখেছেন। যারা বাড়ি এবং বাড়ির সকল জিনিসের দেখাশোনা করে।  সেই লোকগুলো নাজিরপুর গ্রামেরই একটি ছোট্ট ঝুপড়িতে থাকতো। লোকগুলোর মুখের দিকে তাকালে হামিদ মিয়ার হৃদয়টা কেঁদে কেঁদে উঠতো। আর সেই কারণেই তিনি  লোকগুলোকে নিজের বাড়ির কাজ দিয়েছেন।
বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই কাটছিলো এতোটা দিন। কিন্তু হঠাৎ করেই সবকিছু এলোমেলো হয়ে যেতে শুরু করে। তার জমিদার বাড়ির প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু হারিয়ে যেতে থাকে। এইতো সেদিন তার বাড়ির কাজের লোক তাকে জানালো যে, আপনার দেহরক্ষী আপনাকে খবর দিতে বলেছে- বাড়ি থেকে পাঁচশ বছর আগের ঐ প্রথম জামিদারের সোনার মূর্তিটি চুরি গেছে। কিন্তু কে চুরি করেছে সেটা জানা যায়নি। ঐ মূর্তিটাই ছিলো জমিদার বাড়ির একটি শক্তি। পাঁচশ বছর আগে জমিদার বাহাদুর শাহ বলে গিয়েছিলেন, যদি কখনো আমার এই জামিদারিত্বে অর্থ সংকট দেখা দেয়, তবে যেন এই মূর্তিটা বিক্রি করে সেই সংকট টা দূর করে।
কিন্তু হায়, সেই মূর্তিটাই চুরি হয়ে গেছে। আবার আরেকদিন জমিদার তথা হামিদ মিয়ার দেহরক্ষী  তাকে জানায়,  তার নাকি জীবন সংকটে আছে। এই কথা শুনে হামিদ মিয়ার যেন পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায়। তিনি ক্ষনিকের জন্য স্তব্দ হয়ে যান। তার প্রাণ সংকটের কারণ জানতে চাইলে দেহরক্ষী জানায়, সে নাকি সেটা স্বপ্নে দেখেছে। আর তার স্বপ্ন নাকি কখনো মিথ্যে হয়না।
জিনিস চুরি যাওয়াতে হামিদ যতটা দুঃখ এবং অর্থ সংকটের ভয় পেয়েছিলেন, তার থেকে এখন তিনি হাজার গুণ ভয় পাচ্ছেন। তিনি প্রাণনাশের ভয়ে তার দেহরক্ষীর সংখ্যা বাড়িয়ে দেন।
.
সাম্প্রতিক লক্ষ করা যায় একটি বালক উত্তরের ঐ ফসলের মাঠে ঘুড়ি উড়ায়। মাঠে ফসল নেই। ফসল কাঁটা হয়েছে প্রায় মাস খানেক হবে। কিছুদিন বাদেই চাষীরা মাঠে মসূর বুনবে। সেই জন্যে চাষীরা মাঠের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। মাথার উপর প্রচন্ড উত্তাপিত সূর্য। শরীর থেকে ঘাম চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে চাষীদের। বালকটি যখন মাঠে ঘুড়ি উড়াতে আসে, তখন চারিদিকটা যেন শীতল হাওয়াতে ভরে ওঠে। চাষীরাও তখন কপালের ঘামটা মুছে পরমানন্দে মাঠের কাজ করেন। প্রচন্ড গরমের মাঝে অমন শরীর জুড়ানো শীতল বাতাসের কোন জুড়ি নেই।
মাঠের রাখাল ছেলেটার সাথেও বালকটির বেশ ভাব জমে উঠেছে। গরু আর ছাগলের পাল রেখে বেড়ায় রাখাল ছেলেটি। সে খুব ভালো বাঁশি বাজাতেও পারে। বাশির সূর, শীতল বাতাস, চাষীদের ভাওয়াইয়া গান, সবমিলিয়ে চারিদিকটা বেশ জমজমাট হয়ে ওঠে। রাখাল প্রতিদিন সকালে গরু, ছাগল চড়াতে এসে বালকটির সাথে জমিদার বাড়ি নিয়ে কথা বলে। আজও সে জমিদার বাড়ি নিয়ে কথা বলছে। সে বালকটিকে জানায় তাদের জমিদারের প্রাণ সংকটে আছে। রাখালের মুখে প্রাণ সংকটের কথা শুনে বালকটি হাসঁতে থাকে। সেই হাসিতে কম্পিত হতে থাকে চারিদিক। যেমনটা আজ থেকে চব্বিশ বছর আগে হয়েছিলো। রাখাল ছেলেটি বালকটির সেই হাসির কারণটা জানেনা। সে শুধু বালকটির মুখপানে অপলক চেয়ে থাকে। বালকটির নজড় কাড়ানো হাসি দেখে রাখালের হিংসে হয়। সে বলে, বন্ধু তুমি এতো সুন্দর করে কেমনে হাসো? আমারে শিখাবা একটু?
বালকটি হাঁসি থামিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার হাসতে শুরু করে। একসময় হাসি থামিয়ে সে বলে "রাখাল বন্ধু, আমার চলে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। যেকোনো সময় আমি চলে যেতে পারি।"
.
এর কিছুদিন পরেই জমিদার বাড়ি থেকে সামান্য দূরে পথের ধারে একজনের লাশ পাওয়া যায়। লাশটি দেখে কারো চেনার উপায় নেই যে, লাশটি কার! গ্রামের লোকজন জড়ো হয়ে ভীড় জমাতে শুরু করে সেখানে। লাশটির মুখমন্ডল একেবারে বিকৃত হয়ে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন কয়েকদিন আগে মারা গেছে। আর অবাক করা আরেকটি বিষয় হলো, লাশটির থেকে সামান্য দূরেই একটি সোনার মূর্তি।
জমিদার হামিদ মিয়াকে খবর দেওয়া হলে তিনি লাশটিকে দেখতে আসেন।
লাশটিকে দেখা মাত্রই তিনি চমকে যান। কারণ এটা যে আর অন্যকারো লাশ নয়, এটা তার দেহরক্ষী শ্যামের লাশ। যে কিনা তাকে বলেছিলো, তার নাকি প্রাণ সংকটে আছে। যে কিনা বলেছিলো, তার জমিদার বাড়ির পাঁচশ বছরের পুরোনো সোনার মূ্তিটা চুরি হয়ে গেছে।
হঠাৎই জমিদার হামিদের চোখ যায় পথের ধারের ফসলের ক্ষেতে। তিনি দেখেন সেখানে একটি সোনার মূর্তি পড়ে আছে। মূর্তিটার কাছে গিয়ে তিনি বুঝতে পারেন,  এটাই তার পূর্ববর্তী জমিদারের  রেখে যাওয়া সেই মূর্তি।
দেহরক্ষী শ্যাম মারা যাওয়ার পরদিন থেকে সেই ঘুড়ি উড়ানো বালকটিকে আর দেখা যায়নি কোথায়ও।  রাখাল ছেলেটা গরু ছাগল চড়াতে এসে প্রতিদিনই তাকে খুঁজে ফিরে। কিন্তু দিন যায়, মাস যায় তবু বালকটির আর দেখা মেলেনা।
তাহলে সেই বালকটি কে ছিলো?  কিই বা তার পরিচয়?

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.