![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মনে পড়ে, আর একদিনের কথা। সেদিন পুকুরে এক ঘটি জল আনতে গিয়েছিলাম লক্ষ্মী পূজাটা সম্পন্ন করার জন্য। অনেকটা ইচ্ছে করেই গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি ও স্নান করছে। পায়ের কাপড়টুকু উঠিয়ে যেই ঘটিটা পানিতে ডুবিয়েছি অমনি সে বলতে আরম্ভ করল, আমি যাকে ভালোবাসি তার পা আমি কোনদিন দেখিনি। তার বুকে হেঁটেছি, শুয়েছি। একদিন হয়তো তার কোলে ঘুমিয়ে যেতে হবে। আমি বেশ লজ্জা পেয়েছিলাম। কোন কথা না বলেই সেদিনও চলে এলাম। ঘাটের সিঁড়ির চারটি ধাপ পার হতেই ও আমাকে পানি ছিটিয়ে দিল। বলল, ‘তুমি সুন্দর, আমার সেই প্রেমিকার মত--ঠিক প্রেমিকার মত!’ কে ওর প্রেমিকা? সেদিন বুঝতে পারিনি। অনেক পরে বুঝতে পেরেছি। আরেকদিন কোন এক কথা প্রসঙ্গে বাবাকে বলেছিল, ‘জানেন স্যার, এই বাংলার সবাইকে আমার বড় আপন মনে হয়। আমার তো মা--বাবা কেউ নেই। তাই এ দেশ, এই মাটিই আমার মা-বাবা।’ ওর সাথে কখনও কথা বলিনি। কেন? লজ্জা হয়? না, অন্য কিছু--আমি জানি না। আমাদের ব্যাপারটা মা-বাবা-রাম সবাই জেনে গেছে। তাই আমাকে প্রায়ই মায়ের বকা শুনতে হয়। সুমাদকেও একবার বকা শুনতে হয়েছে। একদিন দূর থেকে ওকে দেখেছিলাম। ও কাঁদছে। কেন কাঁদছে? কেন? সেদিন চিন্তায় চিন্তায় সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। শেষ রাতে ঘুমিয়ে গেলে স্বপ্নে দেখি সুমাদ আমাকে ছেড়ে দূরে, বহুদূরে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে চলে যাচ্ছে। আমি কাঁদছি--সেই স্বপ্ন থেকে আজও কাঁদছি। আমার কান্না বোধ হয়, মৃত্যুতেও শেষ হবে না। মা যে বলেছিল, যবন নাস্তিক ছেলেকে ভালোবেসেছি বলে ভগবান নরকে নিয়ে আমাকে কাঁদাবে। তবুও নরকে গিয়ে যেন, ওর দেখা পাই। কত চিঠি ও আমাকে দিয়েছিল--তা গুনে দেখিনি। যে কয়টা সংরক্ষণে ছিল--তা এই লেখনিতে সাজালাম। ধর্ম নিয়ে কথা উঠলে মাকে সুমাদ বলেছিল, ‘কাকীমা, আমি ও স্যার, আমরা কোন নির্দিষ্ট ধর্মের শিকলে বন্ধি নই; আমার সকল ধর্মের উর্ধেŸ।’ মা অবশ্য রেগেছিল। সুমাদ গরু, কাছিম, শুকর, ছাগলের মাংস খেত; সামান্যও ঘৃনা হত না। আমি কোনদিন মাংস খাইনি, আজো খাই না। না খেতে খেতে এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।
ফেব্রুয়ারীর ২০ তারিখ। বিকাল বেলা রামকে নিয়ে ঘাটে গেছি জল আনতে। জল ভরে আমি সিঁড়ির উপর উঠে দেখি কৃষ্ণচুঁড়া গাছের গোড়ায় বসে অশ্রæ নয়নে হাত-পা কাটছে। আমি ভয়ে ঝোপঝাড়ের পথ দিয়ে আসতেই সে পথ আটকাল। ‘কল্যাণী, তুমি কি আমাকে ভালবাস না?’ কোন কথা বললাম না। ভয় পেয়ে কাঁদতে লাগলাম। সুমাদ হাত কেটে রক্ত দিয়ে আমাকে সাজাতে লাগল। রাম দৌঁড়ে বাসায় চলে গেল। ঘটি পড়ে গেল হাত থেকে। ওর গলা জড়িয়ে ধরলাম তবুও কোন কথা বললাম না। মনে মনে বলেছিলাম, হ্যাঁ, আমি তোমাকে ভালবাসি। আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে লাগল সারা শরীরে। আমি আবেগের বশবর্তী হয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে লতা পাতার মাঝে শুয়ে পড়েছিলাম। রক্ত সিঁদুর দিয়ে কপালে টিপ দিল--চুলের সিঁথিতে রেখা একে দিল। আমি ওর বুকে আবেগ ভরা হৃদয়ে খানিকক্ষণ মুখ গুঁজে রইলাম। সেদিন সময়ের কাছে আবেগ আর জীবনের পরাজয় হয়েছিল। মা এসে আমাকে নিয়ে গেল। সুমাদকে বকে গেল। আজ বুঝতে পারছি সেদিন হয়তো আমার গর্ভেই জন্ম দিতে চেয়েছিল বিশ্ব কাঁপানো মহাবিদ্রোহীকে। আজ সব বুঝি, সব...। ২১ তারিখের বিকাল বেলা। একটা ছেলে আমাদের বাসায় এসে দরজায় নক করছে। মা দরজা খুলে দিল।
-- কি চাই ?
--কল্যাণী দিদি আছে ?
-- কেন ? তাকে কেন ?
--এই চিঠিটা তাকে...।
মা চিঠিটা খুলে পড়তে লাগলেন। সব উল্টা করে লেখা। অতএব, মা কিছুই বুঝলো না। আমার মুখের উপর ছুঁড়ে দিয়ে বলে গেলেন, তোকে কোলকাতা পাঠিয়ে দেব অজয়ের কাছে। অজয় আমার মেজো মামা। আমি আয়নার সাহায্য নিয়ে চিঠি পড়তে শুরু করলাম--কল্যাণী, অনেক কষ্ট নিয়ে পরপারে চলে যাচ্ছি। দুঃখ, একটিবার বললে না, আমি তোমায় ভালবাসি। আমি আবার আসব। তোমাদের স্বাধীনতার জন্য যুগে যুগে আমি অবতীর্ন হব এ ভারতবর্ষে। বিশ্বাস করো, আমি হিন্দু নই, আমি মুসলমান নই, আমি সকল ধর্মের উর্ধ্বে। আমি তোমাদের এ কুসংস্কার সমাজের কেউ নই। আমার জন্মও কেউ জানে না, মৃত লাশও কেউ পাবে না। আমি সময়--আমি ’৫২--আমি স্মৃতি। তোমাকে বাংলাদেশ ভেবে ভালবেসেছি, অন্য কিছু নয়। সময়ের উজানে এসেছি--সময়ের ভাটায় চলে যাচ্ছি। না, পরাজয় নয় বরং জয় তোমার-আমার। এদেশকে একদিন নারীরাই শাসন করবে, সেবা করবে। আমি হয়তো সময়ের দৃষ্টি দিয়ে দেখব। তবু থাক না হয়--দু’তীরে দু’টি মন। হে কল্যাণী আমার, ঠিকানা আমার--মুক্ত আকাশ; বিন্দু থেকে সিন্ধু--সিন্ধু থেকে আবার বিন্দু। চিরবিদায়...।’
সন্ধ্যার পর বাবা তার ছাত্র মাহফুজ উল্লাহকে নিয়ে বাসায় আসলেন। মাহফুজ ভাই প্রায়ই আমাদের বাসায় আসতেন। তিনি কবিতা, গল্প লিখেন পত্র-পত্রিকায়। আমি সেই বিকাল থেকে কান্নার্ত চোখে শুয়েছিলাম। বিছানা থেকে উঠে দরজায় আসতেই মাহফুজ ভাইয়ের মুখ থেকে ছাত্র হত্যার ঘটনা শুনতে পেলাম। উনি বলতে লাগলেন, আগের দিন থেকেই একটা আশঙ্কা ছিল--আগামীকাল মারাত্মক কিছু ঘটে যেতে পারে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাষ্ট্র ভাষার দাবীতে কোন মিছিল হলে সরকার কঠিন ব্যবস্থা নিতে পারে। অবশ্য মিছিলের উপর গুলি বর্ষিত হতে পারে এমন আশঙ্কা আমার মনে ছিল না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাই ঘটলো। সংবাদ অফিসে থাকতেই শুনলাম, বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের অবস্থা খুবই খারাপ। ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে মিছিল শুরু হয়েছে, যে কোনো সময় মারাত্মক অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। আমি শংকিত চিত্তে আবার আজিমপুরের দিকে যাত্রা শুরু করলাম, সারা পথেই স্থানে স্থানে মানুষের জটলা। সবাই শংকিত, কি ঘটে না ঘটে। আজিমপুরে পৌঁছেই শুনলাম, মেডিকেল কলেজের মোড়ে পুলিশ ছাত্র জনতার উপর গুলি করেছে, বহু মানুষ তাতে মারা গেছে। এই খবর শুনে আমিও অন্যান্য মানুষের সঙ্গে দৌঁড়ে পলাশী ব্যারাকের মোড়ে গেলাম। তখন ভয়ে আমার হাত-পা সিঁধিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। এই শোকাবহ ঘটনার পরই মেডিকেল কলেজের দিকে অসংখ্য মানুষের যাত্রা শুরু হয়। এরই মধ্যে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ও আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ভবনে মাইক লাগিয়ে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত ও জ্বালাময়ী বক্তিতা শুরু হয়ে গেছে। শোকের গভীর ছায়া ছড়ানোর পাশাপাশি মাইক থেকে সংগ্রামের অগ্নি স্ফুলিঙ্গ ঝরে পড়ছে। জালিম মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে উচ্চারিত হচ্ছে প্রচন্ড ঘৃণা ও ধিক্কার। পলাশীর ব্যারাকের মোড়েই জনতার ভীড়ের মধ্যে মোহাম্মদ আজিজুল হকের সঙ্গে দেখা হল। সে মিছিলে ছিল। গুলি তার গায়ে লাগেনি। তবে ঐ গুলাগুলির পর সুমাদকে আজিজরা কেউ খুঁজে পায়নি। পরে আমি...।”
-- স্যার--
--হ্যাঁ, বল। না থাক, তুমি চা খাও। লক্ষ্মী-
--না স্যার, আমি আসি-
--সুমাদের কোন খবর পেলে-
-- আমি অবশ্যই আপনাকে জানাব
আমাকে দেখে বাবা মাহফুজ ভাইকে থামিয়ে দিলেন। কিন্তু আমি সব শুনে ফেলেছি। আমার মাথা ঘুরতে লাগল, বিছানা পর্যন্ত না যেতেই পরে গেলাম রামের গায়ের উপর। আমার আর কিছু মনে নেই।
সুমাদকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমি জানি, ওকে আর কখনও খুঁজে পাওয়া যাবে না। পৃথিবীতে অনেক কিছুই আছে, সময়ে আসে, সময়ে হারিয়ে যায় আর ফিরে পাওয়া যায় না। শুধু জানি, সুমাদকে আমি খুব ভালবাসতাম কিন্তু বলতে পারিনি। ভালবাসার শিকলে, সময় অথবা যৌবন কাউকেই বেঁধে রাখা যায় না। সময়ের কি লাশ হয়? হয় না? তাইতো সুমাদের লাশও হয়নি, সুমাদ সময়। সেই সময়টাকে সত্তর বছর ধরে হৃদয়ের হাজার ফুট গভীরে লুকিয়ে রেখেছি। এতদিন লুকিয়ে রেখেছিলাম নারী বলে। আজ আমি বৃদ্ধা। সকল বয়সের বাইরে আমার জীবন। জীবনের এই ভাদ্র বেলায়, সকল মানুষের কাছে সেই সময়ের করুণ সুর শঙ্খের আওয়াজে না হোক, বাঁশের বাঁশিতে বাজিয়ে দিলাম। সুর ভেসে যাক প্রত্যেক নারীতে-পুরুষে। হাজার মানুষের স্মৃতির ভীড়ে, এ স্মৃতি হোক সকলের আপন ।
৩য় পর্বঃhttp://www.somewhereinblog.net/blog/sswapa/30013234#comments
©somewhere in net ltd.