| নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সুম১৪৩২
আমি লিখি আমার দেখা, শোনা আর অনুভবের গল্প। কল্পনা আর বাস্তবের মিলনে গড়ে তুলি নতুন এক জগত। কলমে আমি হলো আমার একান্ত লেখা, শুধু আমার নিজের শব্দের ভুবন।
ভূমিকা:
১৯৭১ সালের এক গ্রামীণ উঠান।
বৃষ্টি পড়ছে, চাঁদের আলো ভিজে উঠানে মিলিয়ে যাচ্ছে।
এক পাগল, এক রাজাকার, এক মুক্তিযোদ্ধা—আর এক শিশু, যে জানে না তার মায়ের কবর কোথায়।
মূল গল্প
আসসালামুআলাইকুম স্যার
সালাম শুনেই সেলিম সাহেব কাগজটা এক পাশ কষে দিলেন। সালাম দেওয়ার দিকে তাকালেন—একটু বিরক্ত হয়ে , গোটা মুখে সেই অচেনা কৌতূহল মেশা অসহ্য ধৈর্যটা ছিলো। দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা হবে পঁয়ত্রিশ-চল্লিশের কোটায়, গায়ের রংটা একটু কালচে। সেলিম সাহেব গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, “কি চাই?”
লাফিয়ে উঠে উত্তর এল, “স্যার, আমার নাম মনু মিয়া। আপনাকে একটা গল্প বলবার চাই।”
সেলিম সাহেব একটু চেঁচে বললেন, “আমাকে কেনা শুনাতে চাও, অন্য কাউকে শোনাও। দেখছো না আমি খবরের কাগজ পড়ছি—এখন যাও, পরে এসো।”
গ্রামের বাড়িতে আসলেই এই এক ঝামেলা, কোথা থেকে না কোথা থেকে লোক চলে আসে, এসেই শুরু করে তোষামোদি, এর পর টাকা চাইবে। আরে ভাই সাহায্য লাগলে সরাসরি বলতে পারে, খালি পেচিয়ে বলে। মেয়ের জন্যই গ্রামে আসা লাগে, না হলে, কে আসে অজ পাড়া গায়ে । এএইসব ভেবে কাগজটা আবার কাছে টেনে নিলেন, আর পড়া শুরু করলেন।
বেশ কিছুক্ষণ খবরগুলোর দিকে চোখ বুলিয়ে, কাগজটা ভাঁজ করতেই হঠাৎ করে খেয়াল করলেন, মনু মিয়া দাঁড়িয়ে আছে। মনু মিয়াকে দেখে এইবার সেলিম সাহেব বেশ বিরক্তই হয়ে জিজ্ঞাসা করলো — টাকা লাগলে বলো, কিন্তু তোমার গল্প শুনতে চাই না।
মনু মিয়া শান্ত কণ্ঠে বললো, “স্যার, আমি আছি। আপনার যখন আমার গল্প শোনার মন চাইবে, তখন বলবো।”
সেলিম সাহেব একটু তীক্ষ্ণভাবে বললেন, “আমার কখন না কখন মন চাবে—তুমি এতক্ষণ অপেক্ষা করবে?”
মনু মিয়া নম্রতাসহ বললো, “জি স্যার, আমি আছি। স্যার, আমাকে কিছু খাইবার দেন—খিদা লাগছে।”
শুনে সেলিম সাহেব বুঝেই ফেললেন—গল্প টলপো না, আসলে নাস্তা পেলে পরে চাওয়া থাকবে টাকা, এরপর চলে যাবে । সেলিম সাহেব, আজিজ আজিজ করে জোরে ডাক দিলেন। আজিজ, ওই বাড়িটা দেখাশোনা করা মানুষটা—হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লো ঘরে।
আজিজ ঢুকে পড়তেই চিৎকার করে উঠলো, “ওই মনু, হারামজাদা! তুই কেমন করে বাড়িতে ঢুকলি? বাহির হো, কুত্তার বাচ্চা!”
সেলিম সাহেব রেগে আজিজকে বাঁধানো গলায় বললেন, “তুমি এইভাবে ওকে গালাগালি করছো কেন?”
আজিজ বললো, “স্যার, এই হারামজাদা পাগল—খালি বিরক্ত করে। নতুন লোক দেখলে তো আরোই বিরক্ত করে।”
এই কথাগুলো বলে দিলো—তারপর মনু মিয়ার দিকে একবার চেয়ে আবার চেঁচিয়ে উঠলো, “ওই তুই যাবি নাকি? লাঠি বাইরে করমু?”
মনু মিয়া বললো,
“ওই আজিজা, তুই এমন করোস কেন রে? আমাকে খাইতে দে—স্যার কয়ছে আমাকে এখানেই খাইতে।”
আজিজ চোখ লাল করে বললো,
“তোর স্যারের গুষ্টি কিলাই! তুইই...”
এর মধ্যে সেলিম সাহেব গলা উঁচু করে চেঁচিয়ে উঠলেন,
“আজিজ, তুমি কি বলছো এসব আবোল তাবোল কথা! ওকে খেতে দাও।”
সেলিম সাহেবের চিৎকার শুনে আজিজ থমকে গেল। মুখে ছেয়ে গেল কেমন একটা অনিচ্ছার ভাব। তারপর ধীরে, একটু কর্কশ গলায় বললো,
“ওই তুই আয় আমার লগে। তোকে খাইয়ন দিচ্ছি। খাওনের পর চইল্লা যাবি—স্যাররে কিন্তু আর বিরক্ত করবি না।”
আজিজের কথা শুনে মনু মিয়া মাথা নিচু করে তার পিছে পিছে বেরিয়ে গেল। তারা বেরিয়ে যেতেই সেলিম সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বুকের ভেতর যেন হালকা একটা ভারমুক্তি। তারপরই হঠাৎ মেয়ের কথায় রাগটা জেগে উঠলো— কেন যে ওর কথায় গ্রামে চলে এলেন! মেয়েটা একরকম বদলে গেছে—বর্ষা বা শীত এলেই গ্রামে না গেলে যেন তার শান্তি নেই।
এইবার ঠিক করলেন, আর গ্রামে যাবেন না। কিন্তু সিদ্ধান্তের খবর যেতেই মেয়ে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ। গ্রামে না যাওয়া পর্যন্ত এক বিন্দু পানিও মুখে তুলবে না। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েই আসতে হয়েছে এই অজ পাড়াগাঁয়ে।
বড় কষ্টের মেয়ে। মা-মরা। কয়েকদিন পরই তো অন্যের ঘরে চলে যাবে। তখন কে আর এমন করে আবদার করবে— এইসব ভাবতেই সেলিম সাহেবের চোখটা ঝাপসা হয়ে এলো।
কিছুক্ষণ পর ঘর থেকে বের হয়ে তিনি যা দেখলেন, তাতে বিস্ময়ে থমকে গেলেন। মনু উঠোনে বসে তৃপ্তি ভরা মুখে খাচ্ছে। আর তার মেয়ে পাশে বসে একমনে মনু মিয়াকে খাবার তুলে দিচ্ছে। দৃশ্যটা কেমন যেন অচেনা এক অনুভূতিতে ভরে দিল সেলিম সাহেবের বুক। মেয়েটা যতবার খাবার তুলছে, মনু মিয়া লজ্জায় না-না করছে। মুখে হাসির আভাস, তবু চোখে এক অদ্ভুত কোমলতা।
সেলিম সাহেব মনে মনে বললেন, “পাগল তো এমন ভদ্র হওয়ার কথা না।”
সেই মুহূর্তে এক অজানা কৌতূহল যেন বুকের ভেতর ঢেউ খেললো— ঠিক করলেন, ওর গল্পটা শোনবেনই।
ধীরে ধীরে মনু মিয়ার কাছে এসে নরম গলায় বললেন, “কি রে মনু , খাওয়া কেমন হলো? আমার মেয়ে নিজ হাতে রান্না করেছে।”
মনু মিয়া চুপ করে রইলো এক মুহূর্ত। তারপর নিচু গলায়, লজ্জিত মুখে বললো, “স্যার, খাবার অনেক ভালো হইছে। যেভাবে খাইয়া তুলতেছে, মনে হচ্ছে আমার মায়ে পাশে বসে খাওয়াচ্ছে।”
এই কথা বলেই মনু মিয়া চোখ মুছতে লাগলো।
সেলিম সাহেব হঠাৎই চুপ হয়ে গেলেন। বুকের ভেতরটা কেমন যেন নরম হয়ে গেল। ভেবে উঠতে পারলেন না— একটা পাগল মানুষ এত মায়াময়, এত করুণ কণ্ঠে কথা বলতে পারে কিভাবে!
সেলিম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
“তুমি থাকো কোথায়?”
মনু মিয়া মাথা নিচু করে বললো,
“পূব পাড়ার নদীর ধারে। ওইখানেই আমার ভিটে-বাড়ি।”
সেলিম সাহেব আর কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যাবেন, ঠিক তখনই আজিজ মুখ গম্ভীর করে বলে উঠলো,
“স্যার, এই হারামজাদার বাপ রাজাকার আছিল। কত মানুষরে যে মাইরা ফেলছে, গুইনা শেষ করা যাইবো না।”
আজিজের কথা শেষ হতে না হতেই মনু মিয়া হঠাৎই ঢুকরে কেঁদে উঠলো। চোখের পানি গাল বেয়ে পড়ছে, আর কাঁপা কণ্ঠে বললো,
“স্যার, আমার বাপে রাজাকার আছিল বলেই, গ্রামের মানুষ আমায় ঠিক মতো খাওন দেয় না। আমার জমি-জায়গা, শোবে চেয়ারম্যান নিয়া গেছে।”
সঙ্গে সঙ্গেই আজিজ আবার চেঁচিয়ে উঠলো,
“ওই কুত্তার বাচ্চা, জমি নেবো না তো কি করবে? তোর বাপ গ্রামে মানুষরে কত জ্বালাইছে, হারামজাদা! তোরে যে এখনো ভিটে-বাড়িতে থাইকা খাইবার দিসি—এইটাও মেলা! রাজাকার এর বাচ্চা, চ্যাটাং চ্যাটাং কথা মারে! হারামজাদা, খাইয়া বিদায় হ, স্যাররে বিরক্ত করলে তোকে এক্কেরে শেষ কইরা ফেলমু!”
মনু মিয়া কিছু বললো না। মুখটা নিচু করে বসে রইলো। সেলিম সাহেব এবার গলা ভারি করে আজিজকে ধমক দিয়ে বললেন,
“তুমি এমন ভাষা ব্যবহার করছো কেন আজিজ?”
উঠানে একটা নিস্তব্ধতা নেমে এলো। এর মধ্যেই সেলিম সাহেবের মেয়ে উঠে গেল— পায়ে চাপ দিয়ে জোরে জোরে হাঁটছে বাড়ির ভেতরের দিকে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, সে রাজাকারের ছেলের সঙ্গে এক মুহূর্তও বসে থাকতে চায় না।
এটা দেখে সেলিম সাহেবের বুকটা হালকা ব্যথা করলো। ভাবলেন—মনু মিয়ার বাবা রাজাকার ছিল, তাই বলে ওর সঙ্গে এমন আচরণ কেন? বাপের পাপ ছেলের ঘাড়ে চাপানো কি ঠিক কথা?
মনু মিয়া এদিকে খাওয়া শেষ করে চুপচাপ বললো,
“স্যার, আমার গল্পটা শুনবেন এখন?”
সেলিম সাহেব একটু থেমে বললেন,
“হ্যাঁ, শুনব। তুমি নদীর ঘাটে গিয়ে বসো, আমি আসছি।”
তারপর আজিজকে ডেকে বললেন,
“আজিজ, আমাকে এক কাপ চা দিও। চা খেতে খেতে মনু মিয়ার গল্প শুনব। আর ঘাটের ওই পাশে একটা চেয়ার দিয়ে আসো।”
মনু মিয়া ধীরে ধীরে নদীর ঘাটের দিকে চলে গেল। সেলিম সাহেব ঘরে ঢুকলেন, মেয়ের সঙ্গে কথা বলার দরকার ছিল।
দশ মিনিট পর সেলিম সাহেব ঘাটে এলেন। দেখলেন, মনু মিয়া চুপচাপ বসে আছে। সেলিম সাহেবকে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো।
চেয়ারে বসে সেলিম সাহেব নরম গলায় বললেন,
“চলো, শুরু করো তোমার গল্প।”
মনু মিয়া নিচু গলায় বললো,
“স্যার, গল্পটা শোনার পর একটা অনুরোধ করব আপনার কাছে। আপনি যদি পারেন, ওই অনুরোধটা রাখবেন।”
সেলিম সাহেব একটু হেসে বললেন,
“আগে তোমার গল্পটা শুনি দেখি, তারপর দেখা যাবে তোমার অনুরোধটা রাখা যায় কি না।”
মনু মিয়া মাথা নিচু করে বসলো। তারপর ধীরে ধীরে, ভাঙা গলায়, শুদ্ধ আর আঞ্চলিক ভাষা মিশিয়ে গল্পটা শুরু করলো— আর সেই কণ্ঠ শুনে সেলিম সাহেব অবাক হয়ে গেলেন। এই সরল, শান্ত মানুষটার ভিতরে এমন গভীরতা—তিনি আশা করেননি।
১৯৭১—আমার বয়স তখন তেরো। নদীর কোলেই আমরার ঘর; মেলা জমিজমা ছিল বাপজানের । ঘাটে দুইটা নৌকা বাঁধা থাকতো, গ্রামের মানুষ বাপজানকে খুব মান্য করে। যুদ্ধ শুরু হলো—আমরার গ্রামে তখনো মিলিটারি ঢুকেনি। গ্রাম থেকে সাত-আট জন যুদ্ধের পথে গেলো; যাদের মধ্যে কেউ আর ফিরে এল না।
একদিন রাতে বাপজান মায়েকে কইলো, “করিমুন, গ্রামে একটা শান্তি বাহিনী বানাতে হবে, যাতে মিলিটারি গ্রামে ঢুকবার না পারে।”
এই কথা শুনে মায়ের গলার রাগ উঠে এলো। সে বলল, “আপনে কি বলেন? গ্রামর বেডাইয়েন রা তো যুদ্ধে যায়, আপনি শান্তি বাহিনী বানাবেন? আপনার আল্লাহ দোহাই লাগে, এইসব কইরেন না।”
বাপজান হেসে বললেন, “অরে বিবি, তোর কি আমার উপর ভরসা নাই? আমি কী করুম—তুই পরে বুঝবি। তুই শুধু আমার লগে থাকবি।”
মায়ে গুমরুম কণ্ঠে বললো, “আপনে এইসব করলে আমি আপনার লগে থাকমু না; আমি আমার পোলারে লৈয়া চইলা যামু।”
বাপজান রাগ করে তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন, “তুই বেশি বুঝস, হারামজাদি। আমি শান্তি বাহিনীত যোগ দিবো —মুক্তি বাহিনীর সাহায্যের জন্য। তুই শুধু আমার লগে থাকবি।”
মায়ে একবার চুপ করে জিজ্ঞেস করল, “কেমনে?”
বাপজান নম্র হয়ে বলল, “এত কিছু তোর বুঝার দরকার নাই—তুই শুধু আমার লগে থাকিস।”
মায়ে সংকোচে বলল, “আচ্ছা।”
তখন বাপজান গ্রামের কয়েকজন বিশস্ত লোককে নিয়ে চলে গেলেন গঞ্জে—মিলিটারি অফিসে গিয়ে কথা বললো, আর গোটা গ্রামের থেকে যারা যেতে চায় তাদের নিয়েই শান্তি বাহিনী গঠন করলো। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে বাপজান মায়েরে কইলো, “বুঝলা করিমুন, এই মিলিটারি গুলো তো বলদ রকম—আমি তাগোরে বুঝাইছিলাম, আমরার গ্রামত কোনো মুক্তি বাহিনী নাই। ওই বলদ গুলো খুশি হইয়া আমাগো বললো—‘সাচ্ছা পাকিস্থানি’।”
এই কথা বলে বাপজান হেসে উঠলো; সাথে মায়ে হেসে উঠল। আমি তখন বাপজানকে জিজ্ঞেস করলাম, “বাপজান, আমরা কার পক্ষে?”
বাপজান কুঁচকে কণ্ঠে বললেন, “বাপরে, তুই অনেক ছোট, এইগুলা তুই বুঝবি না।
কিছু দিন পর, এক রাতে আমি ঘুমোচ্ছিলাম। হঠাৎ শুনতে পেলাম—গ্রামে যুদ্ধে যাওয়া সবাই আমরার বাড়িত আসছে । তাদের দেখে বাবার চোখে যে আনন্দের জোয়ার উঠল, মনে হলো আমরা যুদ্ধই জিতেছি। বাবা জোরে জোরে সবাইকে জড়িয়ে ধরছে, একেকজনের মাথায় হাত বুলিয়ে চোখ মুছছে।
তাদের নিয়ে আমার বাপজান বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেলো , একজন একজন করে কল পারে হাতমুখ ধুচ্ছে আর আমার মায়ে তাদের জন্য খাবার ব্যবস্থা করতে লাগলো। মনে হইসিলো বাড়িতে একটা উৎসব পরে গেসে। বাপজান সবাই কে খাবার বেড়ে দিছিলো , আর আমার মায়েরে কইলো “বুঝলা করিমুন, এই বার ওই জনোয়ারদের রক্ষা নাই, আমরার গ্রামের এরাই দেখবা , সবগুলোকে মেরে ফেলবো।” এইটা বলিই উনাদের দিক তাকিয়ে কইলো " কিরে বাপজানেরা পারবি না সব হারামজাদাদের খতম করতে "
তাদের মধ্যে এক লোক ছিল দক্ষিণ পাড়ার জলিল চাচা। বাবার কথাটা শুনে জলিল চাচা বললো, “তুমি আমরার লাইগা দোয়া কইরো—সবগুলো একবারে শেষ করবো।”
জলিল চাচার কথা শুনে , আমার বাপজান গর্বের সাথে বলে উঠলো " শাবাশ বাপের বেটা , হারামজাদারা এখনো বাঙ্গালীরে চিনস নাই , দেখবি এই বার মজা করে কয়। তুই কি বলিস করিমন "
বাপজানের কথা শুনে মায়ে কিছুই বললো না; বরং আরো হাসি ফুটে উঠলো, উৎসাহে সে তাদের খাওয়াতে লাগলো।
আমি ও বাপজানের মতো তাদের সেবা করছিলাম। তারা খাওয়া-দাওয়া শেষ করে উঠতে গেলো। মায়ে তৎক্ষণাৎ ভেতরের ঘর থেকে একটি পুঁতলি নিয়ে আসে—ভেতরে শুকনা মুড়ি, চিঁড়া, আর একটু গুড়ে নিয়ে । বলল, “শুনো বাপজানরা, এটাই নিয়ে রাস্তা-ই খাইয়া নিও।”
তারা বিদায় নেওয়ার সময় জলিল চাচা বাপজানকে কইলো —“আপনি যা করেছেন, সেটাও যুদ্ধ। কাইল রাতে তিন জন আসবে, তারা আপনাদের কিছু জিনিস দিবে; সেগুলো রাখিও। আর শুনো, কালকে লোকমান নামে একজন আসবে, তিনি শেখাবে মেশিনগান চালাতে—পরে আপনার কাজে লাগবে। হারামজাদার ওপর বিশ্বাস করা যায় না; আপনি শান্তি বাহিনী হও আর যাই হও, ওরা বাঙালির কাউরে বিশ্বাস করে না ।”
জলিল চাচার কথায় বাপজান হেসে বললো, “এইরকম বলদ ধরনের গাধা আমি আগে দেখি নাই; চিন্তা কইরো না, আমি সব সামলে নিব।”
জলিল চাচা বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলো। তারা চলে যাওয়ার পর বাপজানের চোখ থেকে পানি পড়লো; মায়ে চুপচাপ।
পরদিন রাতেও আরো পাঁচজন এলো। তারা ওখানেই খাওয়াদাওয়া করল, খেয়ে ওঠার পর আমার বাবার কাছে একটা বস্তা রেখে গেলো।
কিছুদিন পর পূব পাড়ার, কুদ্দুস চাচা আমরার বাড়িত আইসসা , হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বাপজান কে বলে, জাহিদ আর কিছু মিলিটারি তার মাইয়ারে ধইরা লয়ে গেছে। তুমি কিছু একটা করো আমার মাইয়ারে আইনা দাও।
কুদ্দুস চাচার কথা শুনে আমার বাপজান কইলো " কুদ্দস তুই চিন্তা করিস না আমি তোর মাইয়ারে নিয়ে আইতাসি , তুই আমরা ঘরোত বয় , আমি তোর মাইয়ারে নিয়ে আইতাসি "
এই টা বলে বাপজান বের হয়ে গেলো, সেই রাইতে গঞ্জে গেলো ভোরে আমার বাপজান কুদ্দুস চাচার মাইয়ারে নিয়ে আসলো । কুদ্দুস চাচা তার মাইয়ারে দেইখা, জরাইয়া ধইরা কাঁদতে লাগলো ।
বাপজান কুদ্দুস চাচ্চাকে গম্ভীর কণ্ঠে বললো, “কুদ্দুস, তুই আজই তোর মাইয়ারে নিয়া গ্রাম থেকে বের হয়ে যা, না হলে সামনে তোর আরো বিপদ আয়তে পারে।”
কুদ্দুস চাচ্চা কাঁদতে কাঁদতে কইলো, “আমি কই যাবো? আমার এই ভিটে-ভাটি ছাড়া ,তিন কূলে আর কেউ নাই।”
আমার মায়ে তখন বললো, “ভাইজান, তুমি আমার বাপের বাড়িত যাও—আমি আমার বাপজানরে একটা চিঠি লিখে দিতেছি।”
মায়ের লেখা চিঠিটা কুদ্দুস চাচ্চার হাতে দিলো; চিঠি নিয়ে কুদ্দুস চাচ্চা তার মাইয়ারে নিয়ে চলে গেলো।
এর পরদিন কুদ্দস চাচার লাশ পায় গেসে জংলায় , তার দুই পর তাঁর মাইয়ার কাপড় ছাড়া লাশ পায় গেসে নদীর পাড়ে। কুদুস চাচার মেয়ের লাশ দেখে আমার বাপজান , জাহিদ চাচারে হিরকম মাইর দিসে , জাহিদ চাচা আমার বাপজান এর পায়ে ধইরা কাঁদে আর কয় " ভাইজান আর করতাম না , আমারে ম্যাপ কইরা দেন "
আমার বাপজান কইলো " তুই আর আমরার গ্রামত থাকতে পারবি না , হয় তুই গ্রাম ছাড়বি নাহয় তোরে আমি মাইরা ফেলবাম "
তরপর থেকে জাহিদ চাচ্চার আর দেখা মিললো না—সে গায়েব হয়ে গেলো।
হের্ কিছু দিন পরে আমরার বাড়িত ৩০ জন মিলিটারি আইলো । আমার বাপজান, তাদের জন্য খাওন ও ব্যবস্থা করলো। খাসি জবাই দিল, চিকন চালের ভাত রান্না হলো। আমার মায়ে খাসি ছালুনে, একটু পর পর থুথু দেয় , আর ছানুল রান্দ্বে।
আমি মায়েরে কইলাম “ আমারে খাসি সালুন দিয়া ভাত দে, আমার ক্ষুদা লাগছে”
আমার মায়ে কইলো "এই সালুন দেওন যাইতো না, এইগুলি ইবলিশ শয়তানের ছালুন। আমার আব্বারে ইবলিশ শয়তানের ছালুন দিতাম না। "
আমি আবার মায়েরে কইলাম " তুই ইবলিশ শয়তানের রান্নার রান্দস কিল্লিগা "
মায়ের কইলো "কপাল রে বাবা কপাল"
রান্না শেষ হলে বাপজান ওদের খাওয়ালেন। খাওয়া দাওয়ার পর তারা জাহিদের কথা জিজ্ঞাসা করল। বাপজান মাথা নাড়ে বললেন, “তারে একটু দূরত গ্রামে পাঠাইসে , হে আইসা পড়ব , কিছু দিন পর।”
আমার বাপজান এর কথা শুনে একজন মিলিটারি বললো " জাহিদ বোহত কামাল আদমি হ্যায়, উসকে পাস বোহত লড়কিয়াঁ হ্যায়, তুম উসকো বুলাইও। "
আমার বাপজান কিছু বললো না। সাথে সাথে ওই মিলিটারি আমার বাপজান কে বলে " তুমহারি বিবি কা রান্না বোহত স্বাদ হ্যায়, বাদ মে আওঁগা। "
এই কথা শুনে বাপজান চুপ করে থাকলেন; মিলিটারি গুলো চলে গেলো।
ওই দিন বিকাল থেকেই হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল। সন্ধ্যার দিকে আট জন মুক্তিযোদ্ধা আমরার বাড়িত আসে। মায়ে তাদের খাওন দিলো , হেরার মধ্যে একজন এর অনেক জ্বর ছিল , একটু পর পর সে বমি করছিলো আর শুধু উলট পালট কথা কয় । বাপজান ওকে অন্য ঘরে শুইয়ে মাথায় পানি দিচ্ছিলেন, ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যে সাতজন চলে গেলো; তারা যেতেই আমার মায়ে ওই অসুস্থ মুক্তির গা মালিশ করছিলো।
ওই অসুস্থ মুক্তি একটু পর পর হের্ মায়ে রে খুঁজে, —“মা…।” আমার মায়ে বার বার বলছিল, ‘বাপজান, আমি আছি, আমি তোমার মা, তুমি ঘুমাও, ঠিক হয়ে যাবে।’ মায়ের যত্ন দেখে , আমার মন বিষম খারাপ হলো। আমি সেটা দেখে মায়ের দিকে রেগে গিয়ে বললাম, “আমি তো তোর পোলা—তুই কেন তারে নিজের পোলা কইলি ?”
আমার বাপজান হেসে বললো, ‘বাপ রে, যারা দেশের জন্য যুদ্ধ করছে, তাদের সকলের মা হচ্ছে তোর মা; আমিও তাদের বাবা। তুই হলি তাদের ছোট ভাই—বুঝলি বাপ?’
রাত বাড়তেই বৃষ্টি টা একটু জোরে ধইরা নামল। মেঘের ফাঁক দিয়া চাঁদের আলো ঢুইকা উঠানজুড়ায় পড়তেছিল—ভিজা মাটির গন্ধ, উঠান পুরা চুপচুপে। হঠাৎ জাহিদ চাচ্চার ডাক উঠলো উঠান থেকে—বাপজানকে ডেকে—বাপজান খানিক চমকে গেলেন। জানালা দিয়ে খেয়াল করল, কি জানি দেখলেন, তারপর আমার কাছে এসে বললেন, “পুতে, তুই পেছনের দরজা দিয়াই জঙ্গলে চলে যা—তাড়াতাড়ি।”
আমি কেঁপে উঠলাম, বললাম, “আমি কোথায় যামু, এই বৃষ্টির মধ্যে?”
এর মধ্যে আবার জাহিদ চাচা জোরে জোরে দরজা থাক্কা দিতে লাগলো , আমার বাপজান চিৎকার করে বলে উঠলো " ওই জাহিদ খাড়া আইতাসি "
এই টা বলে আমারে কইলো " বাপজান যাও, আমরার বড় বিপদ। "
আমার মায়ে আইসা জিজ্ঞাস করলো " কি হইসে "
বাপজান কইলো " জাহিদ কুত্তার বাচ্চা , মিলিটারি নিয়ে বাড়িত আইসে "
মায়ে কইলো " এখন কি হইবো "
বাপজান মাথা না ঘামিয়ে আরো জোরে বললেন, “পুতেকে পেছনের দরজা দিয়া জঙ্গলে পাঠাইয়া দে—আর তুই ওই পোলার কাছে দা দিয়া বেইছা থাক। আমি দেখি, ওই হারামজাদা কিচ্ছু বলিয়া বিদায় করতে পারি কি না ।
আমার মা আমাকে পেছনের দরজা দিয়ে ঠেলে দিয়ে দিল। আমি উঠান থেকে একটু দূরে গিয়ে গাছের আড়ালে লুকাইলাম—চাঁদের হালকা আলোয় সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। জাহিদ চাচ্চা দরজার কাছে দাঁড়ানো, আর একটু দূরে উঠানে সাতজন মিলিটারি।
বাবা দরজা খুলে জাহিদ চাচার সঙ্গে কিছু কথা বললেন; তারপর ঘরে ঢুকে গেলেন। জাহিদ চাচা মিলিটারি দের কাছে চলে গেল— একটু দূরে দাঁড়িয়ে তারা কথা বলছে। আমার মন বিষম ব্যাকুল—কী হবে জানি না।
কিছুক্ষণ পর হঠাৎই শুনলাম গুলির গুঞ্জন। আমার বাপজান, ওই মুক্তির মেশিং গান নিয়ে মিলিটারি দিকে তাক করে গুলি মারা শুরু করলো, আর চিৎকার করে বলছিলো " ‘কুত্তার বাচ্চা জাহিদ, তুই আমার বিশ্বাস নষ্ট কইরসোস —কুত্তার বাচ্চা… তোরে মাইরা ফেলব!” কথাগুলো বলেই গুলি চালালো —সবাই ছুটে ছুটে ছিটকে পড়লো। মাটিতে দুইজন মিলিটারি পড়ে গেলো। কিছুখন পর আবার গুলির শব্দ—এইবার মিলিটারির বুলেটে বাবা পড়লো। বাবা উঠানে পরে গেলো ।
মা দা হাতে দৌড়ে উঠিয়ে চিৎকার করে উঠলো, “কোন হারামজাদা এত সাহস —আমার বাড়িতে এসে আমার ওনাকে মারে!” বলেই উঠোনে নামতে নামতেই গুলির শব্দ আর মা উঠোনে গিয়ে মাটিতে নেমে পড়লো।
আমার মায়ে উঠানে পরে যাবার পর , মিলিটারি তাড়াতাড়ি চলে গেলো, একটু পর আমি দৌড় দিয়ে মায়ের কাছে গেলাম, যেয়ে দেখি আমার মায়ে, হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আর বৃষ্টির পানিতে মায়ের রক্ত বইয়ে যাচ্ছে। বিস্ম কষ্টে আমি চিৎকার করে মায়েরে জড়িয়ে ধরে কইলাম , ‘ওইই মা, আমারে খাইবার দে, বিষম ক্ষুধা লাগছে, আমারে খাসির চালুন দিয়ে খাইবার দে, তুই কথা কস না কেন।’
ঠিক তখনই কারো টর্চের আলো আমার ওপরে পড়ল। ভয়ে আমি ঝট করে উঠে, অন্ধকার জঙ্গলের দিকে দৌড়াইলাম—পায়ে কাঁচা মাটির গন্ধ, বৃষ্টির ভেজা পাতা খসখসে করলো, আর চাঁদের আলোর ফালি একটুও রইলো না।
আমি তো স্যার—পাগল , আমার বাপেও রাজাকার আছিল, তাই বলে কি আমি আমার বাপের আর মায়ের কবর দেখবার পারতাম না?
আমি জানি না আমার মায়ের আর বাপের কবর কোথায়। আপনি একটু মুক্তিযোদ্ধা জাহিদ চেয়ারম্যানকে বলেন—ওরা আমার বাপের আর মায়ের কবর কোথায় ফেলে দিল?”
মনু মিয়া কণ্ঠে সেই কাঁচা, ছেঁচানো রাগটা মেশালে বলল, “স্যার, আমার কোনো জিনিস লাগত না—শুধু আমার বাপ-মায়ের কবরটি দেখতে চাই। স্যার আমি পাগল না, ওরা আমারে পাগল বলে ”
এ কথাটা বলেই মনু মিয়া চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। ওর কাঁদার শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের ভেতর থেকে আজিজ আর সেলিম সাহেবের মেয়ে দৌড়ে ওঠে, ঘাটের দিকে ছুটে আসে।
ঘাটে এসে আজিজ মনু মিয়ার দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে , কিন্তু সেলিম সাহেব এর ভয়ে কিছু বলছে না।
সেলিম সাহেবের মেয়ে এসে দেখলো—তাঁর বাবার চোখ থেকে নীরবভাবে পানি গড়িয়ে পড়ছে। মেয়েটা বুঝল না, এই রাজাকারের ছেলের জন্য তার বাবার ভিতরে এত মমতা—কিসের জন্য……………..
২|
২৮ শে অক্টোবর, ২০২৫ রাত ৮:০১
সৈয়দ কুতুব বলেছেন: আপনি সামুর ধুমকেতু !
২৯ শে অক্টোবর, ২০২৫ বিকাল ৪:২৬
সুম১৪৩২ বলেছেন: ধূমকেতু হইলেও, আলোটা যেন কিছু মানুষের চোখে লেগে থাকে — এই কামনাই করি ভাই । ধন্যবাদ ভাই
৩|
২৮ শে অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১১:০২
dupur১২৩ বলেছেন: বোরো ভাই , লেখা তা এত বড় , একবারে পড়তে পারি নাই। দুই বারে পড়লাম। লেখা তা ভালো বলবো , তবে মোটামোটি হয়েছে। ২ টা পার্ট এ দিলে ভালো হতো
২৯ শে অক্টোবর, ২০২৫ বিকাল ৪:২৯
সুম১৪৩২ বলেছেন: yes, u r right omi , আমি আসলে বুজতে পারি নাই , পরবর্তী সময় খেয়াল রাখবো। কমেন্ট এর জন্য ধন্যবাদ bro
৪|
২৯ শে অক্টোবর, ২০২৫ বিকাল ৩:৩২
রাজীব নুর বলেছেন: চমৎকার।
২৯ শে অক্টোবর, ২০২৫ বিকাল ৪:৩০
সুম১৪৩২ বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই
©somewhere in net ltd.
১|
২৮ শে অক্টোবর, ২০২৫ বিকাল ৫:৪৫
সুম১৪৩২ বলেছেন: আমি লেখা টা একটু raw অবস্থাতেই পোস্ট করেছি । সময় করে পরে আরেকটু furnish করবো। লেখার ছোটখাটো inconsistency গুলো please ক্ষমার চোখে দেখবেন।
ধন্যবাদ সবাইকে