নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

স্বপ্নভেলার মাঝি...

সুপান্থ সুরাহী

কবিতার প্রেমে অক্ষরের সঙ্গে শুরু হয়েছিল ঘরবসতি। এখন আমি কবিতার; কবিতা আমার। শব্দচাষে সময় কাটাই...

সুপান্থ সুরাহী › বিস্তারিত পোস্টঃ

লাগ লাগ ভেলকি লাগ

২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:৫৮

লাগ লাগ ভেলকি লাগ


আঠারো বাড়ি রেলওয়ে স্টেশন। রাত বাজে বারোটা। বিদ্যুৎ নাই। প্লাটফর্মে মানুষ গিজগিজ করছে। সন্ধ্যা ছ’টার ট্রেন এখনো আসেনি। পরিবহন ধর্মঘটে সড়ক পথ বন্ধ। মানুষের শেষ ভরসা এখন ট্রেন। ভৈরবগামী ও ময়মনসিংহগামী যাত্রীরা রাজ্যের হতাশা নিয়ে বসে আছেন স্টেশনে। গা ছমছম করা অদ্ভূত অন্ধকার! প্লাটফর্মের দোকনীগুলোও বাতি জালাচ্ছে না। বাদাম, বরই, বুট, ডিম ইত্যাদি বিক্রেতা হকারদের টিমটিমে কুপি বাতিগুলোকেও বড্ড নিষ্প্রভ লাগছে। একটু পরপর শিয়ালের ডাক শিশু কিশোরদের মনে ভয়ের হুইসেল দিচ্ছে।

ট্রেন লাইনচ্যূত হয়েছে নীলগঞ্জে। গৌরিপুরের বুকাইনগরে লাইন তুলে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। একই বলে মরার ওপর খাড়ার ঘা। সব কিছু ঠিক হয়ে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হতে লাগবে ছ’সাত ঘন্টা। ততক্ষণে ভোরের আলো ফুটে ওঠবে।

মানুষ আরও আগেই হয়তো নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতো। পারেনি। একে তো ধর্মঘট; সেই সঙ্গে বেরসিক টিপটিপ বৃষ্টি। “আধুনিক যুগে মানুষের এতটা অসহায়ত্ব ভাবতেই পারছি না।” বললেন, একজন মধ্যবয়সী ভদ্রলোক। আশপাশের নির্জীব বসে থাকা মানুষগুলো যেন সোনা-রূপার জিয়ন কাটির স্পর্শে জেগ ওঠে। গিজগিজ মানুষের জায়গাতে গমগম মুখরতা থাকাটাই নিয়ম। তবে, আজকের রেলস্টেশনে হয়েছে তার উল্টোটা। মানুষের মুখে দেখা দিয়েছিল ভাষার অভাব! একটু আগে। এখন সবাই কথা বলতে শুরু হরেছে। কেউ সরকারের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধারে নেমেছেন। কেউ রেল কর্তৃপক্ষের বারোটা বাজাচ্ছেন। একটু আতেল টাইপ যারা, তারা বাঙ্গালী জাতির চারপুরুষের ঐতিহাসিক ভুলের খতিয়ান খুলে দিচ্ছেন। আলাপ মুখ থেকে মুখ হয়ে ছুটে চলছে এমাথা থেকে ওমাথায়। রাজনীতির প্রথম পাঠ নেওয়া যুবকটি পিণ্ডি চটকাচ্ছে পুঁজিবাদের। একটু বেশি মনোযোগ চাওয়া শিক্ষিত ছেলেটি বলছে, বুর্জোয়া রাজনীতি, শ্রেণি সংগ্রাম আর প্রলেতারিয়েত জনতার কথকথা।

নিজের লেখক সত্তা জাহির করার জন্য কথা বলছে একজন। তার বক্তব্যের শ্রোতাও বেশি। কোথায়, কবে তিনি সমাজের কোন অসঙ্গতি নিয়ে লিখেছিলেন তার ফিরিস্তি জানিয়ে দিচ্ছেন। তার কথা সবাই বিশ্বাস করছে এমনটাও মনে হচ্ছে না শ্রোতাদের মুখ দেখে। এই অবিশ্বাসটা সেই মধ্যবয়সী ধরে ফেলছেন। এখন তিনি তার, ঝোলা হতে নানা পত্রিকার কাটিং বের করে প্রমাণসহ কথা বলছেন। কিন্তু বিদ্যুৎ না থাকায় তার প্রত্রিকার কাটিংগুলো বুঝা যাচ্ছে না। একজন সে দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে কোত্থেকে যেন একটা টর্চলাইট যোগার করে নিয়ে আসছেন। লেখক ভদ্রলোকটির উৎসাহ বেড়ে গেছে। দেশের নানাবিধ সমস্যার জন্য তিনি কর্পোরেট সভ্যতাকে দায়ী করছেন। বেশ ভাল একটা মজমার মত জমে গেছে। স্টেশনের সব মানুষের দৃষ্টি এখন এই লেখক ভদ্রলোকের দিকে। তিনি এখন বেশ জনপ্রিয় নেতার মত বক্তব্য দিচ্ছেন-

“দেখুন, কর্পোরেট কুলাঙ্গাররা আমাদের জীবন থেকে সব সুখ হরণ করেছে। আমাদের মধ্যে চাহিদা উত্থান ঘটিয়ে লোভী বানিয়ে দিয়েছে। ক্ষুদ্র যত ব্যাবসা বাণিজ্য আছে সব এখন বড় বড় কর্পোরেট হাউজগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে। সেজন্যই আমাদের ক্ষুদ্র-কুটির শিল্পগুলো মার খেয়ে গেছে। তাই আমরা এখন সবাই শহর মুখো। শহরে না গেলে ভাত জুটে না। এই ধরুন, একসময় মফস্বলে ছিলো মোমের কারখানা, কলমের কারখানা, কয়েলের কারখানা, লজেন্স বানানোর কারখানা। সেখানো কাজ করতো গ্রামীণ শ্রমিকরা। এখন এইসব পণ্যের উৎপাদক হয়ে গেছে বড় কোম্পানিগুলো। সেজন্যই আমাদের আজকের এই অসহ্য দীর্ঘ অপেক্ষা।” তিনি আশপাশে চেয়ে দেখেন মানুষের সমর্থনের আশায়। কয়েকটি যুবক চিৎকার করে ওঠে ‘ঠিক’ বলে। তিনি আরো কিছু বলতে চাইছিলেন। এমন সময় পূর্ব দিক থেকে একটি তীব্র আলো এগিয়ে আসতে দেখা যায়।

আলোটা দেখে সবার মধ্যেই একটা ভয়ের শিহরণ নেমে আসে। ডাকাত আসছে এমন একটা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে পুরো প্লাটফর্মে। নারী-শিশু, কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে শুরু হয় চাপা কান্নার গমক। যুবকদের মধ্যে দেখা যায় প্রতিরোধের একটা প্রস্তুতি। পুরো স্টেশন একটা কারবালা হতে যাচ্ছে। এরই মধ্যে একদল অবিবেচক বলাবলি করছে, আঠারোবাড়ির ডাকাতরা খুব ভয়ঙ্কর হয়। এরা লুটতরাজ এর সঙ্গে মানুষকে অনর্থক মারধোর করে। সমাজের একদল লোকই আছে যারা কখনই মানুষকে আশাবাদি করতে ও শান্তনা দিতে পারে না। সবসময় মানুষকে হতাশ করে আর ভয় দেখায়। এরা সব জায়গায় থাকে। আছে স্টেশনেও।
কারো হাত গুটানো দেখে মুরুব্বীগোছের কেউ আবার বলছেন, “খালি হাতে ডাকাতের মোকাবিলা করাটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। স্টেশনে জিআরপি পুলিশ আছে। চলো পুলিশের কাছে খবর দেই।” আশাপাশের অনেকেই মুরুব্বীর কথায় সায় দেন। পুলিশ ফাঁড়ির মধ্যে গিয়ে দেখা যায় দু’জন মাত্র কনস্টেবল আছে। বাকিরা কোথায়, তারা বলতে পারে না। আরে ভাই, স্টেশনে ডাকাত আসছে। আপনাদের কোন দায়িত্ব নাই? একজন যুবক চিৎকার করে বলে।
- এ্যাই পুলা এত গরম দেখাস কেন? বেশি ভাব ধরলে তোরেও ডাকাতি মামলায় হান্দায়া দিমু। বলে কনস্টেবল।
- দেখেন আপনি আইনের মানুষ। এভাবে কথা বলতে পারেন না। আপনি একটা দায়িত্বশীল মানুষ। এত এত মানুষ স্টেশনে আটকে আছে। একটা বিপদ আসন্ন। আপনাদের কাজ হলো জনগণের নিরাপত্তা দেওয়া। আপনারাই যদি হুমকি দেন তাহলে আমরা কোথায় যাবো। বললেন, লেখক ভদ্রলোক।
পুলিশ ফাঁড়ির চারপাশে মানুষের ভিড় জমে গেছে। লেখকের কথায় সেই কনস্টেবল কিছু একটা বলতে চাইলে পাশের পুলিশটি তার কানে কানে কী জানি বলে। সে আর মুখ খোলে না। পাশের পুলিশটি বলে, চলুন আমরা পুলিশ জনতা সবাই মিলে প্রতিরোধ করি। তার কথায় সবাই সায় দেয়। কথা ঠিক! কথা ঠিক!! একটা রব ওঠে চারদিকে।

আলোটা অনেক্ষণ ধরেই আসছে। ক্রমশ বড়োও হচ্ছে। প্রায় আধা ঘন্টা ধরেই আসছে। মানুষের ভেতর ভয় আর উদ্বেগের ধুকপুকানি বাড়ছেই। কেউ কেউ স্টেশন মাস্টারের কাছে যাচ্ছে তাদের টাকা পয়সা ও অলঙ্কারগুলো মাস্টারের পাশের বসায় জমা রাখতে। ‘বিপদের সময় মানুষের বিশ্বাস কি আসলেই বেড়ে যায়? না হলে স্বাভাবিক অবস্থায় সম্পদ দিয়ে রেলস্টেশনে কাউকে বিশ্বাস করার কোন কারণতো নেই আমাদের দেশে!’ বললেন একজন প্রবীণ। স্টেশন মাস্টার পড়ছেন উভয় সঙ্কটে। কী করবেন বুঝতে পারছেন না। মানুষের টাকা-অলঙ্কার রাখবেন? নাকি পারবো না, বলে ফিরিয়ে দিবেন! এমন সময় মাথায় তার বুদ্ধি আসে। আরে আপনাদের মোবাইল ফোন নাই? পুলিশ ফাঁড়ি তো রায়বাজারেই। একটা ফোন দেন। চার মিনিট লাগবে। পুলিশ আসতে। কিন্তু দু:খের বিষয় হলো, কারো মোবাইলেই চার্জ নেই। এমনকি স্টেশন মাস্টারের মোবাইলেও নেই। টেলিফোন লাইন কবে যে নষ্ট হয়েছে তার কোন হিসেব মাস্টার নিজেও রাখেন না।

লেখক সাহেব এইবার হেসে ওঠলেন। তার হাসি দেখে সবাই রেগে গেলো। স্টেশন মাস্টার বললেন- আরে ভাই, আপনি লেখক মানুষ কিন্তু মানুষের এই বিপদে আপনি হাসতেছেন!
- আসলে এমনিতেই হাসি চলে এসছে। কারণও একটা আছে। দেখুন, বিজ্ঞান যতই উন্নত হচ্ছে, ততই মানুষ অসহায় হয়ে যাচ্ছে। আজকে যদি হন্টন যুগ থাকতো। এই মানুষ এতক্ষণে নিরাপদে তার ঘরে ফিরে যেতো। যদি বিদ্যুৎ না থাকতো তাহলে সবাই নিজ নিজ ব্যস্থায় আলো জ্বালাতো। যদি সাদাকালো মেবাইলের যুগ থাকতো তাহলে কারো মোবাইলই চার্জের অভাবে বন্ধ হতো না। এন্ড্রয়েডের যুগ এসে যেমন ভেলকি লাগিয়ে দিয়েছে। তেমনি মানুষকে কিছুটা অসহায়ও করে দিয়েছে। অবশ্য শহরে হলে সবাই একস্ট্রা পাওয়ার সেভার রাখতো। কিন্তু সেই সন্ধ্যা থেকে মোবাইলই চিলো সবার সঙ্গী। যে কারণে স্টেশন ছিলো শান্ত। যেই মোবাইলগুলো চার্জের অভাবে বন্ধ হয়ে গেলো। এমনিই সবাই আবার কথায় জেগে ওঠলো। ঠিকাছে, আমার সেই নুহু যুগের মেবাইলটাই নিন! থানায় একটা ফোন করুন। বলেই তিনি পুরনো আমলের মেবাইলটা বের করে দিলে। যেটার চার্জ থাকে তিনদিন পর্যন্ত।

লেখকের কথায় সবাই কেমন যেন নড়েচড়ে ওঠলো। আবারো একটা ফিসফিসানি বাতাসে। সবাই বলছে আসলে লেখক মানুষ তো। সব দিকেই খেয়াল রাখেন। কেউ আবার নেতিবাচক ভাবলো, বললো- নিজেকে জাহির করার জন্য মানুষ কতকিছুই তো করে! আর লেখকদের একটা বড়ো অংশই জনপ্রিয়তাকাতর। অবশ্য, বেশ কয়েকজন তাকে বললো, রাখেন মিয়া আপনের ফাউ প্যাঁচাল। পুরো ইস্টিশনে একটা মেবাইলও জীবিত নাই। সেই সময় তিনি সাহায্য করলেন; আর আপনে তাকে নিয়ে বাজে কথা বলেন!

লাগ লাগ ভেলকি লাগ! বুড়া মাইনষের আডুত লাগ! পুলাপানের চউক্ষ লাগ! মাইয়া মাইনষের কপালে লাগ... বয়স্ক অনেকেই মৃদু হেসে তাকায় আওয়াজের উৎসের দিকে। কিশোর-কিশোরিরা হকচকিয়ে যায়। শহুরে নারীরা ভয়ে সিঁটিয়ে যান। স্টেশন মাস্টার বলেন, আর ফোন করার দরকার নেই। ইস্টিশনে চলে এসেছে মনা জাদুকর। আপনাদের কোন সমস্যা নেই।
- আরে যাদু দিয়ে কি ডাকাত ফিরবে। এসব কি বলছেন! স্টেশনে এতএত মানুষ নিজেদের নিরাপত্তা সংকটে ভুগছে। আর আপনি বলছেন কোন বেটা জাদুকর চলে এসেছে! সমস্যা নাই। আসলে আপনার মাথায় সমস্যা আছে মনে হয়। বললো একজন যুবক।
- আরে বাবা! পুরো কাহিনী শুনে তারপর রাগ দেখাও। এত রেগে গেলে তো চলবে না। রেগে গেলে তো হেরে গেলে!

আরে! একজন স্টেশন মাস্টার এত ধৈর্য দেখাতে পারে! এত সুন্দর করে কথা বলতে পারে! দেশ আসলেই এগিয়ে যাচ্ছে। একজন বুড়ো মতো মানুষের কণ্ঠে এই কথা শুনে সবাই তাঁর দিকে তাকায়।
- আপনারা যে আলোটা এতক্ষণ দেখছেন সেটা মনা জাদুকরের হ্যাজাকের আলো। মনে হয় স্টেশনে এত মানুষের সারারাতের অপেক্ষার খবর শুনে জাদু দেখাতে চলে এসেছে। আসলে ডাকাত-ডুকাত নেই।

স্টেশন মাস্টারের কথায় সবার গলায় জমে থাকা শুকনো শুকনো অনুভূতিটা কমতে শুরু করে। তবুও কারো কারো সন্দেহ দূর হয় না। কিন্তু স্টেশনের উত্তর দিকের খালি জায়গায় তাকিয়ে সবারই মনে নেমে আসে স্বস্তি। যখন স্টেশন মাস্টারের কামরা হতে অভিযোগকারী দলটা বের হয়ে আসে; তখন পুরো স্টেশন জুড়ে একটা শান্তি শান্তি আবহাওয়া বয়ে চলছে। চকিত মানুষের মন থেকে ভয়-ডড়-উদ্বেগ উধাও।

হ্যাজাক লাইটের আলো আর মনা জাদুকরের কথার জাদুতে সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। জাদুকর বলতে থাকে। “গত আট-দশ বছর আগেও আমি এই স্টেশনে নিয়মিত জাদু খেলা দেখাতাম। এখন পারি না। এখন খেলা দেখায়া পেট চলে না। মানুষ আইজকাইল ইস্টিশনে আইসা বইসা থাকে না। বাস আছে, সিএনজি আছে। চলে যায়। যাগোর রেলগাড়ি ছাড়া উপায় নাই। তাগোর আছে মোবাইল। ইস্টিশনের দোকানগুলোতে আছে টেলিভিশন। কার ঠেকা পড়ছে আমার মত এই গেরাইম্যা জাদুকরের খেলা দেখার! এইসব ভেলকিবাজির এখন কোন দাম আছে? টেলিভিশন খোললেই দেখা যায় দুইন্যার বড় বড় জাদুকরের জাদু। কম্পিউটারে খেলা যায় কত রকমের খেলা। আমার নাতি কয়, ‘দাদা! তোমার জাদুর থিকা আমার কাছে আরো বড় জাদু আছে। তুমি কি ভেলকি লাগাইবা! আসো আমি তোমাকে ভেলকি দেখাই’ আমি তার কাণ্ডকারখানা দেখে সত্যিই ভেলকি খেয়ে যাই। আরে! রং নাই, কলম নাই, খাতা নাই তবুও সে লেখে, ছবি আঁকে! আমি পুরাই টাস্কি খায়া যাই! সে কম্পিউটারের টেলিভিশনে গাড়ির খেলা দেখায়। আমি বেক্কল হইয়া যাই। কইনছেন আপনারা, এইসব মজার মজার খেলা রাইখ্যা কে যায়- মনা জাদুকরের মান্দাতা আমলের জাদু দেখতে?” মনা জাদুকর চার পাশে তাকায়। মানুষের উত্তরের অপেক্ষা করে।
- আরে! আপনি আজকে আমাদের খেলা দেখাবেন। আমরা আপনার খেলা দেখবো। আমরা সারা জীবন জেনে আসছি ক্যানভসার, স্ট্রিট মেজিসিয়ান, আর ফেরিওয়াদের কাছ থেকে কেনাকাটা করে তাদের সাহায্য করি। কিন্তু আজকে আমরা দেখতে পাচ্ছি আপনি একজন স্ট্রিট মেজিসিয়ান আমাদের সাহায্য করছেন। আপনার এই হ্যাজাক লাইটের আলো আমাদের দীর্ঘ অন্ধাকারযাপন থেকে রক্ষা করলো। আপনার জাদু খেলা আমাদের সময় কাটাতে সাহায্য করবে। আপনাকে ধন্যবাদ। বললেন লেখক সাহেব।
- আমি যখন আমার ছেলের কাছে শুনলাম, আজ সারা রাত ইস্টিশনে মানুষ থাকবে। কারো কোথাও যাওয়ার সুযোগ নাই। তখন হ্যাজাকের খোঁজে বাইর হইলাম। হ্যাজাক কি আর পাওয়া যায়! চার্জ লাইট আর কারেন্টের কারণে গ্রামেও এখন আর কেউ হ্যাজাক রাখে না। তার পরও আমার পুরান একটা ও মাতবর সাবের একটা। এই দুইটা জ্বালায়া চলে আসলাম আপনাদের একটু মজা দিতে। আবার আন্দাইরটাও কাটাতে। তাইলে শুরু হয়ে যাক...

মনা জাদুকর মনে করতে পারছেন না, শেষ কবে এত মানুষের সামনে জাদু দেখিয়েছেন। গ্রাম্য, শহুরে, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, কিশোর-কিশোরি, নারী-পুরুষ সব মিলিয়ে তিনি বেশ মজায় আছেন। হাতের সঙ্গে সঙ্গে তার মুখও চলছে। কে, কোথায়, কবে তার জাদু দেখে প্রশংসা করেছিলো। কবে, কোথায়, কে তাকে পুরষ্কার দিয়েছিলো; সব বর্ণনা করছে। তার বর্ণনার মধ্যেও জাদু আছে। আবার চিরাচরিত অভ্যাস মতো বলছে, যদি কেউ তার যাদু নষ্ট করতে চায়, তাহলে তার বারোটা বাজিয়ে দিবে। হাতে কয়েকটি লাউ বিচি দেখিয়ে বলছে, যদি কেউ আমার খেলায় কোন গণ্ডগোল পাকাতে চেষ্টা করে; তাহলে সে এই লাউ বিচিগুলো এখানেই মাটিতে লাগামু! পাঁচ মিনিটের মধ্যে গাছ হবে। দশমিনিটের মধ্যে লাউ হবে। সেই লাউ তার হাতের ছুরি দিয়ে এক কোপে দুই টুকরো করবো। তার পর সেই বাছাধনও দুই টুকরা হয়ে যাবে। যে আমাকে জাদুর মধ্যে প্যাঁচ লাগাবে। তাই, জিনি জাদু জানেন, তিনি চুপ করে দেখবেন। আর যিনি সূরা ইয়াসিন জানেন তিনি দয়া করে এই খেলার মধ্যে সেই সূরার কোন আয়াত পাঠ করবেন না।” যদিও সে জানে আজকে কেউ তাকে চ্যালেঞ্জ করবে না। তবুও জাদু মানেই তো কিছুটা অতিপ্রকৃত অনুভূতি। কিছুটা ভয়। কিছুটা শিহরণ। সেটা তারা শুরুতেই কথার মায়জালে অনেকটাই বাড়িয়ে নেন। কথা শেষ করেই মনা জাদুকর তার জোলা থেকে একটা বল বের করলো।

বলটা দেখিয়ে সবাইকে বললো এটা কী দেখছেন? সবাই সমস্বরে চিৎকার করে বললো, ‘বল’। বলেই সবাই অবাক! বল বলে শেষ করেই তাকিয়ে দেখে এটা একটা ছাগলের বাচ্ছা হয়ে গেছে। আবার ম্যাঁ ম্যাঁ শব্দও করছে। ততক্ষনাৎই আবার ছাগলের বাচ্ছাটা নাই হয়ে গেছে। মনা জাদুকর কান্না শুরু করে দিয়েছে। প্রথমে প্রথমে সবাই এটাকে মজা ধরলেও একসময় সবাই ভয় পেয়ে যওয়ার মতই কান্না শুরু করে দিয়েছে। দর্শকরা সবাই অবাক। যখন সবাই নিশ্চিত হয়ে গেছে মনার কিছু একটা হয়েছে। তখনই লেখকের জোলার ভেতর ছাগলের বাচ্ছাটা ম্যাঁ ম্যাঁ করে ওঠলো। মনা দৌড়ে গিয়ে লেখককে বললো, আরে! আপনে তো আমার চেয়ে বড় জাদু জানেন। আমার ছাগল আপনি নিয়ে লুকিয়েছেন আপনার ব্যাগে। উপস্থিত সবাই শব্দ করে হেসে ওঠলো। করতালিতে চারপাশ মুখরিত হলো! লেখক বললেন, আরে! এটা কী হলো। ছাগল আমার ব্যাগের মধ্যে কেন?
- স্যার, শুধু আপনার ব্যাগের মধ্যেই না। আরো অনেকের ব্যাগের মধ্যেই আমার জিনিস চলে গেছে। আমার হাত ঘড়িটা কে নিয়েছেন? তাড়াতাড়ি বের করে দেন। বললো, মনা।

কিন্তু কেউই কথা বলছে না। এমন সময় জাদুকর একজন মধ্যবয়ষ্ক মহিলার ভেনিটি ব্যাগ খুলতে বললো। মহিলা তো রাগে লজ্জায় অস্থির। কোন মতেই তার ব্যাগের চেইন খোলবে না। এমন সময় মনা বলে, ঠিকাছে। আমি বের করছি। তখন মনা তার ঝোলা থেকে একটা পাখির বাচ্ছা বের করে। বলে যা পাখি আপার ব্যাগ থেকে আমার ঘড়ি বের করে নিয়ে আয়। ওমনি পাখি ওড়ে আসে। ভেনিটি ব্যাগের কাছে। সবাই অবাক হয়ে দেখে ব্যাগের ভেতর থেকে জাদুকরের ঘরি বের হয়ে আসছে স্বংক্রিয়ভাবে। আবার তুমুল হাততালি। এভাবে প্রায় কয়েকঘন্টা চলে মনার জাদু। হঠাৎ স্টেশনঘরের ঘন্টা বেজে ওঠে। মানুষ নিজ নিজ গন্তবের জন্য ওঠে দাঁড়ায়। মজমা ভেঙ্গে যায়। প্রতিটা কিশোর কিশোরির মুখে মুখে চলতে থাকে, লাগ লাগ ভেলকি লাগ! বুড়া মাইনষের আডুত লাগ! পুলাপানের...

অনতি দূরে দেখা যায় লেখক সাহেব মনা জাদুকরের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করেছেন।



গল্পটি বাংলানিউজটুয়েন্টিফোরে প্রকাশিত...

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:১৬

শায়মা বলেছেন: ভাইয়া কতদিন পরে
অনেক ভালো লাগা ভাইয়া।

২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:০১

সুপান্থ সুরাহী বলেছেন: হ্যাঁ, অনেকদিন পরপরই আসি।
ধন্যবাদ জানবেন আপু...

২| ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:২০

অন্ধবিন্দু বলেছেন: লেখায় ভেলকি আছে। মজা পাচ্ছিলুম। শেষটা খুব পরিচিত।

আপনাকে ধন্যবাদ, সুপান্থ সুরাহী।

২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:০৪

সুপান্থ সুরাহী বলেছেন: মনোযোগী পাঠের জন্য সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ।

আপনাকেও ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন সবসময়...

৩| ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:৪২

হাসান মাহবুব বলেছেন: পরিস্থিতিটা ইন্টারেস্টিং ছিলো। তবে শেষটা মনঃপুত হয় নি।

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:০১

সুপান্থ সুরাহী বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ জানবেন। আপনার এই সমালোচনা আমার বড় প্রাপ্তি। কোন সাজেশনস দিলে ভাল হতো...

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.