নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কবিতার প্রেমে অক্ষরের সঙ্গে শুরু হয়েছিল ঘরবসতি। এখন আমি কবিতার; কবিতা আমার। শব্দচাষে সময় কাটাই...
ঈশ্বরথেরাপি
গভীর রাত। দিনের মুখরতা থেমে রাতের নিরবতা ঝেঁকে বসার কথা। আমাদের এই তল্লাটে নেমে এসেছে হাহাকার আর তীব্র আর্তনাদ। রাতের নিরবতা এখন আমাদের কাছে ইতিহাস। অবশ্য কেউ কেউ মুখর আনন্দে আছে। এরা ভীষণ ধৈর্যশীল। আমাদের তল্লাটে এরা ভিন্ন মানুষ। এরা নির্ঘুম-নির্মোহ থাকে। নির্ভার থাকে। এদের ক্ষমতা দেখে নিজেকে অসহায় মনে হয়। ভীষণ অসহায় মনে হয়। মনে হয় আমি হয়তো অসামাজিক। অথবা ঠিক যুগে আমার আগমণ হয়নি! পরক্ষণেই দেখি, আমার মত অনেকেই নিজেকে অসহায় মনে করে। অনেকেই সময়কে বেয়াড়া বলে, যুগের বাতাসকে নিয়ন্ত্রণহীন ভেবে নিজেরে ভেতর নিজেই গোমরে মরে। নতুন আলোর প্রত্যাশায় প্রতিটি রাতের কোলে নিজেকে সঁপে দেয়। হাহাকার আর গমকপূর্ণ রাত একসময় শেষ হয়। কিন্তু রাতের অন্ধকার শেষ হয় না। আলোর আগমণ হয়ে থাকে সুদূরপরাহত।
বলছিলাম রাতের হাহাকার আর আর্তনাদের কথা। হ্যাঁ আমাদের তল্লাটে চোখ মেললেই রাত আলোকিত হয়। কান পাতলেই সেই আলোর ভেতরের আর্তনাদ আর হাহাকার শুনা যায়। আমরা ভীষণ ভয় পাই। আমরা আমাদের অনাগত প্রজন্মের জন্য একটা আগুণের তাওয়া দেখতে পাই। একটা কঠিন জীবনের আগমণধ্বনি আমরা শুনতে পাই। এসব কারো কাছে বলতে পারি না। কেউ আমাদের পাত্তা দেয় না। আবার আমরা যারা এই তল্লাটের দুঃখ-সুখের সঙ্গে একাকার হয়ে যাই; আমারা খুবই দুর্বল। কিন্তু আমাদের ভেতরে আগুন আছে। প্রেম আছে। সাহস আছে। তবুও আমরা মিশে যাই। কোথায় মিশে যাই? সেই মুখর আনন্দে থাকা, নির্বিকার-নির্ঘুম থাকা আমাদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে। আমরা তাদের সঙ্গে খেলতে পারি না। এই তল্লাটে আমরা খেলতে আসিনি। এসেছি একটা মহান উদ্দেশ্য নিয়ে। সেই উদ্দেশ্যের কথাও বলতে পারি না। কোত্থেকে যেন আমাদেরকে আতেল, বিলাসী, সেকেলে ও শত্রু বলে পরিচয় করিয়ে দেয়। ‘কোত্থেকে যেন!’ কেন বললাম? কারণ, কারা আমাদের সুন্দরকে অসুন্দরে রূপান্তর করে সেটাও জানি। বলতে চাই না। বলি না। কীসের যেন ভয়। কীসের যেন আড়ষ্টতা। ওদের সঙ্গে সহাবস্থানের তীব্র একটা আকর্ষণ। তীব্র একটা মোহ। হৃদয় থেকে ভেসে আসে ওরা তোমাদের ভাই। ওদেরকে শত্রু ভেবো না। আমরা ওদের কথা বলতে পারি না। অথচ ওরাই আমাদের ওপর সতত কাঁচা-পাকা মিথ্যা চাপিয়ে দেয়। আমরা ঠিক থেকেও বেঠিক হয়ে যাই। দেখুন! আমি এখনো ওদের পরিচয় বলতে পারছি না। আসলে আমাদের ভেতরে ভয় আছে। ভয়ের কার্যকরণও আছে...
এই দেখুন! কী শুরু করেছি। বলতে চেয়েছিলাম রাতের হাহাকারের কারণ, আর্তনাদের কারণ। কিন্তু শুরু করে দিলাম যাপিত জীবনের কাসুন্দি। থাক! আপনাদের বিরক্ত না করে বলেই ফেলি। আসলে আমাদের তল্লাটে একটা রোগী আছে। ওর পুরো দেহে অসুখ। কেবল ত্বকটা দিব্যি সুস্থ। এই ত্বকটা নিয়ে সেই রোগীটা জীবনের চারযুগ চার বছর পারি দিয়ে ফেলেছে। এই ত্বকের জোড়েই আমাদের এই তল্লাটে একটা মানচিত্র দখল করে রেখেছে এখনো। সেই রোগের কারণেই মানচিত্র দখল করতে হয়েছিল তার। দখল প্রক্রিয়ায় তার রক্তক্ষরণ হয়েছিল ঢের। আপনাদের না বললে বুঝবেন না! সেই রক্ত একটা সাগর ধারণ করতে পারবে না। অথচ রোগীটা নিজেই পুরোটা রক্ত দিয়েছিল। সেই রক্ত দিতে দিতেই তার ভেতরে আরেকটা রোগ বাসা বাঁধে। প্রাথমিকভাবে এই রোগটাকে কেউই তেমন পাত্তা দেয়নি। দিনে দিনে সেই রোগটা ঝেঁকে বসেছে তার ভেতরে। এখন তার ভাষা বদলে গেছে। তার আচরণ বদলে গেছে। আসলেই কি তার ভাষা ও আচরণ বদলে গেছে? ঠিক তা না। তার অবিভাজ্য অঙ্গের কার্যক্ষমতা বদলে গেছে। তার ভেতরে ‘অসংখ্য’ হয়ে গেছে সে নিজেই।
এখন আমরা দেখতে পাই তার অসুখের কোন খবর নেই। নিজেকে নিয়ে এখন আর সে ভাবছে না। বরং আমারা দেখতে পাচ্ছি, সে তার নিয়ন্ত্রিত অঙ্গের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে। নিজেকে এখন আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সে। পারবেই কেমনে? সে নিজেই তো রুগ্ন। আসলে ক্রমশঃ নিজেকে আরো অসুস্থ করে তুলছে সে। আমরা তার কোন চিকিৎসা করতে পারছি না। আমরা তার ধারে কাছেই যেতে পারি না। যদিও তার খুব আপনজনকে কোন বিষয়ে পরামর্শ, উপদেশ অথবা অনুরোধ করতে যাই। তাহলে কত রকমের যে হেনস্তা হই। কখনো কখনো আমাদের বলা হয় তোমরা এই তল্লাট ছেড়ে চলে যাও। তোমাদের মত এত সাধু-সন্ত আমরা হতে পারবো না। যদিও আমরা কেউই সাধু-সন্ত না। আমরা সবাই এই তল্লাটের। আমরা সবাই মানবিক মানুষ। তবুও ওরা আমাদের সাধু-সন্ত বলে। কেন বলে? কারণও আছে। আমাদের এসব বললে, মানবিক মানুষ থেকে আমাদের দূরে রেখে আরেকটা প্রজাতি বানানো যায়। অতঃপর খুব দ্রুতই আমাদের বাক্সবন্দি করা যায়। ওরা বলুক। আমরা আমাদেরসহ ওদের আপন করতে চাই। আমাদের প্রতি ওদের মানবিক অনুভূতির উত্তরণ চাই। যদিও অতীতের ইতিহাস বলে, সেটা অসম্ভব। “আচ্ছা! আপনি কেন বার বার ‘ওরা’ ‘ওরা’ করছেন?” কেউ একজন আমাকে প্রশ্ন করে। আমি বুঝতে পারি না। আমি কেন ‘ওরা’ ‘ওরা’ করছি। ওরা কারা? এখানেই কেউ ওরা নেই। সবাই আমরা। মূলত, আমরা বলে এই তল্লাটের সবাই ‘আমরা’ হতে চাই। যাক ‘ওরা’ কেউ নেই। সবাই আমরা। আসুন আমরা আমাদের রোগীটা নিয়ে কথা বলি।
কিন্তু এতকিছুর পরও আমরা এই রোগীটাকে ভুলতে পারি না। এর প্রতি মমতা ত্যাগ করতে পারি না। মনে হয় এই রোগীটা একান্তই আমার। আমিই রোগী। এই রোগীর জীবনের সঙ্গে আমার জীবন জড়িয়ে আছে। রোগীটার অবস্থার ক্রমশ অবনতি মানে আমারই অবস্থার অবনতি। আমরা কোথাও যেতে চাই না। আমাদের কোথাও যাওয়ার যায়গা নেই। যদিও অনেকেই আমাদের প্রানাধিক রোগীটার রোগ বাড়াতে চায় কেবল এই তল্লাটটা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে। কিন্তু আমরা কোথাও যাবো না। আমরা এই রোগীটাকে সুস্থ করতেই এই তল্লাটে থাকবো। একদিন না একদিন আমরা সুযোগ পাবোই এর চিকিৎসার। অবশ্য আমারা চিকিৎসার সুযোগ না পেলেও দুঃখ নেই। রোগিটা সুস্থ হলেই হলো।
“আপনি কী শুরু করলেন? সেই কখন বললেন, গভীর রাতের কথা। এখনো গভীর রাতের কাহিনী বলেননি। শুধু এদিক সেদিক কথা ঘুরাচ্ছেন!” আমি একটা অদৃশ্য ধমক স্পষ্ট শুনতে পাই। “দেখুন, কারো প্রিয় কেউ রোগী থাকলে তার মাথা কি ঠিক থাকে। আমার মাথাটা আসলেই আলোমেলো হয়ে গেছে।” বললাম আমি। “হুমম! আপনারা পারেনও। একজন আরেকজনরে দোষ দিয়ে দিব্বি রোগীটারে এড়িয়ে যাচ্ছেন। রোগীটার ভেতরে দগদগে ক্ষত এখন স্পষ্ট। অথচ আপনাদের দোষাদোষি এখনো থামলো না। রোগীটার জীবনটা অসংখ্য দুঃখের ফোল্ডারে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠছে। তার ভেতরে হাজারো বিভাজিত ভাইরাসের আক্রমণ। দেহের প্রতিটা অঙ্গ এখন একটা আরেকটার শত্রু হয়ে ওঠছে। অসংখ্য অগ্নিশিখা তার ভেতরটা পুড়ে ছাই করছে। আর আপনারা আছেন কে কাকে দোষী বানাতে পারবেন সেই ডার্টিগেমে। ছিঃ আপনারা এই অপরুপ তল্লাটের মালিক কীভাবে হলেন! সেটা আমার কখনই বুঝে আসে না।” অদৃশ্য আওয়াজটা বললো। কিন্তু আমাকে আর কোন কথা বলতে বারণ করলো। বললো, “তোমার মুখে প্রচ- দুর্গন্ধ। আমার সঙ্গে আর কতা বরবে না। যদি বেশি বকবক করো তাহলে তোমাকে বোবা বানিয়ে দেবো। তার আগে কেবল বল, রাতের কথা কী বলতে চেয়েছিলে?” আমি অনেক কিছু বলতে পারতাম। কিন্তু, কথায় জিতে যাওয়া আর বাস্তবে জিত থাকা এক নয়। তাই চুপ করলাম। বললাম রাতের কথা যথা সময়ে বলা হবে। অদৃশ্যে আর কোন আওয়াজ শুনতে পেলাম না।
০২.
যে রোগীটা নিয়ে আমি কথা বলছি। তার কোন চিকিৎসা হয়নি সেটা বলা যাবে না। আবার রোগীর অবস্থা অনুযায়ী চিকিৎসা হয়েছে সেটাও বলা যাবে না। অপরদিকে রোগীর ইচ্ছায় চিকিৎসার কোন সুযোগ যেহেতু নেই। সেজন্য রোগীও তার চিকিৎসক নির্বাচন করতে পারেনি কখনই। অথচ তার চিকিৎসা করতে বহুজন বহু পথে তার কাছে এসছে। বহু উপায়ে চিকিৎসা করতে চেয়েছে। কেউই সফল হতে পারেনি। কেউ কেউ সফলতার মুখ দেখেতে চেয়েইে রোগির ভাইরাসে নিজেই সংক্রমিত হয়ে নিঃশেষ হয়েছে। কেউ রোগীকে ওভার ডোজ দিয়ে রোগীর আঘাতে হারিয়ে গেছে কালের পাতায়। কিন্তু এই দুর্দান্ত ক্ষমতাধর ও লড়াইপটু রোগীটা নিজেকে কেবল ত্বকের সুস্থতা দিয়ে ঠিকিয়ে রেখেছে আমাদের এই তল্লাটে। এ এক আশ্চর্য ও দুর্দান্ত দুঃসাহসের গল্প। এই রোগীর বাস্তব জীবন নিয়ে সিনেমা হলে পৃথিবীর সব প্রেক্ষাগৃহে সুপার-ডুপার হিট হতো। কেবল তার মানচিত্র দখলের রক্তক্ষরণের কাহিনীই পৃথিবীকে নির্বাক করে দিয়েছিল।
এই পর্যন্ত তার চিকিৎসা করতে এসে দুজন ডাক্তার জীবন হারিয়েছেন। একজন ধুকে ধুকে বেঁচে আচেন। যিনি ধুকে ধুকে বেঁচে আছেন আর প্রতি এই রোগীর অভিশাপ আছে মনে হয়। তিনি এই রোগীকে বাঁচাতে অনেক অনেক তল্লাট ঘুরে সাহায্য এনছেন। কিন্তু এই সাহায্য রোগীর নানা অঙ্গ অচল করতে ব্যবহার করেছেন। অপর দিকে তিনি রোগীর চিকিৎসা না করে নিজের আর্দালি, কম্পাউন্ডার, আয়া, বুয়া, দেহরক্ষি, রক্ষিতাসহ নানা চাটুকারের পেছনে খরচ করতেন। ফলে রোগির অভিশাপে সেই ডাক্তার পতিত হয়েছেন পৃথিবীর সকল রোগীর কাছ থেকে। এখন আর তিনি চিকিৎসক নন। কেবল ভাড়ের অভিনয়ে বিনোদিত করতে চাচ্ছেন জগত সংসার। তবে, ‘অভাগা যে দিকে তাকায় সাগর শুকায়।’ তার ভাড়ামোতে এখন কেউ আর বিনোদন পায় না। পায় কেবল জীবানু আর জীবানু।
আরো দুজন ডাক্তার চিকিৎসা করছেন ঘুরেফিরে। রোগীর অবস্থার কোন বদল হয়নি। রোগী ক্রমাগত রোগের ভাইরাসে প্রবল হচ্ছে। সুস্থতায় না এগিয়ে রুগ্নতার দিকে এগুচ্ছে। ওফফ! আপনাদের বলাই হয়নি। এই রোগীর কিন্তু আরেকটা ক্ষমতা আছে। সে তার রোগের প্রভাবে প্রভাবশালী হতে পারে। এবং কখনো কখনো আমাদের তল্লাটের সবাইকে রুগ্ন করে দিতে পারে। প্রতিভাবান দু’জন ডাক্তারের চলমান চিকিৎসায় রোগী এখন নেতিবাচক ক্ষমতা অর্জন করছে। আমাদের তল্লাটের পুরো অবয়বকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। হিংস্রতার আগুন আর ফাঁপা চিৎকারের দুর্গন্ধ আমাদের জীবনকে বিষিয়ে তোলছে। আমরা ক্রমশঃ রোগে ও রোগীতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। নতুন ডাক্তারে কোন খোঁজ নাই। সব নয়া ডাক্তার অতীতের ইতিহাসকে সামনে রেখে নিরাপদ অবস্থানে আত্মগোপন করছে। রোগীটা স্থবির হয়ে আছে। অথচ এমন ঘোর অমানিশার সময়ে ডাক্তারে ডাক্তারে শুরু হলো রায়ট! হতভাগা আমি এখন কোথাই যাই?
আবারো আমরা থেকে বেড়িয়ে আসতে হলো আমার। ‘ওরা’ নিয়ে কিছু বলতে হচ্ছে। আমরা যখন ঘোর অমানিশা দেখতে পাচ্ছি। রোগীর দেহের স্থবিরতা দেখতে পাচ্ছি। তারা তখন ব্যর্থ পুরোনো ডাক্তারকেই আবার চিকিৎসায় আনতে চাচ্ছে। অথবা গতবার ব্যর্থ ডাক্তারকেই তার ব্যর্থ সহযোগীসহ আনতে চাচ্ছে। যে সহযোগী নিজেকে নিখাঁদ বললেও তার ভেতেরে খাঁদের অভাব নেই। আমার সিক্সথ সেন্স দেখতে পারছে যে, রোগীর স্পিরিচুয়াল পাওয়ার বুঝে গেছে। তার জীবনে এখন গভীর রাতের অমানিশা। রোগী আমাদের ডাকছে। আমরা পারছি না, পুরনো ডাক্তারের দাপটে সামনে যেতে। রোগীর অভিশাপে আমরাও এখন পুড়ে যাচ্ছি। ক্ষমতা হারাচ্ছি অনুভবের। হয়ে যাচ্ছি লিলিপুট। ডাক্তারগুলোকে বানাচ্ছি গালিভার। আমাদের তল্লাটের প্রতিটা প্রতিবেশে ও শুন্যে ঝুলে আছে আমাদের জন্য ধিক্কার। আমরা এখন নিজেকে অপরাধি ভাবলেও একদল ‘ওরা’ ঠিকই চেহারায় চিকনাই ধরে রেখেছে অভিনব কুশলতায় অথবা নিপুন অভিনয়ে।
০৩.
আমি, মানে ‘আমরা’র প্রতিনিধি। পালাতে চাচ্ছি। আসলে তল্লাট ছেড়ে নয়। রোগী ছেড়ে নয়। আমার কর্তব্য থেকে। আমার বিশ্বাস থেকে। আমার অবস্থান থেকে পালাতে চাচ্ছি। কিন্তু! কোথায়? নিজেরে ভেতরেই নিজে একটা খোলস বানিয়ে লুকিয়ে ফেলবো নিজেকে! আমার একটু শান্তির প্রয়োজন। এত এত চাপ আমি নিতে পারছি না। কেন যেন সব ‘আমরা’ হঠাৎ করেই আমি হয়ে গেছি। আর পারছি না। এখন আমাকে লুকাতেই হবে। আমি আমার ভেতরেই লুকাবো, যেখানে কেউ নেই আমার অবস্থান বলে দেওয়ার। আমি গেলাম... “না তুমি যেতে পারবে না। তোমার বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার জায়গাটাকে আরেকবার নক করে দেখো।” আমি আবার গম্ভীর একটা আওয়াজ শুনতে পাই।
_ কে? কে?? একটা দীর্ঘ জিজ্ঞাসা ছুড়ে দেই অদৃশ্যে।
_ আমি তোমার ঈশ্বরের প্রতিনিধি। তোমাকে দিয়ে বিশেষ একটা কাজ নেওয়া হবে। দ্রুত তৈরি হও। হ্যাঁ, কেমনে তৈরি হবে? সেটাই বলছি। শোন। কেবল নিজেরে আত্মাকে সকল লোভ লালসা থেকে রক্ষা করো। এটাই তোমার প্রস্তুতি।
_ আমি আজীবন লোভ লালসা থেকে পবিত্র। তুমি যা বলবে, বলতে পারো। অবশ্য আমার একটা প্রশ্ন আছে।
_ কী সেই প্রশ্ন?
_ আমাকে যে কাজের জন্য বলা হবে তাতে কি আমার করা না করার স্বাধীনতা থাকবে?
_ না। ঈশ্বরের নির্দেশে কোন প্রশ্ন করার সুযোগ থাকে না। অবশ্য তিনি চাইলে দিতে পারেন। তবে আজকে তুমি কোন স্বাধীনতা পাবে না। তবে তোমাদের রোগীর চিকিৎসার জন্য তোমাকে এই কাজটা করতেই হবে। এবং তুমি এটাতে সানন্দেই রাজি হবে।
আমি আনন্দ চিত্তেই রাজি হলাম। একটা আশার আলোক দেখতে পেলাম। আমার তল্লাটের সেই পুরনো রোগীটা হয়তো এখন সুস্থ হয়ে ওঠবে। আমাদের রাতগুলো আর হতাশার ও হাহাকারের থাকবে না। রাতের মোহনীয় নিরবতা আমরা এখন উপভোগ করবো জমিয়ে। মনের মধ্যে এক চিকন শিহরণ বয়ে যাচ্ছে।
আমাকে প্রথমে বলা হল। আমাদের তল্লাটের সব সাধু-সন্ত ও সন্নাসীকে ডেকে আনতে। যেহেতু আমার কোন প্রশ্ন করার অধিকার নাই। সেহেতু আমি ছুটতে চাইলাম। প্রতিনিধি বলল, ‘কোথায় ডেকে আনবে?’ আমি চুপ করে রইলাম। তিনি আবার বললেন, “নদীর ওপারে বিজন চরে নিয়ে আসো সবাইকে। অবশ্য অনেকেই প্রশ্ন করবে। আসতে চাইবে না। তখন তুমি তাদেরকে বাধ্য করার ইচ্ছে করবে। সঙ্গে সঙ্গে বাধ্য করার ক্ষমতা পেয়ে যাবে।” আমি ছুটলাম। এবং কোন বাধা বিপত্তি ছাড়াই সবাইকে চরে নিয়ে আসলাম।
এরপর আমাকে আমাদের তল্লাটের সব অলি-বুজর্গ, গাউস-কুতুব, আলেম-উলেমা, পীর-মুর্শিদকে ডেকে আনার নির্দেশ দেওয়া হলো। ঈশ্বরের কথা শুনে তারা কেউই আর কোন প্রশ্ন না করেই চলে আসলো। তারপর একে একে ফকির, বাউল, পুরোহিত, নান, ব্রাহ্মণ, যাযক, কবি, সুশীল সবাইকে ডেকে আনার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু গোল বাধল, সুশীল সমাজ ও কিছু কবিদের ক্ষেত্রে। তারা আমাকে পাত্তা দিতেই চাইলো না। বরং আমাকে অপমান-অপদস্ত করতে চাইল। অবশেষে আমি আমার ক্ষমতা প্রয়োগ করলাম। অল্প সময়ে সমাজের বিশেষ শ্রেণির সবাইকে একত্রিত করতে পারার জন্য তিনি আমাকে ধন্যবাদ দিলেন। বললেন, ‘তোমার কাজ শেষ। চলে যাও।’ মন খারাপ করতে যাবো... ঠিক এমন সময় অদৃশ্য কণ্ঠ ভেসে এল। “আমার আজকের এই বিশেষ সাক্ষাৎকারে জাবেদ আজকের আহুত প্রজাতির কোন একটা না হয়েও থাকবে।” চরের মধ্যে দেখলাম অল্পক্ষণের মধ্যেই একটা মায়াজগত তৈরি হয়ে গেল।
আশ্চর্য হয়ে দেখলাম। সবচেয়ে সুন্দর জায়গাটাতে কবি আর সুশীল সমাজ দখল নিয়ে লাগিয়ে দিল। একটু পর দেখলাম চারপাশেই সেই দখল কসরত। হেসে ওঠলাম। ঈশ্বরের অনাগত ধমকের কথা কল্পনা করে। তাই হল। ঈশ্বরের ধমক দিয়ে সবাইকে থামিয়ে দিলেন। কিন্তু কী আশ্চর্য! এখন কেউ আর সংঘবদ্ধ নেই। ছড়িয়ে ছিটিয়ে নানাজন নানা জায়গায় বসে গেল।
ঈশ্বরের কণ্ঠ ভেসে এল। “তোমরা সবাই তোমাদের তল্লাটের রোগীটার চিকিৎসা করবে। রাজি?” চারপারশ থেকে গুনগুন আওয়াজ শুরু হয়ে গেল। ঈশ্বর আবার ধমক লাগালেন। সবাই থেমে গেল। আমি দেখলাম আমাদের তল্লাটের সব মানুষই এখনো ‘শক্তের ভক্ত আর নরমের যম’ই আছে। একটু পর ঈশ্বর একজন একজন করে জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু দেখা গেল, কেউই আমাদের তল্লাটে কোন রোগী আছে; সেই কথা স্বীকার করতে চাইছেন না। ঈশ্বর আবার ধমকে ওঠলেন। এবার সবাই কিছুটা নরম হলো। বলতে লাগলো রোগীর কথা। রোগীর রোগের জন্য একেকজন একেকজনকে দায়ী করতে লাগলো। শুরু হয়ে গেল হট্টগোল। কেউ বলছেন এসব পীর ফকিরেরাই আমাদের এই তল্লাটের রোগীর অনুস্থতার দীর্ঘসূত্রতার জন্য দায়ী। এবার একে অন্যকে দোষারোপ শুরু হয়ে গেল। ঈশ্বর দেখলেন এদরেকে সাইজ দিতে হবে। এছাড়া এদের দীর্ঘ চর্চিত স্বভাবের বিপরীতে কোন কাজ কারানো যাবে না।
তিনি এবার একজন একজন করে অদৃশ্যে নিয়ে যেতে থাকলেন। কিন্তু কেউই আর ফিরে আসছে না। দেখে অনেকেই পালাতে চাচ্ছেন। কিন্তু এই ক্ষমতা কাউকেই দেওয়া হয়নি। একে একে ঈশ্বর সবার সাক্ষাৎকার শেষ করলেন। সবাই আবার মাঠে ফিরে আসলো। এতক্ষণে যারা এতগুলো মানুষের ফেরত না পাওয়ার চিন্তায় ব্লগ লেখা বা মিছিল করার প্ল্যান করছিল তাদের দেখে মনে হল বেশ মনক্ষুণ্ন হয়েছেন। আবার আরেকদল মনক্ষুন্ন হয়েছেন একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে বলির পাঠা বানাতে পারার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেছে দেখে। এরা অবশ্য আমাদের তল্লাটে যে কোন ঘটনার তদন্তের মোড় ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে অলটাইম উস্তাদ।
ঈশ্বর এবার রোগীর চিকিৎসার জন্য দায়িত্ব দিতে চাইলেন। ঐক্যতানে সবাই দায়িত্ত নিতে রাজি। কেউ কেউ তো ঔষধ পথ্যের নাম বলতে শুরু করে দিয়েছে। ডাক্তার না হয়েই। এবার দায়িত্ব নিতে সবাই হট্টগোল শুরু করে দিল। ঈশ্বর বললেন, যে বা যারা দায়িত্ব নিবে তারা তাদের দেহের একটা অংশ রোগীকে দান করতে হবে। দান করার পাঁচ বছরের মধ্যে তার মৃত্যু হবে কে কে রাজি আছো? এবার কেউই আর কথা বলে না। ভেতরে ভেতরে ফিসফাস চলতে থাকে। ঈশ্বর দেখলেন কেউই কোন কথা বলছে না। তিনি রেগে যাবেন। এমন সময় তিনজন কবি ওঠে দাঁড়ায়। বলে, “আমাদের প্রাণের চেয়ে প্রিয় এই রোগীর জন্য আমার একটা অংগ না পুরোটাই দিতে চাই।”ঈশ্বর খুশি না বেজার হলেন বুঝা গেল না।
মাত্র দশ মিনিট পরে আমি দেখলাম মাঠে কয়েকজন কবি ছাড়া কেউ নেই। ঈশ্বর ঘোষণা দিলেন, “তোমাদের আত্মকেন্দ্রিকতার জন্য তোমাদের সবাইকেই আমি প্রত্যাহার করলাম। আমার এই সুন্দর তল্লাট থেকে।” একটু দূরে তাকিয়ে দেখি সবাই মাটির নিচে সমাহিত হচ্ছে... ঈশ্বর গম্ভীর কণ্ঠে বলছেন। “তোমাদের আর এই তল্লাটে থাকার যোগ্যতা নাই। রুগীর সঙ্গে থেকে থেকে তোমরাও রুগী হয়ে গেছে। কিন্তু তোমাদের কোন ক্ষমতা নেই। কেবল অক্ষমতা ছাড়া। ’ কবিদের মধ্যে মাত্র তিনজনকে বাঁচিয়ে রেখেছেন তিনি। আমাকে দেখিয়ে তাদের বললেন, “যাও এর সঙ্গে গিয়ে নতুন করে শব্দের চাষ করো। শব্দের ক্ষমতায় তোমাদের রুগী ভাল হয়ে ওঠবে।
০৪.
বাইরে এসেই দেখি। বর্তমানে আমাদের এই তল্লাটে রোগির চিকিৎসক হতে চাওয়া দু’জনকেই আমাদের রোগির ভাইরাস আক্রমন করেছে। সেই আক্রমণের প্রভাবে দিকবিদিক শূন্য হয়ে তারা ধেয়ে আসছেন আমাদের দিকে। কবিত্রয় জ্ঞান হারালেন। আমি অন্য জগত হয়ে এসে, আপনাদের কাছে এই কাহিনী বর্ণনা করলাম।
১৩. ০৩. ২০১৫
০৭ ই জানুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৩:২৭
সুপান্থ সুরাহী বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ। গল্পটি কী কারণে যেন নির্বাচিত পাতায় যায়নি। তবুও আপনি খোঁজে পড়েছেন।
আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
২| ০৭ ই জানুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ২:৫২
প্রোফেসর শঙ্কু বলেছেন: দেশ ও দেশের ভেতরে বিভাজন এবং নানান কাল্পনিক সমাধান আর বিদ্রূপের কথকতা রুপকের মাধ্যমে উঠে এসেছে।
২ এর প্রথম লাইনে - 'যে রাগীটা নিয়ে আমি কথা বলছি।' ঠিক করে নেবেন।
০৭ ই জানুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৩:২৯
সুপান্থ সুরাহী বলেছেন: অনেক অনেক ধন্যবাদ।
হ্যাঁ আপনি ঠিকই ধরেছেন। রূপকাশ্রয়ী কিছু একটা লিখার চেষ্টা ছিল।
ঠিক করে দিয়েছি।
৩| ১১ ই জানুয়ারি, ২০১৬ ভোর ৫:১২
হাসান মাহবুব বলেছেন: সমাজের পরতে পরতে রোগ, বিশিষ্ট রোগীরাই কি ঈশ্বরের আশীর্বাদপুষ্ট? এ এমন এক সমাজ, যেখানে রোগীদের ত্বকে অঙ্কিত মানচিত্রে লুকিয়ে থাকে স্বদেশ। তারা যে অসুখের আবাদ করছেন, তাতে শব্দেরা শবদেহ হয়ে যায়, ডাক্তারদের আয় রোজগার বাড়ে,আর সুচেতনা মারা যায়। অতঃপর সবাই একদিন কবি হবে, আর তাদের রচিত শব্দের ধুম্রজ্বালে রোগীটি ভীষণ কেশে সবাইকে গালাগাল করবে এক লক্ষ অন্ধকার রাত্রি। সে ঘটনা বলার কেউ কি থাকবে?
ইদানিং আপনার লেখাগুলো বেশ নিরীক্ষাধর্মী হচ্ছে, বক্তব্যে বহুমাত্রিকতা থাকছে। স্বাগত জানাই।
১২ ই জানুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ২:৪৯
সুপান্থ সুরাহী বলেছেন: এই গল্পটি নির্বাচিত পাতায় যায়নি। আমি বুঝিনা আমার প্ররিশ্রমী এবং আশাবাদি একটা পোস্টওও নির্বাচিত পাতায় যায় না। কী কারণ?
খুব আহত হয়ে সামুতে আসতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। আপনার এই মন্তব্যের পর কিছুটা মন ভাল হয়ে গেছে। ধন্যবাদ প্রিয় হামা।
©somewhere in net ltd.
১| ০৭ ই জানুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১:৩১
কান্ডারি অথর্ব বলেছেন:
লেখক স্বত্বা আসলেই ঈশ্বর প্রদত্ত।