নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কবিতার প্রেমে অক্ষরের সঙ্গে শুরু হয়েছিল ঘরবসতি। এখন আমি কবিতার; কবিতা আমার। শব্দচাষে সময় কাটাই...
ছবি: নিজের করা ক্যালিগ্রাফির ডিজিটাল ফাইল।
সাইফ সিরাজ
শিরোনামে ত্রিমুখী শিক্ষাধারার কথা লেখা আছে। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষাধারা আসলে কতোমুখী- সেইটে একটা বড় গবেষণার বিষয়। যদিও প্রকাশ্যে তিনটি ধারা আমরা দেখি; তবুও প্রতিটি ধারায় আবার তৈরি হয়েছে একাধিক উপধারা। তিনটি ধারায় মৌলিকভাবে তিনটি মনস্তত্বের মানুষ তৈরি হচ্ছে আমারদের সমাজে। সেই তিন সমাজের ভেতরে তৈরি হচ্ছে আরও ভিন্ন মনস্তত্বের মানুষ। চিন্তা, অভ্যেস, সামাজিক আচরণ, দায়িত্ববোধ, দেশপ্রেম, ভাষাপ্রেম, নেতা আদর্শ, ধর্মীয় আদর্শ, ধর্মের অনুসরণ, ধর্মীয় বিভাজন ইত্যাদির প্রতিটি সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং বাণিজ্যিক যোগাযোগের আলাদা আলাদা বোধের মানুষ তৈরি করছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা।
এই যে আলাদা বোধ, আলাদা চৈতন্য, আলাদা সামাজিক অবস্থান কিংবা অর্থনৈতিক অসাম্য তা কি সমাজে বিশেষ কোন বিভাজন কিংবা কমপ্লেক্স তৈরি করছে? এসব ফ্যাক্ট কি সমাজিক হীনমন্যতাবোধের কারণ? এতোসব চিন্তা-শিক্ষা-বোধগত বৈপরিত্য কি একটা কল্যাণ রাষ্ট্র তৈরিতে আমাদের পিছিয়ে দিচ্ছে? ঘুষ, দুর্নীতি, অতিরিক্ত সম্পদের নেশা, আধিপত্যবোধ, বিকৃত রুচিবোধ কিংবা ড্রাগের অনিয়ন্ত্রিত বাজার কি আমাদের মনোজাগতিক বিশেষ কোন কমপ্লেক্সের ফলাফল? যে শিক্ষা আমাদের এক ও নেক করার কথা, দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করার কথা, নতুন পৃথিবীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের তৈরি করার কথা, অংশীদারমূলক রাজনীতির ভেতর দিয়ে একটা সমৃদ্ধ দেশ ও জাতি গড়ার কথা, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও অধিকারগত বৈষম্য দূর করে একটা সুদৃঢ় ঐক্যবদ্ধ জাতি তৈরি করার কথা; আমাদের শিক্ষা কি আমাদের সেই প্যত্যাশা পূরণ করছে?
আজকের আলাপে ইতিহাস, ঐতিহ্য, বাস্তবতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর জবাব ও নতুন কিছু বাস্তবতার জট খুলতে চেষ্টা করবো। চেষ্টা থাকবে আধুনিক পৃথিবীর জন্য আমাদের করণীয় কী হতে পারে তার কিছু ইশারা উপস্থাপনের।
ত্রিমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা বলতে আমরা কোন কোন শিক্ষা ব্যবস্থাকে চিনি! সেইসব শিক্ষাব্যবস্থার সংক্ষিপ্ত একটা পরিচয় তুলে ধরছি শুরুতেই।
জেনারেল শিক্ষা:
জেনারেল শিক্ষা যদিও আমরা চেনার সুবিধার্তে বলি; বাস্তবে জেনারেল শিক্ষা বলতে কিছু নাই। জেনারেল বলতে আমরা মৌলিকভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত মূলধারার শিক্ষাকেই বুঝিয়ে থাকি। এই শিক্ষারও কয়েকটি ধাপ ও ধারা আছে। প্রতিটি ধারায় আলাদা বৈশিষ্ট্য ও জীবনবোধ তৈরি হয়।
স্কুল:
কিন্ডার গার্টেন, প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের দুইটা ধারা বাংলা মাধ্যম ও ইংরেজি মাধ্যম। ইংরেজি মাধ্যম বলতে জাতীয় শিক্ষাক্রমের ইংলিশ ভার্সন। কিন্তু ইংলিশ মিডিয়াম আবার ভিন্ন ব্যাপার। ইংলিশ মিডিয়ামে আছে বৃটিশ কারিকুলামে (ক্যাম্ব্রিজ ও এডেক্সেল) ও-লেভেল, এ-লেভেল, আইবি কারিকুলাম, কানাডিয়ান কারিকুলাম ও অস্ট্রেলিয়ান কারিকুলাম। এইসব স্কুল কলেজকে ঘিরে একটা ইনফেরিয়র ও সুপেরিয়র ব্যাপার সমাজে চলতেই থাকে।
কলেজ:
কলেজগুলোতে কিছু আছে এলিট যেমন নটরডেম, হলিক্রস ইত্যাদি। কিছু কলেজ প্রাইভেট। কিছু ইন্টারমিডিয়েট কিছু ডিগ্রি। আবার কিছু কলেজ ইন্টারমিডিয়েটসহ অনার্স মাস্টার্সসহ। যে কলেজগুলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভূক্ত। ঢাকার কয়েকটি কলেজ আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভূক্ত। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভূক্তির ব্যাপারেও শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা এলিটিজমের চর্চা চলতেই থাকে।
বিশ্ববিদ্যালয়:
পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আছে অনেকগুলো। এইসব পাবলিক, প্রাইভেট, ঢাবি, বুয়েট, ঢাকা মেডিকেল ব্যক্তির ব্যক্তিগত ক্লাস নির্ণয়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় কখনও কখনও।
আলিয়া ধারার মাদরাসা:
১৮৮১ সালে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এই মাদরাসার পথচলা শুরু। নানান চড়াই-উথরাই পাড়ি দিয়ে আজকে বাংলাদেশে রাষ্ট্র স্বীকৃত একটি শিক্ষাধারা এই আলিয়া মাদরাসা। এই প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ তথা ক্ষমতাসীনদের একধরণের উন্নাসিকতা চলতেই থাকে। স্বীকৃতি আর অধিকারের প্রশ্নে অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের থেকে নানাভাবেই পিছিয়ে থাকে এইসব আলিয়া মাদরাসা।
এর প্রাইভেট শিক্ষা সেইভাবে ডেভেলপ করেনি আমাদের দেশে। অল্প কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া আলিয়া মাদরাসার বিস্তৃত কোন প্রাভেট সেক্টর নাই।
একটা মাধ্যমিক স্কুলের জন্য যেমন অনেকগুলো সাপোর্টিং প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকে আলিয়া মাদরাসারগুলোর জন্য এবতেদায়ী মাদরাসা বলতে নাই বললেই চলে।
অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন আলাদা আলাদা। আলিয়া মাদরাসাগুলো তেমন নয়। দাখিল পর্যন্ত যেই মাদ্রাসা সেইটে এবতেদায়ী থেকে শুরু। আলিম পর্যন্ত হলেও এবতেদায়ী থেকে শুরু। ফাজিল মাদরাসা হলেও এবতেদায়ী থেকে শুরু। কামিল ও ফাজিল অনার্স মাদরাসাগুলোও সেই এবতেদায়ী থেকে শুরু। মানে আলিয়া মাদরাসা মানেই কম্বাইন্ড। প্রাইমারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এক ক্যাম্পাসে।
আলিয়া মাদরাসার জন্য একটা বোর্ড। মাদ্রাসা বোর্ড নামে। ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় নামে অধিভূক্তির জন্য আরেকটা বিশ্ববিদ্যালয়।
আলিয়া মাদরাসার মধ্যে আভ্যন্তরীণ এলিটিজমের চর্চা কম। যেহেতু এখানে বহুবিধ সিলেবাস ও ইংলিশ ভার্সন বা আরবি ভার্সন নামে আলাদা কোন কারিকুলাম গড়ে উঠেনি।
কওমী মাদরাসা:
১৮৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের আদর্শ ও সিলেবাসকে ধারণ করে বাংলাদেশে যেসব বেসরকারি ওয়াকফ কেন্দ্রিক মাদরাসা গড়ে উঠেছে সেইসব মাদরাসাই কওমী মাদরাসা। এইসব প্রতিষ্ঠানগুলোকে দরসে নেজামিও বলা হয়। কারণ, এইসব প্রতিষ্ঠানের কারিকুলামটি গ্রহণ করা হয়, মোল্লা নাজিমুদ্দিন সাহলাভী কর্তৃক ১৬৭৭-৭৮ সালে প্রণীত শিক্ষা কারিকুলাম থেকে।
বাংলাদেশে কওমী মাদ্রাসার কয়েকটি বোর্ড আছে। বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়াসহ মোট ছয়টি বোর্ড সরকার স্বীকৃত। এছাড়াও দাওরা হাদীসকে স্নাতকোত্তর মানের জন্য একটি এফিলিয়েটিং ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান আছে আল হাইয়াতুল উলয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়্যা নামে।
কওমী মাদরাসার সিলেবাস নিয়ে এই প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট মানুষের মধ্যে একধরণের অস্বস্তি আছে। সেই থেকে এর সিলেবাস মাদরাসা থেকে মাদরাসা ভিন্নতর হয়ে থাকে। যদিও বোর্ড পরীক্ষার সিলেবাস একই থাকে। মোটা দাগে চারটা সিলেবাস আমরা দেখি। দরসে নেজামীর মূল সিলেবাস, মাদীনী নেসাব, মহিলা মাদরাসার জন্য সংক্ষিপ্ত নেসাব ও বিভিন্ন ব্যক্তি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আরবি মাধ্যম কওমী মাদরাসা।
কওমী মাদরাসার ওয়াকফ প্রতিষ্ঠান গুলোর পাশাপাশি প্রাইভেটাইজন বিস্তৃত হয়েছে। মহিলা মাদরাসাগুলো প্রায় সবগুলোই প্রাইভেট। আরবি মাধ্যমগুলোও প্রাইভেট। মাদানী নেসাবের অধিংশই প্রাইভেট। এছাড়াও আলিয়া কওমী সিলেবাসের সমন্বিত কিছু ক্যাডেট ইন্টারন্যাশনাল নামেরও প্রাইভেট মাদরাসা আছে।
কওমী মাদ্রাসার শিক্ষাধাপগুলো নূরানী, নাজেরা হিফজ ও কিতাবখানা। কিতাবখানায় হাফেজ ছাত্রদের জন্য একটা 'বিশেষ জামাত' আছে।
আবাসিক অনাবাসিক:
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় কওমী মাদরাসা প্রায় পুরোটাই আবাসিক। বেশিরভাগই অবৈতনিক। শিক্ষার্থীদের খাবার পর্যন্ত বিনামূল্যে দেওয়া হয়।
অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশেষ কিছু কলেজ ছাড়া জেনারেল শিক্ষায় আবাসিক ব্যবস্থা নাই বললেই চলে।
আলিয়া মাদরাসাগুলোর মধ্যে বড় শহরের কিছু মাদরাসা আর খানকা কেন্দ্রিক কিছু মাদরাসা ছাড়া আবাসিক মাদরাসার সংখ্যা খুবই কম।
শিক্ষাধারার সমালোচনা:
ক.
জেনারেল শিক্ষা নিয়ে মূল সমালোচনা হলো; এই শিক্ষাধারা বৃটিশ প্রণীত। এ থেকে বড় ধরণের স্কলার, বিজ্ঞানী বা দার্শনিক তৈরি করা সম্ভব না। বৃটিশরা তাদের কেরানী তৈরির জন্য এই শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন করেছিল। ফলে আমাদের জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার মূল টার্গেট হয়ে গেছে চাকুরী। প্রতিজন ছাত্রের শিক্ষার মূল লক্ষ্য থাকে একটা ভালো কর্মস্থল। সাম্প্রতিক বাংলাদেশে বিসিএস দিয়ে এর চিত্রায়নটা সহজ হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া সাহিত্যের ছাত্র ব্যাংকার হচ্ছে। কৃষি প্রকৌশলের ছাত্র পুলিশ হচ্ছে। অথচ রাষ্ট্র যেকারণে তার পেছনে ইনভেস্ট করেছে সেই ফিল্ডে তিনি যাচ্ছেন না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাধর্মী শিক্ষার কোন ভ্যালুই আর থাকছে না।
বহু বছর ধরেই নানাবিধ সংস্কার আর শিক্ষা কমিশনের ভেতর দিয়ে গিয়েও আমরা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আমাদের মাটিসংলগ্ন করতে পারিনি। নিজস্ব বোধবুদ্ধির অনুকূলে অনুসরনীয় কোন পরিবর্তন আনতে পারিনি আমাদের শিক্ষায়। অনুসরণ আর অনুকরণেই চলছে আমাদের শিক্ষা সংস্কার।
এই গত বছরেও যে কারিকুলাম পাঠ্য করা হলো তা ফিনল্যা থেকে ধার করা। অথচ আমাদের দেশের প্রত্যান্ত গ্রামের একজন শিক্ষার্থীর মৌলিক চাহিদার সুযোগ এবং সার্বিক শিক্ষা পরিবেশ আর রাজধানী শহরের একজন শিক্ষার্থীর মৌলিক চাহিদার সুযোগ এবং সার্বিক শিক্ষা পরিবেশের প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপই ছিলো না কারিকুলাম প্রণেতাদের।
খ.
কওমী মাদ্রাসার কারিকুলাম নিয়ে সমালোচনা আছে তাদের নিজেদের ভেতরেই। কারও মতে ষোল বছর পড়াশোনা করার পরেও যথাযথ যোগ্যতা তৈরি হয় না। আরবি মাধ্যমের পুরো পাঠ শেষ করেও অধিকাংশ শিক্ষার্থী আরবি বলতে পারে না স্বতঃস্ফূর্তভাবে।
এর আরবি শিক্ষাদান পদ্ধতি। ইসলামের মৌলিক বিষয়ের শিক্ষাদান পদ্ধতি নিয়ে তরুণ আলেমদের সমালোচনা আছে। সমালোচনা আছে যে, কওমী মাদ্রাসার সিলেবাস প্রায় দুই শো বছরের। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের জন্য মানসিকতা তৈরি করার সহায়ক হিসেবে প্রণীত সিলেবাস এখনও কেনো চলবে। এখনও কেনো সাতশো আটশো বছর আগের লেখা কিতাব পাঠ্য থাকবে। ইতোমধ্যেই পৃথিবী বদলে গেছে নানাভাবেই। আমাদের পরিবর্তিত পৃথিবীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সিলেবাসকে আধুনিকায়ন করতে হবে। রিফর্মেশন করতে হবে এর শ্রেণিবিন্যাসও।
বাইরে থেকে সমালোচনা আছে যে কওমী মাদ্রাসার সিলেবাস এইসময়ের উপযোগি না। যদিও কওমী সংশ্লিষ্ট আলেম ও শিক্ষাবিদগণ এইসব অভিযোগকেই পাত্তা দেন না। তাদের মতে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই কওমী মাদরাসা এগিয়ে চলছে। যেটুকু সমস্যা আছে সেইটে রাষ্ট্র বনাম মাদরাসার দূরত্বের কারণে। রাষ্ট্র বনাম কওমী মাদ্রাসার দূরত্বের আরেক কারণ হলো; এই মাদরাসাগুলো রাষ্ট্রের টাকায় চলে না। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত চাঁদার টাকায় চলে।
গ.
আলিয়া মাদরাসার কারিকুলাম নিয়ে সেই অর্থে অভিযোগ কম। তবে মাদরাসা হিসেবে এর বর্তমান সিলেবাস নিয়ে অস্বস্তি আছে আভ্যন্তরীণ। সরকার এই প্রতিষ্ঠানকে মাদরাসা কম জেনারেল বেশি বানানোর চেষ্টা করেছে।
মাদরাসার সিলেবাসে নৃত্য ঢোল বাজনা প্রবেশ করিয়েছে। অথচ ইসলামের সঙ্গে এর বিরোধ সবাই জানে। স্কুল কলেজের পূর্ণ সিলেবাস দিয়ে আবার মাদরাসার সিলেবাস দিয়েছে। কারো কারো মতে, এটা মূলত আলিয়া মাদরাসা থেকে যেনো ছাত্ররা ড্রপআউট হয়; এই জন্য করা। তাদের যুক্তি- উচ্চমাধ্যমিকের একজন শিক্ষার্থী যখন ঐচ্ছিক বিষয়ের বারোশো নম্বরের পরীক্ষা দেয় ঠিক সেই সময়ে একজন আলিম পরীক্ষার্থী পনেরো শো নম্বরের পরীক্ষা দিতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই একজন শিক্ষার্থী মাদরাসা ছেড়ে কলেজে যেতে চাইবে।
এছাড়া আরবি ও ইসলামী বিষয়াবলীর কারিকুলাম নিয়ে তেমন কোন সমালোচনা নেই। চেষ্টা করা হয়েছে একটি আধুনিক ইসলামী কারিকুলাম তৈরির। তবে এই জায়গায় সমালোচনা ভিন্ন জায়গায়; আলিয়ার শিক্ষার্থীরা আলেম হওয়ার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার দিকে মনযোগ বেশি। ফলে তারা আরবিসহ ধর্মীয় বিষয়গুলকে গুরুত্ব দেয় কম। যদিও কিছু কিছু বিশেষ মাদরাসা ব্যতিক্রম।
ত্রিমুখী শিক্ষাধারার সমস্যা:
এই ত্রিমুখী শিক্ষাধারা আমাদের অনৈক্য, অসতর্কতা, কুটরাজনীতি ও শিক্ষা বাণিজ্যের মানসিকতা বহুমুখী শিক্ষাধারায় নিয়ে পৌঁছে দিয়েছে। ফলে, আমাদের রাষ্ট্রে ও সমাজে বহু মত ও পথের মানুষ তৈরি হয়েছে। তৈরি হয়েছে চিন্তা ও যাপনের বৈচিত্র্য। কিন্তু বৈচিত্রের ভেতরেও একটা দৈশিক ও জাতীয় ঐক্য এবং স্বদেশ ভাবনার মানবিক সহাবস্থান- যাকে বলতে পারি 'এক ও নেক' এমন মনোজগত আমাদের তৈরি হয়নি। না হওয়ার অনেক কারণ আছে। তবে সবচেয়ে বড় কারণ আমাদের অধঃমুখী রাজনীতি। ধর্মীয় রাজনীতিই বলি আর ক্ষমতা কেন্দ্রীক দলীয় রাজনীতিই বলি দুই দিক থেকেই এই রাজনীতি আমাদেরকে একটা জাতি হয়ে উঠতে দেয়নি বিগত পঞ্চাশ বছরেও। যে কারণে তৈরি হয়েছে অগণিত সমস্যা ও সংকট।
জাতীয় সমস্যা:
মানুষের মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে আশরাফ-আতরাফ একটা চৈতন্য চলতে থাকে জাতীয় রাজনীতি ও অর্থনীতিতে। শিক্ষাধারার বহুধা বিভক্ত চিন্তার ফলে জাতীয় জীবনে এইসব চিন্তা ক্রিয়াশীল থাকে। চাকরীর ক্ষেত্রে কে ঢাবিয়ান, কে কওমী, কে আলিয়া এইসব বিষয় চলতেই থাকে। গতো পনেরো বছরে শুধু কওমী ব্যাকগ্রাউন্ডের কারণে বহু চাকরিপ্রার্থী সরকারী চাকুরী পায়নি।
জাতীয় সংকটের আরেকটা দিক আছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার। বাংলাদেশে সরকারী চাকুরীর কয়েকটা ভাগ আছে। যেমন, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের চাকুরি খাত। রাজস্ব খাত। অনুদান খাত। এখানে অনুদান খাত হলো এমপিওভূক্ত শিক্ষকেরা। যখন সবাই মাসের এক তারিখে বেতন ভাতা পায়, ঈদে পূর্ণাঙ্গ বোনাস পায়; সেখানে এমপিওভূক্ত শিক্ষকেরা কোন কোন মাসে আঠারো তারিখে বেতন ভাতা পান। ঈদে মূল বেতনের পঁচিশ ভাগ বোনাস পান। আর তাদের এইসব বেতন-ভাতা প্রসেসিং করেন সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তারা। এই যে বৈষম্য এটা চলে আসছে যুগ যুগ ধরেই। মেডিকেল ও বাড়ি ভাড়া নিয়েও আছে বৈষম্য। শিক্ষকগণ মনে করেন, সিভিল সার্ভিসের আমলারা যদি চাইতেন তাহলে এই বৈষম্য খুব কম সময়েই সমাধান হতো।
এই বৈষম্যকে আমাদের বহুমুখী শিক্ষা ধারার একটা কুফল হিসেবে আমি দেখছি।
অর্থনৈতিক সমস্যা:
একজন কওমী মাদ্রাসার শিক্ষক, আলিয়া মাদরাসার শিক্ষকের বেতন ভাতায় আকাশ পাতাল ব্যবধান। ওদিকে একজন সরকারি চাকুরীজীবীর বেতন-ভাতা ও এমপিওভূক্ত শিক্ষকের বেতন-ভাতায় বিশাল ব্যবধান। ওদিকে প্রাভেট সেক্টরের সঙ্গে সরকারী চাকুরীর ফিনান্সিয়াল ব্যবধান থাকার পরেও সামাজিক মর্যাদায় আবার সেই ব্যবধান বিপরীতমুখী।
অপরদিকে একজন কলেজ ও আলিয়া মাদরাসার লেকচারার দৈনিক তিন থেকে চারটি ক্লাস নিয়ে যে বেতন পান; একজন কওমী মাদরাসার মুহাদ্দিস দৈনিক ছয় সাতটা ক্লাস করানোর পরেও সেই অর্থনৈতিক সুবিধে পান না। আবার একজন কওমী মাদ্রাসার শিক্ষক পাঠ পরিকল্পনার জন্য কম করে হলেও পাঁচ ঘণ্টা সময় দেন ক্লাসের বাইরে।
একজন সরকারী মসজিদের ইমামের বেতন আর সাধারণ মসজিদের ইমামের বেতন যদি আমরা সামনে রাখি আমরা দেখবো একটা অর্থনৈতিক বৈষম্যের দুঃখজনক চিত্র।
সামাজিক সমস্যা:
আমাদের সমাজে তিন ধারার শিক্ষিতকে তিনভাবে মূল্যায়ন করে থাকে। যে সমাজে জেনারেল শিক্ষিতের মর্যাদা বেশি সেই সমাজে আবার মাদরাসা শিক্ষিতের মর্যাদা কম। যেখানে কওমী আলেমের মর্যাদা বেশি। সেখানে আলিয়ার আলেমের মর্যাদা কম। যেখানে আলিয়ার আলেমের মর্যাদা বেশি সেখানে কওমীর আলেমের মর্যাদা কম। সামাজিক এই কমপ্লেক্সের কারণে অনেক মানুষই হীনমন্যতাবোধের শিকার হোন।
জেনারেল বলছে আরে হুজুর! এরা কী জানে! দুনিয়া চলে গেছে মঙ্গলে ওরা এখনও পরে আছে তালাকের মাসআলা নিয়ে।
কওমী বলছে আলিয়া খালিয়া। আলিয়া বলছে কওমীরা দুইটা সিগাহ ছাড়া আর কী জানে! একজন আরেকজনের প্রতি প্রতিনিয়ত অভিযোগের পসরা সাজিয়ে একটা মনস্তত্বিক সামাজিক দূরত্ব তৈরি করে রাখা হয়।
ওদিকে কেউ ভালো কলেজে পড়ছে তো পুরো পরিবারেই তাকে ভিন্নভাবে দেখছে। যে একটু কম রেটিংয়ের কলেজে পড়ছে তারে আবার আন্ডার এস্টিমেট করা হচ্ছে।
এই মর্যাদা আর ছোট করার ব্যাপারটা ভালো মাদ্রাসা আর ছোট মাদরাসার মধ্যেও চলে। এই মনস্তত্বিক সংকট মসজিদ, মাদরাসা হয়ে সমাজ ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানে বিস্তৃত হয়।
রাজনৈতিক সমস্যা:
একজন আলেম যতোই যোগ্য ও ভালো নেতা হোন না কেনো; রাজনীতির ময়দানে ধর্মীয় মন্ত্রণালয় ও অনুষ্ঠানে কুরআন তেলাওয়াত ছাড়া তার আর কোন উপযোগ আমাদের পলিটিশিয়ানরা স্বীকার করেন না।
আওয়ামীলীগ বলেন আর বিএনপি বলেন একজন আলেমের নিয়তি উলামা লীগ অথবা উলামা দলেই। এই যে স্পেস না দেওয়া; এইটাও শিক্ষাধারার এলিটিজমের ফল।
ফলে যখন কোন আলেম অথবা সৎ মানুষ রাজনৈতিক মাঠে আসেন ও নির্বাচনী পলিটিক্স করেন; তখন মানুষ একজন ভালো মানুষ কেনো নির্বাচন করবে! এই বলে পরিত্যাগ করার চেষ্টা করেন।
অপরদিকে আলেমগণ রাজনীতে ধর্মীয় রাজনীতির নামে একটা শ্রেণি সংগ্রাম অথবা একটা ইস্যূকেন্দ্রীক রাজনীতির চক্রে চলতে থাকেন। ফলে রাজনীতিতেও বৈষম্য ও আস্থার সংকট চলতে থাকে।
কর্মসংস্থানের সমস্যা:
কামিল ও দাওরাকে মাস্টার্সের মান দিয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত বিসিএসে এলাও করেনি এই দুই সনদকে। এমনকি অন্যান্যা ননক্যাডার প্রথম শ্রেণির চাকুরীর জন্য কামিল ও দাওরার সনদকে যোগ্য ধরা হয় না।
টুপি, দাঁড়ি, ও হিজাব নিয়ে সমস্যা তো প্রতিটি কর্মক্ষেত্রেই চলে। সমস্যা আছে সরকারি চাকুরীর মতো বেসরকারি চাকুরিতেও। যেখানে যে বস থাকেন সেখানে বসের বিপরীত আদর্শের মানুষেরা নিয়মিত বুলিংয়ের শিকার হোন। অনেকেই ধরে নিয়েছেন এইটাই নিয়তি।
সহাবস্থানগত সমস্যা:
বহুধারার শিক্ষিত মানুষের কারণে যে কোন স্থানে বহুধারার শিক্ষিত মানুষের একত্রিত হওয়া একটা অস্বস্তির কারণ। যেমনটা আমরা দেখি বইমেলা থেকে মাদরাসার ছাত্রদের এরেস্ট করা হয়। শুধু মাদরাসার ছাত্র হওয়ার কারণে। আর এই এরেস্টের আরেকটা কারণ লেখক জাফর ইকবালের অস্বস্তি।
অবদমনের খেলা:
চাকুরীর ক্ষেত্রে মাদরাসা শিক্ষিতরা পিছিয়ে থাকায় দেখা যায় যে কোন ধর্মীয় ইনিশিয়েটিভ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমন একুশে বইমেলায় ইসলামী বইয়ের প্রকাশকেরা স্টল পায় না। অপরদিকে বায়তুল মোকাররমে ইসলামী বইমেলায় প্রকৃত প্রকাশকেরা স্টল পায় না। যদি আমাদের শিক্ষাধারার একটা কমন ধারা থাকতো অথবা বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের একটা রাজনৈতিক প্রচেষ্টা ও সিদ্ধান্ত থাকতো তাহলে এমনটা হওয়ার সুযোগ কম ছিলো।
সমাধানের পথ:
এই বৈষম্য, দূরত্ব, ইনফেরিয়র ও সুপেরিয় কমপ্লেক্স দূর করে একটা জাতি হিসেবে আমাদের এক ও নেক হওয়ার সহজ পন্থা অনেকেই বলে থাকেন একমুখী শিক্ষাধারা।
কিন্তু একমুখী শিক্ষাধারা কি আদৌ এই দেশে সম্ভব? এমন বিশ্বাস ও আস্থার রাজনীতি কি এই উপমহাদেশের সংস্কৃতিতে আছে?
আমরা যদি মাদরাসা শিক্ষার ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরাই আমরা দেখবো সেখানে কেবলই অবিশ্বাস আর প্রতারণার ইতিহাস। ইংরেজ আমলের ইতিহাসে মাদরাসার শিক্ষার ইতিহাসে যা পাওয়া যায় তা আমি লিখেছিলাম "কওমী সনদের স্বীকৃত: যে শঙ্কায় মন কাঁদে" নিবন্ধে--
"কলকাতা মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পর ইংরেজরা যখন দেখল, এটা তাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না। তখন তারা সাধারণ মানুষের মাঝে একটা প্রত্যাশা তৈরি করে। যাতে সবাই চাকরি ও শাসকদের সুযোগ সুবিধা লাভের আশায় মাদরাসায় ইংরেজি শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করে। পরিকল্পনা সফল হয়। জনতার মধ্য থেকেই দাবি ওঠে মাদরাসা শিক্ষার আধুনিকায়নের। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯০৭-৮ সালের জনশিক্ষা পরিচালক আর্চডেল আর্ল-এর নেতৃত্বে গঠিত বিখ্যাত ‘আর্ল কমিটি’ এবং ১৯১৪ সালে গঠিত নাথান কমিটি মাদরাসা শিক্ষায় আমূল পরিবর্তনের সুপারিশ করে। ১৯১৫ সালের ১ এপ্রিল থেকে মাদরাসা শিক্ষায় নিউ-স্কিম ব্যবস্থা সর্বত্র চালু হয়। এ স্কিমের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ফারসি ভাষা বর্জন ও ইংরেজি বাধ্যতামূলক করা। এসময় পাঠ্যসূচিতে বাংলা, অঙ্ক, ভূগোল, ইতিহাস, ইংরেজি, অঙ্কন, হাতের কাজ এবং ড্রিল অন্তর্ভুক্ত হয়। ফলে ১৯১৪-১৫ সাল থেকে নিউ-স্কিম ও ওল্ড-স্কিম নামে মাদরাসার দু’টি ধারা চালু হয়। সেই সময়ে শর্তারোপ করা হয়-যদি কোন মাদরাসা নিউ-স্কিম পদ্ধতিতে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তিত না করে, তাহলে তাদের জন্য সব ধরণের সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা বন্ধ করে দেওয়া হবে। তখন যুক্ত বাংলার অনেক আলেম এটাকে ইসলাম ও ইসলামি শিক্ষার ওপর নতুন খবরদারির চেষ্টা হিসেবে দেখলেন। সেজন্য তারা মাত্র কয়েকটি মাদরাসা নিয়ে মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীনের উপর ভরসা রেখে; সরকারী সাহায্য পাওয়ার আশা ত্যাগ করেই ওল্ড-স্কিম শিক্ষা ব্যবস্থার উপর অটল থাকলেন। সরকার সেই মাদরাসাগুলোকে ‘খারিজী’ তথা সরকারী সাহায্য থেকে বাতিল হিসেবে ঘোষণা দেয়। ইতিহাস বলে ১৯২২ সালে দুই বাংলা মিলে মাত্র ১৯ টি মাদরাসা ওল্ড-স্কিমের তালিকায় ছিল।
পরে কালক্রমে নিউ-স্কিম মাদরাসা সাধারণ স্কুল-কলেজের রূপ ধারণ করে। ১৯৫৭ সালে সরকারি এক ঘোষণায় অসংখ্য মাদরাসাকে স্কুল-কলেজে রূপান্তরিত করা হয়। ১৯৭৪ সালের হিসেবে যার সংখ্যা ছিল ১০৭৪ টি। ঢাকায় বর্তমান নজরুল কলেজ, চট্টগ্রামের মুহসীন কলেজ, রাজশাহীর হাই মাদ্রাসা এককালে মাদরাসা থাকলেও অধুনা এই কলেজগুলো ইসলামি শিক্ষার ঐতিহ্য হারানোর সাক্ষী হয়ে আছে।"
ঠিক গত দের দশকেও আলিয়া মাদরাসা ও কওমী শিক্ষা নিয়ে সরকার বৃটিশদের মতোই ডার্টি পলিটিক্স করেছে। সেই পলিটিক্সের উৎস সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বক্তব্য, "আমরা মাদরাসায় শিক্ষার্থী কমানোর আন্দোলন করছি।"
আমরা এখনও বিশ্বাস করি আমাদের রাজনীতি যদি আস্থার জায়গায় ফিরে আসে তাহলে তিন ধারার শিক্ষাধারাকে বিলুপ্ত করে একটি একমূখী শিক্ষাধারা বাংলাদেশকে পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সাহায্য করবে।
কিন্তু এই অঞ্চলের রাজনীতির যে চরিত্র; তাতে করে একমুখী শিক্ষার কল্পনা করাও আতঙ্কের এবং বিপদের। যারা বলবেন তারাও প্রত্যাখ্যাত হবেন। তাহলে উপায়?
উপায় হলো; বৈচিত্র্যের মধ্যে একটা ঐক্যের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। আলিয়া ও কওমীর মধ্যে মনস্তত্বিক দূরত্বকে কমিয়ে আনার রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টা জারি রাখতে হবে। জেনারেল ও মাদরাসা শিক্ষাধারার শিক্ষিতদের মধ্যে একটা নিয়মতান্ত্রিক মাথষ্ক্রিয়ার ব্যবস্থা করতে হবে রাষ্ট্রের।
আইন:
যে কোন ধরণের ঘৃণা চর্চামূলক আলাপকে আইন করে নিষিদ্ধ করতে হবে। রাষ্ট্রীয়, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সবধরণের বৈষম্য ও অধিকারহীনতাকে শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে।
পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সাংবিধানিক আইনের কার্যকর প্রয়োগ করলে এইসব বিরোধ অনেকটাই কমে আসবে।
রাজনৈতিক মঞ্চে, মসজিদের মিম্বরে, ওয়াজের মাহফিলে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঐক্য বিরোধী যে কোন বক্তব্য ও কন্টেন্টের জন্য শাস্তির বিধান রাখতে হবে এবং এর প্রয়োগে যথাযথ ট্রান্সপারেন্সির ব্যবস্থা রাখতে হবে।
প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সিলেবাসে সামাজিক, রাজনৈতিক ও মনস্তত্বিক ঐক্যের জন্য বিশেষ পাঠের ব্যবস্থা রেখে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্যাম্পেইন শুরু করতে হবে নিয়মিত।
মসজিদ ও মাদরাসাগুলোকে আবাদ করে সেখানে সমাজের সবধরণের মানুষের জন্য নানাবিধ অংশগ্রহণমূলক আয়োজন করতে পারলে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে।
শৃঙ্খলা:
কারিকুলাম ও সিলেবাসে একটা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা জরুরী। সরকারি ও বেসরকারি যেমন প্রতিষ্ঠানই হোক সিলেবাসের জন্য একটা শক্তিশালী কর্তৃকপক্ষ দরকার। কওমী, আলিয়া ও জেনারেল সবজায়গায় নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী একটা অথরিটি দরকার। না হলে এই বহুমুখী শিক্ষাধারা আমাদেরকে কখনোই জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি তৈরি করতে দেবে না।
নীতি ও আদর্শ:
দেশের সকল নাগরিকের জন্য নৈতিক শিক্ষা ও সামাজিক আদর্শ শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা। নিজ নিজ ধর্মীয় নীতি-নৈতিকতাকে ধারণ করতে উদ্ধুদ্ধ করা। যে কোন ধরণের নৈতিক স্খলনকে নোটিশ করে স্খলনের মাত্রা অনুযায়ী শাস্তির ব্যবস্থা হয়তো ভালো কিছুর সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে।
আখলাকে হাসানা শেখানো ও চর্চার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ইনিশিয়েটিভ জরুরী। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান নিজ নিজ শিক্ষার্থীদের মনোজাগতকে একটা কল্যাণ রাষ্ট্রের কল্যান নাগরিকের মতো করে গড়ে তুলতে সচেষ্ট থাকতে হবে।
শিক্ষা কমিশন:
এমন একটা শিক্ষা কমিশন গঠন করা দরকার যেখানে সকল চিন্তার মানুষের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যার শিক্ষা-চাহিদার ভিত্তিতে সিলেবাস প্রণীত হবে কিন্তু কোন ভিন্ন ধর্মের মানুষ ধর্মীয় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে না।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে অবিশ্বাসী ও বামপন্থাকে একেবারেই বিদেয় করতে হবে। নাহলে একটা ঐক্যবদ্ধ জাতি কখনোই আমরা তৈরি করতে পারবো না। কারণ; এরা বৈষম্যহীন সমাজের কথা বললেও অন্তরে ধার্মিক ও আলেম শ্রেণিকে বঞ্চিত করার চিন্তা সবসময়ই লালন করে।
শিক্ষা সংস্কার ও চিন্তা সংস্কার:
স্বাধীনতাউত্তর সময়ে আমরা কেবল বিভাজনই দেখেছি। মোল্লা ও মিস্টারে বিভাজন। মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারে বিভাজন। ডানপন্থা ও বামপন্থার বিভাজন। প্রতিক্রিয়াশীল ও প্রগতিশীলের বিভাজন। মাদরাসা ও ভার্সিটির বিভাজন। কওমী ও আলিয়ার বিভাজন। সুন্নী ও ওয়াহাবীর বিভাজন। জামায়াতে ইসলামী ও আওয়ামীলীগ বিভাজন। তাবলীগ ও খানকার বিভাজন।
এইসব বিভাজনের পেছনে শিক্ষাধারা ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার দায় পুরোটাই। বাকি কিছু কিছু দায় অন্যদিকের থাকতেও পারে। এইসব বিভাজনের ফলে বাংলাদেশ একটা ছোট ও সহজ সরল মানুষের দেশ হওয়া সত্বেও একটা সংকল্পবদ্ধ জাতি হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি।
শেষকথা:
বাংলাদেশের মানুষ সহজ এবং ক্ষমা পরায়ণ। উদাহরণ দিলেই সহজ হবে ব্যাপারটা। আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এক বক্তব্যে বলেছিলেন যে আওয়ামীলীগ ক্ষমতা ছাড়লে দলের দশ লাখ নেতাকর্মী মারা যাবে। এটা বলার পেছনে তাদের জুলুম ও অত্যাচারের মাত্রা তারা যেমনটা উপলব্ধি করেছে সেইটে ক্রিয়াশীল ছিলো। অথচ আভরা আমরা আশ্চর্য হয়ে দেখলাম তেমন কিছুই আসলে ঘটেনি। তার মানে এই জাতিকে গাইড করতে পারলেই সব সহজ।
বিস্রস্ত পুলিশহীন কয়েকটা সপ্তাহ থাকার পরেও কয়েকজন শিক্ষার্থীর কথায় মানুষ প্রতিশোধের কথা ভুলে দেশ গড়ায় মনযোগ দিয়েছে। এমন একটা জাতিকে সত্যিকারের সৎ, দেশপ্রেমিক ও কারিশমাটিক কোন রাজনৈতিক নেতা যদি নেতৃত্ব দেয় ইন শা আল্লাহ পুরো পরিবেশ বদলে যাবে। শুধু হিংসা ও ঘৃণার রাজনীতিটা ছাড়তে হবে।
কালান্তর ম্যাগাজিন ০৪ এ প্রকাশিত।
২| ১৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:০৭
Ruhin বলেছেন: আপনার কাছে একটা বিষয় জানতে চাই । ইউরোপীয়রা মানে ব্রিটিশরা তো আমাকে ১৯০ বছরের মতো শাসন করছিল । কিন্তু তারা মিশর, সিরিয়া, ইরাক, ইরানে মাত্র কয়েক যুগ শাসন করেছে । কিন্তু এতেই মিশর, সিরিয়া,ইরান, ইরাকের কালচার এত পশ্চিমা হয়ে গেল কেন? ঐখানের মেয়েরা ১৯৪০ থেকেই ৮০ দশক পর্যন্ত মিনি স্কার্ট, শর্ট ড্রেস, বিকিনি ও পড়ত । এদিকে প্রায় ২ শতাব্দী ভারতবর্ষ শাসন করলেও এখানকার মেয়েরা শাড়ি ও সেলোয়ার, কামিজ উড়না ছাড়া বাইরে যেতে অস্বস্তি বোধ করত ১৯৪০-৭০দশকে ,যেখানে মধ্যপ্রাচ্যের ও আরবের মেয়েরা বিশেষ করে মিশর, সিরিয়া, ইরাক, ইরানের অধিকাংশ মেয়েরা দেদারসে পশ্চিমা পোশাক, সংক্ষিপ্ত পোষাক পড়ত। ১৯৪০-৫০ থেকেই ঐসব দেশের মেয়েরা স্কুল,কলেজে মিনি স্কার্ট পড়ত, বিশ্ববিদ্যালয়েও তা একেবারে স্বাভাবিক ছিল । তাহলে তাদের আমাদের এই উপমহাদেশে আর মধ্যপ্রাচ্যের শাসনের মধ্যে পার্থক্য কোথায় ছিলৃ?যে তারা কয়েক বছর শাসন করেই মধ্যপ্রাচ্যের ও আরবের অধিকাংশ মেয়েদের শর্ট ড্রেসে অভ্যস্ত করছে ও সমাজকে পশ্চিমা সংস্কৃতির করছে?
©somewhere in net ltd.
১| ১৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৫১
ডঃ এম এ আলী বলেছেন:
লেখাটিতে বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার বহুমুখী ও বিভাজিত বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে। মূলত তিনটি
শিক্ষাধারা—জেনারেল, আলিয়া মাদ্রাসা ও কওমী মাদ্রাসা থাকলেও এর মধ্যে নানা উপধারা এবং অভ্যন্তরীণ
বিভাজন রয়েছে, যা জাতীয় ঐক্যের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ ধরণের বৈচিত্র্য সামাজিক, অর্থনৈতিক ও
রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও বিভাজন এবং বৈষম্য তৈরি করেছে, যা ভবিষ্যতে সমৃদ্ধ জাতি গঠনে বড় চ্যালেঞ্জ।
শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিটি ধারা যেমন একক মনস্তত্ব তৈরি করছে, তেমনি একে অপরের সাথে দ্বন্দ্ব ও বৈষম্য বাড়াচ্ছে।
যেমন, সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থাকে চাকরিমুখী ভাবা হলেও মাদ্রাসা শিক্ষার উদ্দেশ্য ধর্মীয় আদর্শে প্রতিষ্ঠা লাভ। এ
ধরনের বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির কারণে প্রতিটি শিক্ষা ধারার ছাত্ররা সমাজে আলাদা আলাদা মর্যাদা ও সুযোগ সুবিধা
পেয়ে থাকে, যা মূলত সামাজিক বৈষম্য ও হীনমন্যতা তৈরিতে ভূমিকা রাখে।
লেখাটিতে সমাজের বিভিন্ন স্তরে এই শিক্ষাধারার কারণেই যে মানসিক সংকট, অর্থনৈতিক বৈষম্য, এবং রাজনৈতিক
সংকট তৈরি হয়েছে, তার সুন্দর করেছেন। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার ও যুগোপযোগী পরিবর্তন আনাই
এই সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ বলে আপনার অভিমতে বিষয়ে সুধিজনেরা ও সংস্লিষ্টরা আরো গভীর
ভাবে পর্যালোচনা করে দেশে একটি সর্বাত্তক কল্যানকামী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে পারেন ।