![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
জীবন ছোট হলেও এর গল্পগুলো ছোট নয়। আমার এই অপরাবাস্তব জীবনের গল্পটি যদিও ছোট নয় তবু এটি ছোট গল্পের মত, শেষ হইয়াও হইলোনা শেষ! ছোট প্রান ছোট ব্যাথা, ছোট ছোট দুঃখ কথা...।
কপালে শীতল হাতের স্পর্শ অনুভব করল মহুয়া। প্রবল জ্বরে আধবোজা চোখ খুলে দেখতে পেল ১৪/১৫ বছর বয়সী একটি মেয়ে তার একটি হাত মহুয়ার কপালে দিয়ে মধ্য বয়সী এক মহিলার সাথে ফিসফিসিয়ে কথা বলছে।
- ইশশিরে খালা, জ্বরে একেবারে গা পুইড়া যাইতেসে! কি করন যায়?
- আমি ক্যাম্নে কমু? আমি কি দাক্তার না জ্যোতিষ?
খালার কথায় মেয়েটি বিষণ্ণ হয়ে চুপ করে গেল। খালা ভাগ্নী দু'জনেই তাকিয়ে আছে মহুয়ার দিকে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে। আধবোজা চোখ খুলে মেয়েটিকে জানতে চাইলো,
-নাম কি তোমার?
-জবা।
-জবা? বেশ সুন্দর নাম। তোমার মতই।
অন্ধকারে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে জবা ফুলের বৈজ্ঞানিক নাম মনে করবার চেষ্টা চালাচ্ছে মহুয়া। কিছুতেই মনে পড়ছেনা তার। উহ! অসহ্য লাগছে। একটি জিনিস চেষ্টা করে মনে না আনতে পারলে তার গা গুলায়। মাথার ভেতরে লুপিং হতেই থাকে। অস্থির লাগে। আরমানকে জিজ্ঞেস করতে পারলে ভালো হত। সেই সুযোগ নেই। নেটওয়ার্ক নেই একেবারেই ট্রেনের ভেতর। আর তাছাড়া ফোনে কথা বলতে মহুয়ার একটুও ভালো লাগেনা। তবে এসব ভাবতে গিয়ে মাথা থেকে জবা ফুলের বৈজ্ঞানিক নামের ব্যাপারটি নেমে গিয়েছে।
তার মাথায় এখন নতুন ভাবনা। এই জবা ফুল প্রাচীনকালের অসংখ্য নরবলির সাক্ষী। জবার মত নির্দোষ একটি ফুলের সাথে নরবলির এক ভয়ংকর কাহিনী জড়িয়ে আছে।
প্রচলিত আছে দেব দেবীর সান্নিধ্য পেতে অথবা অমরত্ব লাভের জন্য সেই সময় নরবলি দেয়া হত। বিশেষ করে ১৪/১৫ বছর বয়সী অপেক্ষাকৃত সুন্দর ছেলে আর কুমারী মেয়েদের। বলিদানের পূর্বে অমাবশ্যা রাতে তাদের গোসল করানো হত জবা ফুলের মালা পরিয়ে। নরবলি দাতারা কেন এই জবা ফুলটিকেই বেছে নিয়েছিলেন তা আজও অজানা।
আচ্ছা, জবা মেয়েটির বয়স ও তো ১৪/১৫ হবে। মেয়েটি সুন্দর। টানা টানা চোখ। পোশাক আশাক দেখে খুব বেশি অবস্থাপন্ন ঘরের মনে হচ্ছেনা। অথচ গায়ের রং ফর্সা! গরীবের ছেলেমেয়েরা ফর্সা হয় খুব কম। দারীদ্রতার সাথে কালো বর্ণের কোথায় যেন একটি সম্পর্ক রয়েছে। পৃথিবীর বেশিরভাগ দরীদ্র দেশ গুলো কালো কিংবা শ্যামলা মানুষদের হয়। এটা কেন হয়? এতদিনতো সে খেয়াল করেনি! আরমানকে জিজ্ঞেস করবার তালিকায় আরেকটি প্রশ্ন যোগ হল। ব্যাগ খুলে ডায়রি বের করতে করতে মহুয়া ভাবছিলো সে নিজেও শ্যামলা। আরেকটু ফর্সা হলে কি হত?
আরমানকে এই আক্ষেপ জানিয়েওছিলো সে। ফাজিলটা হেসে দিয়ে বলেছিলো, এমনিতেই তোমাকে লুকিয়ে রাখবার জায়গা পাইনা আর ফর্সা হলে তোমায় নিয়ে আরেকটি ট্রয় নগরী ধ্বংস হয়ে যেত। তুমি হতে মহুয়া অফ ট্রয়। তারপর এক গভীর প্রেম পূর্ণ চোখে তাকিয়ে থাকা। মহুয়া লজ্জা পেয়ে যায় আরমানের ওরকম তাকানো দেখে। আরমান প্রায়ই অমন ভাবে তাকায়। প্রতিবারই প্রচণ্ড এক ভালোলাগা বোধ ঘিরে ধরে মহুয়াকে। তার মরে যেতে ইচ্ছে করে সুখে। ভালোবাসা আসলেই অদ্ভুত এক অনুভুতি, প্রকাশ করা যায়না। ভেতরে ভেতরে কি এক উদ্যাম দ্যুতি আর তুমুল প্রেম বয়ে বেড়ায় মানুষেরা কিন্তু বোঝাতে পারেনা ঠিক মত। এত অক্ষমতা কেন? আচ্ছা, মনে পড়েছে! জবা ফুলের বৈজ্ঞানিক নামটি মনে পড়েছে। "হিবিস্কাস রোজাসিনেন্সিস"। সায়েন্টিফিক এইসব নাম কি যে বিদঘুটে হয়!
ট্রেন সবেমাত্র লাকসাম এলো। অথচ মহুয়ার মনে হচ্ছিলো অনন্তকাল ধরে যেন সে ট্রেনে বসে আছে। জবার খালা ইতিমধ্যেই ঘুম। নাক ডাকছেন ভদ্রমহিলা। মেয়েদের নাক ডাকা হা করে ঘুমোনো মুখ দেখতে ভালো লাগেনা। শুনতে বিশ্রী লাগে। অথচ আরমান মহুয়াকে বলেছিলো, 'আমি যেমন নাক ডাকি তুমিও হালকা ডাকো কিন্তু। তখন আমার প্রচন্ড মায়া হয় তোমায় দেখতে। মনে হয়, আহারে! রাজ্যের অসহায়ত্ব নিয়ে এত চমৎকার একটি মেয়ে নাক ডাকছে পরম নিশ্চিন্তে। নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয় খুব।'
মহুয়া লজ্জা পেয়ে বলেছিলো, ঈশ! আমি না ডাকিনা। খুব টায়ার্ড ছিলাম বলে হয়ত, একটি আধটু ডেকেছি। আহ! জীবন কত সুখের। এত অল্প দিনের পরিচিত মানুষটিকে এত আপন মনে হয় কেন? বাবা,মা, ভাই আত্মীয় স্বজন সবার কথা আজকাল আর মনে পড়েনা তেমন। কি লজ্জার কথা!
জ্বরের উত্তাপ কিছুটা কমেছে মনে হচ্ছে। তবে মুখে তেঁতো একটি স্বাদ। কিছু খাওয়া যায় কিনা দেখছে মহুয়া। আরমানকে বলা হয়নি সে অসুস্থ। বললে বেচারা অস্থির হবে। সে অল্পতেই অস্থির হয়। আর মহুয়াকে যেতে দেবেনা, নিজেই আসতে চাইবে। আরমান সবে মাত্র নতুন জবে জয়েন করেছে। এই মুহূর্তে ওর জন্য বিশাল ক্ষতির কারণ হবে ছুটি নিয়ে আসা। তাই মহুয়া লুকিয়েছে। সে আরও অনেক কিছুই লুকিয়েছে আরমানের কাছ থেকে। একদিন সব বলবে, ওর হাত ধরে। কান্না পেলে যেন জড়িয়ে ধরে কাঁদতে পারে।
-আফা আমড়া লইবেন?
আমড়া ওয়ালা বাচ্চা একটি ছেলে চারটা আমড়া বাড়িয়ে ধরে আছে জানালা দিয়ে। মহুয়া চারখানাই কিনে নিয়ে জবার দিকে তাকিয়ে বলল,
-আমড়া খাবে জবা?
-না, খাবোনা। আপনি খান। আপনার অনেক জ্বর। চোখ লাল হয়ে আছে। তয়, আপনার চোখগুলা খুব সুন্দর। আমার বইনের চোখও খুব সুন্দর।
- আচ্ছা ধন্যবাদ। একটা খাও।
-না আপা। আসার সময় মা বলে দিসে, অপরিচিত কারো কাছ থেকে কিছু না খেতে।
- তোমার মা ঠিক কথাই বলেছেন। অপরিচিত কারো কাছ থেকে কিছু খেতে হয়না।
- আচ্ছা দেন। একটা খাই। আপনারে অপরিচিত মনে হইতেসে না। বুজানের মত লাগে দেখতে।
- আমড়ায় ভিটামিন সি আছে, তোমার বিষণ্ণ ভাব কেটে যাবে। এত সুন্দর একটি মেয়ে বিষণ্ণ হয়ে আছে দেখতে ভালো লাগছেনা।
-আপা, আপনে খুব সুন্দর কইরা কথা বলেন। আমাদের স্কুলের বাংলা ম্যাডামের মত।
- হা হা হা, তাই বুঝি? আরমানও এরকম বলে।
- আরমান কে? আপনার জামাই?
- তোমার দুলাভাই, তুমি ওর শালী। আমি তোমার দুলাভাইয়ের কাছে যাচ্ছি, হা হা হা।
- আপনে উনারে খুব ভালোবাসেন, না? একলা একলা যাইতেসেন!
মহুয়া ভাবছে এই ভালোবাসা কি জিনিস? ভালোবাসা হল এক পরশ পাথর, যার স্পর্শে মানুষ শুদ্ধ থেকে শুদ্ধতর হয়ে ওঠে। এমন জিনিসকে সকল প্রকার সন্দেহ থেকে দূরে, মনের পবিত্র সিন্দুকে মমতার তালা দিয়ে বন্ধ রাখতে হয়। সেই সিন্দুকের চাবি হল বিশ্বাস। যার কাছে বিশ্বাস নামের চাবি নেই সে ভালোবা্সার সিন্দুক খুলতে পারেনা সারা জীবনেও। ভালোবাসাকে ন্যাপথলিন দিয়ে সুন্দর করে
ভাঁজ করে আলমিরাতে সাজিয়ে রাখতে হয়। আটপৌঢ়ে ব্যাবহারে ভালোবাসা কদর্য হয়, সৌন্দর্য নষ্ট হয়।
-ঢাকায় তোমার কে থাকে জবা?
- কেউনা আপা। দুঃসম্পর্কের এক চাচা থাকে। বিরাট বড়লোক। গাড়ি আছে। আমাদের সাথে সম্পর্ক রাখেনা। আমিও হের বাসায় যাইতেসিনা। আমি সৌদি আরব যাবো। এই যে, উনি, উনি আমার গ্রামের খালা। উনিই ব্যাবস্থা করতেসেন দালালের মাধ্যমে।
-উনি তোমার আপন খালা না?
-না, তবে উনি লোক ভালো। অনেক মেয়েকে সৌদি পাঠাইসে। মিতা আপাও...
- থামো জবা। আমি আর শুনতে চাইছিনা। তুমি জানোনা ওখানে কি হয়। আর উনি লোক ভালো না। তুমি যেতে পারবেনা, আমি তোমায় যেতে দেবোনা।
- আপনে এইসব কি বলতেসেন? আমার আব্বা-আম্মা না খায়া মরবে। আব্বার যক্ষা হইসে। চিকিৎসার টাকা দিসে খালায়।
- তোমার আব্বা মরে যাক। আমি তোমায় যেতে দেবোনা।
মহুয়ার চিৎকারে জবার পাড়াতো খালা রাহেলা বানু জেগে উঠে এদিক সেদিক তাকাতে লাগলেন হতভম্ব হয়ে। অন্য সিটের সবাই ব্যাস্ত ব্যাগ গোছাতে। কমলাপুর স্টেশন এসে গিয়েছে। ট্রেন থেমে গিয়েছে। নামতে শুরু করেছে যাত্রীরা। ট্রেন প্রায় খালি। চারদিকে বাঁশির শব্দ, হইহুল্লোড়। সবাই যার যার গন্তব্যে যেতে ব্যাস্ত। মহুয়া পাগলের মত
চেঁচিয়ে বলেই যাচ্ছে খালাটিকে, আপনি ওকে বিক্রি করে দিচ্ছেন কেন? আপনাকে আমি পুলিশে দেব। আপনি খারাপ মানুষ। চরম খারাপ। জবা তুমি যাবেনা। আমি তোমায় যেতে দেবোনা। জবার হাত শক্ত করে ধরা মহুয়ার হাতে।
মহুয়া অচেতন হয়ে লুটিয়ে পড়ার ঠিক আগ মুহূর্তে একটি ভরাট কন্ঠের দাক শুনতে পায়,
-মহুয়া, কি হয়েছে মহুয়া? এইযে আমি! আমি আছিতো মহুয়া!
- আরমান! আরমান! ওরা জবাকে নিয়ে যাচ্ছে। তুমি ওকে যেতে দিওনা। ওরা বিক্রি করে দেবে আমার জবাকে। তুমি ওকে বাঁচাও আরমান।
মহুয়ার আরমান তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে শক্ত হাতে বুকে জড়িয়ে ধরে গভীর ভরসা মাখা গলায় বলে, "না মহুয়া, লক্ষ্মী সোনা আমার! আমি ওকে যেতে দেবোনা। তুমি দেখো, আমি জবাকে নিয়ে যেতে দেবোনা।" মহুয়া পরম নিশ্চিন্তে আরমানের বুকে মুখ রেখে ঘুমিয়ে পড়ে। ভোরের রহস্যময় আলোয় সাদা শাড়ি পরিহিতা আলুলায়িত কেশের মহুয়াকে অপসরীর মত লাগছে! আরমানের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানির ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে
মহুয়া মানবীর কপালে।
২০ শে মে, ২০১৪ রাত ৯:৪৬
আমিই মানুষ বলেছেন: ধন্যবাদ
©somewhere in net ltd.
১|
২০ শে মে, ২০১৪ সকাল ৮:৪১
আজীব ০০৭ বলেছেন: +++