![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি কেবল একজন ক্ষুদ্র পাঠক,তার মাঝে থেকে একটু লেখার চেষ্টা করি.......
ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে আসার কারণে চীনের সামনে সুযোগ এসেছে, সে এখন বিশ্বায়ন ও উদার বাণিজ্যের প্রধান রক্ষক হতে পারে। মানুষের কাছে এই নতুন উদ্যোগের প্রতিনিধি আর কেউ নন, স্বয়ং চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। এ মাসে দাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের যে সম্মেলন হলো, তাতে প্রথম চীনা প্রেসিডেন্ট হিসেবে বক্তব্য দিলেন সি। বক্তৃতায় তিনি বৈশ্বিক বাণিজ্যের বিস্তার যেন না থামে, তার পক্ষে কথা বলেন।
তাঁর প্রচেষ্টা অন্তত একভাবে সফল হয়েছে। কারণ, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল শিরোনাম করেছে, ‘চীনা প্রেসিডেন্ট সি বিশ্বায়নের নেতৃত্ব হাতে নিলেন।’ চীনা প্রেসিডেন্ট রিজিওনাল কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক প্রোগ্রামের (আরসিইপি) জন্য নতুন যে উদ্যোগের ডাক দিয়েছেন, তাতে তাঁর দেশ পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এমনকি যে দেশগুলোর টিপিপিতে যোগ দেওয়ার কথা ছিল, তাদের সঙ্গেও চীন আলাদাভাবে চুক্তি করার চেষ্টা করছে। কথা হচ্ছে, এই আরসিইপি টিপিপির পাল্টা উদ্যোগ নয়, কারণ অনেক দেশই এই দুই উদ্যোগে একসঙ্গে থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু টিপিপির ব্যর্থতার কারণে চীনের সামনে বাণিজ্য উদারীকরণের উদ্যোগে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ এসেছে।
তবে সি চীনকে বিশ্বায়নবাদী পক্ষের নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন, তা কিন্তু নতুন ব্যাপার নয়। এটা আসলে চীনের কূটনৈতিক প্রভাব বিস্তারের সর্বশেষ পদক্ষেপ। কূটনৈতিক প্রভাব মূলত খুবই অস্বচ্ছ এক শব্দবন্ধ, যা চালু করেছিলেন জোসেফ নাই। এর মানে হচ্ছে, একটি দেশ বলপ্রয়োগ ছাড়াই তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের সক্ষমতা কতটা অর্জন করেছে, সেটা। চীন বহু বছর ধরে কূটনৈতিক প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে প্রতাপ বাড়ানোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু তাতে সে ভালো ফল পায়নি। তবে এবারও সির এই আক্রমণাত্মক জনসংযোগ সেই একই কারণে অনুপযুক্ত হতে পারে, যে কারণে চীনের আগের প্রচেষ্টাগুলো নানা সমস্যার মুখে পড়েছিল।
চীন ২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিক ও ২০১০ সালে সাংহাই এক্সপো আয়োজন করে বৃহত্তর কূটনৈতিক প্রভাব অর্জনের চেষ্টা করে। এর মধ্য দিয়ে তারা আন্তর্জাতিক পরিসরে ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার চেষ্টা করেছে। যদিও এ ধরনের বড় আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করেও চীন কাঙ্ক্ষিত প্রচার পায়নি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, চীন ২০০৩ সালের পর ছয়বার মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতা আয়োজন করেছে। কিন্তু সম্প্রতি খবর বেরিয়েছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য চীনা সরকারের সমালোচনা করায় মিস কানাডাকে তারা ভিসা দেয়নি।
ওদিকে কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে চীন নিজের সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এই ইনস্টিটিউট বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অংশীদারত্বের মাধ্যমে চীনা ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর কোর্স চালু করেছে। কিন্তু যে অ্যাকাডেমিশিয়ানরা চীনা নীতির সমালোচনা করে, চীন তাদের টাকা দিতে চায় না। ফলে অনেক বড় বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক স্বাধীনতার জন্য কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেছে।
তবে সে থেমে থাকেনি, অদম্য শক্তির মতো সে পরিবেশের ইস্যুতে ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে স্বাক্ষর করাসহ নানাভাবে কূটনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছে। চীনা সরকার প্রবাসী চীনা নাগরিকদের সহায়তায় অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করেছে। উচ্চাভিলাষী আরসিইপি ও মহিরুহ ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচির মাধ্যমে সে তার বিশাল অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করতে চেয়েছে। তারা আশা করছে, অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করে তারা যেমন বৈশ্বিক বাণিজ্য বিস্তার করতে পারে, তেমনি এর মাধ্যমে তাদের অর্থনীতির পরিসরও বাড়বে, যার বদৌলতে তার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। বেইজিং ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ প্রকল্পে ৮৯ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করার কথা বলেছে, যার মধ্যে তারা ইতিমধ্যে ৪ হাজার কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
কিন্তু উদারনীতিবাদের অবতার হিসেবে চীন যেভাবে নিজেকে পুনরায় ব্র্যান্ড করতে চাইছে, তার পথে অনেক বড় বাধা রয়েছে। লন্ডনভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান পোর্টল্যান্ড কমিউনিকেশন ৩০টি দেশের কূটনৈতিক প্রভাববিষয়ক একটি জরিপের প্রতিবেদন প্রকাশ করলে দেখা গেল, চীন বহু চেষ্টাচরিত্র করেও এই তালিকার একদম শেষে স্থান পেয়েছে। মূল বাধাটা কিন্তু দৃশ্যমান: চীন প্রকৃত অর্থে উদার দেশ না হলেও সে পশ্চিমা উদার নীতি গ্রহণ করতে চায়। চীনবিষয়ক পণ্ডিত বিল বিশপ বলেছেন, ‘যে দেশ ফেসবুক, গুগল, টুইটার, ইউটিউব প্রভৃতি বন্ধ করে রাখে, তারা কীভাবে মানুষের হৃদয় ও মন জয় করতে পারে?’ সত্য হচ্ছে, চীনা সরকার এখনো কর্তৃত্বপরায়ণ, যার ফলে তাদের পক্ষে কূটনৈতিক প্রভাব অর্জন করা কঠিন। কারণ, অধিকাংশ মানুষই সংবাদমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা বা ভিন্নমত দমন পছন্দ করে না।
এমনকি অর্থনীতিতেও চীন সুরক্ষা নীতি অবলম্বন করে, ফলে সি যে উদার মূল্যবোধের নেতা হতে চাইছেন, তাতে তাঁকে কঠিন সময়ের মুখোমুখি হতে হবে। চীন যে নিয়মিতভাবে অন্য দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ মেরে দেয়, তার জন্য তো সে বিখ্যাত। একই সঙ্গে তারা বিদেশি প্রতিদ্বন্দ্বীদের খাটো করতে দেশীয় শিল্পে ভর্তুকি দেয় এবং চীনা শিল্পে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগে বাধা দেয়। ফলে চীন যে বাণী দিয়ে বেড়ায় তা যদি চর্চা না করে, তাহলে তারা উদারীকরণের বিশ্বাসযোগ্য নেতা হতে পারবে না।
এমনকি চীন বাণিজ্যের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণেও ভালো অবস্থায় নেই। কারণ, নৌ-চালনার স্বাধীনতা দেওয়ার ক্ষেত্রে তার রেকর্ড ভালো নয়। বাণিজ্যের স্বাধীনতার সঙ্গে নৌ-চালনার স্বাধীনতা অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। কিন্তু সে যেভাবে দক্ষিণ চীন সাগর থেকে অন্যদের হটিয়ে দেওয়ার অধিকার তার আছে বলে জোরগলায় বলছে, তাতে উদার বিশ্বব্যবস্থার রক্ষক হিসেবে তার দাবির বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে না।
সি যে বিশ্বায়নের রক্ষক বলে নিজেকে দাবি করছেন, তা প্রশংসনীয়। এর মধ্য দিয়ে চীনের কূটনৈতিক প্রভাব উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে তার সম্ভাবনা কম, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অর্থনীতি ও রাজনীতির দ্বার খুলে দিচ্ছে। কিন্তু যে সংস্কার কার্যক্রমে বহির্বিশ্বে চীনের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল কিন্তু দেশের ভেতরের পরিস্থিতি খারাপ হবে, সেটা তারা হাতে নেবে এমন সম্ভাবনা খুবই কম। ফলে সি টের পাবেন, এসব মুখে বলা যত সোজা, বাস্তবায়ন করা তার চেয়ে অনেক কঠিন।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, দ্য ডিপ্লোম্যাট থেকে নেওয়া।
জন ফোর্ড: চীনবিষয়ক বিশ্লেষক।
©somewhere in net ltd.