![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমার স্কুল জীবনের লেখাপড়ায় সবচেয়ে বিরক্তিকর বিষয় ছিল বাংলা ২য় পত্রের ভাবসম্প্রসারণ। এই বিষয়টা আমি একদমই পড়তে চাইতাম না। কিন্ত যেহেতু পরীক্ষায় একটি নম্বর নির্দিষ্ট থাকত ভাবসম্প্রসারনের জন্য, তাই প্রবল অনিচ্ছা থাকা সত্বেও ভাবসম্প্রসারনের চাপ্টারটি পরীক্ষার রাতে অন্তত একবারের জন্যে হলেও পড়তে হতো কিছু নম্বর পাওয়ার জন্য। তারপর পরীক্ষার হলে সব উত্তর দেওয়ার পরে যেটুকু সময় হাতে থাকত, সেই সময়টুকু ব্যয় করতাম নিজের ধারনা থেকে চিন্তা করে ভাবসম্প্রসারনের জন্য। তাতে কিন্ত পরীক্ষার খাতায় নম্বর খুব একটা খারাপ পেতাম না । কিন্ত যে সকল বাক্যগুলি ভাবসম্প্রসারণ করতে হতো, সেইগুলি যে বাস্তব জীবনে এতোটাই প্রয়োজনীয় বাস্তব সত্য, তা কিন্ত তখন একটুও বুঝতে পারিনি।
তখন শুধু পরীক্ষা পাশের জন্যই ভাবসম্প্রসারণগুলি পড়তাম। এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি য়ে, ঐ সকল নীতিবাক্যগুলি শুধু পরীক্ষা পাশের জন্য প্রয়োজন ছিল না, প্রয়োজন ছিল বাস্তব জীবনে প্রতিফলনের অভ্যাস গড়ে তোলার। সেই বাক্যগুলি ছিল পরীক্ষিত সত্য যা অনেকটা বিজ্ঞানীদের আবিস্কৃত বিভিন্ন সূত্রের মতো। তেমনি একটি বাক্য ছিল যা অনেকবারই পরীক্ষার খাতায় লিখতে হয়েছে প্রায় সকল ছাত্রকেই, আর সেই বাক্যটি হলো:”ভোগে নয়, ত্যাগেই সুখ”। এই বাক্যটির সত্যতা আমি আমার জীবনে বহুবার প্রয়োগ করে বাস্তবেই উপলব্ধি করতে পেরেছি এবং সেই সাথে এই বাক্যটির আরো একটি বড় গুনের সন্ধান আমি পেয়েছি, যা আমি শিরোনামের অংশ করেছি।
এই প্রসংগে আমি আমার জীবনের দুটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই সকলের আমার বক্তব্যের উপর বিশ্বাস স্থাপনের নিমিত্তে।যথা:
প্রথম ঘটনা: আমি একবার পাবনা থেকে বাসে করে ঢাকা আসছিলাম। টিকিট কেটে একে একে সকল সিটের যাত্রী ওঠে যায় শুধু একটি সিট খালি থাকে। কিন্ত সেই সিটেরও টিকিট বিক্রি হয়ে যায়, যে কিনা উঠবে গাড়ী ছাড়ার পরের স্টপেজ থেকে। যথারীতি গাড়ী ছেড়ে পরের স্টপেজে থামে ঐ যাত্রীকে নেওয়ার জন্য।যাত্রী উঠলে গাড়ী আবার ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে । কিন্ত বিপত্তি বাধে যখন নতুন উঠা যাত্রী তার সিটে বসতে যায় তখন। যাত্রী তার সিট নম্বর মিলিয়ে দেখে যে তার সিটে অন্য একজন যাত্রী বসে আছে এবং ঐ সিটের পাশের সারিতে একটি সিট খালি আছে যার হেলান দেওয়ার অংশটুকু রশী দিয়ে কোনরকম আটকাইয়া রাখা হইয়াছে অর্থ্যাৎ ঐ সিটে শুধু বসে যাওয়া যাবে কিন্ত হেলান দেওয়া যাবেনা এবং ঐ ভাংগা সিটটি মূলত পরে উঠা যাত্রীর সিটে যিনি বসে আছেন তার জন্য বরাদ্দকৃত । তখন পরে ওঠা যাত্রী তার সিটে বসে থাকা যাত্রীকে তার জন্য বরাদ্দকৃত সিটটি ছেড়ে দিতে বললে সিটে বসা যাত্রী সিটটি ছেড়ে দিতে অস্বীকৃতি জানায় । এই নিয়ে শুরু হয় দুইজনের মধ্যে প্রচন্ড বাগবিতন্ডা । এই বাগবিতন্ডা শেষ পর্যন্ত পুরো বাসে ছড়িয়ে পড়ে । বাসের যাত্রীরাও দুইভাগে ভাগ হয়ে প্রচন্ড ঝগড়ায় লিপ্ত হয় । একপক্ষ বলে যে, যে পরে বাসে উঠেছে সে ভাংগা সিটে বসবে, আর অন্যপক্ষ বলে যে, সিটে দেওয়া নম্বর অনুযায়ীই সবাইকে বসতে হবে । ঝগড়া শেষ পর্যন্ত এমন পর্যায়ে পৌছে যে , বাসের স্টাফদের বেশ কয়েকবারই উত্তম-মদ্যম খেতে হয় বাসের যাত্রীদের দ্বারা ভাংগা সিটের টিকেট বিক্রির জন্য । বাসের ড্রাইভারসহ অন্যান্য স্টাফরা বার বার ক্ষমা চেয়েও যাত্রীদের এই ঝগড়া থামাতে ব্যর্থ হয় । এক পর্যায়ে দুই পক্ষই মোবাইলে ফোন করে তাদের লোকদের লাঠি-সোঠা নিয়ে ঢাকার পথে তাদের নিজ নিজ এলাকার রাস্তায় আসতে বলে একপক্ষ আরেক পক্ষকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিতে থাকে । গাড়ির ভিতরে এতোটাই হট্রোগোল চলছিল যে, কাউকেই বুঝিয়ে শান্ত করা যাচ্ছিল না । ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই অসহনীয় লাগছিল । অবশেষে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে ঝগড়া থামানোর জন্য আমি ঐ ভাংগা সিটে বসে ঢাকা যাবো । আমার জন্য বরাদ্দকৃত সিটটি ছিল যেই সিটটি নিয়ে ঝগড়া চলছিল তার দুই সারি সামনে । আমি আমার সিট থেকে বের হয়ে ভাংগা সিটে বসা যাত্রীকে, যে কিনা তার ভাল সিটটিতে বসার জন্য ঝগড়ায় লিপ্ত রয়েছে, তাকে আমার সিটে এসে বসার জন্য অনুরোধ করলাম । তখন ঐ ব্যক্তি আমাকে জিজ্ঞেস করল যে, তাহলে আপনি কোথায় বসবেন ? তখন উত্তরে আমি বললাম যে আমি ঐ ভাংগা সিটে বসে যাবো, তাতে আমার কোন অসুবিধা হবে না । আমার ভালো সিট ছেড়ে ভাংগা সিটে বসে যাওয়ার প্রস্ততি দেখে, পুরো গাড়ির সব যাত্রী ঝগড়া-ঝাটি ছেড়ে একেবারে নিশ্চুপ হয়ে যায় । আমি যেই যাত্রীকে আমার সিটে বসার জন্য অনুরোধ করলাম, সে তখন লজ্জা পেয়ে নিজেই ঐ ভাংগা সিটে বসে গেল এবং আমার সিটে তাকে কোন ক্রমেই বসাতে পারলাম না । আর অন্যদিকে যার জন্য ভাংগা সিটটি বরাদ্দ ছিল, সেও তখন তার ঐ ভাংগা সিটে এসে বসার জন্য এতোক্ষন জোর করে বসে থাকা সিটটি ছেড়ে বেরিয়ে এলো কিন্ত তাকেও আর তার জন্য বরাদ্দকৃত ভাংগা সিটে বসতে দিলনা পরে উঠা যাত্রীটি, যে কিনা ভাংগা সিটে বসতে চাচ্ছিলনা এতোক্ষন যাবৎ । সামান্য একটা সিট নিয়ে কত বড় ঝামেলাই না হতে যাচ্ছিল বাসে অথচ আমার সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকারের মনোভাব কিভাবে ঝগড়াটি নিমিষেই শেষ হয়ে গেল । এই ত্যাগ স্বীকারটা যদি ঐ দুই যাত্রীর যে কোন একজন প্রথমেই করলে কিন্ত এতো বড় ঝগড়ার সৃষ্টি হতো না । ঐ দিনের এই শিক্ষা আমি পরবর্তিতে বহুবার কাজে লাগিয়ে অনেক ছোট-বড় সমস্যা মিটিয়েছি ।
দ্বিতীয় ঘটনা:একদিন আমি আমার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে বসে ব্যবসায়ীক কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম । এমন সময় আমার ছোট ভাইয়ের এক বন্ধু এসে আমাকে ডেকে বলল, ভাইয়া, আপনার সাথে আমার কিছু জরুরী কথা আছে, একটু দোকানের বাইরে আসেন । তখন আমি আমার ছোট ভাইকে দোকানে রেখে আমাদের দোকান থেকে একটুদূরে তাদের দোকানে গিয়ে বসি । তখন তাদের দোকানে আমি ও সে ছাড়া আর অন্য কোন লোক ছিল না । সে তখন কান্নাজড়িত কন্ঠে আমাকে বলল যে, ভাইয়া, আমি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়াছি, কারন এছাড়া আমার আর কোন উপায় নাই । আমি কি কারনে আত্মহত্যা করব, সেই কথাটা জানানোর জন্যই আপনাকে ডেকে এনেছি । আমি মরে গেলে সবাই যেন আমার আত্মহত্যার কারন জানতে পারে, সেইজন্য আমি সবকিছু আপনাকে জানাবো । তারকথা শুনে আমি পুরোপুরি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি । কি বলব তাকে, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলামনা । তার সমস্ত কথা শুনে আমি তার কাছে একদিন সময় চাইলাম । সে কিছুতেই সময় দিতে রাজি হচ্ছিলনা । আমি তাকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করলাম যে, আমি তার সমস্যা সমাধানের আপ্রান চেষ্টা করব । তারপরও সে আমার কথায় আশ্বস্ত হতে পারছিল না । তার এককথা যে তার এতোবড় সমস্যা আমার পক্ষে সমাধান সম্ভব না । তারপরও তার হাত ধরে কড়জোরে অনুরোধ করে তার কাছে একদিন সময় নিলাম, তাও শর্তসাপেক্ষে যে, তার দেওয়া সময়ের আগে আমি এই কথা কাউকে বললে আমাকে তার মরা মুখ দেখতে হবে । তার সমস্যাটি ছিল মূলত ব্যবসায়িক । ছেলেটি বেশ স্মার্ট , সুদর্শন ও চটপটে ছিল বিধায় সকলের ছোট হওয়া সত্বেও তাদের ভাইদের যৌথ ব্যবসার সকল কাগজ-পত্র ও মিল-ইন্ডাষ্ট্রীজ তার নামে ছিল । ক্যাপিটাল মেশিনারীজ ইম্পোর্ট করার সুবাদে তার খুব ঘন ঘন বিদেশ যাত্রাও হতো । ফলে তার বেশ বড় বড় ব্যবসায়ীদের সাথে ওঠ-বস ছিল । কিন্ত তার সবচেয়ে বড় ভাইটি ছিল বেশ লম্পট চরিত্রের । একদিন ব্যাংক থেকে বড় ধরনের লোন নেওয়ার কথা বলে তার নামে থাকা সকল ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান তার বড় ভাই নিজ নামে নিয়ে নেয় এবং তাকে শূন্যহাতে ব্যবসা থেকে বিদায় করে দেয় । এতে সে চরমভাবে আর্থিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং আত্মহত্যার মতো চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে । আমি সারারাত ভেবেচিন্তে যেকোন উপায়েই হোক ছেলেটিকে বাচাঁনোর চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নেই এবং প্রয়োজন হলে কিছু টাকাও তার জন্য জোগার করার চিন্তা করি । পরেরদিন তাকে নিয়ে নিরিবিলি একটা জায়গায় বসি । তারপর তাকে খুব ঠান্ডামাথায় বুঝাই যে তার ব্যবসা-বানিজ্য সব তার ভাই নিয়ে গেলেও তার যে অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে তা তো তার ভাই নিতে পারে নাই । সে যেন তার সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে পূনরায় দাঁড়াতে পারে সেই পরামর্শ আমি তাকে দেই এবং সেই সাথে তার যদি কোন অর্থের প্রয়োজন হয়, তবে তা আমি জোগার করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি তাকে দেই । এতে সে আমার কথায় আশ্বস্থ হয় এবং পুরোপুরি বিশ্বাস করে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে । তারপর সে আমার পরামর্শ মতো চলতে থাকে । যখনই তার সাথে আমার যাওয়ার প্রয়োজন পড়তো আমি তার সাথে যেতাম, আমার যত কাজই থাকত না কেন । অল্প কয়েকমাসেই সে তার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে পূনরায় আবার উঠে দাড়াল । তার এই উঠে দাঁড়াতে কিন্ত আমাকে একটি টাকাও খরচ করতে হয়নি ।শুধু মাঝে মাঝে তার সাথে বড় ভাই সেঝে বিভিন্ন জায়গায় চেষ্টা-তদ্বির করতে হয়েছে । আর এতেই তার বেশ কাজ হয়েছে । এখন সে অর্থনৈতিকভাবে আমার চেয়েও বেশ ভাল অবস্থায় পৌছে গেছে । তার জন্য আমার এই সামান্য ত্যাগ স্বীকার, তাকে সম্পূর্ন নূতন জীবন ফিরিয়ে দিয়েছে । এই কথা যখন আমি ভাবি, তখন আমার বেশ ভালো লাগে । তবে সবচেয়ে ভাল লাগে যখন তার সাথে দেখা হয়, তার সে কি কৃতজ্ঞতা ! সে কি করবে ? আমাকে কি খাওয়াবে ? তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে । সত্যি ! তখন বুকটা ভরে যায় খুশিতে । এখন বলুন, এতোটুকু ত্যাগ স্বীকার করা কি মানুষের জন্য খুবই কষ্টকর ? খুব কি ক্ষতি হয়ে যায় কারো ?
তাই আমি এখন নির্দিধায় বলতে পারি যে, আমাদের দুই নেত্রীর, যে কোন একজনেরও যদি এইরুপ ত্যাগ স্বীকারের মন-মানসিকতা থাকত, তবে আমাদের দেশের বর্তমানের এই অরাজক পরিস্থিতি থাকত না এবং যিনি এই ত্যাগ স্বীকারের মনোভাবাপন্ন হতেন, তিনি অবশ্যই সকল শ্রেনী-পেশার মানুষের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ও জনপ্রিয় হয়ে উঠতেন । ফলে ক্ষমতার পিছনে তাকে আর হন্নে হয়ে ঘুরতে হতো না, বরং ক্ষমতাই তার পিছনে পিছনে ঘুরত।
©somewhere in net ltd.