নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

পেশায় সাংবাদিক। ‘জল পরীর ডানায় ঝাপটা লাগা বাতাস’ (২০১৩), ‘সাদা হাওয়ায় পর্দাপন’ (২০১৫) দুটি কবিতার বই প্রকাশিত। তার লেখা নাটকের মধ্যে ফেরা, তৎকালীন, আদমের সন্তানেরা উল্লেখযোগ্য। লেখালেখির জন্য ২০১৫ সালে হত্যার হুমকি প্রাপ্ত হন।

সৈয়দ মেহেদী হাসান

আমার পরিচয় খুঁজচ্ছি জন্মের পর থেকেই। কেউ পেলে জানাবেন কিন্তু....

সৈয়দ মেহেদী হাসান › বিস্তারিত পোস্টঃ

মুন্সী জুয়েল আহম্মেদ : স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ও পাপ উইল করে গেছেন কবিতাকে

২৭ শে জুন, ২০১৬ দুপুর ২:১১



‘এমন অজস্র কথা আছে, যা লিখতে পারি না। পেশায় পুলিশ। মনের কথা বললে মানুষ ঘাড় তুলে তাকায়, হতবাক হয়।’

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে এ কথা বলে নিজেকে চেনাচ্ছিলেন তিনি। আমরা নিশ্চুপ। আড্ডা ধানসিড়ির শুক্রবারের এক আড্ডায় পরিচয় হবার পরের এ বক্তব্য। মনে আছে তার সম্পাদিত ‘ভেনাস বরিশাল’ ঐদিন হাতে তুলে দিয়েছিল। কেউ একজন খুব জোরে জোরে বলছিল, আপনিতো পুলিশ। আসামী ধরবেন। কবিতা ধরলেন কেন?

আমরা যারা ছিলাম হো হো করে হেসে উঠি। সেও হাসে। হাসি থামলে বলে, কবিতা ছাড়া আমার গতি নেই। ঐদিনের কথা আমরা কেউ আমলে নিয়েছিলাম কিনা জানি না। তবে তার স্বাভাবিক ও খোলামেলা আন্তরিক আচরণ দেখে আমিও তার বয়সীদের মত করে আলাপ আলোচনা পাতিয়ে দেই । অন্যদের মত ডাকতে আরম্ভ করি,পুলিশ কবি বলে। আর এ নামেই সমধিক চিনতো। কবির নাম আহম্মেদ জুয়েল। যদিও মৃত্যুর পরে মুন্সী জুয়েল আহম্মেদ নামটি ছড়িয়ে পরে। কর্ম জীবনে যেখানে যুক্ত ছিলেন অনায়াসে উচ্চ মধ্যবিত্ত হবার চেতনা বা হতে পারতেন। কিন্তু ওদিকটা বোধ করি তার ছিল না তা টের পেয়ে ছুটেছেন কবিতার পিছু। চাকরী শুরূ করেন পুলিশ সদস্য হিসেবে। পরে র‌্যাবে ছিলেন কয়েকদিন। জুয়েল জানতেন তার হাতে অস্ত্র কোন কাজেই আসবে না। তার চেয়ে কবিতা হতে পারে সমাজ ও জাতি গঠনের প্রধান হাতিয়ার। এ কথাই বলতো হরহামেশা। আর আমরা আহাম্মকের মত পিছনে গা টেপাটিপি করতাম ‘পুলিশ কবি’র কবিতার লাইন নিয়ে। তাতে কোন অভিমান জমেছিল কিনা জানা নেই ।

জুয়েল লিখেছেন,
‘কবি আমি
গুঞ্জন করি না কর্ণপাত
সবশেষে সত্য আমি’-(সত্য আমি)

তার কবিতা অতি সাম্প্রতিকতা বির্বজিত ছিল হয়তো। তবে শিল্প বির্নিমানে সময়টাকে ধরেছেন সচেতন ভাবে। কবিতাগুলো পাঠ করতে করতে এটা স্পষ্ট, কয়েকটি র্স্পশকাতর জৈবিক নিয়ামক নিয়ে উদ্গত কেটে গেছে কবি জীবন। প্রেমকে যেমন ছাড়তে পারেন না তেমনি মৃত্যুকে যন্ত্রনা হিসেবে দেখেছেন। নৈতিকতা তার যেন অলংকারের মত। এমনকি যৌনতাকে দিয়েছেন জীবনের সমান অহমিকা।
‘চিকন সুতায় ঢেকে রেখেছি
নিশির চাষের যৌবন’-(পরাজিত)

অথবা

‘বালিচোরার ঘাট’ এ বলেছেন,
‘ যাকে আলিঙ্গন যান্ত্রিক
পৃথিবীর বুকে একমুঠো রোদে
হাজারো তারার সঙ্গমে ধূসর পাখায়
ভেজা ওষ্ঠদ্বয় আত্মাহুতি দিয়ে
অপেক্ষমান ক্লান্ত দেহটা
যার শীতল মাটিতে হেলে দেব
সে কিনা দাবানলে পুড়িয়ে
আচমকা ভস্ম করে দিল।’

মুন্সী জুয়েল প্রত্যাহ পুড়েছেন জীবনের দংশনে। রক্ত, মৃত্যু, প্রহসন, তিরষ্কার, স্বার্থপরতা, মানুষে মানুষের দূরত্বে ঘুম আসতো না।

‘আমি জেগে থাকি অচেনা পৃথিবীর মত
স্বপ্নের আলখেল্লায় রক্তের দাগ’-(জীবন চিতা)

অবশিষ্টে কবির কিছু কি করার থাকে? সমাজ বাস্তবতায় সব হানাহানি, প্রেম, মিলন শব্দনোটের মত কত কি লিপিবদ্ধ করে চলে সে। নিজের আদালতে কাউকে খালাস দেয়, কাউকে জীবনভর ফাসিয়ে দেয়। কিন্তু পার্থিব শোনে না সে বক্তব্য। ফলে চিরন্তন একা কবি পৃথিবীর সব দায় নিয়ে চলেন। এখানেই হয়তো শিল্পমূলেন উদ্ভব।
‘দোষের পৃথিবীতে আমি
শূন্য দেয়ালিকা,
কি আর বলার আছে
বলে যাও বন্ধুরা,
কাল যদি সময় আসে
দেখাবো শান্ত পৃথিবীকে
কত সুন্দর ছিলে।’-(কথা)

সব দায় কবির সত্য । কিন্ত জুয়েল নিজেকে নিয়ে গেছেন অন্য এক প্রত্যয়ে। জীবনকে টপকে নিজেকেও ফেলে গেছেন অজ্ঞাত পোস্টখামে। সে যেমন বিশ্বাস করতো শেষ পর্যন্ত কবিতাই মানব মুক্তির পথ, একমাত্র স্বজন, শেষ পর্যন্ত কবিতাই আশ্রয়। তাই কবিতাকে দিয়ে গেছেন স্থাবর-অস্থাবর সকল সম্পত্তি। আমার অসম্ভব প্রিয় মুন্সী জুয়েল আহম্মেদ এর কবিতাটি, ‘কবিতা আর আমি’। আদ্যোপান্ত ছড়িয়ে আছে কবির রক্ত, মজ্জা, ঘিলু, হাড়, হৃদয়, নখ ও নখর্দপন।

কবিতা আর আমি

কবিতা লিখবো বলে
শব্দ কুড়াচ্ছি,
শব্দের খোলসে জীবন লুকিয়েছি,
তাই আমি আর কবিতা
দুজনে পাশাপাশি।
আমার চারপাশে যখন
ছিল আরষ্ঠ অন্ধকার,
নেহাত জেগেছিল বিদীর্ণ অন্তর,
চোখ জুড়ে ছিল
নোনতা জলের ফোয়া
ক্লান্ত দেহে নিথর হয়ে
পড়েছিল ভেজা কাষ্ঠচিতা,
তখন শক্ত করে স্থির চিত্তে
আমায় আগলে ছিল কবিতা।
তাই কবিতাকে উইল করেছি
আমার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ
আমার পাপ, আমার অবাধ্যতা।
আমার মাধুর্যতা আর আমার
বিশ্বাসী সনদ।
যৌবনের সবটুকু জের,
যখন আমি আর কবিতা
বসি পাশাপাশি
তখন পৃথিবীর
দেয়াল ছুঁয়ে নেমে আসে
নীরবতা, নিস্তব্ধতা,
জেগে থাকি পথহীন
আমি আর কবিতা।


১৯ ডিসেম্বর ২০১৪ শুক্রবার অপরাহ্ন। স্বপরিবারে যোগ দিয়েছিলাম একটি অনুষ্ঠানে। সম্ভবত ৪টা পনের বা কুড়ি মিনিট তখন। হেনরী স্বপন দাদার মোবাইল কল এলো।

-হ্যালো দাদা, কেমন আছেন?
-আচ্ছা তুমি কি মুন্সী জুয়েল আহম্মেদকে চিনতে?
-দাদা আমাদের পুলিশ কবি ! কেন?
-ওতো মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছে। আমি প্রথমে শুনে বিশ্বাস করিনি। ছুটে এসেছি মর্গে। জুয়েলতো মর্গে শুয়ে চির নিদ্রায় ঘুমিয়ে আছে....আমার সামনে ওর লাশ।

হেনরী স্বপন দাদার কণ্ঠটা ভিজে আসে।
একজন কবির মৃতদেহের সামনে আর অগ্রজ কবি স্থির থাকতে পারবেন না এটা স্বাভাবিক। আমি আসতেছি দাদা.... বলে মোবাইলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ছুটে গেলাম মর্গে। চুলগুলো এলোমেলো, ঠোট দুটি কয়লা কালো-আমাদের চিরচেনা কবি নিশ্চল শুয়ে আছেন।

পরের দিন চরিত্রহীন পত্রিকায় সংবাদ এলো, ট্রাকের চাপায় পুলিশ সদস্য নিহত। এটা সত্য যে পত্রিকাগুলোর কাছে একজন কবির চেয়ে একজন পুলিশ অনেক দামী। কারণ অপরাধ করে পুলিশের কাছ থেকেই মুচলেকা নিতে হয়। কোন কবির কাছ থেকে নয়। তাই কবি শব্দ বাদ দিয়ে পুলিশ শব্দ জুরে দিলে একটুতো হাওয়া দেয়া হল।

জুয়েল আহম্মেদ এর লাশ ডুম ঘরে রেখে আসতে আসতে মাথার মধ্যে কথা বলছিল যেন,
‘আমায় আগলে ছিল কবিতা।
তাই কবিতাকে উইল করেছি
আমার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ
আমার পাপ, আমার অবাধ্যতা।’


[মুন্সী জুয়েল আহম্মেদ কবি, পঁয়ত্রিশ বছরের যুবক, ২০১৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর সড়ক দুর্ঘটনায় বরিশালে নিহত হন। গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠি জেলার কাঠালিয়া উপজেলায়। বরিশালের আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন পাবলিক স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তার একটি শিশুতোষ গল্পের বই প্রকাশিত হয়েছে, গল্পের বইয়ের নাম ‘ভূতের রাজ্যে ভূত নেই’। ২০১৫ এর একুশে বইমেলায় কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, কিন্তু আকস্মিক মৃত্যুতে তা থেমে যায়। ‘কলাপাতা’ নামে একটি ছোটকাগজ সম্পাদনা করেছিলেন, ‘কলাপাতা’র প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় জৈষ্ঠ-১৪১৭, বরিশাল থেকে। ২০১৪ এর অগাস্ট-অক্টোবর সংখ্যা হিসেবে আরেকটি সাহিত্য পত্রিকা বের করেন, পত্রিকাটির নাম ‘ভেনাস বরিশাল’। পত্রিকাটি তিনি আহমেদ জুয়েল নামে সম্পাদনা করেন, যদিও তিনি মুন্সী জুয়েল আহম্মেদ নামেই পরিচিত। ২০১৫ সালের ২৩ জানুয়ারি তাকে নিয়ে জাতীয় কবিতা পরিষদ-বরিশাল শাখার সম্পাদনা পরিষদ একটি স্মরণপত্র প্রকাশ করেছে।]

মন্তব্য ৫ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ২৭ শে জুন, ২০১৬ বিকাল ৩:৩৬

ঘটক কাজী সাহেব বলেছেন: জুয়েল; জুলু, ' শুনেছি... এই নামের এক কবি ছোট বেলা কোথাও দাওয়াত খেতে গেলে, বাসায় ফেরার পরে কেউ যদি জিজ্ঞাসা করতো, কি দিয়ে খেয়েছ, বলতো... মাংস খাইছি একখান, ডিম খাইছি একটা, হাড্ডি কি মজা, দুধ আর আম খাইতে মনে নাই...;;


;;; ভালো থাকুন কবি সব সময়......

২৮ শে জুন, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:২৪

সৈয়দ মেহেদী হাসান বলেছেন: বুঝলাম না। কি বুঝােত চাইেলন মহামান্য?

২| ২৭ শে জুন, ২০১৬ বিকাল ৫:৩৪

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: আমি জেগে থাকি অচেনা পৃথিবীর মত
স্বপ্নের আলখেল্লায় রক্তের দাগ’-(জীবন চিতা)
দারুন বলেছেন!

‘আমায় আগলে ছিল কবিতা।
তাই কবিতাকে উইল করেছি
আমার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ
আমার পাপ, আমার অবাধ্যতা।’....

উনার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।

৩| ২৭ শে জুন, ২০১৬ বিকাল ৫:৫৮

অতৃপ্তচোখ বলেছেন: পুলিশ' চাকরিটা এক আজন্ম পাপ। তাদের হাজারো ভালো মিলিয়ে যায় এক জায়গাতেই তারা 'পুলিশ'!
আমরা ভালো মানুষ যারা কত কঠিন পাপই করি, কিন্তু পুলিশের সামান্য ভুলেই উদ্দার করতে থাকি পুরো পুলিশ সদস্যদের!
ভাল কিছু জানলাম। ভালো লেখেছেন। শুভকামনা

৪| ২৭ শে জুন, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:০৩

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: মরহুম কবি মুন্সী জুয়েল আহম্মেদের প্রতি রইল সশ্রদ্ধ সালাম। আল্লাহ তাঁকে বেহেশতে নসীব করুন।

ধন্যবাদ সৈয়দ মেহেদী হাসান।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.