নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

পেশায় সাংবাদিক। ‘জল পরীর ডানায় ঝাপটা লাগা বাতাস’ (২০১৩), ‘সাদা হাওয়ায় পর্দাপন’ (২০১৫) দুটি কবিতার বই প্রকাশিত। তার লেখা নাটকের মধ্যে ফেরা, তৎকালীন, আদমের সন্তানেরা উল্লেখযোগ্য। লেখালেখির জন্য ২০১৫ সালে হত্যার হুমকি প্রাপ্ত হন।

সৈয়দ মেহেদী হাসান

আমার পরিচয় খুঁজচ্ছি জন্মের পর থেকেই। কেউ পেলে জানাবেন কিন্তু....

সৈয়দ মেহেদী হাসান › বিস্তারিত পোস্টঃ

সভ্যতার সেরা পন্য ‘মানুষ’ ও নতুন রূপে মানুষ বিক্রি

২৮ শে জুন, ২০১৬ রাত ৮:৫১



কেউ নারী হয়ে জন্মায় না। জন্মানোর পর সে হয়ে ওঠে নারী। সিমোন দ্য বেভোয়ার সমাজের চোখে নারীর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে এ বক্তব্য দিয়েছেন। তার এই বক্তব্য শুধুমাত্র নারীদেরকেই প্রতিনিধিত্ব করছে না, সুদূরপ্রসারী চিন্তাক্ষেত্র খুলে দিচ্ছে। সমাজ ও নারী সম্পর্কে বেভোয়ারের উক্তিটি যতটা নারী সম্পৃক্ত তার চেয়ে দর্শনে উজ্জল। বহু ক্ষেত্র আছে যেগুলো এই তত্ত্বটি দিয়ে সহজভাবে উপস্থাপন করা যাবে বলে বেভোয়ারকে টেনে আনা। বেভোয়ারের চিন্তা ধরে এগোলে কেউ যেমন নারী হয়ে জন্মায় না, জন্মানোর পর সে হয়ে ওঠে নারী। তেমনি, কেউ অপরাধি হয়ে জন্মায় না, জন্মানোর পর হয়ে ওঠে অপরাধি। কেউ ছোটলোক হয়ে জন্মায় না। জন্মানোর পর হয়ে ওঠে ছোটলোক। দাস হয়েও জন্মায় না কেউ, জন্মানোর পরই তাকে দাস/দাসী হতে হয় বা বানানো হয়। দাসত্ব নিয়ে এরিষ্টটলের বক্তব্য যতটা না সামাজিক তার চেয়ে ভয়ংকর রকমের নির্যাতকের মত। তিনি বলেছিলেন, দাস প্রথা বাচিয়ে রাখা উচিত। কারণ যারা অসামর্থ বা পরাজিত তারা জয়ীদের উপকারে আসবে। তাদের দাস হয়ে থাকবে।

আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে এরিষ্টটল হয়তো ঝোঁকের মাথায় মন্তব্যটি করেছেন। আসলে কি তাই? ধর্মীয় দৃষ্টিকোন ও বৈজ্ঞানিক বর্ণনায় যতটুকু নিশ্চিত হওয়া গেছে, অতীতে তিনটি ভয়াবহ রেওয়াজ চালু ছিল মতান্তরে এখনো বিদ্যমান। এর মধ্যে (ইসলাম অনুসারে) আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগ, দ্বিতীয় (হিন্দু মতে) সতীদাহ প্রথা এবং তৃতীয়ত দাস প্রথা। সমাজ বিশ্লেষকদের অভিমত দু:শাসনের তিনটি সময়ই এখন অতীত। গল্পে, ইতিহাসে পড়া যায়। এমনকি এই সময়গুলো আর ফিরছে না সমাজে। কারণ আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে কন্যা সন্তান হলে তাকে জীবন্ত মাটিতে পুতে হত্যা করা হত এবং এ কাজটিকে সৎকর্ম বিবেচনা করা হত। সতীদাহ প্রথার অনুকূলে স্বামীর সাথে স্ত্রীকেও আগুনে ঝাঁপ দিয়ে পুড়ে মরতে হত এবং দাস প্রথায় মানুষকে পশুর মত ব্যবহার করতো। হাটে-বাজারে দর কষাকষি করে বিক্রি হত।

উল্লেখিত তিনটি অবস্থাার কোনটিই বর্তমানে কোন দেশে দেখা যায় না। পাশাপাশি এই প্রথাগুলো বন্ধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সহ-অবস্থান ধারণ করায় সমাজ বা রাষ্ট্র নতুবা যুগ পরিচালনা এর কোন নিদর্শণ নেই। ভবিষ্যতেও আসবে না। কিন্তু অবস্থা কি তেমন? কন্যা সন্তান জন্ম দেয়া পাপ, সতীদাহ পদ্ধতি সম্পর্কে কয়েকশ বছর ধরে জাতিগত কাউন্সেলিং চলার পর মানসিক অবস্থার উন্নতি হলেও দাস প্রথার বিষয়টি এখনো আপেক্ষিক রয়েছে। দাস প্রথা এখন আর নেই, বাতিল হয়ে গেছে এ ধরণের বক্তব্য যারা দিয়ে থাকেন সে সব সমাজ বিজ্ঞানীদের, সমাজ সম্পর্কে কতটুকু পর্যবেক্ষণ রয়েছে, সে ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করতেই হয়। তাদের এ কথাগুলো বানোয়াট ও জবরদস্তিমত ভূয়া মনে হয়।

দরিদ্র দেশকে উন্নয়নশীলের মাস্ক পরিয়ে বিশ্ব নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের যে বহুগামী রাজনীতি বিদ্যমান, দাস প্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেছে সেই বক্তব্য প্রদান করাও তদ্রুপ। আদতে আমরা দাসদের মুক্তি দিয়েছি কতটুকু?

এ বিষয়ে যাবার আগে দেখা উচিত দাস আসলে কি? দাসত্ব নিয়ে অষ্টাদশ শতক থেকে সমাপ্তির আলোচনা অনেক হয়েছে এবং এর পুর্বে দাস প্রথা নিরূপনে শ্রেনী সংগ্রাম হয়েছে। এ সময়ে বিশিষ্টজনেরা ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে দাসত্বকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। সে সমস্ত বর্ণনার সার কথায় গেলে আমরা অধিকারহীন শাসন আমল পাই। অর্থাৎ বিত্তশালী শ্রেণী অভাবীদের উপর চড়াও হতেন। মোদ্দাকথা বাধ্য করাটাই দাসত্বের সমান। কিন্তু বাধ্য করা ছাড়াও কোন যুগ শাসিত বা পরিচালিত হয়নি। সেক্ষেত্রে একটু পিছিয়ে সম্যক ধারণা কিংবা দৃশ্যত ক্রিয়াকলাপ নিয়ে চেষ্টা করা যেতে পারে, দাসত্ব কি? দৃশ্যত ক্রিয়াকলাপ বলতে ধরুন মানুষ বিক্রি করা। মাধ্যম ভেদে এর প্রচলন চলে আসছে এবং পনের শতক থেকে আঠারো শতক পর্যন্ত মানুষ বিক্রি হত বিধায় এটিকে শিরোনামে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে দাস প্রথা।



আদি কথাঃ

দাস প্রথা একটি অনুমোদিত সামাজিক ও আইনানুগ ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় বাজারে মানুষের আনুষ্ঠানিক বেচা-কেনা চলত এবং ক্রীত ব্যক্তি ক্রেতার ব্যক্তিগত সম্পত্তি রূপে কাজ করতে বাধ্য থাকত। প্রাচীন ও মধ্যযুগের প্রায় সব শাসন ব্যবস্থাতেই দাস প্রথার প্রচলন ছিল। গবাদিপশুর ন্যায় মানুষেরও কেনা বেচা চলত। অন্যান্য প্রায় সকল দেশের মতো বাংলায়ও প্রাচীনকাল হতেই দাস প্রথা প্রচলিত হয়ে আসছিল। শুধু আইন পুস্তক ও প্রশাসনিক গ্রন্থেই নয়, এ প্রথা সব ধর্মেও স্বীকৃতি ছিল। মেগাস্থিনিস উল্লেখ করেন যে, পাটলিপত্রের রাজার নিরাপত্তার দায়িত্ব ক্রীতদাসীদের ওপর ন্যস্ত ছিল। সব ধর্মীয় পুস্তকেই ক্রীত দাসদাসীদের সাথে সদ্ব্যবহারের উপদেশ দেওয়া আছে। দাস প্রথার ওপর প্রাপ্ত নথিপত্রে প্রমাণ মেলে যে, বনেদি সামাজিক-রাজনৈতিক কাঠামো ও গ্রামীণ উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে এ প্রথা সরাসরি সংশ্লিষ্ট। বাজারে মুক্ত শ্রমিক পাওয়া দুষ্কর থাকায় সমাজের শক্তিশালী শ্রেণি তাদের উৎপাদন ও প্রাধান্য অব্যাহত রাখতে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলতর শ্রেণির লোককে দাসে রূপান্তর করত। অভিজাত শাসকশ্রেণি, তাদের পারিবারিক ও অন্যান্য সামাজিক-রাজনৈতিক পদমর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার তাগিদে, সুবৃহৎ কর্মীবাহিনীর প্রয়োজন অনুভব করে। গণপূর্ত কাজ, যেমন সরকারি ভবন, বাঁধ, সেতু, সড়ক ও প্রধান পথের নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রাষ্ট্রের এক বিশাল শ্রমশক্তির প্রয়োজন ছিল। সৈন্য চলাচল ও তাদের রসদ সরবরাহের জন্যও শ্রমশক্তির প্রয়োজন ছিল। দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ ও শ্রেণিভেদ প্রথা যাদেরকে গুরুত্বহীন করে তুলেছিল প্রধানত তারাই দাস প্রথার বলি হতো। অভাবগ্রস্ত, নিঃস্ব, এতিম ও বিধবাদের অনেকেরই শেষ গন্তব্য ছিল ক্রীতদাস বাজার। দাস বাজারের অনেক ঠগ ও অপরাধী বিক্রি করার জন্য শিশুদের অপহরণ করত। আইনত ও প্রথাগতভাবে, ক্রীতদাস-দাসীরা ও তাদের সন্তান-সন্ততিরা তাদের মালিকের সম্পত্তি রূপে পরিগণিত হতো। ক্রীতদাস-দাসী হস্তান্তরযোগ্য পণ্য ছিল। তাই, অনেক মালিক তাদের উদ্বৃত্ত বা অপ্রয়োজনীয় দাস-দাসীদের বাজারে বিক্রি করে দিত। দাস-দাসীদের আমদানি ও রপ্তানি দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ খ্যাত ছিল।

বাংলার সুলতানগণ আফ্রিকা, তুরস্ক, পারস্য ও চীনদেশ হতে দাস-দাসী আমদানি করতেন বলে জানা যায়। এ ধরনের কিছু ক্রীতদাসকে মুক্তি দেওয়ার পর মন্ত্রী, প্রশাসক, এমনকি সেনাপতির পদেও উন্নীত করা হয়েছিল। পনেরো শতকের শেষদিকে আবিসিনীয় বংশোদ্ভূত দাসগণ স্বল্পকালের জন্য বাংলায় তাদের নিজস্ব শাসন ব্যবস্থাও কায়েম করেছিল। বাংলার বাজারে ১৮৩০ সাল পর্যন্তও হাবশী ও কাফ্রী নামে পরিচিত আফ্রিকান ক্রীতদাস-দাসী আমদানি করা হতো। বাংলায় সাধারণত ধনী স্ভ্রান্ত মুসলিমগণ ও ইউরোপীয় বণিকগণ কঠোর পরিশ্রমী ও কর্তব্যনিষ্ঠ বলে খ্যাত হাবশীদেরকে দাস হিসেবে রাখত। ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্য পরিবহণ ও কারখানা প্রহরার জন্য নিয়মিত শ্রমিকের বিকল্প হিসেবে ক্রীতদাসদের নিয়োগ করত। ইউরোপীয় অধিবাসীদের মধ্যে ক্রীতদাস রাখার এমনই রেওয়াজ হয়ে গিয়েছিল যে, স্যার উইলিয়ম জোনস এর ন্যয় একজন মানবতাবাদী, আইনজ্ঞ ও পন্ডিত ব্যক্তিরও চারজন ক্রীতদাস ছিল। ক্রীতদাসদের মধ্যে সবচেয়ে দামি হাবশী দাসগণ খানসামা, পাচক (বাবুর্চি), গায়ক, নাপিত, গৃহ প্রহরী ইত্যাদি হিসেবে তাদের প্রভুদের সেবায় নিয়োজিত হতো। দাসদের মধ্যে তাদের মর্যাদা এত উচুঁ ছিল যে, তাদের মালিকগণ তাদের ব্যবসা সংক্রান্ত ও গৃহ পরিচালনা বিষয়ে এবং রাজনৈতিক ব্যাপারেও তাদের সাথে পরামর্শ করতেন। অভিজাত সম্প্রদায়ের হারেমে নিয়োজিত খোজাদের মধ্যে হাবশী দাসদের সংখ্যাই সর্বাধিক ছিল। আঠারো ও ঊনিশ শতকের গোঙার দিকে বাংলার বাজারের জন্য কেবল আফ্রিকাই নয়, বরং আরব, চীন, মালয়, আরাকান ও আসাম হতেও ক্রীতদাস আমদানি করা হতো। আরব দেশ থেকে আনীত দাসদের অধিকাংশই হতো খোজা। বাংলার বাজার হতে ক্রীতদাস রপ্তানিও হতো। ইউরোপীয় বৈদেশিক উপনিবেশগুলির জন্য বাগান শ্রমিক হিসেবে বঙ্গীয় বংশোদ্ভূত দাসদের চাহিদা ছিল।

দাস মুখ্যত দু’ধরনের ছিলঃ (১) গার্হস্থ্য ও (২) কৃষিকার্যাধীন

একটি স্ভ্রান্ত পরিবারে গুটি কয়েক দাস থাকবে সেটাই ছিল সামাজিক প্রত্যাশা। তারা পদ ও মর্যাদার প্রতীক ছিল এবং তা কেবল স্ভ্রান্ত জমিদারের ক্ষেত্রেই নয়, মধ্যবিত্ত ও ধনী কৃষকদের বেলায়ও ছিল। হিন্দু মালিকগণ দাস গ্রহণের সময় তাদের গোত্রের বাছবিচার করতেন। ঐ বিবেচনায় কায়স্থ, গোয়ালা, চাষা, বৈদ্য প্রভৃতি গোত্রের দাসদের শুদ্ধ (পবিত্র) এবং শূদ্র, তাঁতি, তেলি, ডোম, বাগ্দি, কৈবর্ত, জোলা, চন্ডাল প্রভৃতিদের অশুদ্ধ (অপবিত্র) বলে মনে করা হতো। কোনো ব্রাহ্মণকে দাসে পরিণত করা ধর্মে নিষিদ্ধ ছিল। শুদ্ধ গোত্রের দাসদের ঘরের ভেতরের কাজে এবং অশুদ্ধদের বাইরের কাজে লাগানো হতো। মুসলিম পরিবারের দাসদাসীরা মুসলমান না হলে তাদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করতে হতো। হিন্দু সমাজে দাসদের ক্রীতদাস বা শুধু দাস এবং যারা স্ত্রীলোক তাদেরকে দাসী বলা হতো। মুসলমান সমাজে পুরুষ দাসদের বলা হতো গোলাম বা নফর এবং স্ত্রীলোকদের বান্দি বা লৌন্ডি। লৌন্ডিরা সুদর্শনা হতো এবং তাদেরকে বাজার থেকে কেনা হতো। তাদের প্রয়োজন ছিল গার্হস্থ্য শ্রমিক রূপে নয়, বরং প্রধানত উপ-পতœী রূপে। হিন্দু ও মুসলিম, উভয় আইন মোতাবেক, যৌন পরিতৃপ্তির জন্য ক্রীতদাসীরা ব্যবহৃত হতে পারত। তাদের সন্তান সন্ততিগণও দাস-দাসী হতো, তবে হিন্দু ও মুসলিম আইন অনুযায়ী, তারা মালিকের জমিজমায় নামমাত্র কিছু অধিকার অর্জন করত।

কৃষি কার্যাধীন দাসের সংখ্যাই ছিল সর্বাধিক। বাজার হতে মুক্তশ্রমিক প্রাপ্তি সম্ভবপর না হওয়ায় সম্ভ্রান্ত স্তরের ও ধনী কৃষক শ্রেণির কৃষিকাজে ক্রীতদাস ব্যবহারের কোনো বিকল্প ছিল না। অতীতকাল থেকে উনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত বাংলায় কৃষি কর্মোপযোগী দাস বা দাসখত লেখা শ্রমিক ব্যবহারের ব্যাপক রেওয়াজ ছিল। কেউ সম্পদবিহীন হয়ে স্বাধীন জীবন ধারণে অক্ষম হলে, ইচ্ছুক সম্পদশালী কোনো পরিবারের নিকট নিজেকে বিক্রি করত। এসব পরিবার এ ধরনের অভাগাদের কিনে তাদের ক্ষেতের কাজে লাগাত। তারা সব ধরনের কৃষিকাজ করত যথা, মাটি খনন, পানি সেচ, গো-চারণ, মাছ ধরা, নির্মাণ কাজ ইত্যাদি। শ্রমের বিনিময়ে তারা তাদের প্রভুদের কাছ থেকে খাদ্য, বাসস্থান, বস্ত্র এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে বৃদ্ধ বয়সের ভরণপোষণও পেত। অনেক ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি মহাজনদের কাছে তাদেরকে বিক্রি করে দিয়ে তাদের দেনার দায় পরিশোধ করত। দেনার কারণে দাসত্ব, আজীবন অথবা জীবনের খানিক অংশের জন্য, হতে পারত।
যেসব জেলায় বিশেষভাবে কৃষিনির্ভর দাস প্রথার প্রচলন ছিল সেগুলি হচ্ছে সিলেট, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও ঢাকা। আইন কমিশনের (১৮৩৯) প্রতিবেদনে দেখা যায়, এসব জেলায় প্রতি পাঁচ জনের একজনই ছিল দাস।

সাধারণ দাস বাজার থেকে ক্রয় না করে সরাসরি সামাজিক উৎস হতে কৃষিনির্ভর দাস সংগ্রহের রেওয়াজ ছিল। অভাব, দুর্ভিক্ষ, নদী ভাঙন, পরিবারের উপার্জনকারী সদস্যের মৃত্যু প্রভৃতি দুর্যোগ কবলিত ব্যক্তিদের বেঁচে থাকার তাগিদে স্বেচ্ছায় দাসত্ব গ্রহণ করতে হতো। তাদের বেলায় বংশপরম্পরায় গার্হস্থ্য শ্রমিক হিসেবে থেকে যাওয়াই অবধারিত ছিল। তাদের বয়স, শারীরিক গঠন, লিঙ্গ, গোত্র, জাতি, এবং সর্বোপরি দেশের চলতি অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় তাদের মূল্য নির্ধারিত হতো। উনিশ শতকের প্রথম দিকে শিশু ও বৃদ্ধদের বাজার দর ছিল পাঁচ থেকে সাত টাকা। স্বাস্থ্যবান তরুণ দাসদের মূল্য হতো কুড়ি থেকে পঞ্চাশ টাকা। অভাব ও দুর্ভিক্ষ হলে বাজার দাসে ছেয়ে যেত এবং তখন দাম পড়ে যেত।

আঠারো শতকের শেষের দিকে ইউরোপে প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাস প্রথার অবলুপ্তি ঘটে। দাস প্রথাধীন শ্রমিক ব্যবস্থা শিল্পায়ন ও শিল্প-বিপ্লবোদ্ভূত মানবিক নব মূল্যবোধের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ প্রতীয়মান হয়। দাস শ্রমের চেয়েও মুক্ত শ্রম অবশ্যই অধিকতর উৎপাদনমূখী ছিল। শিল্পবিপ্লবহীন বাংলার অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা তখনও দাস শ্রম ও দাস শোষণ প্রথা আঁকড়ে ছিল। তাই, সহজে দাস শ্রমের বদলে মুক্ত শ্রমের প্রবর্তন সম্ভবপর হয় নি। দাস প্রথার সমর্থনে উপনিবেশিক শাসকগণের আর একটি যুক্তি ছিল যে, হিন্দু ও মুসলিম উভয় ধর্মে এর সমর্থন রয়েছে। কিন্তু, ইউরোপে মানবতাবাদী আন্দোলনের প্রভাবে, উনিশ শতকের গোঙা থেকে, এবং গুরুতর ভাবে ১৮২০ সাল হতে, ব্রিটেনে ক্ষমতাসীন সরকার দাস প্রথা নিরুৎসাহিত করে। ১৮৩৩ সালের চার্টার অ্যাক্ট দ্বারা যথাসম্ভব দ্রুত সব ধরনের দাস প্রথা অবলুপ্ত করার সুস্পষ্ট পদক্ষেপ নিতে কলকাতার সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়। ধাপে ধাপে দাস প্রথার অবলুপ্তির জন্য ১৮৪৩ এর ‘অ্যাক্ট ফাইভ’ প্রণীত হয়। এ আইনের আওতায় দাস রাখা অপরাধমূলক ছিল না, এতে কেবল মুক্ত ব্যক্তি ও দাসের মধ্যে আইনগত পার্থক্যের অবসান ঘটানো হয়েছিল। আইনে বিধান রাখা হলো যে, কোনো আদালত কোনো দাসের ওপর কারও দাবি গ্রাহ্য করবে না। এ আইন সব দাসদের মুক্ত বলে ঘোষণা করে নি। বরং আইনে বলা হলো যে, কোনো দাস ইচ্ছে করলে তার মালিককে পরিত্যাগ করে স্বাধীনভাবে বাস করতে পারবে। দাস আমদানি ও রপ্তানি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তবে, বাস্তবক্ষেত্রে দাস প্রথা হঠাৎ করে থেমে যায় নি। দাস প্রথা সামাজিকভাবে ঘৃণ্য ও পরিত্যাজ্য বিবেচিত হতে আরও কয়েক দশক লেগে যায়। মুক্ত শ্রমের ব্যবহার বৃদ্ধি, শিল্পায়নে ক্রমিক অগ্রগতি, এবং উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ হতে মানবতাবাদী আন্দোলনসমূহ দাস প্রথাকে ধীরে ধীরে জনগণের নিকট অপ্রিয় ও সমাজে অগ্রহণযোগ্য করে তোলে। বিশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলা দাস প্রথা হতে মুক্ত হয়।

এখানে স্পষ্ট উল্লেখ করা আছে দাসদের দুটি ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হত। ক্ষেত্র দুটি এখনো মানব সমাজে বিদ্যমান। সমাজ গঠন করতে হলে যেহেতু পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটি অত্যাবশ্যকীয় তেমনি পরিবারের উৎপত্তি যৌনত দিয়ে। ফলে দাস প্রথা, দাস রাখা না রাখার ক্ষেত্রেও গৃহস্থলী এবং যৌনতার মুখ্য। পূর্বে যৌন আকাঙ্খা মেটাতে দাসী/ বন্দী রাখা হত ও গৃহস্থলীর জন্য দাস রাখা হত। যেহেতু অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে দাস/ দাসী নিযুক্তের নামে মানুষ অন্য কোন মানুষকে নির্যাতন করে পশুর মর্যাদায় নিয়ে গেছে প্রসঙ্গ সিদ্ধান্ত হয় দাস প্রথা রহিতকরণ। ফলে সেই দাস/ দাসী শব্দের সমার্থক কিছু শব্দ ঢুকে পড়ে। যেমন ২০০১ সালের দিকে জেএমবি’র শীর্ষ সন্ত্রাসী বাংলা ভাই মদ এর নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলা’ রেখে কুরআনের নির্দেশ মান্য করার ফতোয়া দেয়। তার যুক্তিটা ছিল ধর্মে মদপান হারাম। কিন্তু ‘বাংলা’ বলতে কোন শব্দের উপর নিষেধাজ্ঞার নজির ধর্মগ্রন্থে নেই। সে শুধু মদের নাম পাল্টে ধর্মকে ফাঁকি দিয়ে লৌকিকভাবে সাধু সেজে ছিলেন।

এখানের ক্রিয়াকলাপও তদ্রুপ। দাস প্রথা রহিতকরণ হলে নাম পাল্টে ভিন্ন নামে একই কাজ চলছে সারা বিশ্বে। এক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য দাস এর কাছাকাছি কতগুলো শব্দ অঞ্চল ভেদে প্রচলিত রয়েছে। যেমন: কামলা, বদলা, ঠিকা, লেবার, শ্রমিক, দিনমজুর, ভৃত্য, চাকর, কাজের লোক ইত্যাদি। বাংলা অভিধানে শব্দগুলোর অর্থ দেখলেই বোঝা সম্ভব এ সকলের সাথে দাস এর সাজুয্য কতখানি। অভিধানে শ্রমিক শব্দের অর্থ লেখা আছে নীচকর্মচারী; ঘৃনিত, নীচ। আর এই শ্রমিক শব্দের আঞ্চলিক সমার্থক শব্দ হিসেবে অন্যান্য শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়। যেমন শ্রমিককে বরিশাল অঞ্চলে ‘বদলা’ বলা হয়। চট্টগ্রাম অঞ্চলে ‘কামলা’ আর নগরায়ন বিশেষিত যেমন ঢাকায় বলা হয় ‘কাজের লোক’।

অপরদিকে দাসী এর কাছাকাছি শব্দ কাজের বুয়া, কামের বেটি, যৌনকর্মি, পতিতা, নটি, বেশ্যা, খানকি, মাগী, ভৃত্যা, চাকরানী ইত্যাদি।

উল্লেখিত শব্দগুলো যাদের সাথে সম্পর্কিত তাদের বিবেচনা করা হয় অর্থমূল্যে ক্রয় করা যায় এবং এরা অর্থমূল্যে বিক্রি হয়। অর্থাৎ দাস প্রথায় যেমন মানুষকে ক্রয়-বিক্রয় করা হত তদ্রুপ কামলা, বদলা, কাজের বেটি, খানকি এদের ক্রয়-বিক্রয় সম্ভব। অতএব আমরা আপতত সিন্ধান্তে আসতে পারি অষ্টাদশ শতকে দাস প্রথা রহিতকরণের যে সিদ্ধান্ত তার মাধ্যমে প্রথাটি কেবল নাম পরিবর্তন করে সমার্থক অন্য কিছু শব্দের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। চূড়ান্তভাবে সিদ্ধান্তে আসতে হলে আমাদের জানা উচিত ঐ সময়ে দাস/ দাসী এবং এখনকার কামলা/ যৌনকর্মীর কর্মকান্ডের মিল আছে কি নেই। এ পর্যায়ে বাংলাদেশ ও বরিশাল কয়েকটি প্রতিবেদন পর্যালোচনা করা যেতে পারে।



মেয়ে মানুষ কেনা-বেচাই ব্যবসা

‘ওদের সবাইকে ফাঁদে ফেলেছি। কারো সাথে প্রেমের জাল ফেলে, কেউ কাজ খুঁজতে এসে এ পথে নেমেছে। স্বেচ্ছায় আসেনি কেউ। এমনও আছে মারধর করে এখনো হোটেলের রুমে আটকে রাখা হয়েছে। আমার কি করার আছে, আমিতো ওদের বেঁচে দিয়েছি। মেয়ে মানুষ আমার কাছে জিনিসের মত, কেনা বেচাই আমার ব্যবসা।’ গল্পে পড়া কোন ঘটনার ভূমিকা এটি নয়। সহজ-সরল মেয়েদের যারা নষ্ট পথে নিয়ে আসে, করে ফেলে যৌনকর্মি। সমাজ যাদের বেশ্যা বলে ঘৃণা করে। সেই বেশ্যাদের কারিগরদের একজনের বক্তব্য। মানুষ কেনা-বেচা বরিশালে উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে এমন সংবাদের ভিত্তিতে অনুসন্ধান চালাই। খুঁজতে থাকি মানুষ বিকিকিনির ব্যবসায়ীদের মুনাফা জুগীয়ে দিতে কারা কাজ করে প্রান্তিক পর্যায়ে। খোঁজ পাওয়া গেল এক দালালের। নাম আরাফাত। বয়স ৩৫। নিজের বাড়ির কথা জানালো খুলনার খালিশপুর। পিতা মৃত মজিদ মৃধা। খুলনার বাসিন্দা হলেও পাওয়া গেল তাকে মহসিন মার্কেটের দ্বিতলায় মা-বোর্ডিংয়ে। যে হোটেলটির মালিক ১০নং ওয়ার্ড বিএনপির সেক্রেটারি সাঈদ। প্রথম পরিচয়ে আরাফাত জানালো সে হোটেলের কর্মকর্তা হারুন, শামীম ও ইউসুফের আত্মীয়। ঘনিষ্ঠতা বাড়ালে স্বীকার করে সে নারীর দালাল। এবার ৩ জনকে নিয়ে এসেছে বরিশালে। এর মধ্যে একজনের নাম সাথী। আরাফাত জানায় ২ বছর আগে ২০১২ সালে ভোলা থেকে ফাঁদে ফেলে সাথিকে। প্রেমে করে প্রথমে পালিয়ে যায় চট্টগ্রামে। সেখানে একটি চক্রের কাছে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করে। ঐ চক্রটি দেহ ব্যবসায় বাধ্য করে সাথীকে। পরে ২০১৩ সালে তাকে (আরাফাত) পুনরায় নিজ জিম্মায় আনে। তবে দেশীয় অস্ত্র দেখিয়ে কারো কাছে কিছু বলতে নিষেধ করে। এমনকি নিয়মিত মারধর করে। সাথী জানায়, এরপর আর কোনদিন ভোলা ফিরে যাইনি। গেলে আমার এই অবস্থার কথা জেনে কেউ ঘরে নেবে না। অসহায় সাথীর বয়স এখন ১৭। এক পর্যায়ে আরাফাতকে গণমাধ্যমকর্মীর পরিচয় খুলে বললে হোটেল ছেড়ে কৌশলে পালিয়ে যায়।। আরাফাতের গতিবিধি অনুসরন করে পুনরায় জর্ডন রোডে পাওয়া যায়। সে আরো স্বীকার করে নারী বেচা কেনার সাথে দীর্ঘ ১০ বছর জড়িত রয়েছে সে। এ পর্যন্ত ১২/১৩ জন মেয়েকে ফাঁদে ফেলে ব্যবসায় নামিয়েছে। কি ধরনের টাকা পায় জানতে চাইলে জানায় ভালো মেয়ে বেচে দিলে ১০ বা ২০ হাজার টাকা পাওয়া যায়। তবে এ কাজে দীর্ঘদিন জড়িতদের হোটেলে দিলে প্রতি খদ্দেরের টাকা থেকে ২০ টাকা পাবার চুক্তিতে কাজ করছে। এইবার হোটেল আজ, মা বোর্ডিং ও হোটেল পায়েলে দিয়েছে। তাকে বরিশাল এনেছে কে জানতে চাইলে জানায় মা বোর্ডিংয়ের হারুন। পুলিশের হাত থেকে আত্মরক্ষার্থে যাকে নিয়ে আসে তার সাথে স্বামী-স্ত্রীর পরিচয় দেয়। আরাফাত জানায় তার নিজেরও একটি হোটেল আছে খুলনায়। হোটেলের নাম মুসাফির।

বরিশালে মানুষ বিক্রির হাট

মাত্র দুই থেকে আড়াইশ টাকায় পাওয়া যায় জ্যান্ত একজন মানুষ। অবাস্তব হলেও মানুষ বিক্রির এমন হাটের অস্তিত্ব আছে আমাদের বরিশালেই। একেবারে পন্যের মত দর কষাকষিতে বিক্রি হওয়া এসব মানুষকে কেনার পর তাকে দিয়ে করানো যাবে যে কোন কাজ, নিয়ে যাওয়া যাবে যে কোন জায়গায়। একেবারে দাসের মত কাম করি, বলল বিক্রি হওয়া ইউনুস শরীফ। নগরীর মরকখোলার পুল ও সাগরদী পুলে খোঁজ মেলে মধ্যযুগীয় এমন হাটের। এটাকে যদি দাস প্রথার সময়কার কোন চিত্রের সাথে মিলিয়ে নেবার চেষ্টা করি তাহলে কেউ দাস ব্যবস্থার সে সময় থেকে বর্তমান সময়কে পৃথক করতে পারবেন না। মরকখোলার পুল ও সাগরদী পুলে প্রতি খুব সকালে জড়ো হয় পঞ্চাশ থেকে একশ মানুষের। চলে দর কষাকষি। মানুষের ভিড় দেখে মনে হয় এরাই হয়তো ক্রেতা-বিক্রেতা। হাটে যে মানুষগুলো জড়ো হয় তাদের মধ্যে কয়েকজন ক্রেতা ছাড়া বাকি সবাই এখানে পন্য! দক্ষিণের এই জনপদে অনেকেই পরিবারের সদস্যদের মুখে খাবার তুলে দেবার জন্য বাধ্য হয়েই নিজের ইচ্ছেতেই নিজেকে বিক্রি করার জন্য আসেন এখানে। কারন এদের নিজস্ব মুনাফা নেই যা দিয়ে পন্যের ব্যবসা করবে। ফলে নিজেই পন্য হয়েছেন। কেউ কেউ বিক্রি হন আবার কেউ কেউ পরের দিনের জন্য অপেক্ষা করেন। পরের দিন আবার আসেন নিজেকে বিক্রি করার যুদ্ধে। জসিমউদ্দিনকে কিনে নিয়ে যাচ্ছিল এনায়েত হোসেন নামে এক ভদ্রলোক। তিনি জসিমকে দাস বলতে নারাজ। তবে ‘বদলা’ বা শ্রমিক বলতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। জসিমউদ্দিন জানায়, সকাল ৮টায় কাম শুরু হরমু। এক্যরে সন্ধ্যায় শ্যাষ করমু। দিনে চাইরশ টাহার চুক্তি। কি কি কাজ করার কথা হয়েছে জানতে চাইলে এনায়েত হোসেন জানান, টাকা দিয়া ঠিক করছি। যতডু পারি করামু। টাইম শ্যাষ হওনের আগেতো যাইতে পারবে না।

সরেজমিন কথাঃ

সরেজমিনে নগরীর কয়েকটি মানুষবিক্রির স্পট ঘুরে জানা গেল ভুক্তভোগীদের নানামুখি অভিজ্ঞতার বর্ননা। সুলতানা আক্তার। বয়স ১৪-১৫ বছর। মূল বাড়ি বাকেরগঞ্জে। তবে বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্ন ঠিকানা বলে থাকে। সুলতানার জীবনের গল্পটা আর দশটা বিক্রিত মানুষের জীবনের মত। ১৫ জুন কথা হয় বরিশাল সামাজিক প্রতিবন্ধি মেয়েদের পুর্নবাসন কেন্দ্রে। এখানে নানা ধরনের প্রতারনার শিকার মেয়েদের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে। সুলতানা জানায়, বড় চাকরীর আশায় আমাগো গ্রামের পোলা রফিকের লগে পলাইয়া গেছালাম। হে পেরথম আমারে নিয়া ফরিদপুর একজনের ধারে যায়। হেই জায়গায় ফালাইয়া থুইয়া যায়। ঐ জায়গায় বুঝি নাই যে মোরে বেইচ্চা দেচে। হেরপর তিনমাস অনেক মাইর-ধইর সইছি। হের পর আর কি.....এই কামে নাইম্মা গেলাম। পুর্নবাসন কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক মোঃ আসাদুজ্জামান জানান, এখানে যারা আসে তাদের অধিকাংশ মেয়েরা বিক্রি হয়ে যাওয়া বা জিম্মি হয়ে যাওয়া। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় এটা মনে হচ্ছে, দারিদ্রতা ও পারিবারিক কলহের কারনে ছেলে মেয়েরা পরিবারের প্রতি বিরাগভাজন হয়। এই সুযোগ কাছে খাটিয়ে দালালরা স্বার্থ হাসিল করে। গোপন সংবাদ পাওয়া যায় হোটেল গালিবে ‘চালান’ এসেছে। মানব পন্য এলে এরা চালান বলে। সূত্র মতের তথ্যানুযায়ী ১৭ মার্চ অনুমানিক রাত সোয়া নয়টার দিকে গালিবে উপস্থিত হলে দেখা যায় চারজন ১৫-১৯ বছর ও একজন ২৫/২৬ বছর বয়সী নারীকে নিয়ে একটি কক্ষে বসে আছে তিনজন। কথা শোনা যাচ্ছিল, এই ছেমরির শইল ধেকতে বালো না। এইডা বাদ। ঐডাতো বুড়া। বাকি তিনডার দাম দিমু বিশ (বিশ হাজার টাকা)। অন্য একজন বলল, কয় পার্সেন্ট আমি পামু? কথার এক ফাকে দরজা ঠেলে ভিতরে গেলে কথা বলতে থাকা লোকগুলো নড়েচরে বসে। পরিচয় জানতে চাই একজন মিলন অন্যজন এনামুর এবং তৃতীয়জন মনির নামে পরিচয় দেয়। তারা জানিয়েছিল, ব্যবসায়িক একটা হিসাব করছিল। আর পাশে থাকা নারীদের বিষয়ে জানতে চাইলে জানায়, ওরা এখানে কাজ করে। পরে মনির হোসেন জানায়, এদের কেবল নিয়ে আসা হয়েছে চট্টগ্রাম থেকে। তবে সেই নারীদের সাথে কথা বললে তাদের ভাষাগত উচ্চারনে সবাইকেই দক্ষিনাঞ্চলের মনে হয়েছে। প্রশাসনের ব্যপারে জানতে চাইলে জানায়, লাভ নাই ভাই। ওনারা রেগুলার টাকা নেয়।
একইভাবে মানুষ বিক্রি হয় বিভিন্ন দোকান, রেস্টুরেন্ট, ওয়ার্কশপে। সেখানে যারা বিক্রি হচ্ছে তাদের অধিকাংশই শিশু। তেমনি নতুন বাজারে তারিকুল নামে ১১ বছরের এক রেস্টুরেন্ট শ্রমিক জনায়, আব্বায় এইহানে দিয়া গেছে। মুই থাহি আর খাই। আব্বায় মাস শ্যাষে মহাজনের ধাইরদা ১২শ’ টাহা নিয়া যায়।



মার্কিন টেলিভিশনে দৌলতদিয়া যৌনদাসত্ব

বাংলাদেশের দৌলতদিয়া যৌনপল্লি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রচার করে মার্কিন টেলিভিশন চ্যানেল-ভাইস নিউজ। চলতি বছরের ফেব্র“য়ারী মাসে ২০ মিনিট ২৫ সেকেণ্ড সময়ব্যাপী প্রতিবেদনটি প্রচার করলেও সাম্প্রতি আলোচনায় উঠে আসে প্রসঙ্গটি। প্রতিবেদনটিতে উঠে এসেছে ভয়াবহ চিত্র। যৌনপল্লির অধিকাংশের বয়স ১৮ বছরের নীচে। এমনকি ১০ বছরের শিশুকেও যৌনব্যবসায় বাধ্য করা হচ্ছে। এসব শিশুদের হয় অপহরণ অথবা চাকরির কথা বলে এই পল্লিতে বিক্রি করা হয়। ইয়াবা আর মদের ‘কিটি পার্টি’তে তাদের ওপর চলে যৌন নির্যাতন। সেখানে তাদের ক্রিতদাসীর মত ব্যবহার করা হয়। প্রতিবেদনে এক শিশু যৌনকর্মী (১৪) জানান, কিভাবে তাকে জোর করে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। এখন যে ফিরে যেতে চাইলেও আর পারছে না। তার ফিরে যাওয়ার আর কোন সুযোগ নাই। আরো একজন শিশু যৌনকর্মী জানান, খদ্দেররা তাদের ওপর শারীরীক নির্যাতন চালায়। কখনো কখনো ১০ থেকে ১২ জন খদ্দের একসঙ্গে এসে এই যৌন নির্যাতন চালায়। তাদের করার কিছুই থাকে না। যৌনপল্লির সর্দারনী স্বীকার করেন, অল্প বয়স্ক কন্যা শিশুদের এনে ওষুধ খাইয়ে মোটা করা হয়। তাদের যৌন ব্যবসার উপযোগী করা হয়। আর এসব ওষুধ সেখানেই কিনতে পাওয়া যায়। একজন দালাল জানান, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রধানত চাকররি লোভ দেখিয়ে অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদের যৌন পল্লিতে এনে বিক্রি করে দেয় তারা। তাদের ২০ থেকে ৩০ হাজার ঢাকায় বিক্রি করা হয়। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার তৈরি পোশাক কারখানায় টার্গেট করে এইসব শিশুদের তারা ফাঁদে ফেলে। আবার কখনো অপহরণ করে নিয়ে আসে। দৌলতদিয়া যৌনপল্লির একজন খদ্দের শিকার করেন যে, তিনি ১০ বছর বয়সের শিশুদের ঘরেও গিয়েছেন। তার শিশুদেরই পছন্দ। সে যাদের ঘরে যায় তাদের সবার বয়স ১০ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। তার শিশুদের সঙ্গে এই আচরণ করতে খারাপ লাগে কীনা প্রশ্নের জবাবে সে জানায়,‘ খারাপ লাগে না, ভাল লাগে ’ এজন্য তার কোন অনুশোচনাও নেই। সীমা নামের এক যৌনদাসী জানান, তাঁকে ১৪ বছর বয়স থেকে এই পল্লিতে যৌন ব্যবসায় নামানো হয় জোর করে। তাকে কৌশলে দালালরা এখানে নিয়ে আসে। সে এখন তাঁর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। তাঁর পরিবারের সদস্যরাও জানে না সে কেথায় আছে। একটি সংসার, পরিবার আর বাবা-মা’র জন্য সে এখন কাঁদছে। কিন্তু তারা কান্না কেউ শোনে না। রাজবাড়ি জেলার গোয়ালন্দ থানা এলাকায় দৌলতদিয়া যৌনপল্লির অবস্থান। স্থানীয় একজন সাংবাদিক জানান, এই পল্লিতে নিবন্ধিত যৌনকর্মীর সংখ্যা দুই হাজারের বেশি না। তবে বাস্তবে আছে সাড়ে চার হাজারের মত। অনিবন্ধিত দুই হাজারেরও বেশি যৌনকর্মীর অধিকাংশই শিশু। তাদের বয়স ১০ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে। যৌনকর্মী হিসেবে নিবন্ধ নিতে বয়স কমপক্ষে ১৮ বছর হতে হয়। আর কেউ এই পেশা বেছে নিলে তা আদালতে গিয়ে নিজেকে ঘোষণা করতে হয়। ওই সাংবাদিক জানান , দৌলতদিয়া যৌনপল্লি থেকে মাসে লাখ লাখ টাকা আয় করেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। তারাই সব সামাল দেন।

রিক্রুটিং এজেন্সি শ্রম রপ্তানির নামে মানুষ বিক্রি করে

ইরাক থেকে ফিরে আসা ইঞ্জিনিয়ার মো. সিদ্দিক পাচারের শিকার বাংলাদেশিদের ওপর বর্বর নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন। ১১ এপ্রিল, ২০১৫ (শনিবার) যশোর প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ইঞ্জিনিয়ার সিদ্দিক জানান, শ্রম পাচারের নামে বাংলাদেশের কতিপয় রিক্রুটিং এজেন্সি বিদেশে মানুষের কেনাবেচার হাটে তুলে বিক্রি করছে। সেখানে বিক্রি বাংলাদেশিদের দাস হিসেবে কিনে স্থানীয়রা তাদের ওপর চালাচ্ছে নারকীয় নির্যাতন। রিক্রুটিং এজেন্সি ক্যারিয়ার ওভারসিস কনসালটেন্ট লি. গত বছরের ২২ মে যে ১৮০ জন বাংলাদেশিকে ইরাকে নিয়ে গিয়েছিল। তাদের উপরও অমানসিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে সিদ্দিক জানান, ১৮০ বাংলাদেশিকে ইরাকের নাজাফ শহরে একটি বদ্ধ ঘরে আটকে সকাল-বিকেল-রাতে পাইপ ও লোহার রড দিয়ে পেটানো হয় এবং অনেকের ওপর যৌন নির্যাতন চালানো হয়। কাউকেই ঠিকমতো খাবার দেওয়া হতো না, দিনে ২০ ঘণ্টা কাজ করিয়ে নেওয়া হতো এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা না রেখে বহুতল ভবনের ওপর উঠে কাজ করানো হতো। ক্যারিয়ার ওভারসিস কোম্পানির লোক ছাড়াও ভাড়া করা ইরাকি সন্ত্রাসীরা এ কাজ করতো। ইরাকের বন্দিদশা থেকে পালিয়ে স্থানীয় বাংলাদেশিদের সহায়তায় গত ৪ এপ্রিল দেশে ফিরে আসেন ইঞ্জিনিয়ার মো. সিদ্দিক। ইঞ্জিনিয়ার সিদ্দিক মানব পাচারের দায়ে ক্যারিয়ার ওভারসিস কনসালটেন্ট লি. এবং তাদের সহযোগীদের শাস্তি, পাচারের শিকার ব্যক্তিদের নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনা এবং উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের দাবি জানান।

মানিকগঞ্জে মানুষ বিক্রির বৃহৎ হাট

আসেন ভাই,আমাগো নিয়্যা যান। কাজ কাম ভালই পাইবেন। বড় বড় বোঝা মাথায় নিতে পারি, বেশী বেশী ধান কাটতে পারি। মানিকগঞ্জে শ্রম বিক্রি করতে এসে এমন কথাগুলো বলেছেন সিরাজগঞ্জ থেকে আসা আশরাফ, সুমন,হাবিব,আকমল,ইজ্জত আলী। অভাবি এসব মানুষ গুলো এভাবেই কথার ছলে নিজেদের বিক্রি করছে। আর ক্রেতারা মানুষ বেচা কেনার হাটে গিয়ে স্বাস্থ্য সবল ও দক্ষ কামলা ক্রয় করে চলতি মৌসুমে ইরি বোরো ধান কাটার জন্য নিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের মানিকগঞ্জ বাসষ্ট্যান্ড এলাকায় দেখা যায় এ হাট। নবীন সিনেমা হলের সামনে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা হাজারো মানুষ শ্রম বিক্রিন জন্য বসে থাকেন। কখন বিক্রি হবেন সে চিন্তায় মাথার উপর রোদ-বৃষ্টি নিয়েও অপেক্ষা করেন তারা। আর ফসল উৎপাদনকারী কৃষকরা দরদাম করে তাদের নিয়ে যান। সকাল থেকে রাত প্রায় ১০টা পর্যন্ত চলে এই মানুষ কেনা বেচার হাটের কার্যক্রম। দেখা গেছে, এখানে সুস্থ্যসবল কামলার দিকে ক্রেতাদের নজর থাকে বেশী। রংপুর, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, যশোর, নড়াইল, গাইবান্ধা, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শত শত অভাবি মানুষ প্রতিদিনই ছুটে আসছে মানিকগঞ্জের এই মানুষ বেচা কেনার হাটে। প্রত্যেকটি এলাকা থেকে কমপক্ষে ৪ থেকে ৫ জনের একেকটি গ্রুপ হয়ে বসে থাকেন ক্রেতার অপেক্ষায়। এই হাটে একেকটি কামলা একদিনের জন্য বিক্রি হচ্ছে কমপক্ষে সাড়ে তিনশ টাকায়। তবে স্বাস্থ্যবাদ ও সুঠাম দেহের অধিকারী কামলাদের কদর বেশী। তাদের মুজুরীও বেশী। সিরাজগঞ্জ থেকে আসা আশরাফ, সুমন, হাবিব, আকমল, ইজ্জত আলী নবীন সিনেমা হলের সামনে দাড়িয়ে এক ক্রেতাকে বলছেন, আসেন ভাই,আমাগো এই ৫জনকে নিয়্যা যান। কাজ কাম ভাল পাইবেন। বড় বড় বোঝা মাথায় নিতে পারি,বেশী বেশী ধান কাটতে পারি। তাদের আক্ষেপ রাস্তার পাশে কিংবা মার্কেটের সামনে তারা জরো হলেই ব্যবসায়ী ও পুলিশ তাদের তাড়িয়ে দেয়। রাতে থাকার জায়গা না থাকায় রাস্তার আশ পাশে তাদের ঘুমাতে হয়। কামলা ক্রয় করতে আসা মানিকগঞ্জের ঘিওরের সমশের উদ্দিন জানান,এবার তিন বিঘা জমিতে রোবো ধান রোপন করেছিলাম। ফলনও ভাল হয়েছে। এখান ধান কাটার সময় হয়েছে বিধায় কামলা নিতে এখানে এসেছি। ৪০০ টাকা রোজে ৫ জন কামলা নিয়ে গেলাম।

বাংলাদেশে সাত লাখ ‘দাস’

সারা বিশ্ব থেকেই 'দাস' প্রথা মোটামুটি উঠে গেছে এমনটা মনে করা হয়েও বিশ্বে এখনও প্রায় তিন কোটি ৫৮ লাখ লোক দাস হিসেবে বাস করে। আর সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান নবম। বাংলাদেশের দাসের সংখ্যা ছয় লাখ ৮০ হাজার ৯০০। এমন তথ্যই জানালো অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ‘ওয়াক ফ্রি ফাউন্ডেশন’। ২০১৪ সালের নভেম্বরে এ তথ্য প্রকাশ করে সংস্থাটি। ‘ওয়াক ফ্রি ফাউন্ডেশন’ এর তালিকা অনুসারে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি দাস বাস করে ভারতে। বাংলাদেশ রয়েছে নবম স্থানে। এছাড়া মরিতানিয়া, উজবেকিস্তান, কাতারেও বিপুলসংখ্যক দাস বাস করে। সংস্থাটির হিসেবে, ২০১৩ সালে দাসের সংখ্যা ছিল দুই কোটি ৯৮ লাখ। এবার তথ্য সংগ্রহ ব্যাপকতর হওয়ায় দাসের সংখ্যা বেড়েছে বলে জানানো হয়েছে। বাধ্যতামূলকভাবে শ্রম, পতিতাবৃত্তি, ঋণের জালে আবদ্ধ থাকা লোকদের দাস হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এসব লোক স্বাধীনভাবে কোথায় যেতে পারে না, এমনকি বিয়ে পর্যন্ত করতে পারে না। তাদেরকে বিভিন্নভাবে শোষণ করা হয়। তাদের ওপর চালানো হয় নানা নির্যাতন। দাসের সংখ্যার দিক থেকে ১৬৭টি দেশের মধ্যে ভারত শীর্ষে রয়েছে। দেশটির ১২৫ কোটি লোকের মধ্যে দাস রয়েছে এক কোটি ৪৩ লাখ। ভারতের পর সবচেয়ে বেশি দাস রয়েছে চীনে। সেখানে দাসের সংখ্যা ৩২ লাখ। এর পর রয়েছে পাকিস্তান (২১ লাখ), উজবেকিস্তান (১২ লাখ), রাশিয়া (১০ লাখ ৫০ হাজার), নাইজেরিয়া (আট লাখ ৩৪ হাজার), কঙ্গো (সাত লাখ ৬২ হাজার), ইন্দোনেশিয়া (সাত লাখ ১৪ হাজার), বাংলাদেশ (ছয় লাখ ৮০ হাজার ৯০০), থাইল্যান্ড (চার লাখ ৭৫ হাজার ৩০০)। জনসংখ্যা হারের দিক থেকে মৌরিতানিয়ায় সবচেয়ে বেশি দাস রয়েছে। দেশটির ৩৯ লাখ লোকের ৪ শতাংশই দাস। ভারতে দাস রয়েছে এক দশমিক ১৪ শতাংশ। তবে বাংলাদেশে এই হার ১ শতাংশেরও নীচে।

উপসংহারের আগে

প্রতিবেদন গুলোতে যেমন ভুক্তভোগীর বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে, তদ্রুপ যারা কাজটি করাচ্ছেন অর্থাৎ কর্তা শ্রেণীর বক্তব্যও উল্লেখ রয়েছে। ফলে দাস প্রথার আদি ক্রিয়াকলাপের সাথে বর্তমান ক্রিয়াকলাপের বিশেষ কোন তফাৎ আছে বলে মনে হয় না। ইতিহাসে যেমন পাওয়া যায়, দাস/দাসীদের নির্যাতন করা হত, বর্তমানেও তার ব্যত্যয় হয় না। গণমাধ্যমের কল্যানে আমরা প্রায়ই দেখে থাকি গৃহকর্মীদের উপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। হাত-পা পুড়িয়ে দেয়া হয়। আর একটু ব্যাখ্যা দেয়া যাক। বরিশালের সাবেক জেলা ও দায়রা জজ মোঃ শহিদুল্লাহ তার বাসার মুন্নুজান ওরফে মনুজা বেগম নামে এক গৃহপরিচারিকা বা কাজের বুয়া রাখেন। তাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে ধর্ষণ করতেন এবং অন্ত:সত্ত্বা করে ফেলেন। পরে আদালতের কর্মচারী দীন মুহাম্মদকে দিয়ে মুন্নুজানের গর্ভের সন্তান নষ্ট করিয়ে ফেলে। এ ঘটনায় মুন্নুজান মামলা দায়ের করে। বর্তমানে মামলাটি চলমান। মামলা সংক্রান্ত এক সংবাদ সম্মেলনে নির্যাতিত মুন্নুজান বরিশাল প্রেস ক্লাবে বলেছিলেন, আমাকে সে (জজ শহিদুল্লাহ) দাসী-বান্দীর মত ব্যবহার করতো। তার কথায় রাজি না হইলে কইত, আমি জজ তোরে জেলে ঢুকিয়ে দেব। আমি তার কাছে জিম্মি ছিলাম। এছাড়া সরাসরি মানুষ বিক্রি হয়ে থাকে বরিশাল নগরীর হোটেল গুলোতে। পায়েল বোডিং, হোটেল গালিব, হোটেল আজ, হোটেল অতিথি, হোটেল সীভিউ, হোটেল পূর্ণিমা, হোটেল সানফ্লাওয়ার সহ বিভিন্ন হোটেলে যৌন শ্রমিক রাখার ক্ষেত্রে প্রায়ই নারী/ মেয়ে বিক্রির বাজার বসে। দেন-দরবার করে বিক্রি হয় যাত্রার নর্তকীরাও। সদর উপজেলার সাহেবের হাটে আসা আনন্দ অপেরার সর্দার অমল চন্দ্র জানিয়েছিলেন, দশ থেকে পনেরো হাজার টাকা করে এখানের ড্যান্সার কিনে এনেছি। তাদের দ্বারা কি কি কাজ করান জানতে চাইলে জানায়, রাত্রে নাচে। আর ভাল কাস্টমার পেলে তাদের মনমত কাজ করে। চাইলে কি তারা (নর্তকীরা) বাড়ি বা অন্য কোথাও যেতে পারে? প্রশ্নের জবাবে অমল বলেন, না। আমার কথার বাইরে কারও সাথে কথা বলাও নিষেধ আছে। কতদিনের চুক্তিতে কিনেছেন জানতে চাইলে সর্দার জানান, ওভাবে চুক্তি হয় না। যার কাছ থেকে কিনেছি তাকে এই টাকা দিয়েছি। আমি মেয়েদের ততদিন রাখবো যতদিন দেখবো আয় হচ্ছে। যখন রূপ-যৌবন কমে যাবে তখন অন্য দলের কাছে বিক্রি কলে দেব। তখন কেমন দাম পাবেন প্রশ্নের জবাবে অমল জানায়, তখন বেশি দাম পাবো না। ধরেন পাঁচ-সাত হাজার।

উল্লেখিত উদাহরন, কারণ তাদের জবানবন্দি পাওয়া গেছে। এসব মানুষের কথা আর পনের থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মানুষের কথা মিলিয়ে দেখলেই স্পষ্ট হয় দাস প্রথা আসলেই কি চলে গেছে? নাকি আমাদের ভিতরে শক্ত ভিত্তি গড়ে লুকিয়ে আছে?

বিংশ ও একবিংশ শতকের এই সময়ে এসে কেউ হয়তো বলতে পারবেন না থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ জুড়ে বিদেশ যাবার নামে যে ঘটনা ঘটেছে সেটা কেউ ভুলে যেতে পারবেন। সভ্যতার চরম উৎকর্ষ কেন্দ্রিক এ সময়ে আমাদের হতভম্ব করে দিয়েছে মানুষ বিক্রির নিত্য নতুন রূপগুলো। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক পরিবারের সুন্দর পরিবেশ ছেড়ে কেন মেয়েগুলো পা দিচ্ছে অন্ধকারে কিংবা দেশের মাটি ছেড়ে যুবকেরা কেন যাচ্ছে থাইল্যান্ডের শংখলা প্রদেশের গণকবরের দিকে। এই যাত্রা কেন? বিশ্লেষকরা বলছেন এর দুটি কারণ হতে পারে। প্রথমত একটু ভাল থাকার রঙিন স্বপ্ন এবং দ্বিতীয়ত সংসারের অসচ্ছলতা। সামাজিক প্রতিবন্ধি মেয়েদের পূর্নবাসন কেন্দ্রের স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মকর্তা মোঃ রেজাউল ইসলাম বলেছেন, দীর্ঘদিন এদের নিয়ে কাজ করে জেনেছি দেশের অধিকাংশ পরিবারের অবস্থান ভাল নেই। দিন যত গড়াচ্ছে পারিবারিক বিশৃঙ্খলা বাড়ছে। ফলে শিশু অর্থাৎ মেয়ে শিশুরা সুস্থ্য পরিবেশে বেড়ে উঠতে পারছে না। তারা অর্থনৈতিক অসচ্ছল হওয়ায় খুজতে থাকে অর্থনৈতিক সচ্ছলতার পথ। এই সুযোগে বিপথগামী হয়।

রেজাউল ইসলামের কথা প্রসঙ্গে উঠে আসে সিটি কর্পোরেশন এলাকার ভ্রাম্যমান কর্মী হোসনেয়ারা বেগমের কথা। তিনি জানিয়েছিলেন, আমার ঘরে দুইটা পোলা আছে। মায় রুগী। নিজেরে মানষের কাছে বেইচ্চা না দিয়া উপায় কি? এই শহরে কেউতো মোরে কামে (কাজে) ডাকে না। বাইচ্চাতো থাকতে অইবে। ওদিকে পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া থানার সোনাখালী গ্রামেরর হারুন হাওলাদার জানান তার দুঃখের কথা। তার মতে, বিএ পাস করেছি ভাই। সরকারী চাকুরীর বয়স চলে গেছে। শেষে চেষ্টা করে দালাল ধরে সৌদি আরব গেলাম। কিন্তু ভিসা ঠিক না থাকায় ছয়মাস জেল খেটে দেশে ফিরছি। দেশ ছেড়ে বিদেশে কেন গেলেন এমন প্রশ্নের জবাবে হারুন কান্না সংবরণ করতে না পেরে বলেছে, আমার কি ভালো থাকার অধিকার নাই? অর্থাৎ অষ্টাদশ শতক থেকে এখন পর্যন্ত কোন কিছুই বদলায়নি, যেগুলো বদলে ফেলার কথা ছিল। উল্টো মানুষের অসহায়ত্বকে কেন্দ্র করে নিত্য নতুন রূপে বিক্রি করা হচ্ছে সেই মানুষগুলোকে। পূর্বাপেক্ষা মানুষ পন্যে পরিণত হচ্ছে বর্ধিত সংস্করণে। এর পিছনে হয়তো খাদ্য, জীবনমান দায়ী, তবে সে দায় মোচনের দূরত্ব আর কতদূর? আর কত সহস্র শতাব্দী মানুষ পন্য থাকবে, হয়ে উঠতে পারবে না সত্যিকারের মানুষ? আদৌ কি বন্ধ হবে মানুষ বিকিকিনির আন্তঃ ও আন্তর্জাতিক বাজার?


তথ্য সহায়ক: বাংলাপিডিয়া, AK Chattopadhyay, Slavery in India, Calcutta, 1959; DR Chananah, Slavery in Ancient India, Delhi, 1960; Amal Kumar Chattopadhyay, Slavery in the Bengal Presidency 1772-1843, London, 1977, বাংলা টেলিগ্রাফ, আমার দেশ।

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ২৮ শে জুন, ২০১৬ রাত ১০:৪৪

ঘটক কাজী সাহেব বলেছেন: সমস্ত মানব জাতী দাস বা দাসী, কেউ তার বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেনা, যে আমি তা থেকে মুক্ত। এমন কি স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাও নন, তিনি তাঁর বান্দা-বান্দি, দাস-দাসীর জন্য সর্বদাই মঙ্গল কামনায় নিহিত। আর যারা এই প্রবিত্র নামের সাথে মানুষ গুলো কে অপব্যাবহার করে, তাদের স্থান কোথায় তা সবাই জানে। মায়ের কাছে পাঁচটি সন্তান যেমন একই রকম, আল্লাহ্‌র কাছেও সকল মানব জাতি একই রকম।

তিনি দিয়েছেন একটি ঘর, যে ঘরে তিনি কোন দেয়াল গড়ে দেননি, দিয়েছেন একটি ফ্লোর, আর একটি ছাদ। এই ঘর, ফ্লোর আর ছাদ কি? ঘর- পৃথিবী, ফ্লোর- জমিন, ছাদ- আকাশ। আছে কি কোন দেয়াল? নেই তো। তবু কেন মানুষে মানুষে এত ভেদাভেদ;
চোখের সামনে সবাই দেখে, ধনী-গরীব, বাদশা-ফকির, মৃত্যুর পরে সবাই শূন্য হাতে চলে যাচ্ছে... কেউ কিছু, এমনকি হাতে করে একটি বালু কণাও নিয়ে যেতে পারছে না। তবুও এই মানুষ নামের জীবদের এতটুকু হুশ হয়না, যে আমার বলে এই জগতে একটি বালুকণাও নেই, সবই ওই মহান সৃষ্টিকর্তার দান। সবাই এটা আমার, ওটা আমার সেটা আমার, হেন আছে, তেন আছে বলে অহংকার আর দাপটে ব্যস্ত। রাস্তার গরিব কোন শিশু, বৃদ্ধ মা, কিংবা কোন বয়স্ক বাবা এসে পাশে দাঁড়ালেই নোংরা বলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতে দ্বিধা বোধ করেনা। ঘরে যে মেয়েটি, বা ছেলেটি অর্থাৎ যাদের কে দাস দাসী বা অন্যান্য বলে থাকে ভিন মানুষেরা, তারা একবারও চিন্তা করেনা, এই মানুষটাই আমার কষ্ট লাগবের একমাত্র বন্ধু বা সাহায্যকারী। আজ আপনারা আপনাদের সন্তানদের বলুন না, তোকে মাসে এই সামান্য মজুরী দিবো... তুই আমার ঘরের সমস্ত কাজ করে দিবি। দেখেন তো দেয় কিনা। দিবেনা, তা হলে আমাদের সবার কি উচিত নয় সবার আগে আমাদের কাজে যিনি বা যে সাহায্য করে, তাকেই বেশি প্রাধান্য দেয়া। এই দুনিয়ায় সবাই সবার চাকর চাকরানী, কেউ তা থেকে মুক্ত নয়।

মুলে গিয়ে কি দাঁড়ালো... সৃষ্টিকর্তার কাছে দাসী-বান্দি, বান্দা-দাস এর উপরে, ওই রাজা-রানী, বাদশা নাম কখনোই প্রিয় নয়।

লেখক কে ধন্যবাদ এমন সুন্দর একটি পোষ্টের জন্য। অনেক দোয়া ও শুভ কামনা রইলো আপনার প্রতি। আশা করি এমন মানব সচেতনা লেখা আরও লিখবেন। ভালো থাকুন সব সময়।

২৮ শে জুন, ২০১৬ রাত ১০:৫৫

সৈয়দ মেহেদী হাসান বলেছেন: ধন্যবা.... ধন্যবাদ..... ধন্যবাদ..... ধন্যবা.... ধন্যবাদ..... ধন্যবাদ..... ধন্যবা.... ধন্যবাদ..... ধন্যবাদ..... ধন্যবা.... ধন্যবাদ..... ধন্যবাদ.....

২| ২৮ শে জুন, ২০১৬ রাত ১১:৪২

ঘটক কাজী সাহেব বলেছেন: এত ধন্যবাদের প্রয়োজন নেই কবি, প্রতিউত্তরের জন্য সালাম জানালাম।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.