নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

পেশায় সাংবাদিক। ‘জল পরীর ডানায় ঝাপটা লাগা বাতাস’ (২০১৩), ‘সাদা হাওয়ায় পর্দাপন’ (২০১৫) দুটি কবিতার বই প্রকাশিত। তার লেখা নাটকের মধ্যে ফেরা, তৎকালীন, আদমের সন্তানেরা উল্লেখযোগ্য। লেখালেখির জন্য ২০১৫ সালে হত্যার হুমকি প্রাপ্ত হন।

সৈয়দ মেহেদী হাসান

আমার পরিচয় খুঁজচ্ছি জন্মের পর থেকেই। কেউ পেলে জানাবেন কিন্তু....

সৈয়দ মেহেদী হাসান › বিস্তারিত পোস্টঃ

কবি আসমা চৌধুরীর কবিতার সমিরণে

১২ ই জুলাই, ২০১৬ বিকাল ৪:৩৯



বাংলা সাহিত্যে এক নিভৃত নিরাসক্তের নাম আসমা চৌধুরী। খুব নাম ডাক কামাই করা, বা কবিতা লিখে অমুক জনপদে একটা অবস্থান কেড়ে নিতে হবে তেমন তাগিদ তার নেই। মৃদুমন্দা বাতাসের মত প্রথমে ছুয়ে যায়, তারপর হাড়ে গিয়ে জানান দেয় কবিতার অনুভূতি; সেই সাথে বোধ করি ঢুকে পরেন একজন আসমা চৌধুরীও। সৃষ্টিশীলতা বা সৃষ্টিশীল মানুষ বুঝি এভাবেই হয়। একদিনে নয় দীর্ঘ দিনের জানাশোনায় বুঝেছি। অথচ এই শহরে বা সমগ্র দেশে দেখছি এক নোংরাখেলা ‘আমি ভাল লিখছি’ প্রতিষ্ঠা করতে ঠোকাঠুকি, বৈরীতা ও যথারীতি চরিত্র হননের প্রতিযোগীতা চলছে। এই প্রজাতির নিচু শ্রেণীর সাহিত্যিক বা কবি দেখে করুণা চলে আসে। আসমা চৌধুরী ততটা বিখ্যাত নন। তবে যথার্থ কবি হিসেবে বিখ্যত হবার দাবী রাখে। কিন্তু ভেজালের দুনিয়ায় প্রকৃত মানুষের মূল্যায়ন কবে হয়েছে? আমাদের দেশটাতো উল্টো রাজার উল্টো দেশ। নির্মলেন্দু গুনকে উৎসর্গ করে আবুল হাসান যে “অসভ্য দর্শন” দিয়েছিলেন তারচেয়ে বড় উদাহরণ কি আছে?
“দালান উঠছে তাও রাজনীতি
দালান ভাঙছে তাও রাজনীতি,
দেবদারু কেটে নিচ্ছে নরম কুঠার তাও রাজনীতি
গোলাপ ফুটছে তাও রাজনীতি,
গোলাপ ঝরছে তাও রাজনীতি!
মানুষ জন্মাচ্ছে তাও রাজনীতি,
মানুষ মরছে তাও রাজনীতি!”
(অসভ্য দর্শন/আবুল হাসান)

এর ভিতর থেকে অন্য কোন দৃষ্টিভঙ্গি সচ্ছ করতে চাইলে সেটা বুঝি খুব ভ্রম হবে না। যেমন-
কবি বিখ্যাত হচ্ছেন, তাও রাজনীতি
কবি মৌলবাদ হচ্ছেন তাও রাজনীতি
লেখক জন্মাচ্ছে তাও রাজনীতি
লেখক মারা হচ্ছে তাও রাজনীতি

সুতরাং বৃত্তের বাইরে আপনার অস্তিত্ব কল্পনা করাই যাবে না। যদি তেমন কিছু হয়ে থাকে সেটা হবে অপরাধ। কারণ ঘাতক বা বিখ্যাত হবার পিছনে যুগ-যুগান্তরে পুঁজিবাদী ও মোড়লেরা কলকব্জা নাড়িয়ে থাকেন। এমন মোড়ল ধরতে পারেননি বলে হয়তো আসমা চৌধুরীর কদর নেই। পরে আছেন অখ্যাত আর্বতে। কেউ তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়, নারী কবি বা বরিশালের কবি। এমন অসভ্যতা প্রায়ই চলে এবং চলছে। কিন্তু আসমা চৌধুরী কি আসলেই নারী কবি বা বরিশালের কবি?

আসমা চৌধুরীর কবিতা, নির্মান ও বাস্তবতাঃ
১৯৯০ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় তার গল্পের বই। সেই থেকে এ বছর মেলায় সর্বশেষ বের হয় কবিতার বই। এ পর্যন্ত মোট বইয়ের সংখ্যা ১০। এর মধ্যে একক ও পূর্ণাঙ্গ কবিতার বই তিনটি।
১। আকাশী রংয়ের মেয়ে (২০০২)
২। এই দুঃখটুকু রেখে দিলাম (২০১০)
৩। রোদ্দুরে ধুয়ে যায় ফর্সা আঙুল (২০১৫)
এছাড়াও প্রকাশিত হয় যৌথকাব্য সংকলন- পাঁচ পাতার অরণ্য (২০০৬) ও ত্রিবেনী কাব্য (২০০২)। আমরা তার একক কবিতার বই গুলোর দিকে আলোকপাত করলেই হয়তো খুজে পাবো নির্মানশৈলী। প্রথম কবিতার বই অর্থাৎ আকাশী রংয়ের মেয়ে হতে আসমা চৌধুরী বলেছেন সে কে?

“নিম্পাপ সমরে হাত ধরে জীবনে প্রবেশ করেছি
জীবন এখন আমার সাথে কানামাছি খেলে অহরহ
............................................
আমি আদিম যুগে ফিরে যেতে চাইলে
আমি আদিমতম ভালবাসা দেখতে চাই
আমি বৃত্তের মাঝখানে একখানা সাদা পতাকা ওড়াতে চাই”
(বসবাস -দুই/আকাশী রংয়ের মেয়ে)
এই প্রথম কাব্যগ্রন্থে অনেকটা সিদ্ধান্তহীন নিজের গন্তব্যে নিজের কন্ঠস্বর কোন মাত্রায় রাখবেন তেমন সংশয় থাকলেও দেখি উপাদান গুলো নিজস্বতার জানান দেয়।
বৈশাখে কারুকাজ, বৈশাখ বেদনার ঝাঁপি
বৈশাখে সেজুঁতি বিশ্বাস, বিএম স্কুল মাঠ
বৈশাখে সাদা শাড়ি, সাদা হাসি, নীল টিপ
(বৈশাখে বৃষ্টি এলো)
কবি তার অনুভূতি প্রকাশ করতে কারও কাছে হাত পেতে অলংকরণ ভিক্ষা করতে যাননি। যে ম্যানিয়া শূন্য দশক থেকে পরবর্তী দশক গুলোতে বেশি প্রতীয়মান। কেউ নিচ্ছেন জীবনানন্দ থেকে, কেউ অমিয় চক্রবর্তী, কেউ বিনয় মজুমদার কেউ শামসুর রহমান, হুমায়ুন আজাদ প্রমুখ ব্যক্তিদের রচনার শব্দ শৃঙ্খল কৌশলে নিয়ে অদ্ভুদ কম্পোজিশন করে কবিতা পয়দা করেন। অথচ আসমা চৌধুরীতে দেখছি তার জীবন সংশ্লিষ্ট উপমা।
“ভোরবেলা বাড়ী থেকে বের হয় বাবা
চালের বাজার দেখে, পুঁজি পাতি নাড়া চাড়া করে
আউশ আমন ইরি সরিষার ফুল দেখে
তিষি বৃক্ষে তুলে দেয় অচেনা বাউলসুর
(বাবা/আকাশী রংয়ের মেয়ে)
এই কবিতাটিতে পিতার সংজ্ঞা আকৃত্রিম ভাবেই পাওয়া যায়। আমার বা গ্রামের আর দশজন সন্তানের দর্শনে তার পিতা যেমন দৃশ্যমান। আটপৌড়ে সহজ-সরল। যে মানুষ গুলোর সখ্যতা প্রকৃতি ও পরিমলের সাথে। অর্থাৎ আকাশী রংয়ের মেয়ে কাব্যগ্রন্থে দৃশ্যকল্প, বর্ণনা ছন্দ ও অন্যলোকে আসমা চৌধুরী আমাদের মধ্যবিত্ত একান্নবর্তী শ্রেণীর মুখপাত্র। তার কবিতার এটা ভালভাবেই প্রতিষ্ঠিত। আর মাঝখানের কাব্যগ্রন্থ ‘এই দুঃখটুকু রেখেদিলাম’- এক বাক ঘুরে যদি ‘রোদ্দুরে ধুয়ে যায় ফর্সা আঙুল’ মেলে ধরি তবে দেখব আরও দগ্ধ, যন্ত্রনাগ্রস্থ ও দর্শন ঋদ্ধ আসমা চৌধুরীকে। অর্থাৎ নির্মানের পথ বেধে নাগরিক চরম বৈকল্য ও বাস্তবতম অর্ন্তলোকের রিমান্ডে রয়েছেন তিনি।
বইটির শিরোনাম কবিতার বলেছেন,
“আমাদের শৈশবগুলো প্রকাশ হলে
নাগরিক হিসেবে মতামত পাল্টে যায়”
(রোদ্দুরে ধুয়ে যায় ফর্সা আঙুল)
অর্থাৎ কবি নাগরিক কায় ক্লেশে শৈশব অর্ন্তধান করে কিনতে শিখে গেছেন। চিনে ফেলেছেন জীবন বাস্তবতা,
“ভাতের হোটেলগুলো সবাইকে দেখায় আছে
শুধু নদী ভাঙা মেয়েটি জানে,
নুলো ভিখারীজানে বাকিতে কিছু নেই,...
ভাতের হোটেল গুলো বড় হয় রোজ
ভাতের হোটেলে কাজ করে যে যুবক
পয়সার বাক্সে জমিয়ে রাখে প্রতিদিনের আয়ু
(ভাতের হোটেল/রোদ্দুরে ধুয়ে যায় ফর্সা আঙুল)
ভাতের হোটেল কবিতার চেয়ে সম সমায়িক বাস্তবতার উদাহরণ দিতে অন্য কোন প্রসঙ্গ টেনে আনতে হবে না বোধ করি। দামী পোশাক, সুস্বাদু খাবার, প্রমোদ উদ্যান, বিলাসী অট্রালিকা-বিলাসী জীবন কিন্তু এসব কি সে খুজে পায় যিনি নুলো ভিখারী? নদী ভাঙুলী মেয়েটি কি এসব কল্পনায়ও আনতে পারে? পারে না। তাহলে এসব কারা ভোগ করে বা করছে? ফলত সমাজের শ্রেণী বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে সেটাই বুঝিয়েছেন কতগুলো দৃশ্যকল্প জুড়ে দিয়ে।
“.........নিজেকে খুলে কোন নদী দেখাবে না তরঙ্গ।
কেন যেনে রেখে যাও নিজের আত্মা? কার কাছে যাও?
সে তোমাকে নিরন্তর একা করে রেখে দেয় অবরুদ্ধ খাচায়।”
(এই আছি এই নেই/ রোদ্দুরে ধুয়ে যায় ফর্সা আঙুল)

এভাবে প্রায় কবিতায়ই দৃশ্যকল্প এবং বাস্তবতা উঠে এসেছে; আস্তে মোলায়েম ভঙ্গিতে। কারন এসময় বা সমাজে যিনি সত্য বলছেন তাকে হরণ করার উদ্ধত অস্ত্র অহরহ। তার ফাঁসি কাষ্ঠের রশি এখানে ওখানে ঝুলছে। লটকে দেয়ার অপেক্ষা। ফলে বাস্তবকে আঁকতে গিয়ে ক্যানভাসতো ভেঙে ফেলতে পারে না। কবিতার বইটিতে তার অদ্বিতীয় কাব্য কল্পনা প্রতীয়মান হয়েছে। নিজের ব্যক্তি বর্ণনাকে নিয়ে গেছেন ভিন্নতর উচ্চতায়।

“অভিমান লুকাতে লুকাতে চেহারাই বদলে গেছে। এখন যে কেউ দেখা হলেই প্রশ্ন করে, তোমার অসুখ?
....................
বাউল তুমি ভেঙ্গে কোন একতারা, আমাকে বাজাও এখানেও গান আছে, মন্দিরের মত দুপুর শীতাল।”
(আমাকে বাজাও)
কবি নাগরিক জীবিকার গলির মধ্যদিয়ে ছুটছেন। দাবড়ে নিয়ে যাচ্ছে একটা অনুভূতি ও কবিত্বের খোলা তরবারি। ধাবমান পথে নির্মান করে যাচ্ছেন যে কবিতাগুলো তা নামকামানো কবি কুলের মত ভঙ্গুর নয়। এ নির্মাণ স্বকীয়।

আসমা চৌধুরী তার কবিতার অজস্র ইউনিক চিত্রকল্প ব্যবহার করেছেন। সাম্যকভাবে এটা কোন কিছুকে আড়াল করছে ভেবে নিতে পারেন তবে চিত্রকল্পকে ঘষে দেখলে কিছু দর্শন ধরা দেয় মানসপটে। আমার মতে, এর নামই কবিতা যার গভীরতা রয়েছে। দৃশ্যকল্প বা ভাষা প্রারম্ভিকা থেকে সরাতে শুরু করলে ক্রমশ আরও উজ্জল এবং অর্থদ্যোত্যক কিছু বেরিয়ে আসবে। এভাবে যতদূর পাঠক চিন্তা করবে তার থেকেও অন্তত তিন আলোক বর্ষ গভীরতা কুয়াশা ও মোহাবৃত্ত করবে হৃদয়। যার অত্ত্যুজ্জল উদাহরণ জীবনানন্দ দাশ বা উইলিয়াম ওয়ার্সওয়ার্ড। আসমা চৌধুরী তাদের ঘরেরই মেহমান। কবিতার বই মাত্র তিনটি হলেও এর মধ্যে চিত্রকল্প, উপমার খেলা খেলেছেন দক্ষভাবে। বিশেষ করে “রোদ্দুরে ধুয়ে যায় ফর্সা আঙুল” তার বিচরণ ভূমি।

উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারেÑ রবীন্দ্রনাথের মতরোদ উঠল, নিজের বাড়ি মানে নিজের মত হাট বাজার, খুচরো পয়সা হয়ে লুকিয়ে থাকি অজান্তে, অনির্দিষ্ট কিছু মানুষ চেহারা নিয়ে এগিয়ে আসে, এখানে দিন যাপনের গন্ধে শুয়ে থাকে অবিশ্বাস, রূপোর মত আকাশ, প্রভৃতি। চিত্ররুপময়তার ভিতর থেকে তার কবিতাগুলো অর্থদোত্যক হয়ে ওঠে, সরলের মধ্যে গরল ঠেলে দেন তিনি। কখনো পুরো কবিতাই হয়ে ওঠে একটি লাইন।

পকেট
পকেট ওয়ালা জামার জন্য বায়না ধরতাম
যে কোন ডিজাইনেই হোক না কেন পকেট চাই
পকেটের ভিতর অনেক কিছু রাখতাম
শীতকালে ঠান্ডা হাত, চুরি করা বেলিফুল
পকেটের ভিতরে রেখে দিতাম আয়না
সুযোগ পেলেই চেহারাটা দেখে নেয়া
পকেটের ভেতরে থাকত গোপন রুমাল
প্রিয় অক্ষরে সাজানো সেলাইয়ের সেই নাম
পকেটের ভেতরে এখন গোপন বেদনা
পকেটের ভেতরে নিশিমুখে, ছায়া কষ্ট
পকেটের ভেতরে তোমার ফেলে যাওয়া গন্তব্য
একটুকরো অবিশ্বাস.........

চিত্রময়তা এই দশকের কবিতার অপ্রতিদ্ধন্দ্বি অহংকার হলেও আসমা চৌধুরীর মত খলবলে ভাষায় এতটা সাচ্ছন্দ্য বোধ করি গুটি কয়েকজন ছাড়া বিস্তর পাওয়া যাবে না। সাধারণত, তার আমি প্রত্যয়, বা উত্তম পুরুষের প্রয়োগটা বেশি হওয়ায় অনেকেই বাহুল্য দৃষ্টি বলে ত্যাগ করতে চান। তবে এটা ভুল বিষয় এ কারনে, আমি বা উত্তম পুরুষই আসমা চৌধুরীর কাব্য চরিত্র। ফলে এটা ত্যাগ করার সুযোগ নেই। এটাই তার কবিতার স্টাইল।

অর্থাৎ নির্জনে ঢেকে থাকা আসমা চৌধুরীকে এড়িয়ে যাবার কোন সুযোগ নেই। আধুনিক চিন্তাক্ষেত্র, উত্তরাধুনিক নির্মান আর শব্দ প্রয়োগ জানান দেয় আসমা চৌধুরী নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। তাকে প্রয়োজন কবিতার অগ্রসরতায়, শংকর বুহ্য ভেদ করতে।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১২ ই জুলাই, ২০১৬ বিকাল ৫:০০

রুদ্র জাহেদ বলেছেন: অসাধারন পোস্ট।কবি আসমা চৌধুরীর সৃষ্টিকর্মের অসাধারন উপস্হাপন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.