নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

পেশায় সাংবাদিক। ‘জল পরীর ডানায় ঝাপটা লাগা বাতাস’ (২০১৩), ‘সাদা হাওয়ায় পর্দাপন’ (২০১৫) দুটি কবিতার বই প্রকাশিত। তার লেখা নাটকের মধ্যে ফেরা, তৎকালীন, আদমের সন্তানেরা উল্লেখযোগ্য। লেখালেখির জন্য ২০১৫ সালে হত্যার হুমকি প্রাপ্ত হন।

সৈয়দ মেহেদী হাসান

আমার পরিচয় খুঁজচ্ছি জন্মের পর থেকেই। কেউ পেলে জানাবেন কিন্তু....

সৈয়দ মেহেদী হাসান › বিস্তারিত পোস্টঃ

পদ্মা ফেরীতে দুর্বিষহ অসহায়ত্বের সেই রাত

২৭ শে জুন, ২০২২ সকাল ১০:৩০



পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলবাসীর জন্য হয়তো আর্শিবাদ। ২৫ জুন ঐতিহাসিক দিন, সেটিও সত্যি। পদ্মা সেতুর অনুষ্ঠানের উদ্বেলন জাতিগতভাবেই আমাদের ও আমাকে নাড়া দেয়। লাখো মানুষ এই সেতু দেখতে গেছেন। কিন্তু সকাল থেকেই আব্বাকে আমার খুব মনে পড়ছে। একটি বিশেষ কারনে এই নদী অত:পর ইতিহাস হয়ে যাওয়া সেতু আমার জীবনের একটি ক্ষত।

তারিখটি ঠিক মনে নেই। প্রেসক্রিপশন দেখে বলতে হবে। সাল ২০১৮র মাঝামাঝি। দশদিন জ্বরে ভুগে আব্বা অত্যান্ত কাভু হয়ে এলেন বরিশাল। মাস খানেক হলো তখন নথুল্লাবাদের বাসা ছেড়ে রূপাতলী একটি নতুন হাউজিংয়ে দেবাশীষ কুণ্ডু দাদার বাসায় উঠেছি। একেবারে নতুন বাসা। আব্বা আসায় তাকে বিছানা করে দেওয়া হলো। ডাক্তার দেখালাম সাউথ এ্যাপোলো ডায়াগনস্টিক সেন্টারের গোলাম মাহমুদ সেলিমকে। আব্বাকে এর আগেও জ্বরে পেয়েছিল। কিন্তু অতটা কাবু হতে দেখিনি। যে বাবাকে দেখে প্রাণসঞ্চার হতো তাকে দেখলাম অত্যান্ত চুপচাপ বসে থাকেন। ডাক্তারের চেম্বারে নির্জিব। ডাক্তার প্রেসক্রিশন ভরে জ্বর ঠেকানোর ওষুধ দিলেন। বাসায় এসে সেই ওষুধ চললো। কিন্তু জ্বর থামে না। টানা তিনদিন ওষুধ খাওয়ানোর পর অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় দেখা করলাম গোলাম মাহমুদ সেলিমের সাথে। তিনি সব শুনে বললেন, ওষুধ চলবে। কেন তিনি এই কথা বলেছিলেন জানি না। ওদিকে আব্বার অবস্থা খারাপ হচ্ছে। বাসায় কারো মুখে হাসি নেই। কেউ কারো সাথে কথাটুকু বলা হচ্ছিল না। আব্বার অবস্থা দেখে বড় ভাইয়ার উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে গেলো। অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। আমাদের ঘরটা নিরব নিস্তব্ধ সুনসান।

চারদিনের দিন অবস্থার অবনতি হওয়ায় শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করালাম। আমার চারপাশে তখন সাংবাদিক সহকর্মীরা। কথাটি সহকর্মী বললে ভুল হবে, আপন যদি কোন প্রতিশব্দ বাংলায় থাকে সেটি। মনে হচ্ছিল আমার আব্বা অসুস্থ হননি, তাদের পিতাও অসুস্থ। আসলে এই ঋণ কোনদিন শোধ করার সামর্থ আমার নেই। নামগুলো উহ্য রাখলাম। তাদের নিয়ে আরেকদিন লিখবো।

দুপুরে আব্বাকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর পরে অনেকগুলো পরীক্ষা করানো হলো। রিপোর্ট নিয়ে মেডিসিন ওয়ার্ডের দায়িত্বরত চিকিৎসকের কাছে গেলাম। ঢুকতে গিয়ে ভুলটা করলাম। স্যার আসতে পারি বলে সম্মোধন না করায় ওই শিক্ষানবিশ চিকিৎসক আমার আব্বার পরীক্ষা করানোর ফাইলটি ছুড়ে ফেলে দিলেন। অসহায় হয়ে পরলাম। একবার খুব রাগ চেপে গেলো মাথায়। কিন্তু জানি রাগ করে লাভ নেই। প্রতিবাদ করলে চিকিৎসাতো পাবোই না উল্টো আমাকে গ্রেফতার হতে হবে। আর বেশি প্রতিবাদ করলে হয়তো আব্বার লাশ নিয়েও ফিরতে হতে পারে। শেষে সেই কাগজের ফাইল কুড়িয়ে তুলে হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে রুমে ঢুকে দেখালাম। দায়িত্বরত শিক্ষানবিশ চিকিৎসক পুরানো ওষুধ বাদ দিয়ে নতুন স্যালাইন, ট্যাবলেট আর কোরামিন ইনজেকশন লিখে দিলেন।

আমি ওষুধ দেখে চিনিনি। বড় ভাইয়া ওষুধ দেখে কিছু বলার আগেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তিনি বারবার বলছিলেন, আব্বার ডায়াবেটিস তাহলে তার শরীরের স্যালাইন পুশ করবে কেন? আর কোরামিন ইনজেকশন দিবে কেন? আব্বাতো মৃত্যুপথযাত্রী নন। নতুন প্রেসক্রিপশনের ওষুধ কিনে আনলেও নার্সকে অনুরোধ করে প্রয়োগ বন্ধ রেখেছি। শেষে সহকর্মী সাংবাদিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডাঃ ভাস্কর সাহার সাথে যোগাযোগ করলেন। তিনি তখন বাসায় চলে গেছেন। তবে সিনিয়র একজন চিকিৎসককে ব্রিফ করার জন্য বলে দেন। আমরা দ্রুত সেই চিকিৎসকের কাছে যাই। তিনি প্রথমে আমতা আমতা করছিলেন। শেষে বেড়িয়ে এসে আবার একা আমি গিয়ে তার সাথে দেখা করি। তিনি স্পষ্ট জানালেন, আব্বার দুটি কিডনি অচল হয়ে গেছে। ডায়াবেটিস মাত্রাতিরিক্ত। রোগি টেকানো অসম্ভব। দ্রুত ডায়ালাইসিস না করালে ৩/৪ ঘন্টার মধ্যে মারা যাবেন। মূলত কোরামিন দিতে চেয়েছেন শেষ চিকিৎসা হিসেবে।

তার কথা শোনার পর শ্রেফ সিদ্ধান্ত জানালাম, দ্রুত আমাদের রেফার করে দিন। আমরা এখানে থাকতে চাই না। তাকে অনুরোধ করলাম, স্যার আব্বার মুখ চেয়ে হলেও হাসপাতালের ফর্মালিটিস দ্রুত শেষ করবেন। ওই চিকিৎসক কথা রেখেছিলেন। অল্প সময়ে আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে আব্বাকে নিয়ে রওয়ানা হলাম। তখন রাত সাড়ে ১১টা।


এগারো হাজার টাকায় একটি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ছুটলাম। চালককে বললাম, রাস্তা যখনই খালি পাবে সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে চালাবে। জানি এই পরামর্শ আসলে ঠিক ছিল না। কিন্তু করার কিছু ছিল না। পুরো পথে একস্থানে আব্বা খুব কান্নাকাটি করে বললেন, বাড়ি ফিরে যাবেন। তার অনেক কষ্ট হচ্ছে। দম আটকে আসছে।

আমি আর আমার মেঝ ভাই ছিলাম সেই যাত্রায়। বিশ্বাস করুন আমরা সবকিছুর জন্য প্রস্তুত ছিলাম। নথুল্লাবাদ স্ট্যান্ড পার হওয়ার পর থেকেই আব্বা বলছিল, যেন তাকে কালিমা পড়াতে থাকি। পুরো পথ কি অবর্ণনীয় কষ্ট আর আব্বার কান্না দেখতে দেখতে যেতে হয়েছে তা প্রকাশের ভাষা আমি আজো শিখিনি। রাত দুইটার দিকে আমরা মাওয়া ফেরিঘাটে গিয়ে পৌঁছি। ভাগ্য ভালো গিয়েই ফেরিতে উঠতে পারি এবং মিনিট পনেরোর মধ্যে গাড়িটি ছেড়ে দেয়। কষ্টে তখন আব্বা স্বাভাবিক সেন্সে ছিলেন না। গামছা দিয়ে তার শরীর মুছতে মুছতে আব্বার সাথে গল্প করছিলাম। সেই কষ্টের মধ্যেও আব্বা বলছিলেন, পদ্মায় নাকি সেতু হচ্ছে। আমি বললাম, হুম হবে। আব্বা বললেন, তাহলে আর মানুষের কষ্ট হবে না। আমি বললাম, কেন? তিনি বললেন, এই যে দুই তিন ঘন্টা ভাসতে হয়। এতে অনেক মানুষ ফেরিতেই মারা যায়। বুঝলাম আব্বা ভয় পাচ্ছেন ‍এবং মৃত্যুর জন্য তৈরী হচ্ছেন। নয়তো হঠাৎ ‍এই চিন্তা তার মাথায় আসবে কেন।

একটা কথা বলে নেই, আব্বা গ্রামের মানুষ। তবে রাজনীতি সচেতন। সারা জীবন আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছেন। ফলে সারাদেশের খবর আমাদের চেয়ে তার কাছে বেশি ছিল।


তিনি যখন কথা বলছিলেন, তখন অনেকটা নির্ভার হচ্ছিলাম যেন গল্পে গল্পে তার শ্বাসকষ্ট, শরীরের যন্ত্রনার কথা ভুলিয়ে রাখা যায়ে। এজন্য দুই ভাই মিলে গল্প জুড়ে দিলাম। তিনি কষ্ট করে হলেও গল্প চালিয়ে যাচ্ছিলেন। আধা ঘন্টা পরে হঠাৎ বুক চেপে ধরে বলে উঠলেন আর দম নিতে পারছেন না। দ্রুত অ্যাম্বুলেন্সের চালককে ডাকলাম অক্সিজেন মাস্কটি পরিয়ে দিতে এবং অক্সিজেন সিলিন্ডারটি চালু করে দিতে। তখন এসব সর্ম্পকে কোন ধারণা ছিল না। চালক আরেকটি গাড়িতে গিয়ে সিগারেট টানছিলেন। হন্যে হয়ে খুঁজে আনতেই তিনি বললেন, অক্সিজেন লাগানোর কথাতো ভাড়ার চুক্তিতে ছিল না। যদি রোগীর অক্সিজেন লাগে তাহলে নগদ ৩শ টাকা দিতে হবে। আমরা বললাম, তুমি মাস্ক লাগাও যা লাগে দিচ্ছি। চালক নাছোড়বান্দা। মাস্ক দিবেন না টাকা ছাড়া।


তাকে দিলাম ৫ শ টাকার নোট। তিনি বলছেন, ভাংতি দেন। আমরা বললাম পুরাটা নাও তবু মাস্কটি দাও। শেষে সে মাস্ক দিল।
অক্সিজেন মাস্ক পরানোর পরে আব্বা কিছুটা স্বস্তি পেলেন। তবে বরিশাল হাসপাতাল থেকে জানিয়েছিল, বেশিক্ষণ অক্সিজেন দিয়ে রাখলে তার লাঞ্চে পানি জমবে। কারন তার লাঞ্চও এ্যাফেক্টেড। ফলে জটিল একটি পরিস্থিতির মধ্যে পরলাম।


অক্সিজেন পেলেও আব্বা বার বার বলছিলেন, পদ্মা পার হতে আর কতক্ষণ। আড়াই ঘন্টায় সেই রাতে পদ্মা পারি দিয়েছি। মনে হয়েছে আড়াই শতাব্দী। বিপদের সময় দীর্ঘ হয় জানি। পরিশেষে রাত পৌনে ৫টায় ওপারে উঠি। হাফ ছেড়ে বাঁচি। এরপর আব্বাকে নিয়ে জাতীয় কিডনি ইন্সটিটিউটে ভর্তি করা হয়েছিল। সেখানে চিকিৎসা পেয়ে আব্বা ভালো হয়েছিলেন। সেখানকার চিকিৎসকরা বলেছিলেন, ভুল ওষুধ সেবনে দশ দিনের ব্যবধানে আব্বার কিডনি বিকল হয়ে পরেছে। কিন্তু তখন আর আমাদের হাতে করার কিছুই ছিল না। ওই বিষয় নিয়ে আর আগানোও হয়নি। আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছি। আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছি সেই ইন্টার্ন ডাক্তারের ফাইল ছুড়ে ফেলার বিষয়টি। আব্বা আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে পারি জমিয়েছেন ২০২০ সালের ২৬ এপ্রিল।

২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হলো। কিন্তু সেই রাতের সেই বিভিষিকা, অসহায়ত্ব কোনদিন ভুলবো না। জানি শুধু আমাদের সাথেই নয়, হাজার বছর ধরে এমন পরিস্থিতির সাথে সংগ্রাম করেছে দক্ষিণাঞ্চলের কোটি মানুষ। যার অবসান হলো ২৫ জুন শনিবার ২০২২।

আজ আমার আব্বা বেচে থাকলে তাকে নিয়ে পদ্মা সেতু দেখাতে নিয়ে যেতাম। কিন্তু তাতো আর সম্ভব না। তবে এটুকু বলতে চাই, দল-মত আর ব্যাক্তি বিরোধ নয় শেখ হাসিনা অবিসংবাদিত প্রধানমন্ত্রী হয়ে থাকবেন এই অঞ্চলের মানুষের কাছে আমার মত লাখো মানুষের কাছে। আমার মত স্বজনদের নিয়ে পদ্মার পারে অসহায়ের মত অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার, হোটেল মালিক, বাস চালক, ফেরী চালক, ঘাট শ্রমিকদের কাছে জিম্মি হয়েছেন কোটি কোটি মানুষ। সেই যুগের অবসান হলো।


হ্যাঁ বলতে পারেন, এই সরকারের আমলে গণতন্ত্র সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। মানুষ ভোট দিতে পারছে না। এসব নিয়ে ভিন্ন মঞ্চে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু পদ্মা সেতু প্রশ্নে শেখ হাসিনার বিকল্প কেউ নেই। তিনি যোগ্য এবং অবিসংবাদিত প্রধানমন্ত্রী।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৭ শে জুন, ২০২২ সকাল ১০:৪৬

সৈয়দ মশিউর রহমান বলেছেন: পদ্মা সেতুর প্রয়োজন ছিল।

২| ২৭ শে জুন, ২০২২ দুপুর ১২:৪৬

রাজীব নুর বলেছেন: চাঁদগাজী/সোনাগাজী ঠিকই বলেন, পদ্মাসেতু ৭২ সালে করা দরকার ছিলো।

৩| ২৭ শে জুন, ২০২২ দুপুর ১:০৯

রিফাত হোসেন বলেছেন: খুব খারাপ লাগল। বিভাগীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নতি করা উচিত৷ তেমনি শিক্ষাসহ ও সকল ক্ষেত্রে রাজধানীমুখি না হতে হয়। এই সকল পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে পদ্মা সেতুর প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এগুলো নিয়ে অতি আবেগের কিছু নেই। হয়েছে ভাল লাগল, আশা করি সামনে আরো অনেক কিছু হবে। কিন্তু এটাই যেন শেষ না হয়।

৪| ২৭ শে জুন, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:২৯

সৈয়দ মোজাদ্দাদ আল হাসানাত বলেছেন: আপনার আব্বার কথা শুনে খুব খারাপ লাগলো। আল্লাহ বাবাকে ওপারে ভালো রাখুন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.