| নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
তাহমিদ রহমান
কবি ও স্বপ্নচারী। শখের বশে কবিতা লেখার প্রয়াস হয়। হয়তো সেগুলা কবিতা হয়ে ওঠে না, হয় অগোছালো শব্দমালা,জীবনের মতোন...
অধ্যায় ১ঃ হাসপাতালের নাইট শিফট (৩য় খন্ড - সমাপ্য)
( পর্ব ২ এর পর)
.......................
বাস তার স্টপেজে এসে থামল। অনিক নেমে গেল।
রাস্তা দিয়ে হাঁটতে শুরু করল অনিক। পাঁচ মিনিটের হাঁটা। ছোট্ট একটা রাস্তা, দুপাশে সারি সারি ফ্ল্যাট — দোতলা, তিন তলা, ইটের দেয়াল, সাদা জানালা। Stratford-এর এই এলাকা লন্ডনের মান অনুযায়ী সস্তা, কিন্তু তবুও ব্যয়বহুল।
অনিকের ফ্ল্যাট দ্বিতীয় তলায়। সিঁড়ি দিয়ে উঠল। চাবি দিয়ে দরজা খুলল।
ভেতরে ঢুকল।
ছোট্ট ফ্ল্যাট — সাড়ে চারশ স্কয়ার ফুট। লিভিং রুম, রান্নাঘর, বেডরুম, বাথরুম।
অনিক জুতো খুলে ব্যাগ সোফায় ফেলল, জ্যাকেট হ্যাঙ্গারে টাঙাল। ফ্ল্যাটটা নীরব — শুধু রেফ্রিজারেটরের মৃদু গুঞ্জন। জানালা দিয়ে ধূসর আলো, বাইরে মেঘলা আকাশ।রান্নাঘরে গিয়ে ডিম ভাজল, দুটো রুটি টোস্ট করল। খেল — স্বাদ নেই, শুধু পেট ভরানো। যান্ত্রিক। প্লেট ধুয়ে পানি পান করে বেডরুমে গেল। পর্দা টানা, অন্ধকার। বিছানায় শুয়ে পড়ল।
চোখ বন্ধ করল। কিন্তু মাথায় হাজারো চিন্তা।
মিসেস প্যাটারসনের কথা মনে পড়ল — "Doctor, never get old………it's not fun at all."
বুড়ো হওয়া। একা হওয়া। শরীর ভেঙে পড়া।
অনিকের বয়স ত্রিশ। এখনও তরুণ। কিন্তু মনে হলো সে বুড়ো হয়ে গেছে ভেতর থেকে।
জীবনে কী চায় সে?
প্রেম? হ্যাঁ। কিন্তু কোথায় পাবে?
বন্ধু? হ্যাঁ। কিন্তু লন্ডনে কে আছে?
পরিবার? ঢাকায়। হাজার মাইল দূরে।
তাহলে কী আছে তার কাছে?
একটা চাকরি। একটা খালি ফ্ল্যাট। একটা একা জীবন।
চোখ খুলে সিলিংয়ের দিকে তাকাল। সাদা, ফাঁকা। কোণায় একটা দাগ — পুরোনো লিক, কখনো ঠিক করা হয়নি।
মোবাইলের স্ক্রিন অন করল। সকাল আটটা বেজে পনেরো। ঢাকায় দুপুর দুটো।
WhatsApp-এ মায়ের মেসেজ এখনো খোলা - "ভালো আছো, বাবা? খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করছ তো? শীত বেশি?"
টাইপ করতে গিয়ে থামল। কী লিখবে?
"হ্যাঁ মা, ভালো আছি" — মিথ্যা।
"মা, আমি একা। আমি ক্লান্ত" — সত্যি, কিন্তু লেখা যায় না।
মোবাইল বালিশের পাশে রেখে আবার চোখ বন্ধ করল। এবার ঘুম এল। ধীরে ধীরে। ক্লান্তি তাকে টেনে নিয়ে গেল অন্ধকারে।
স্বপ্ন দেখল।
ঢাকা। মেডিকেল কলেজের ক্যাফেটেরিয়া। বন্ধুরা বসে আছে — হাসছে, গল্প করছে, চায়ের কাপ হাতে। কেউ সিগারেট ধরাচ্ছে। কেউ মোবাইলে লাউড স্পিকারে গান শোনাচ্ছে।
অনিকও আছে সেখানে তাদের মাঝে — হাসছে, কথা বলছে। জীবন্ত।
হঠাৎ সব ঝাপসা হয়ে গেল। বন্ধুরা মিলিয়ে গেল। ক্যাফেটেরিয়া খালি হয়ে গেল। শুধু অনিক একা বসে আছে। চায়ের কাপ ঠান্ডা হয়ে গেছে।
জেগে উঠল।
দুপুর একটা। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ঘুমিয়েছে — যথেষ্ট নয়, কিন্তু আর ঘুমাতে পারছে না। মাথা ভারী, মুখ শুকনো।
বাথরুমে গেল অনিক। মুখ ধুল। আয়নায় তাকাল — চোখ লাল, চুল এলোমেলো, খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি গজিয়েছে। শেভ করা দরকার। কিন্তু এখন না।
রান্নাঘরে গিয়ে চা বানাল — দুধ, চিনি, বাংলাদেশি স্টাইল। সোফায় বসে চায়ে চুমুক নিল। গরম। চমৎকার!
ল্যাপটপ খুলল। Netflix। কিছু একটা দেখবে ভেবেছিল। কিন্তু মন নেই। বন্ধ করে দিল।
জানালায় গিয়ে দাঁড়াল। বাইরে রাস্তা, গাড়ি যাচ্ছে, মানুষ হাঁটছে। জীবন চলছে।
আজ শনিবার। আগামীকাল রবিবার। দুদিন ছুটি। তারপর আবার হাসপাতাল, আবার সাড়ে বারো ঘণ্টার দীর্ঘ শিফট।
এই কি জীবন?
রাহুলের মেসেজ এসেছে — "আজ রাতে পাব, রাত আটটা। শোরডিচ। সিলিহর্স পাব। আসবে?"
যাবে? নাকি এখানে বসে থাকবে?
টাইপ করল। "দেখি।"
রিপ্লাই এল। "ঠিক আছে। জানিও।"
ফোন সরিয়ে রাখল।
আবার জানালায় তাকাল। বাইরে মেঘ কেটে একটু রোদ বেরিয়েছে। ধূসর আকাশে একটুকরো নীল।
হয়তো বেরোবে, হাঁটবে, পাবে যাবে। হয়তো!
কিন্তু এই মুহূর্তে সে শুধু দাঁড়িয়ে আছে জানালার পাশে, চায়ের কাপ হাতে, একা।
লন্ডনের নভেম্বর। শীত নামছে। দিন ছোট হচ্ছে। রাত দীর্ঘ হচ্ছে।
আর অনিক আহমেদ — ত্রিশ বছর বয়সী, সুদর্শন, ভাবুক, একাকী এক প্রবাসী বাংলাদেশী — দাঁড়িয়ে আছে তার খালি ফ্ল্যাটে, এবং ভাবছে:
এই কি সব?
নাকি আরও কিছু আছে?
নাকি কোথাও, কেউ তার জন্য অপেক্ষা করছে?
সে জানে না। এখনও জানে না।
কিন্তু জীবন চলছে। সময় গড়াচ্ছে। আর কোথাও, হয়তো, কোন একটা নতুন গল্প শুরু হতে চলেছে।
...............(চলবে)
©somewhere in net ltd.