| নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
তাহমিদ রহমান
কবি ও স্বপ্নচারী। শখের বশে কবিতা লেখার প্রয়াস হয়। হয়তো সেগুলা কবিতা হয়ে ওঠে না, হয় অগোছালো শব্দমালা,জীবনের মতোন...
অধ্যায় ২ঃ খালি ফ্ল্যাট (১ম খন্ড)
(পর্ব ৩ এর পর)
শনিবার বিকেল চারটা। অনিক জানালায় দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। আকাশ ধূসর, ঘন মেঘে ঢাকা, রোদ নেই। আবার বৃষ্টি নামবে মনে হচ্ছে। নভেম্বরের লন্ডন — সকাল থেকে সন্ধ্যা একই ধূসরতা।
ফ্ল্যাটটা এখনও সেই একই নীরবতায় ডুবে আছে। সারাদিন সে তেমন কিছুই করেনি। দুপুরে ঘুম থেকে উঠে চা খেয়েছে, ল্যাপটপে কিছু কাজ করবার চেষ্টা করেছে — মন বসেনি। বন্ধ করে দিয়েছে।
দুপুরে খিচুড়ি রান্না করেছিল — চাল, ডাল, হলুদ মিশিয়ে দেশি স্টাইলে। মায়ের রান্নার কথা মনে পড়েছিল। মা যেভাবে খিচুড়ি রান্না করে — পেঁয়াজ কুচি, আদা-রসুন বাটা, একটু গরম মসলা। কিন্তু এখানে সেসব নেই। শুধু চাল, ডাল, হলুদ। স্বাদ আসেনি খুব একটা; খেয়েছে, তবে তৃপ্তি হয়নি।
এখন বিকেল চারটা। আর ঘণ্টাখানেক পরেই সন্ধ্যা। রাত আটটায় পাবে যাওয়ার কথা। যাবে কি না, ঠিক করতে পারেনি।
সোফায় ফিরে এল। খালি ঘরের দিকে চোখ পড়ল।
এই ফ্ল্যাট। তার বাসা। দুই বছর ধরে।
ছোট একটা লিভিং রুম। ধূসর সোফা, আইকিয়ার সেন্টার টেবিল, দেয়ালে ৩২ ইঞ্চি টিভি। দেয়ালে কোনো ছবি নেই — শুধু সাদা, ফাঁকা। রান্নাঘরে আধোয়া প্লেট, বেডরুমে ভাঁজ না করা বিছানা। বাথরুমের আয়নার এক কোণে ফাটল — কখনো ঠিক করা হয়নি।
জানালা দিয়ে দেখা যায় পাশের বিল্ডিং। মাঝেমধ্যে একটা দম্পতিকে দেখা যায় — হাসছে, কথা বলছে। অনিক তাকিয়ে থাকে, তারপর পর্দা টেনে দেয়।
ভাড়া সাড়ে এগারোশ পাউন্ড — বেতনের এক-তৃতীয়াংশ। ট্যাক্স, খাবার, যাতায়াত, বিল — মাস শেষে হাতে থাকে সামান্যই। কিছু দেশে পাঠায়, বাকিটা জরুরি খরচে শেষ। সঞ্চয়? নামমাত্র।
ঢাকায় এই টাকায় কী হতো? তিন হাজার পাউন্ড — প্রায় চার লাখ টাকা। ঢাকায় এই টাকায় রাজার মতো থাকা যেত। একটা ভালো ফ্ল্যাট, হয়তো তিন বেডরুমের। হয়তো একটা গাড়িও কেনা যেত। কাজের লোক রাখা যেত।
এখানে? এই ছোট্ট জায়গা, যেখানে দম বন্ধ হয়ে আসে। যেখানে রান্না করলে পুরো ফ্ল্যাটে গন্ধ ছড়িয়ে যায়। যেখানে পাশের ফ্ল্যাটের টিভির শব্দ, এমনকি গভীর রাতে যখন চারপাশে কেবল নিস্তব্ধতা থাকে,তখন কাশির শব্দও শোনা যায়।
কিন্তু এটাই লন্ডন। এটাই বাস্তবতা।
অনিক ফোন হাতে নিয়ে ইন্সটাগ্রাম দেখতে লাগল। খাবারের ছবি, ভ্রমণের ছবি, সেলফি — সবাইকে অনেক খুশি দেখাচ্ছে, সবাই যেন উপভোগ করছে জীবন।
একটা পোস্ট চোখে পড়ল। মেডিকেল কলেজের এক সিনিয়র, ডা. রফিক। তিনিও লন্ডনে থাকেন, কিন্তু তার জীবন একদম আলাদা। গত মাসে পোস্ট করেছিলেন স্পেন ভ্রমণের ছবি — বার্সেলোনার সমুদ্রতট, দামি রেস্তোরাঁ। আজ পোস্ট করেছেন নতুন বাড়ির ছবি — তিন বেডরুমের ডিটাচড বাড়ি, বাগান সহ, লন্ডনের উপকণ্ঠে।
মাথায় ভাবনাটা আবার এল — তফাৎটা কোথায়? একই পেশা, একই শহর। তাহলে কেন তার জীবন এত আলাদা? হয়তো উনি আরও হিসেবী। হয়তো তার স্ত্রীও ভালো আয় করেন। হয়তো স্টক মার্কেটে বা ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন। হয়তো... নাকি সে নিজেই কিছু ভুল করছে?
মনে হলো — অন্যরা এগিয়ে যাচ্ছে, আর সে দাঁড়িয়ে আছে। নাকি সে পিছিয়ে যাচ্ছে?
নিজেকে বোঝাল — না, টাকা সব না। শান্তি চাই। মনের শান্তি।
কিন্তু শান্তি কোথায়? এই খালি ফ্ল্যাটে?
ফেসবুকে তানভীরের পোস্ট দেখল — "আজ মেয়ের জন্মদিন। তিন বছর হলো। সময় কত দ্রুত চলে যায়।" নিচে ছবি: কেক, বেলুন, হাসিমুখ।
অনিক ছবিতে লাইক দিল, কমেন্ট করল: "শুভ জন্মদিন!" ফোন সরিয়ে রাখল।
তারপর উঠে রান্নাঘরে গিয়ে চা বানাল — এই ফ্ল্যাটে এসে চা বানানো যেন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ছুটির দিনে পাঁচ-ছয় কাপ। চা বানানো, চুমুক দেওয়া, জানালায় দাঁড়িয়ে বাইরে তাকানো — এই হয়ে গেছে তার জীবন।
চায়ের কাপ নিয়ে জানালায় এল।
বাইরে রাস্তায় একটা পরিবার হাঁটছে — বাবা, মা, দুটো বাচ্চা। বাচ্চারা দৌড়াচ্ছে, হাসছে। বাবা-মা পেছন থেকে হাঁটছে, হাতে হাত রেখে।
অনিক তাকিয়ে রইল। একটা অদ্ভুত অনুভূতি। ঈর্ষা নয়, হয়তো আকাঙ্ক্ষা — এমন একটা জীবন, সরল, সাধারণ, কিন্তু পূর্ণ।
তার কাছে কী আছে? একটা ভাড়া ফ্ল্যাট, একটা চাকরি, একটা রুটিন। কিন্তু কোনো মানুষ নেই। কেউ নেই যার সাথে ভাগ করে নেবে দিনের গল্প, রাতের ক্লান্তি, সকালের চা।
চায়ের গরম ভাপ মুখে লাগল।
মোবাইল বাজল। রাহুলের মেসেজ — "অনিক, আসছো তো? আমরা সবাই যাচ্ছি। মজা হবে।"
যাবে? আগে যে কয়েকবার গিয়েছে, অনিকের খুব একটা ভালো লাগেনি। প্রতিবার রাহুল-ই নিয়ে গিয়েছিল। আসলে ইংল্যান্ডে আসার পর প্রথম দেড় বছর সে তেমন ঘোরাঘুরি বা সামাজিকতা করেনি। কোভিড ছিল একটা কারণ — ঘন ঘন লকডাউন আর সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং। কিন্তু সত্যি বলতে, তখন তার খারাপও লাগেনি। সে আগে থেকেই এমন — একা থাকতে পছন্দ করে, ভিড় এড়িয়ে চলে। হাসপাতালে কাজ, বাসায় ফেরা, বই পড়া, সিরিজ দেখা — এই রুটিনে সে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত।
কিন্তু আস্তে আস্তে সেই স্বাচ্ছন্দ্য ভারী হয়ে উঠেছে। নির্জনতা যেন সহনীয় পর্যায় ছাড়িয়ে গেছে। এখন মাঝেমধ্যে মনে হয় — কারো সাথে কথা বলা দরকার, কারো সাথে সময় কাটানো দরকার। তাই রাহুল যখন প্রথম ডাকল, গিয়েছিল।
পাব। বিয়ার। আড্ডা।
সবাই কথা বলছিল — ফুটবল, টিভি সিরিজ, উইকএন্ডের পরিকল্পনা। অনিক বসে ছিল, শুনছিল, মাঝেমধ্যে হাসছিল। কিন্তু নিজে কিছু বলতে পারেনি। কী বলবে? আর্সেনাল নাকি চেলসি — কোন দল ভালো খেলল? সে জানে না। নেটফ্লিক্সে কোন সিরিজ ভালো? সে দেখে না। উইকএণ্ডে কী করবে? ঘুমাবে, হয়তো একটু হাঁটবে, আবার ঘুমাবে।
তারপর আবার গিয়েছিল সপ্তাহ তিনেক পরে।সেই একই অভিজ্ঞতা। সবাই নিজেদের মধ্যে মজা করছে, আর সে পাশে বসে আছে। একটা অদৃশ্য দেয়াল। ভাষার নয়, সংস্কৃতির।
এবার? হয়তো একই হবে।
কিন্তু এখানে বসে থাকলে? আরও একটা নীরব সন্ধ্যা, আরও একটা একা রাত...
............(চলবে)
©somewhere in net ltd.