![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
একুশ দিন পর চলে গেলো আমাদের ভাতিজি, পৃথিবীতে সময়টা হয়তো তার জন্য অনেক কম কিন্তু বেচে থাকা মানুষের মনে রয়ে যাবে আজীবন, বেচে থাকলে হয়তো ছোট ছোট হাতে বাবার মুখ ছুয়ে দিত, মায়ের কোলে আদরে দিন পার করতো, বাবা মা সবাই হয়তো অনেক স্বপ্ন দেখতো তাকে ঘিরে। দুস্টামিতে মাতিয়ে রাখতো সারা ঘর। এভাবেই হাসি আনন্দে কেটে যেতো দিন, কিন্তু জন্মের পর থেকে মায়ের কোল ছুতে পারেনি একটু সময়ের জন্যও না। বাবার কোলে যখন উঠলো তখন নিস্প্রান, বাবার কোল থেকে মাটির কোলে চিরদিনের জন্য শুয়ে গেলো ছোট্ট শরীরটা।
মাদিহার শরীর, জীবনক্ষন ছোট হতে পারে কিন্তু আমাকে নাড়িয়ে দিয়ে গেলো দীর্ঘ দিনের জন্য। নিজের জীবনের কৃতকর্ম আর তুচ্ছতা মনে করিয়ে দিয়ে গেলো খুব স্পস্টভাবে। কালশী গোড়স্থানের মাটির ঘরে রেখে এলাম আমরা সবাই রাত ১০.৩০ এর দিকে। জানাজা পড়ি কিন্তু অনেক ভাবনা মাথায় ঘোরে। নিজ জীবনের পর্যালোচনা করি, নিজের জীবনের স্থায়িত্ব নিয়ে ভাবি। কর্মের হিসেব নেই।
ভাবনার জগত বলছে আমার দিন দিন মৃত্যু ভয় কমছে, মনটা আগের মতো নরম হয় না, বিষয়টা হলো এমন- ছোট সময়ে ভয়ে গোড়স্তানের পাশ দিয়ে যেতে পারতাম না, যেকোন কবরের পাশ দিয়ে গেলে আত্মাটা কেপে উঠতো। বাউফলের হাসপাতাল গোড়স্থানের পাশ দিয়ে যেতে কী ভয়টাই না পেতাম, বেশিরভাগ সময় দৌড়ে নয়তো জোড়ে হেটে পাড় হতাম এই ছোট্ট জায়গাটুকু, গা ছমছম করতো, তখন এই গোড়স্তানের ভিতর বাশঝাড় ছিলো, ভয়ে ওদিক তাকাতাম না, অথচ প্রতিদিন এই জায়গাটা পাড় হতে হতো অনেকবার, প্রতিবারই আমি এভাবে ভয়ে কুকরে যেতাম, তখন মৃত্যু মানুষের চেহারা দেখতাম না, এমনকি ভয়ে জানাযাও পড়তাম না, সেই আমি অনেক অনেক কবরের মাঝে দাড়িয়ে গতকাল জানাজা পড়লাম, নিজ হাতে আধোআলোতে মাটি দেই ভাতিজিকে। এই নিজের জীবনের ক্ষুদ্রতার ভাবনার সাথে সাথে আমি ভাইয়াকে দেখি, যিনি জন্মের পর জীবন্ত কোলে নিতে পারলোনা, সেই বাবা কিভাবে মৃত নিজঅংশকে কাপড়ে জড়িয়ে ধরে দাড়িয়ে থাকে, কর্পুর দেয়া কাপড়ে মুড়ানো ছোট শরীরকে সামনে রেখে জানাজা পড়ে। হাসপাতাল থেকে বুকের সাথে লাগিয়ে গাড়িতে করে এনে কবরে শুয়ে দিলো নিজ হাতে- তার কী কস্ট, তার কি মর্মবেদনা, তার কী ভিতরগত যন্ত্রনা আমরা বুঝতে পারবো, কোনদিনই পারবোনা। রাতে বিদায় নিয়ে চলে আসলাম কিন্তু ভাবনার জগতটা চলছিলো তুমুল বেগে, কিভাবে রাত পাড় করবে, এই শোকাতুর মা বাবা, আসার সময় ভাবীর মুখের দিকে একবারই তাকিয়ে ছিলাম, আহ কী আবেগতাড়িত চেহারা, কী বেদনাবিধুর উদাস দৃষ্টি, দুখের ছাপ পড়ে আছে পুরো চেহারায়। আমরা হয়তো এই মায়ের প্রথম সন্তানের মৃত্যুশোক কোনদিন বুঝতে পারবো না। এই বয়সে এই শোক হয়তো তাড়িয়ে নিবে তার পুরোটা জীবন, কোন এক রাতে হয়তো ঘুম ভেংগে যাবে, নিজের শরীরের অংশকে খুজবে, হয়তো কাদবে, কিন্তু ফিরে কি পাবে? ব্যস্ত পৃথিবীতে অনেক কাজেই ব্যস্ত থাকবে কিন্তু কখনো হয়তো থেমে যাবে তার কিছুটা সময়, সে ভাবনার জগত হয়তো কোন দিন পাঠ উদ্ধার হবে না, সে স্মৃতি কোনদিন মলিন হবে না।
এগুলো ভাবতে ভাবতে পারিপার্শ্বিক চিন্তাও মাথায় ঘোরে, ক্ষনস্থায়ী জীবনের তুচ্ছতা আরো বুঝতে পারি কবরের জায়গা খুজতে গিয়ে, মারা গেলে এই ঢাকা শহরে স্থায়ী মাটির ঘরও জুটবে না, মাত্র একহাত স্থায়ী কবরের জন্য চাইলো দু লাখ টাকা, এ টাকা না দিলে কয়েক মাসের মধ্যে হয়তো কবরের চিহ্নটুকুও থাকবে না। কবর খুড়তে দিতে হলো ২২০০ টাকা, যিনি জানাজা পড়ালেন তাকে দিতে হলো ৩০০ টাকা। এইতো ঢাকা শহর, এইতো জীবন, এই তো যান্ত্রিক শহর, মৃত দেহ মানেই ব্যবসা, অথচ গ্রামে কত আবেগ নিয়ে কবর খুড়ে প্রতিবেশিরা, পাশাপাশি বাড়ি থেকে খাবার পাঠায় মৃতের বাড়িতে, সবাই শোকে কাতর হয়ে পড়ে প্রিয়জন হারানো ব্যক্তিদের সাথে। এভাবেই এই শহরটা আমাদের আবেগহীন করে তুলছে, মৃত্যু চিন্তা থেকে ব্যস্ততার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে, কে বাচলো, কিভাবে বাচলো, কে মরলো, ব্যস্ততায় আমাদের কিছু মনে হয় না। এভাবে আমরাও অমানুষ হয়ে উঠছি। নিজেকে নিজে চিনতে পারি না।
হায়রে মৃত্যু তুই কত নিষ্ঠুর, ক্ষনিকের মধ্যে জীবনকে এতো তুচ্ছ নগন্য করে দিস, এতো দ্রুতই মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিস, আপন পর হয়ে যায়, গতি স্থির হয়ে যায়, জীবন স্মৃতি হয়ে যায়, সময়ের সাথে সাথে একেবারে বিলুপ্ত, অথচ এই ক্ষুদ্র জীবনটাকে নির্বাহ করার জন্য কত কি করি, মানুষের সাথে ঝগড়া করি, অন্যকে তুচ্ছ করি, প্রতিযোগিতা করি, কত মারপ্যাচে নিজের স্থান টিকিয়ে রাখি। টাকার জন্য কত কিছুই না করি। দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়ে পড়ি, স্বাধীনতার নামে ইচ্ছেমতো চলি। জাগতিকটাই প্রধান হয়ে উঠে। অথচ সামান্য দুটো শব্দে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যেতে পারে। পৃথিবী থেকে এভাবেই একদিন চলে যাবো। অনেক দিনতো হয়ে গেলো এখন কিছুটা প্রস্তুতিতো নিতে হবে...........
©somewhere in net ltd.