নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

যাহা বলিব সত্য বলিব

আল্লাহ মহান, যাহা বলিব সত্য বলিব।

তালপাতারসেপাই

লিন্ক সহ পোষ্টের বাহবা/দায়, মূল লেখকের।

তালপাতারসেপাই › বিস্তারিত পোস্টঃ

সমুদ্রসীমার ন্যায্য ও শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি

১৫ ই জুলাই, ২০১৪ সকাল ৯:৩৯



আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতের রায়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সমুদ্রসীমা নির্ধারণ নিয়ে দীর্ঘকালীন বিরোধের মীমাংসা হয়েছে। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে যে বিরোধটি ঝুলে ছিল, দুই দেশের মধ্যে তিক্ততার কারণ হয়ে ছিল, তারই চূড়ান্ত সুরাহা হয়েছে চলতি জুলাই মাসে।

আন্তর্জাতিক আদালতের এই গুরুত্বপূর্ণ রায়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের বিরোধপূর্ণ ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার এলাকার সার্বভৌম অধিকারী হয়েছে। বঙ্গোপসাগরের বিশাল এলাকায় বাংলাদেশের অধিকার নিশ্চিত হওয়াটা একটা বড় ধরনের জাতীয় প্রাপ্তি বটে; কিন্তু ঠিক একইভাবে দুই নিকট পড়শি দেশের মধ্যে একটি বড় বিরোধের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তিটিও কম স্বস্তিদায়ক নয়।

বাংলাদেশ সৃষ্টির পর পরই সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির আলোচনা শুরু হয় ভারতের সঙ্গে। ১৯৭৪ সালে প্রথম আলোচনার সূত্রপাত হয়। মুক্তিযুদ্ধ শেষে আমি তখন সাংবাদিকতায় ঢুকেছি। আমরা নিজেরাও এসব নিয়ে রিপোর্ট করেছি। কিন্তু বারবার বৈঠক করেও বিরোধটির কোনো সুরাহা করা যায়নি। দুই দেশই জোর যুক্তি উত্থাপন করে গেছে নিজেদের পক্ষে। এরপর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা প্রায় বন্ধই রেখেছে আমাদের সরকারগুলো। ভারতের সঙ্গে নানা বিষয়ে অনেক বাদানুবাদ হয়েছে, ছলচাতুরীর রাজনীতিও করা হয়েছে। কিন্তু বঙ্গোপসাগরের সুবিশাল অধিকার নিয়ে কেউই কথা বলেনি। এর একটি বড় কারণ ছিল এই যে সাবেক সামরিক ও আধা সামরিক সরকারগুলো কেবল তাদের চলতি রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করতে চেয়েছে, রাষ্ট্রের স্বার্থ নয়।

সমুদ্রসীমার ন্যায্য ও শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি

অবশেষে ২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক আদালতে গেছে। সেখানেও সমঝোতা হয়নি। পরে সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ২০১১ সালের মে মাসে বিষয়টি নেদারল্যান্ডসের হেগে সমুদ্রসীমাসংক্রান্ত স্থায়ী সালিস আদালতে (পার্মানেন্ট কোর্ট অব আর্বিট্রেশন- পিসিএ) তোলা হয়েছে। জাতিসংঘ সমর্থিত এই আন্তর্জাতিক আদালত দীর্ঘ শুনানির পর ন্যায্যতা ও সমতার ভিত্তিতে দুই দেশের সমুদ্রসীমা নির্দিষ্ট করে রায় দান করেছে।

এই রায়ে সর্বমোট এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি সমুদ্র অঞ্চল, ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর বাংলাদেশ তার সার্বভৌম অধিকার নিশ্চিত করতে পেরেছে। বাংলাদেশের মতো একটি দেশের জন্য এটি অনেক বড় অর্জন বৈকি।

এর আগে ২০১২ সালে হামবুর্গভিত্তিক সমুদ্র আইনবিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল (ইটলস) সমুদ্রসীমা নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে একটি বড় বিরোধের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি করে দিয়েছে। সেই রায়ে বাংলাদেশ বিরোধপূর্ণ ৮০ হাজার বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকার মধ্যে মোট ৭০ হাজার বর্গকিলোমিটারের অধিকারী হয়েছে। মিয়ানমারের পর ভারতের সঙ্গে এই রায়ে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর ফলে সমুদ্রের স্থায়ী ও পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র পেয়েছে বাংলাদেশ। আজ এবং আগামী বাংলাদেশের মানুষ যে মানচিত্রের সুফল ভোগ করবে।

পরপর দুটি আন্তর্জাতিক আদালতের ঐতিহাসিক রায়ের ফলে বঙ্গোপসাগরের গভীরে মৎস্য আহরণ, সাগরের তলদেশে প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলনে বাংলাদেশ তার সার্বভৌম অধিকার নিশ্চিত করতে পেরেছে। ভারতের সঙ্গে বিরোধ মীমাংসার পর বঙ্গোপসাগরের ২৮টি গ্যাস ব্লকের মধ্যে বেশির ভাগই এখন বাংলাদেশের অধিকারে। মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ ১৭টি ব্লকের মধ্যে ১১টি ইতিমধ্যেই পেয়েছে বাংলাদেশ। এবার পেল ভারতের দাবিকৃত ১০টি ব্লকের সবই।

এই রায়ের ফলে জাহাজ চলাচলেও আগেকার অনাকাঙ্ক্ষিত সব বাধা দূর হয়েছে। আগের অবস্থায় বাংলাদেশ এসব অঞ্চলে অবরুদ্ধ থাকত। চলাফেরায় বিধিনিষেধ থাকত। এখন আর তা হওয়ার সুযোগ নেই। অন্যদিকে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ এবং জলসীমায় নিরাপত্তার দিক দিয়ে বাংলাদেশ এখন অনেক বেশি সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। অন্যদিকে এটিও নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে নিজেদের সমুদ্রসীমায় সম্পদ অনুসন্ধান ও ব্যবহারের কাজে বিদেশি বিনিয়োগ এখন দ্বিধাহীনভাবে আসবে। তবে বলাই বাহুল্য, এসব বিশাল প্রাপ্তি ও সম্ভাবনাকে দেশবাসীর কল্যাণে উপযুক্ত পরিকল্পনায় কাজে লাগাতে না পারলে আখেরে লাভ কিছুই হবে না।

আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর সঙ্গে আমি একমত পোষণ করে বলতে চাই, এই রায় উভয় রাষ্ট্রের জন্যই বিজয় নিশ্চিত করেছে। নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশ ও ভারতের এ এক যৌথ বিজয়। কেননা প্রায় চার দশক ধরে উভয় রাষ্ট্রের মধ্যকার সমস্যাটি শান্তিপূর্ণভাবে নিষ্পত্তি হয়েছে। এই বিরোধ মীমাংসায় কোনো যুদ্ধ প্রয়োজন হয়নি, কোনো তিক্ততা হয়নি, রাজনীতি বা কূটনীতির কোনো কূটকৌশল প্রয়োজন হয়নি; বরং সংকট নিরসনে দুই দেশ যুক্তি ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে সৌহার্দ্যের নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আমার বিশ্বাস, এই সুরাহা বাংলাদেশ-ভারত সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ককে আরো একধাপ এগিয়ে নেবে, উভয় রাষ্ট্রকে সামনের দিকে এগিয়ে নেবে এবং সমঝোতা ও সহযোগিতার সম্পর্কে নতুন দুয়ার খুলে দেবে।

বিষয়টি নিয়ে আমার ধারণা, মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ নিয়ে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির ভূমিকাকে কখনো অস্বীকার করা যাবে না। মূলত তাঁর আমলেই বিষয় দুটি আন্তর্জাতিক আদালতে উঠেছে এবং মামলা অগ্রসর হয়েছে। এখানে সরকারপ্রধানের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার বিষয়টিও ভাবার বিষয়।

লক্ষ করার ব্যাপার যে মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে সুবিশাল সমুদ্রসীমার অধিকার লাভ করার পর সরকারবিরোধীরা তেমন উচ্চবাচ্য না করলেও এবার তারা বেশ সরব হয়েছেন। রায়ে তালপট্টি দ্বীপের এলাকার নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশ না পাওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছে বিএনপি। দলটির অন্যতম নেতা ও সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী হাফিজউদ্দিন আহমদ অভিযোগ করেছেন, এই রায়ে বঙ্গোপসাগরে অর্থনৈতিক সমুদ্রসীমায় ভারতের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বর্তমান সরকার এই রায়ে 'দক্ষিণ তালপট্টি' দ্বীপটি ভারতকে দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সুন্দরবনের দক্ষিণ-পশ্চিমে এককালে জেগে ওঠা 'দক্ষিণ তালপট্টি' দ্বীপটির কোনো অস্তিত্বই যে আজ আর নেই, সেটিও তারা স্মরণে রাখার চেষ্টা করেননি। তবে দ্বীপটির অস্তিত্ব আজ আর না থাকলেও আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে সমুদ্রের ওই অংশটি ভারতের ভাগে পড়েছে। এর পরও দ্বীপটির নিচের (দক্ষিণে) বিশাল জায়গায় বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের পর পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলাসংলগ্ন হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মোহনায় একটি নতুন দ্বীপের উৎপত্তি হয়েছিল। 'যুক্তরাষ্ট্রের ল্যান্ড রিসোর্স স্যাটেলাইট' ১৯৭৪ সালে যে তথ্য প্রকাশ করে সে অনুযায়ী ওই দ্বীপের আয়তন প্রায় আড়াই হাজার বর্গমিটার, যা ভাটার সময় ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরপর বিভিন্ন সময়ে দুই দেশের রাজনীতিতেই 'তালপট্টি' ঘুরেফিরে আসে। ১৯৯০ সালে এক স্যাটেলাইট জরিপের মাধ্যমে দ্বীপটির বিলীন হয়ে যাওয়ার খবর দেয় 'সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস' (সিইজিআইএস)। কারণ নব্বইয়ের দশকের শেষদিকে তালপট্টি সমুদ্রগর্ভে হারিয়ে যায়।

সাতক্ষীরা জেলার হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মোহনায় জেগে ওঠার পর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দ্বীপটির মালিকানা দাবি করা হয়। অন্যদিকে ভারতও নিজেদের মানচিত্রে এর অধিকার দাবি করে, নাম দেয় 'পূর্বাশা' বা 'নিউমুর'। দ্বীপটির মালিকানা নিয়ে আশির দশকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে টানাপড়েন শুরু হয়। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ একটি যৌথ সমীক্ষার প্রস্তাবও দেয়। কিন্তু ভারত ১৯৮১ সালে নৌবাহিনী পাঠিয়ে সেখানে তাদের পতাকা ওড়ায়। এই টানাপড়েনের মধেই ১৯৯০-এর শেষদিকে তালপট্টি দ্বীপটি সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যায়।

সমুদ্র বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশের পক্ষে ভারতের সঙ্গে মামলার ডেপুটি এজেন্ট, 'মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট'-এর সচিব অবসরপ্রাপ্ত রিয়ার অ্যাডমিরাল মো. খুরশেদ আলম সমুদ্রসীমা নির্ধারণ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তিনি জানিয়েছেন, 'দক্ষিণ তালপট্টি' দ্বীপটি ছিল একটি সাময়িক বালির দ্বীপ। ১৯৭০ সালের সাইক্লোনের সময় এটা জেগে উঠেছিল। পরে ১৯৮৫ সালের সাইক্লোনে তা বিলীন হয়ে যায়। খুরশেদ আলম আরো জানিয়েছেন, ১৯৪৭ সালের রেডক্লিফ লাইন মেনে দুই দেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই মানচিত্রেও তালপট্টি বাংলাদেশে নেই। সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আগেই মানচিত্র সংশোধন করার প্রয়োজন ছিল, যা করা হয়নি। এ ধরনের আন্তর্জাতিক দাবিতে দলীয় রাজনীতির লাভক্ষতির চেয়ে রাষ্ট্রের লাভক্ষতির বিষয়টি অগ্রাধিকার পাওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু বাংলাদেশের বেলায় তেমনটা ঘটেনি। বাংলাদেশ কেবল ২০১০ সাল থেকে তার মানচিত্র সংশোধন করতে শুরু করেছে। আর আজ যখন দ্বীপটির কোনো অস্তিত্বই নেই, তখন তো কথাই নেই।

ভারত ও বাংলাদেশের ভূখণ্ড ও সমুদ্রসীমা লাগোয়া, অবিচ্ছেদ্য; এর কোনো পরিবর্তন করা যাবে না। দুই দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিও অনেক বেশি কাছাকাছি। সে কারণেই আমার বিশ্বাস, দুই দেশের গণমানুষের কল্যাণে প্রতিটি ক্ষেত্রে দুই দেশ যদি সৌহার্দ্য ও শান্তিপূর্ণ পন্থায় দ্বিপক্ষীয় সমস্যার সমাধান খোঁজার চেষ্টা করে, তাহলে দুই দেশই উপকৃত হবে।

সুত্র

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.