নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লিন্ক সহ পোষ্টের বাহবা/দায়, মূল লেখকের।
সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলোপ, অত্যুন্নত তথ্যপ্রযুক্তি, জীবপ্রযুক্তি ও অন্যান্য প্রযুক্তির বিস্তার এবং বিশ্বায়নের কর্মধারা বিশ্বব্যবস্থাকে যে রূপ দিয়েছে, এতে বিরাজ করছে যুক্তরাষ্ট্র ও এর ঘনিষ্ঠ সহযোগী শক্তিগুলোর একচ্ছত্র কর্তৃত্ব। অত্যুন্নত নতুন প্রযুক্তির কল্যাণে পৃথিবীতে উৎপাদন বেড়েছে, সম্পদ বেড়েছে, ভোগ-বিলাস বেড়েছে। কিন্তু শান্তি বাড়েনি, অশান্তি বেড়েছে। ন্যায় বাড়েনি, অন্যায় বেড়েছে। নৈতিক দিক দিয়ে মানুষের অবনতি হয়েছে। রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে বৈষম্য বেড়েছে, প্রবলে-দুর্বলে ও ধনীতে-গরিবে বৈষম্য দ্রুততর গতিতে বেড়েই চলেছে। বসনিয়া হার্জেগোভিনা, আফগানিস্তান, ইরাক ও লিবিয়ায় যুদ্ধ হয়েছে, সিরিয়ায় যুদ্ধ চলছে। সিরিয়ার যুদ্ধ কি গৃহযুদ্ধ? বাইরের শক্তি, বাইরের অস্ত্রপাতি, বাইরের চাপ যেখানে এত বেশি- সেখানে গৃহযুদ্ধ আর গৃহযুদ্ধ নেই- যুদ্ধ। গোটা পৃথিবীতে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্বের অবলম্বন বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল। আরও অবলম্বন আছে। কিন্তু মূল অবলম্বন লগ্নিপুঁজির বিশ্ব-বিস্তৃত এ দুটি সংস্থা।
এই বিশ্বব্যবস্থার পরিবর্তন কাম্য। আমরা চাই, ন্যায়মুখী প্রগতিশীল নতুন বিশ্বব্যবস্থা। কাম্য বস্তুকে পাওয়ার জন্য কাজ করতে হবে। কিন্তু সেই কাজ নেই। পরিবর্তনের উদ্দেশে চিন্তাও নেই। প্রচারমাধ্যমের সাহায্যে এবং নানা কূটকৌশল প্রয়োগ করে মানুষের মগজ এমনভাবে ধোলাই করা হয়েছে যে, মানুষ পরিবর্তনের কথা ভাবতেই পারে না। পরিবর্তনটি মনে করে অসম্ভব ব্যাপার! নিও-লিবারেলিজম, প্লুরালিজম, সিভিল সোসাইটি, এনজিও ইত্যাদির সাহায্যে জনমনে এবং বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদদের মনেও এমন ধারণা সৃষ্টি করা হয়েছে যে, পরিবর্তন অসম্ভব।
পরিবর্তন প্রকৃতির নিয়ম। মানুষ কোনও-কোনও ক্ষেত্রে পরিবর্তনটি প্রগতিতে রূপ দিতে পারে। নিজের স্বার্থে ব্যবহার করার জন্যও মানুষ পরিবর্তনটি রূপান্তরিত করতে পারে। কিন্তু পরিবর্তনটি রোধ করে রাখতে পারে না। রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থার বেলায়ও এ কথা প্রযোজ্য। বিশ্বব্যবস্থার ক্ষেত্রে কিছুদিন ধরে পরিবর্তনের সামান্য আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কোনও-কোনও চিন্তাবিদ বলছেন, বিশ্বব্যবস্থা এককেন্দ্রিক অর্থাৎ কেবল ওয়াশিংটনকেন্দ্রিক থাকছে না- মস্কো, বেইজিং, দিল্লি, ইউরোপ, দক্ষিণ আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায় আলাদা কেন্দ্র গড়ে উঠছে। এখন দেখা যাচ্ছে, ওয়াশিংটনের সঙ্গে মস্কো ও বেইজিং কোনও-কোনও ব্যাপারে একমত হচ্ছে না। বেইজিং ও মস্কো আগের মতো অবস্থানে থাকলে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ন্যাটো অনেক আগেই লিবিয়ায় সৈন্য পাঠিয়ে বাশার আল আসাদকে হত্যা করে, লাখ-লাখ মানুষকে হত্যা করে সিরিয়ায় ‘গণতন্ত্র’ কায়েম করে ফেলত। ‘গণতন্ত্র’ মানে যুক্তরাষ্ট্র কথিত ‘লিবারেল ডেমোক্রেসি’- যা আফগানিস্তান, ইরাক ও লিবিয়ায় কায়েম করা হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে জাতীয় সংসদের নির্বাচন নিয়ে ওয়াশিংটন যা চেয়েছিল, দিল্লির বাধার কারণে তা করে নিতে পারেনি। ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্র যা চাইছে, মস্কো এর বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নকে (ইইউ) ওয়াশিংটন নিষ্ক্রিয়তায় ঠেলে দিয়েছে। এসব দেখে বোঝা যাচ্ছে, বিশ্বব্যবস্থায় স্ট্যাটাস ক্যু বজায় থাকছে না।
এরই মধ্যে ব্রাজিল (ই), রাশিয়া (জ), ইন্ডিয়া (ও), চীন (ঈ) ও সাউথ আফ্রিকা (ঝ) মিলে ব্রিকস (ইজওঈঝ) নামে জোট গঠন করেছে। অনেক দিনের আলাপ-আলোচনার পর ১৩ জুলাই ব্রাজিলের ফর্তালেজা শহরে অনুষ্ঠিত ব্রিকসের বৈঠকে ওই ৫ রাষ্ট্রের প্রধানরা বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের বাইরে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক নামে একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার আয়োজন সম্পন্ন করেছে এবং ২০১৬ সাল থেকে আন্তঃরাষ্ট্রিক পর্যায়ে এই ব্যাংক ঋণ নিতে শুরু করবে। এরই মধ্যে ওই ৫ রাষ্ট্র সমান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে মূলধন গঠন করতে শুরু করেছে। ৫০ বিলিয়ন ডলার মূলধন গঠন করা হয়েছে। ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাকারী ৫ রাষ্ট্র তাদের সমঅংশীদারিত্ব নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছে কাজ করছে। নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সদর দপ্তর হবে চীনের সাংহাইয়ে। প্রথম প্রেসিডেন্ট হবেন ভারত থেকে। পরিচালকম-লীর প্রথম চেয়ারম্যান হবেন ব্রাজিল থেকে। বোর্ড অব গভর্নমেন্টের প্রথম চেয়ারম্যান হবেন রাশিয়া থেকে। প্রথম আঞ্চলিক কেন্দ্র হবে দক্ষিণ আফ্রিকায়। ফর্তালেজা শহরে ১৩ জুলাইয়ের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট দিলমা রৌসেফ, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমা। ১৩ জুলাইয়ের বৈঠকটি ছিল একান্তভাবে এ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার আলোচনার জন্যই। এ সম্পর্কে আরও বিভিন্ন কথা জানা যায় এবং জানা যাবে। এখনই এ নিয়ে বেশি কথা বলা যাবে না, বেশি আশান্বিতও হয়ে ওঠা যাবে না। তবে এ উদ্যোগের সাফল্য ও শুভকর ফল আমরা কামনা করি।
অর্থনীতি ও উন্নয়নের সঙ্গে রাজনীতি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে যুক্ত থাকে। যুক্তরাষ্ট্র ও এর সহযোগী শক্তিগুলো এবং বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল অর্থনীতিকে রাজনীতি-নিরপেক্ষ রাখার কথা বলে থাকে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তারা ঋণ নিয়ে, উন্নয়ন নিয়ে রাজনীতিতে মেতে থাকে। বিশ্বব্যাংকের এ রাজনীতিই পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্রের জন্য, দুর্বল দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোর জন্য অভিশাপ। ব্রিকসের নেতারা এ অভিশাপ থেকে দুর্বল, দরিদ্র রাষ্ট্রগুলো মুক্ত করার কথা বলছেন। ব্রিকসের কর্তৃপক্ষ যদি আন্তরিকভাবে তা করতে চায়, তাহলে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টেকার জন্য অবশ্যই বিশ্বব্যাংকের রাজনীতি থেকে উৎকৃষ্ট রাজনীতি তাদের অবলম্বন করতে হবে। রাজনীতি-নিরপেক্ষ থেকে বেশিদূর এগোনো যাবে না। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার ও বিশ্বব্যাংকের রাজনীতিটি গভীরভাবে বুঝতে হবে। তারপর এর চেয়ে উন্নত রাজনীতির রূপ ও প্রকৃত নির্ধারণ করে কাজ করতে হবে। উন্নততর নতুন বিশ্বব্যবস্থার রূপকল্প উদ্ভাবন করে তাদের এগোতে হবে। রাষ্ট্রব্যবস্থার পুনর্গঠন নিয়েও তাদের মত থাকা অপরিহার্য।
ব্রিকসের নেতারা এ ব্যাপারটি কতখানি বুঝতে চাইবেন, তা বোঝা যাচ্ছে না। বিশ্বরাজনীতিতে এ ৫টি রাষ্ট্রেরই রয়েছে গৌরবজনক অতীত। গৌরবজনক ভবিষ্যৎ সৃষ্টিতে এ নেতারা সম্মিলিতভাবে কাজ করবেন এবং সফল হবেন- এটিই আমরা আশা করতে চাই। তবে এ ব্যাপারে পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের বিবেকবান চিন্তাশীল মানুষের বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে হবে। চিন্তা দিয়ে, প্রচার-আন্দোলন দিয়ে ব্রিকসের নেতাদের এবং বিশ্ববাসীকে উন্নততর নতুন বিশ্বব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রয়োজন বোঝাতে হবে। নতুন বিশ্বব্যবস্থার রূপ ও প্রকৃতিও ভাবুক-চিন্তকদেরই উদ্ভাবন করতে হবে। বিশ্ববাসী পরিবর্তন-উন্মুখ হয়ে উঠলে, প্রগতিকামী হয়ে উঠলে শুভকর যেসব ব্যাপার এখন অসম্ভব মনে হয়- সেগুলো সম্ভবপর মনে হবে। আজ হোক, কাল হোক- উন্নততর নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থা অবশ্যই প্রতিষ্ঠা করা যাবে।
দিলমা রৌসেফ, ভøাদিমির পুতিন, নরেন্দ্র মোদি, শি জিনপিং ও জ্যাকব জুমা আমাদের আশা অনুযায়ী নতুন বিশ্বব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করে দেবেন- এটা আশা করা যায় না। তবে আমরা যদি তাদের সামনে নিয়ে আমাদের আশা, আমাদের মতামত প্রকাশ করতে থাকি- তাহলে ব্রিকসের নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক অবশ্যই তা দ্বারা প্রভাবিত হবে। আজ নতুন এ উদ্যোগের সময়েই বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তিদের এ নিয়ে বিশ্ববাসীর পক্ষ থেকে অভিমত প্রকাশ করা- ইনটেলেকচুয়াল মুভমেন্ট পরিচালনা করা সমীচীন।
বাংলাদেশে এমন চিন্তাবিদ কারা আছেন- যারা উন্নততর নতুন বিশ্বব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে চিন্তা করেন? চিন্তার ক্ষেত্রে আমরা প্রায় সবাইকে বিশ্বব্যাংকের পরিকল্পনার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল দেখতে পাই। এই মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র নতুন উদ্যোগ একদিন বৃহৎ উদ্যোগে রূপ নেবে। নিও-লিবারেলিজম, প্লুরালিজম, গ্লোবালাইজেশন ইত্যাদির নামে যেসব গণবিরোধী কার্যক্রম চালানো হচ্ছে, এর স্থলাভিষিক্ত করতে হবে গণকল্যাণের কার্যক্রম।
লিবারেল ডেমোক্রেসির বদলে আমরা চাই শতভাগ মানুষের গণতন্ত্র। এই নতুন গণতন্ত্রকে আমরা নাম দিই নয়াগণতন্ত্র। বিশ্বরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা চাই আমরা। বিশ্বরাষ্ট্র হবে আন্তর্জাতিক ফেডারেল প্রকৃতির। জাতি, জাতিরাষ্ট্র, জাতীয় সংস্কৃতি, জাতীয় ভাষা থাকবে। এর ওপর কায়েম হবে আন্তঃরাষ্ট্রিক ফেডারেল বিশ্বরাষ্ট্র। বিশ্ব সরকার হবে জাতিরাষ্ট্রগুলোর সব সরকারের ঊর্ধ্বতন এক সরকার। রাষ্ট্রীয় সরকারের কিছু ক্ষমতা চলে যাবে বিশ্ব সরকারের কাছে। বিশ্ব সরকারের কাছে একটি সেনাবাহিনী রেখে সব রাষ্ট্রীয় সরকারের সেনাবাহিনী বিলুপ্ত করা হবে। বিশ্ব সরকার কাজ করবে জাতিরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সম্প্রীতি বৃদ্ধি এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিরোধ মীমাংসার জন্য।
জাতিসংঘকে বিশ্ব সরকারে উন্নীত করা সম্ভব। তা করতে হলে জাতিসংঘের সংবিধান ও কার্যপ্রণালিতে মৌলিক সংস্কার সাধন করতে হবে। বর্তমানে জাতিসংঘ হয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের সংঘে। জাতিসংঘ যেখানে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা বাহিনী গঠন করেছে, সেখানে প্রতিটি রাষ্ট্রের বাহিনীকে বিলুপ্ত করার উদ্যোগ বাঞ্ছনীয়।
আজ বিশ্বব্যাপী জাতিরাষ্ট্র পুনর্গঠনের ও আন্তর্জাতিক ফেডারেল বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন চিন্তা-ভাবনা দরকার, নতুন ইনটেলেকচুয়াল মুভমেন্ট দরকার। বাংলাদেশ কি এতে অগ্রসর হবে না? সুত্র
©somewhere in net ltd.