নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লিন্ক সহ পোষ্টের বাহবা/দায়, মূল লেখকের।
তোবা গ্রুপের শ্রমিকদের অনশন, আন্দোলন, এর সঙ্গে সংহতি প্রকাশ, মিডিয়ায় প্রচার-প্রচারণা, শ্রমিকদের বেতন পাওয়া ইত্যাদি সবকিছুরই এক ধরনের অবসান হয়েছে। কিন্তু ১১ দিন এ নিয়ে যা কিছু ঘটেছিল তা আসলে কেন হয়েছিল ভিতর থেকে বোঝা খুব একটা সহজ কাজ নয়। এ বছর ঈদের আগে দেশের মানুষ যেমনটি আশা করেছিল যে, সব মানুষই তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ঈদে আনন্দ করতে পারবে, পরিবার-পরিজন নিয়ে ঈদ করতে পারবে— সেটি তোবা নামক একটি গার্মেন্টসের প্রায় ১৬শ শ্রমিকের ভাগ্যে ঘটেনি। কেন ঘটেনি— তা নিয়ে যেমন হাজারো প্রশ্ন আছে, হতাশা আছে। আবার এই ১৬শ’ শ্রমিকের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে, তাদের প্রতি সহানুভূতি জানানোর ক্ষেত্রে আমাদের নাগরিক সমাজ, রাজনীতি ও মিডিয়ার অবস্থান কতটা লোক দেখানো, ইস্যু সৃষ্টির অবস্থান থেকে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত মহলবিশেষের কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যসাধনের পথে পা বাড়ানোর মতো অবস্থানে চলে যাচ্ছিল। সমগ্র বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ কতখানি আত্মসমালোচনা করছে জানি না, তবে বিষয়টি নিয়ে নৈর্ব্যক্তিক অবস্থান স্পষ্ট করা অনেকের জন্যই বিব্রতকর বলে মনে হচ্ছে। দুঃখজনক হলেও সত্য এই যে, এই ১১ দিনের ঘটনাবলি নিয়ে সত্যিকার কোনো বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন দেশে হবে কি না জানি না। আমাদের কাছে মনে হয় এর কিছু বিষয় ফিরে দেখা খুবই জরুরি।
তোবা গ্রুপের গার্মেন্টস শ্রমিকরা ৩ মাসের বেতন পাচ্ছিল না। বিষয়টি দুঃখজনক ও বেদনাদায়কও। এর মূল দায় মালিকের এতে কোনো সন্দেহ নেই। এখন মালিক এবং মালিকসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন এবং সরকারের ভিতরের বাস্তবতা যতটা সঠিকভাবে জানে— আমরা কেউই তা পুরোপুরি জানি না, জানার কথাও নয়। দেশে পোশাকশিল্পে হাজার হাজার কারখানার মধ্যে কারো না কারো অবস্থা চরমভাবে খারাপ হতে পারে। সব কারখানাই খুব ভালো চলছে— তা মনে করার কোনো কারণ নেই। তোবা গ্রুপের বিষয়টি যে জটিল— তা এই মালিকের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঘটনা দুর্ঘটনা, ব্যবস্থাপনার সমস্যা ইত্যাদি কারণে ঘটতে পারে— এমনটি উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়। মালিক এরই মধ্যে জেলে ছিলেন। মালিকের জেলে থাকার ফলে কারখানার কাজকর্মে জটিলতা হচ্ছিল কি না— তা ওই প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে যারা কাজ করছেন তারা ভালো বলতে পারেন। শ্রমিকদের বেতন তিন মাস যাবত মালিকপক্ষ কি সত্যি সত্যিই পরিশোধ করতে পারছিল না, নাকি শ্রমিকদের জিম্মি করে মামলার জামিন পেতে কাজে লাগিয়েছিল— তাও ভিতরের মানুষজনই ভালো বলতে পারবেন। কিন্তু বাস্তব চিত্রটা জানার আগেই যে প্রচারটি দেয়া হয়েছিল— তাতে মালিকের বিরুদ্ধে একটি জনমত তৈরি হয়েছে। এটি পুরোপুরি সত্য হলে এক ধরনের বাস্তবতা, কিছুটা ঘাটতি থাকলে জনমতটি অনেক বেশি সত্যনির্ভর হতে পারত। আমরা দেখেছি মিডিয়ায় বলার চেষ্টা করা হলো যে, শ্রমিকদের জিম্মি করেই মালিকপক্ষ জামিন পেতে কাজটি করেছে। ঈদের আগে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করা গেল না। এটি বাস্তব সত্য। শ্রমিকগণ শতচেষ্টা করেও তা আদায় করতে পারেনি। ফলে তারা অনশনে গেলেন। বিষয়টি মানবিক। ঈদের এমন মুহূর্তে ১৬শ শ্রমিক বেতন-বোনাস ছাড়া অবস্থায় পড়ে গেলেন— তা দুঃখজনক। কিন্তু যে ঈদের আগে মানুষ অন্যকে বিলিয়ে দিতে অনেকটা উন্মুখ থাকে, জনগণের মধ্যে সাহায্য-সহযোগিতা করার মানসিকতা বিরাজ করে। আমাদের কোনো পক্ষই এই ১৬শ শ্রমিককে ভাগাভাগির ঈদআনন্দে আলিঙ্গন করার পরিবর্তে কোনো কোনো মহল অনশনে উদ্বুদ্ধ করেছে, তাতে ঠেলে দিয়েছে। বাস্তবে কতজন প্রকৃত শ্রমিক অনশনে অংশ নিয়েছিল— আমরা জানি না। তবে অনশনরত শ্রমিকদের সম্মুখে বক্তৃতা দিতে ব্যক্তি ও সংগঠনের কোনো অভাব ঘটেনি। বিষয়টি ঠেলে দেয়া হলো অন্যদিকে। শ্রমিকদের বেতন-বোনাস ও পাওনা পাওয়ার উদ্যোগ নেয়ার চাইতে একটি বিশেষ মহলের বিষয়টি নিয়ে দেশব্যাপী একটি আবেগ সৃষ্টি করা, শ্রমিকদের প্রতি তাদের ভালোবাসা ও দরদ কতখানি বেশি, অন্যদের কত কম— তা দেখানো ও বোঝানোর মহড়াতে চলে যাওয়া হলো। বিষয়টি যদি দেশব্যাপী শত শত গার্মেন্টসের লাখ লাখ শ্রমিকের অভিন্ন পরিস্থিতি হতো— তাহলে এটি একটি আন্দোলনের যৌক্তিকতা পাওয়ার মতো বিষয় ছিল। কিন্তু বাস্তবে বিষয়টি ছিল একটি মাত্র গার্মেন্টসের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, কিন্তু এই শ্রমিকদের প্রতি সহানুভূতি ও সমর্থন পোষণকারী ব্যক্তি ও সংগঠনগুলোকে এমন বাস্তবতাকে গুরুত্বের সঙ্গে না নিতে দেখে বিস্মিত হয়েছি। কিছু কিছু সংগঠন ও ব্যক্তি অতীতের বৃহত্তর শ্রমিক আন্দোলনের নিরিখে বিষয়টিকে দেখা, সমর্থন জানানো, প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিলেন। বিশেষত, বাম রাজনীতি করেন এমন বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে শ্রমিক আন্দোলনের পাশে থাকার নজিরটি এখানেও তারা রাখতে একইভাবে অংশ নিলেন। তারা এই গার্মেন্টসের বিশেষত্বকে বিবেচনায় নিলেন না, বিজিএমইএ এবং সরকার পক্ষ নিজ নিজ অবস্থান থেকে সমস্যাটির সমাধানে কী কী উদ্যোগ হাতে নিয়েছিল, সে সবকে বিবেচনায় না নিয়ে অনশনের মতো কর্মসূচিকে সমর্থন জানানো, কেউ কেউ তাতে অংশ নেয়ার মতো গতানুগতিক রাজনীতি করলেন। এভাবে কোনো আন্দোলন ও রাজনীতি সফল হয় কি না, যৌক্তিকতা আছে কি না— তা আমাদের দেশের বিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের অনেকেই ভাবেন বলে মনে হয় না। তোবা গার্মেন্টসে তা ভাবা হয়নি। সমস্যার সমাধানের চাইতে রাজনীতি করা, শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থের সংগঠন হিসেবে নিজেদের প্রতিবাদ করার মানসিকতা লক্ষ্য করা গেছে। এ ধরনের সরলরৈখিক রাজনীতির শেষ খুব একটা সুফল বয়ে আনে না— এমন শিক্ষা আন্দোলনকারীদের আছে কি না জানি না। যারা শ্রমিকদের আন্দোলন ও অনশনে রেখে বক্তৃতা দিয়েছেন, তারা এখন বিবেচনা করে দেখতে পারেন— সেখানে তাদের আসলে কী উদ্যোগ নেয়া তখন দরকার ছিল। তা নেয়া হলে ১৬শ শ্রমিক সেই পরিস্থিতিতেও কিভাবে ঈদের খুশিতে শামিল হতে পারত। সেই সব উদ্যোগ না নিয়ে তারা গতানুগতিক রাজনীতি করতে গেলেন। একজন নেত্রী দিনের পর দিন অনশন অবস্থায় যেভাবে শুয়ে শুয়ে বক্তৃতা করছিলেন তাতে তার অনশনের প্রকৃত রূপটি নিয়েই প্রশ্ন জেগেছিল। তিনি বা আরো কেউ কেউ যে ওই প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক নন— এটি সকলেই জানেন। তাদের এভাবে অংশ নেয়ার বিষয়গুলো খুব স্বাভাবিক সমর্থন পাওয়ার বিষয় হতে পারেনি। হঠকারী রাজনীতির কারণে কোনো কোনো বাম সংগঠন শ্রমজীবী মানুষের কথা বলেও যে তাদের আস্থা অর্জন করতে পারেনি— তা এ নেতৃবৃন্দ বুঝতে চায় না। এর পরিণতি গোটা বাম রাজনীতির জন্য মঙ্গল বয়ে আনেনি, বামরা শুধু শ্রমজীবীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েনি, রাজনীতিসচেতন মানুষের কাছেও তাদের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করা গেছে, অনশনে অংশ নেয়া উক্ত নেত্রী তোবা গার্মেন্টসের অনশন ও আন্দোলন দেশের সকল গার্মেন্টসে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে ধর্মঘটের ঘোষণা দিয়ে বসেন, একই সঙ্গে জার্মান জনৈক সাংবাদিকের সাহায্যে ইউরোপ, আমেরিকায় খবরটি ছড়িয়ে দেয়ার অনুরোধ করে লাল সালাম জানালেন। গার্মেন্টসের ১৬শ’ শ্রমিকের ৩ মাসের বেতন ও ঈদ বোনাস পরিশোধিত না হওয়ার বিষয়টিকে দেশব্যাপী গার্মেন্টসে ছড়িয়ে দেয়া বা ইউরোপ-আমেরিকায় সংবাদ হিসেবে ছড়িয়ে দেয়ার ঘোষণাটি কতটা হঠকারী ছিল, কতটা তার ব্যক্তিগত স্বার্থসংশ্লিষ্ট ছিল, কতটা দেশের গোটা গার্মেন্টস শিল্পবিরোধী ছিল, কতটা বামপন্থী রাজনীতিকে ধ্বংস করার পক্ষে সহায়ক হতো— তা গভীরভাবে বোঝার বিষয়, চিন্তা করার বিষয়। দেশের হাজার চারেক গার্মেন্টসের মধ্যে মাত্র একটি গার্মেন্টসের ১৬শ শ্রমিকের বিষয়টিকে নিয়ে যা করার চেষ্টা হয়েছিল— তাকে মোটেও হালকাভাবে দেখা উচিত নয়। বিষয়টি যেখানে সমাধানের প্রক্রিয়াধীন ছিল সেখানে এর কোনোটিই হওয়া উচিত ছিল না, বড়জোর ১৬শ শ্রমিকের আনন্দঘন ঈদ করার জন্য তাত্ক্ষণিকভাবে কোনো সাহায্য-সহযোগিতার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারত। তাতে ঢাকা শহরের অসংখ্য মানুষ স্বেচ্ছায় উপস্থিত হয়ে পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়াতে পারত। তা না করে বিষয়টি নিয়ে অতিমাত্রায় উগ্র রাজনীতি করা হলো, কথাবার্তা বলা হলো, প্রচার-প্রচারণা দেয়া হলো। অথচ সেপ্টেম্বর মাসে আমাদের গার্মেন্টসগুলো বিদেশি ক্রেতাদের অর্ডার পাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। আগস্ট মাসে সেই পোশাকশিল্পে ধর্মঘট ডেকে দেশে-বিদেশে প্রচার-প্রচারণা দিয়ে কার সর্বনাশ ডাকা হচ্ছিল, কার স্বার্থ রক্ষা করা হচ্ছিল— তা বোঝা উচিত।
আমাদের মিডিয়াগুলোকে সামগ্রিক বিষয় নিয়ে আরো সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে। খবর এবং লেখালেখি ও আলোচনায় ভিতরের সমস্যা, বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্বকে তুলে না এনে যদি আবেগকাড়া বিষয়কে অবলম্বন করে চলতে চেষ্টা করা হয় তাতে ফল খুব বেশি ভালো হওয়ার নয়, বেশি দূর অগ্রসর হওয়া যায় না। ক’দিন আগে যেমন বিষয়টি নিয়ে প্রচুর খবরের ছড়াছড়ি, টকশোতে টেবিল চাপড়ানো কথা শোনা গেছে। এখন এত তাড়াতাড়ি তা হারিয়ে গেল কেন— তা বুঝতে হবে।
তোবা গার্মেন্টসের শ্রমিকরা ২ মাসের বকেয়া বেতন পেয়েছেন, ১০ তারিখে জুলাই মাসের বেতন পাওয়ার কথা। হয়তো এরই মধ্যে তা পেয়েও গেছেন। এমন বাস্তবতায় তোবাকে নিয়ে দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচার-প্রচারণাটি শেষ পর্যন্ত কোনো ষড়যন্ত্রকারীরাই লুফে নিত, তাতে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতো। যারা বুঝে না বুঝে তাতে অবদান রাখলেন, তারা আর কতকাল আবেগ দিয়ে চলবেন, কবে তাদের মধ্যে সেই সতর্কতা ও বাস্তবতা বোধ জাগ্রত হবে— সেটিই শেষ প্রার্থনা হতে পারে। তোবা গার্মেন্টসের শ্রমিকরা কাজ করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করুন— এটিই আমার কামনা।
সুত্র
©somewhere in net ltd.