![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লিন্ক সহ পোষ্টের বাহবা/দায়, মূল লেখকের।
সমসাময়িক একটি অতি প্রাসঙ্গিক বিষয় হচ্ছে কে কখন কীভাবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। ’৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ’৭৫-এর আগস্ট পর্যন্ত এ বিষয়ে দেশে এমনকি সারা বিশ্বে আদৌ কোনো বিতর্ক ছিল না। সমগ্র বাংলাদেশ এবং সারা বিশ্ব একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছিল যে বঙ্গবন্ধুই ২৬ মার্চের ১ম প্রহরে এ দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
এমনকি তার সামরিক শাসনামলে জে. জিয়াও স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কে নিজেকে জড়িত করে কোনো দাবি উত্থাপন করেননি। সামরিক শাসনের ছত্রচ্ছায়ায় বিএনপি নামক রাজনৈতিক দল গঠন করে তিনি যে কিছুদিন বেসামরিক শাসন পরিচালনা করেন তখনো স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েছেন বলে কোনো দাবি উত্থাপন করেছেন বলে জানা যায়নি। অধিকন্তু, ’৭২ সালে তৎকালীন সাপ্তাহিক বিচিত্রায় স্বনামে লিখিত এক নিবন্ধে তিনি স্পষ্ট উল্লেখ করেন যে ’৭১ এর ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসমুদ্রের সামনে বঙ্গবন্ধুর জ্বালাময়ী ভাষণে অন্তর্ভুক্ত “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ’’ বক্তব্যটি আমাদের জন্য ছিল স্বাধীনতা ঘোষণার একটি গ্রিন সিগন্যাল। লেখক ইসলামাবাদে কেন্দ্রীয় সচিবালয়ে কর্মরত থাকাবস্থায় ঢাকা রেডিও বন্ধ থাকায় বিভিন্ন বিদেশী চ্যানেলের নব ঘুরাতে ঘুরাতে ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় হঠাৎ তৎকালীন পূর্ব জার্মান রেডিওর বাংলা অনুষ্ঠানে শুনতে পান যে বিশ্বস্ত সূত্রের খবরে প্রকাশ বাঙালি নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলকে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা দিয়েছেন।
‘৭২ থেকে ’৮১ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জে. জিয়াউর রহমান কি কখনো এমন দাবি করেছেন যে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক? এরশাদ শাসনের বিরোধিতায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমান্তরাল আন্দোলন চলাকালীন দল হিসেবে বিএনপির অস্তিত্বের শেকড় গভীর করার লক্ষ্যে হঠাৎ করে এক সময় বিএনপির পক্ষ থেকে এ মর্মে প্রচারণা শুরু হয় যে মেজর জিয়াই স্বাধীনতার ঘোষক। সারা জাতি অবহিত যে ’৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকি সামরিক জান্তা ঢাকা শহরে নিরস্ত্র বাঙালি জাতির ওপর নৃশংস আক্রমণ হানে। এরই প্রত্যুত্তরে নির্বাচনে অভূতপূর্ব বিজয়ের অধিকারী বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা সিংহপুরুষ শেখ মুজিব ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে হানাদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটি দেশের মাটি থেকে উৎখাত না করা পর্যন্ত মরণপন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। তৎকালীন ইপিআর-এর ওয়্যারলেস সংযোগের মাধ্যমে তার এই ঘোষণাটি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। চট্টগ্রামে অবস্থানরত বিদেশী জাহাজসমূহের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক প্রচারের জন্য চট্টগ্রামের প্রবীণ এক আওয়ামী নেতার কাছে ঘোষণাটি পৌঁছানো হয়। ২৬ মার্চ দিনের বেলা বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা হান্নান সাহেব বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি একাধিকবার প্রচার করেন। ঐ দিন উক্ত বেতার কেন্দ্র থেকে আরো কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি প্রচার করেন।
জিয়াউর রহমানের শাসনমলে প্রয়াত জনাব হাসন হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় ৬ খ-ে স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস সংকলিত হয়। সে ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরের ঘোষণাকেই স্বাধীনতার ঘোষণা বলে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। ঘাতক টিক্কা খানের গণসংযোগ কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালেক লিখিত “উইটনেস টু সারেন্ডার” গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে ২৬ মার্চ রাত ১২:৩০ মিনিটের দিকে পাকিস্তান রেডিও ওয়েভ সংলগ্ন একটি ওয়েব থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের স্বকণ্ঠে স্বাধীনতা ঘোষণাটি অপেক্ষকৃত ক্ষীণ কণ্ঠে বেজে ওঠে।
মেজর জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে যারা দাবি করেন তাদের বক্তব্য বঙ্গবন্ধু বাস্তবে কোনো ঘোষণা দেননি। প্রচারিত ঘোষণা বাণীটি পরবর্তীকালের এক বানোয়াট সংযোজন। দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে ২৬ মার্চ দিনের বেলা চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা হান্নান সাহেব একাধিকবার স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে উক্ত ঘোষণাটি প্রচার করেন। উক্ত ঘোষণার ভিত্তিতে তন্মধ্যেই ইপিআর, পুলিশ বাহিনী এবং সেনা সদস্যরা দেশের বিভিন্ন স্থনে শত্রু মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রটি অরক্ষিত থাকায় যে কোনো সময় হানাদারদের আক্রমণের শিকার হওয়ার আশঙ্কা ছিল। এর উদ্যোক্তা/সংগঠকরা প্রতিষ্ঠানটির নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে আশেপাশে সেনা সদস্যদের অন্বেষণে বেরিয়ে পড়েন। নির্ভরযোগ্য সংবাদের সূত্রে তাদের ২/১ জন নিকটবর্তী কোনো স্থানে মেজর জিয়ার খোঁজ পেয়ে প্রতিষ্ঠানটির নিরাপত্তার লক্ষ্যে সেনা মোতায়েনের জন্য তাকে অনুরোধ জানান। তাদের অনুরোধে কিছু সেনাসদস্যসহ মেজর জিয়া কালুরঘাটস্থ স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রে উপনীত হন। ২৭ মার্চ বিকেল ৩টার দিকে মরহুম বেলাল মোহাম্মদ ও মেজর জিয়ার যৌথ প্রচেষ্টায় লিখিত একটি বাণী উক্ত বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়ার কণ্ঠে পাঠ করে শোনানো হয়। এ ঘোষণাতে নিজেকে ষোষিত প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান কথাটি অন্তর্ভূক্ত থাকায় এবং বঙ্গবন্ধুর পক্ষে কথাটি উল্লেখিত না থাকায় চট্টগ্রামের এক বিশিষ্ট ব্যক্তির হস্তক্ষেপে পরের দিন ২৮ মার্চ অপরাহ্নে উক্ত বেতার কেন্দ্র থেকে তিনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে পুনরায় ঘোষণাটি পাঠ করেন।
ইংরেজিতে একটি কথা আছে যে ঙঢ়রহরড়হ ফরবং যধৎফ। বোঝাতে চাচ্ছি যে, যারা গোঁড়া পাকিস্তানপন্থী শত সংগ্রাম ও আন্দোলনের পরেও কিন্তু তাদের মনোভাবে পরিবর্তন আসেনি। মেজর জিয়াউর রহমান পাকি গোয়েন্দা বাহিনীর ১জন নিষ্ঠাবান কর্মকর্তা হিসাবে ৭০ সালের মে মাস থেকে চট্টগ্রামে কর্মরত ছিলেন। কিছু কথা স্পষ্ট করে না বলে ইঙ্গিতে বুঝানোই সঙ্গত। মেজর রফিকুল ইসলাম তৎকালীন চট্টগ্রামে ইপিআর বাহিনীর দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। ’৭০-এর নির্বাচন-পূর্ববর্তী সার্থক ও সফল গণআন্দোলনসমূহ ও নির্বাচন পরবর্তী দ্রুত পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তিনি গভীর মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করেন। বাঙালি নেতার হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে পাকিজান্তার অনীহার প্রেক্ষাপটে দেশ দ্রুত একটি সামরিক সংঘাতের দিকে এগিয়ে চলছে বলে তার দৃঢ় ধারণা হয়। এর জন্য চট্টগ্রামে অবস্থানরত ইপিআর সদস্যদের নিয়ে তিনি পাকি বাহিনীকে মোকাবেলা করার গোপন পরিকল্পনা আঁটেন। পাকিস্তানি জান্তাকে আরো সার্থকভাবে মোকাবেলা করার লক্ষ্যে তিনি চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে কর্তব্যরত মেজর জিয়ার সঙ্গে গোপনে সংযোগ রক্ষা করতে থাকেন। রফিক সাহেব জনিয়েছেন যে জিয়াউর রহমান বিষয়টিকে অত্যন্ত গতানুগতিক দৃষ্টিতে দেখে তার সঙ্গে আলোচনাকালে প্রতিবারই সশন্ত্র সংঘাতের কোনো আশঙ্কা নেই বলে এ সম্পর্কে কোনো অগ্রণী ভূমিকা পালনে তাকে নিরুৎসাহিত করেছেন। কিন্তু রফিক সাহেব মেজর জিয়ার সঙ্গে একমত হতে না পেরে তার অধীনস্থ ইপিআর সদস্যদের নিয়ে প্রস্তুতি পর্ব চূড়ান্ত করেন।
পূর্ব বাংলায় সম্ভাব্য বিদ্রোহ দমনের লক্ষ্যে গোটা মার্চ মাসব্যপী বিমান পথে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সেনা আমদানি ও সমুদ্র পথে বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র আমদানি করা হয়। এক সময় সোয়াত নামের একটি জাহাজ বিপুল পরিমাণ সমরাস্ত্র নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙ্গর গাড়ে। এই অস্ত্র বাঙালি ভাইদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে এ আশঙ্কায় বন্দরের শ্রমিক বাহিনী ঐ জাহাজের অস্ত্র ও গোলাবারুদ খালাস করতে অস্বীকৃিত জানায়। জিয়ার সামরিক কমান্ডার কর্নেল জানযুয়ার নির্দেশে মেজর জিয়া বাঙালি শ্রমিকদের দ্বারা অস্ত্র খালাস করার উদ্দেশ্য নিয়ে ২৫ মার্চ সন্ধ্যার পরে বন্দরের দিকে যাত্রা করেন। ঢাকাতে আর্মি ক্র্যাকডাউন শুরু হওয়ার পরেও পাকিস্তানের অনুগত নিষ্ঠাবান যে গোয়েন্দা বাঙালি কর্মকর্তা কমান্ডারের নির্দেশে সোয়াত জাহাজের অস্ত্র ও গোলাবারুদ খালাস করতে বন্দরের পথে যাত্রা শুরু করেন এবং যে ব্যক্তিটি নাকি মেজর রফিকের বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গিকে নিরুৎসাহিত করেন তার মনন, মগজ ও দৃষ্টিভঙ্গি কী আমাদের কাছে ঝাপসা বা অস্পষ্ট থাকতে পারে? অধিকন্ত, চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট ও সেখানে অবস্থানকারী সেনা ও পরিবারবর্গ অরক্ষিত রেখে বা জীবনের ঝুঁকিতে ফেলে দিয়ে নিজের জান বাঁচাতে যিনি দলে বলে পটিয়ার নিরাপদ আশ্রয়ে গমন করেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে পদার্পণ করে কি সহসাই তিনি কট্টর পাকিস্তান অনুরাগী থেকে বাংলাদেশপন্থীতে রুপান্তরিত হয়ে একেবারে ঝুঁকি নিয়ে দেশের স্বাধীনতাই ঘোষণা করে ফেলতে পারেন? একটি প্রবাদ আছে গড়ৎহরহম ংযড়ংি ঃযব ফধু অর্থাৎ ভোর বেলার আবহাওয়া দেখেই বুঝা যায় সারাদিন কেমন যাবে? তাছাড়া ৬ বছর দেশ শাসন কালে যে আদর্শ ও মূলনীতি তিনি অনুসরণ করেছেন তা মূলত একজন পাকিপ্রেমিকের অবন্থান থেকে করা হয়েছে বলে প্রতীয়মাণ হয়।
যুক্তির খাতিরে ধরে নেই যে বঙ্গবন্ধু আসলে কোনো স্বাধীনতা ঘোষণা দেননি। তাহলে মেজর জিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার কে? ঐ ঘোষণা দেয়ার পক্ষে জিয়ার কোন রাজনৈতক, নৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক অধিকার ছিল? ’৭০-এর নিরপেক্ষ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ গোটা পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন। দলের নেতা হিসেবে তিনিই ছিলেন সরকার গঠন করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার একমাত্র দাবিদার। পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ ভুট্টোর সহযোগিতায় সে পথ কণ্টকাকীর্ণ করে তুললে বঙ্গবন্ধু তার সম্মোহনী শক্তি বলে তৎকালীন সারা বাংলাদেশে অত্যন্ত সফল অসহযোগ আন্দোলন গড়ে তুলেন। সেই সফল অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি ও তার দল সমগ্র দেশে সার্থকভাবে পাকিস্তানি শাসন অকার্যকর করে দিয়ে সারা পূর্ববাংলায় নিজ দলের শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেন। পাকিজান্তার হিংস্র আক্রমণ মোকাবেলা করার জন্য প্রদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার রাজনৈতিক, নৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক অধিকার একমাত্র বঙ্গবন্ধুরই ছিল। মেজর জিয়াউর রহমানের এ ধরনের কোনো অধিকারই ছিল না। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ছাড়া তার নিজের পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করা নিছক একটি সামরিক বিদ্রোহ বলে বিবেচিত হতো এবং জনগণের সমর্থনের অভাবে তার এ হঠকারী পদক্ষেপ অচিরেই ভ-ুল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল।
স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েই বঙ্গবন্ধু অসমসাহসী গণনায়কের মতো স্বমর্যাদায় স্বগৃহে অবস্থান করেন। এর ফলে এই বীরসিংহকে পাকিজান্তা গ্রেপ্তার করার সুযোগ পায়। তিনি যুদ্ধে সামরিক নেতৃত্ব দেয়ার জন্য গোপনে ভারতে বা অন্য কোনো দেশে যাওয়ার কথা চিন্তাও করেননি। কেননা তাতে সে দেশের উস্কানিতে শেখ মুজিব পাকিস্তান ভাঙ্গার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হতো। বরং তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নেতা হিসাবে বিচারের নামে যে কোনো প্রহসনের মোকাবেলা করার জন্য বন্দীত্ব বরণ করেন। দীর্ঘদিন তাকে মিয়ানওয়ালী জেলে নিঃসঙ্গ রেখে তার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ এনে তাকে বিচারের সম্মুখীন করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে পাকিস্তানের অখ-তা ধ্বংস করেছেন বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। জিয়াউর রহমান যদি স্বীয় উদ্যোগে জনতার দাবি পূরণের লক্ষ হিসাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করতেন, তাহলে পাকিজান্তা কি তার বিরুদ্ধে (অনুপস্থিতিতে) সামরিক আইনের আওতায় দেশদ্রোহীতার অভিযোগ গঠন করে তাকে বিচারে সোপর্দ করতো না? এটা কি যুক্তিসঙ্গত যে নির্বাচিত ও অবিসংবাদিত নেতা স্বাধীনতা ঘোষণা করে দেশদ্রোহীতার বিচারের সম্মুখীন হলেন আর প্রজাতন্ত্রের একজন সামরিক কর্মকর্তা স্বাধীনতা ঘোষণা করে সামরিক বিচারের রোষাণল থেকে নিষ্কৃতি পান। আমরা এও জানি মুজিবনগর সরকারে যারা অধিষ্ঠিত ছিলেন যথা মরহুম সর্বজনাব তাজউদ্দীন আহমেদ, নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী প্রমুখের বিরুদ্ধে সামরিক আইনে মামলা দায়ের করে তাদের অনুপস্থিতিতে বিচার করে কাউকে ১০ বছর, কাউকে ১৪ বছর কারাদ- দেয়া হয়। কিন্তু মেজর জিয়া যদি বাস্তবেই পাকিস্তানের অনুগত না থাকতেন তাহলে তারও সামরিক আইনে সাজা হতো। এছাড়া যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি ও অন্যান্য সেক্টর কামান্ডার যথা খালেদ মোশারফ, কর্নেল তাহের প্রমুখ অকুতোভয় সেনানীদের মতো যুদ্ধে রেকর্ড সৃষ্টি করতেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় ২৬ মার্চ। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে তৎকালীন সোভিয়েত রাষ্ট্র প্রধান পদগর্নি এক বিবৃতিতে শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করে জনগণের নির্বাচিত নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা হিসেবে তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধান করার জন্য পাকিস্তানকে পরামর্শ দেন। প্রায় সারা বিশ্ব (চীন-মার্কিন বলয়ের বাইরের দেশগুলো) নির্বাচিত নেতাকে মুক্তি দিয়ে তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলার স্বাধীনতা সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিতে পরামর্শ দান করেন। কমনওয়েলথ, জাতিসংঘ এবং অন্যান্য বহুজাতিক সংস্থাতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ ধরনের কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা বা কোনো রাষ্ট্রের সার্বভৌম পালামেন্ট বা সরকার কোথাও জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আলোচনা করে সংঘাতের বিষয়টি সুষ্ঠভাবে নিস্পত্তি করতে বলেননি। এক হিসেবে বলা যায় যে নিজ উদ্যোগে চিরকুট থেকে ২৭ মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তিনি যাই বলে থাকুন না কেন তা কোনোক্রমেই বাংলা রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণা বলে কারো বিবেচনায় আসেনি। এমনকি দেশাভ্যন্তরে যারা প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনে ব্রতী ছিল তাদের দৃষ্টিতে জিয়ার ২৭ মার্চের চিরকুট পাঠ ছিল একটা অতি ক্ষদ্র বুদবুদের মতো। স্বাধীনতার মূল ঘোষণা তো বঙ্গবন্ধুই দিয়েছেন।
দেশটা এখন বিপথে এগুচ্ছে। একজন অর্বাচিন তরুণ মামলা লড়ার ভয়ে রাজনীতি না করার মুচলেকা দিয়ে লন্ডনে অবস্থান করে বিভিন্ন রকম অর্বাচিনসুলভ মুখরোচক মন্তব্য রাখছেন। সারা পাকিস্তানের যিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ নির্বাচিত নেতা তাকে বলছেন কিনা অবৈধভাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। আবার বলছেন জিয়া বাংলাদেশে প্রথম রাষ্ট্রপতি। আমরা ঐ অর্বাচিনকে প্রশ্ন করতে চাই- মরহুম জিয়াকে কারা ভোট দিয়ে ’৭১ সালে রাষ্ট্রপতি করলো? রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার সিংহাসন কি পাকিজান্তা তৈরি করে দিয়েছিল? কখন ও কোথায় তিনি প্রধান বিচারপতির কাছে রাষ্ট্রপতির শপথ গ্রহণ করলেন? অর্বাচিনকে বলবো, ’৭১ সালে তিনি হয়তো সবেমাত্র শৈশব উত্তীর্ণ। তাই ঐ সময়কার ঘটনাবলী সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান রাখেন এমন লোকদের থেকে আসল ঘটনা জেনে নেয়াই তার জন্য উত্তম। মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষক হলে তার ঘোষণার তারিখ ২৮ মার্চই হওয়ার কথা ছিল আমাদের স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। কিন্তু জাতিতো সর্বসম্মতিক্রমে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষণার তারিখ ২৬ মার্চই স্বাধীনতা দিবস পালন করে আসছে। জাতির একটি জাতীয় পতাকা আছে, আরো আছে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। জাতীয় জীবনের দুটো অতি মহার্ঘ্য উপাদানইতো বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্তক্রমে গৃহীত হয়। ’৭৩ সালে গণপরিষদ যে অত্যন্ত প্রশংসিত জাতীয় সংবিধান প্রণয়ন করে তার পেছনে পৃষ্ঠপোষকতা ছিল বঙ্গবন্ধুরই, আর কারো নয়।
ঘোষণা সম্পর্কে বাল্যকালের একটা ঘটনা আমার স্মৃতিপটে উজ্জ¦ল হয়ে আছে। পার্শ্ববর্তী একটা বাড়ি ক্রয় করা নিয়ে আমার (বর্তমানে) প্রয়াত পিতা ও এক প্রতিবেশীর মধ্যে স্বত্বের মামলা (টাইটেল সুট) হয়। বাবা বিজয়ী হলে ঐ বাড়িটি দখল পাওয়ার জন্য বাবা পৃথক মামলা করেন। ঐ মামলায় বিজয়ী হয়ে বাবা নির্দিষ্ট পরিমাণ ফিস জমা দিলে আদালতের হুকুমে সেরেস্তা ও পেয়াদা দখল বুঝিয়ে দিতে আসে। বালক বয়সে অবলোকন করলাম পার্শ্ববতী গ্রামের একজন পেশাদার ঢোলক (নূর মোহাম্মদ ঢুলি) ঢোল বাজিয়ে বাড়িটির চতুর্সীমায় ঘুরে ঘুরে আদালতের নিদের্শে বাবাকে ঐ বাড়ির দখল বুঝিয়ে দেয়ার ঘোষণা দিতে থাকে। উপস্থিত কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তির স্বাক্ষর ও টিপসহিও নেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে আদালতের রায়ে মালিক দখলদার হলেন বাবা। নূর মোহাম্মদ ঢুলি শুধু ঘোষণা দিলেন- উপস্থিত ব্যক্তিরা স্বাক্ষী হয়ে রইলেন। এখানে কী কার্যকর হলোÑ আদালতের রায় না ঢুলির ঢোল বাজনা? পাঠকরা নিশ্চয় বুঝে নিবেন আমি কী বুঝাতে চাই।
©somewhere in net ltd.