নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লিন্ক সহ পোষ্টের বাহবা/দায়, মূল লেখকের।
আজ ২৯ সেপ্টেম্বর, রামু ট্রাজেডি দিবস। ২০১২ সালে বৌদ্ধদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব শুভ মধুপূর্ণিমার আগের রাতে এদেশের নিরীহ এবং শান্তিপ্রিয় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ধর্ম, পরিবার ও প্যাগোডা-উপাসনালয়ের ওপর যে আঘাত হানা হয়েছিল, তা ছিল অতি করুণ ও হৃদয়বিদারক। এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কলংকিত অধ্যায়। আজ এ দিনে আমি সেসব বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী ও বৌদ্ধভিক্ষুদের স্মরণ করি, যারা সে রাতে আহত হয়েছিল এবং যাদের প্যাগোডা ও ধর্মীয় স্থাপনা ভস্মীভূত হয়েছিল।
সেদিন বাংলাদেশসহ বিশ্বের মানবতাবাদী মানুষ এবং জাতিসংঘসহ দেশ-বিদেশের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা সংস্থা ও সংগঠন এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছিল। দল, মত ও নানা ধর্ম-বর্ণের সবাই সমবেদনা জানিয়েছিল এবং সবাই বলেছিল, এ ঘটনা মধ্যযুগীয় বর্বরতা ও নাশকতাকেও হার মানিয়েছে। সে ভয়ংকর রাতের কথা শুনলে এখনও রামু, উখিয়া ও পটিয়ার বৌদ্ধ জনসাধারণ, শিশু-কিশোর, আবালবৃদ্ধবনিতা শুধু কাঁদে আর অঝোরে চোখের জল ফেলে।
রাতটি ছিল বৌদ্ধদের অনেক প্রত্যাশিত বুদ্ধকে মধুদান করার আগের রাত। জ্যোৎস্নার আলোও ছিল এলাকাময়। আর নিমিষেই সেটি হয়ে গেল বাংলাদেশের ইতিহাসে জঘন্যতম এক কালরাত।
একজন বৌদ্ধযুবক উত্তম বড়ুয়ার ফেসবুকে মিথ্যা-বানোয়াট একটি ধর্মীয় অনুভূতির গুজব ছড়িয়ে এ রকম একটি নারকীয় ঘটনা ঘটবে, সেটি আমরা কখনও ভাবতে পারিনি। পূর্বাপর ঘটনার দৃশ্য এবং পরবর্তীকালে সরেজমিন অনুসন্ধান করে জানা গেছে, এটি ছিল সম্পূর্ণ একটি সাজানো ঘটনা।
না হলে এত অল্প সময়ের মধ্যে কিভাবে শত শত মানুষ জড়ো হয়। হাতে এত লাঠি, দাসহ নানা ধরনের দুষ্প্রাপ্য বিস্ফোরকদ্রব্য কীভাবে আনা হয়? উন্মুত্ত জনতার মিছিল, মিটিং এবং দ্রোহ যেন ছড়িয়ে পড়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই। সন্ধ্যা আসতে না আসতেই শুরু হয়েছিল সেদিন এই নৃশংস বর্বরতা। সেদিন শুধু দেখা গেছে চারদিকে আগুনের ধোঁয়া আর লেলিহান শিখা। দাউ দাউ করে একটার পর একটা জ্বলছে বৌদ্ধ বাড়িঘর, আর প্রাচীন প্যাগোডাগুলো। অথচ সেখানকার পুলিশ, র্যাব, আর্মি ও বিজিবিসহ জেলার সব প্রশাসন ছিল একেবারেই নীরব ও নিষ্ক্রিয়। অনুরোধ জানিয়েও সাহায্য পাওয়া যায়নি কারও কাছ থেকে। সেদিন প্রশাসন এবং সরকারের এহেন নীরব ভূমিকায় দেশ-বিদেশে প্রশ্ন উঠেছে- কেন এ রকম হল?
সেদিন রাতে সীমা বিহারসহ রামুর চার-পাঁচশ’ বছরের পুরনো ঐতিহ্য বারটি বৌদ্ধ বিহার ও প্যাগোডা পোড়ানো হল। বুদ্ধমূর্তিগুলো পোড়ানো হল, ভস্মীভূত করা হল। হাজার বছরের প্রাচীন পুঁথি-পুস্তক, পাণ্ডুলিপি, নানা বৌদ্ধ ঐতিহ্য ও নানা ভাষায় লিখিত পবিত্র বৌদ্ধ ত্রিপিটক নিমিষেই পুড়ে ছারখার হয়ে গেল।
শুধু রামু নয়, পরদিন পার্শ্ববর্তী উখিয়ার বৌদ্ধ অধ্যুষিত পল্লীর বাড়িঘর ও নানা স্থানের পাঁচটি বৌদ্ধ বিহার পোড়ানো হল। উগ্রপন্থীদের নগ্নতা এরপরও থেমে থাকেনি। চট্টগ্রামের পার্শ্ববর্তী পটিয়া থানার কয়েকটি বৌদ্ধগ্রাম ও দুটি বৌদ্ধ বিহার এবং নানা ধরনের বৌদ্ধ ঐতিহ্যগুলোকে আগুন দিয়ে জ্বালানো হয়েছিল। সে এক ভয়ংকর দৃশ্য এবং বীভৎস রাত বাংলার মাটিতে বৌদ্ধদের জন্য। যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
স্বাধীন বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা কারও কাম্য ছিল না। আজ বলতে দ্বিধা নেই, এরকম বাংলাদেশ তো আমরা চাইনি। স্বাধীনতা যুদ্ধ তো এজন্য হয়নি। আমরা চেয়েছিলাম একটি সোনার বাংলাদেশ যেখানে থাকবে আমাদের সহ-অবস্থান, পারস্পরিক মেলবন্ধন। ধর্ম-বর্ণের কোনো ভেদাভেদ থাকবে না, থাকবে না কোনো রকম বৈষম্যও। বাকস্বাধীনতা থাকবে, লেখনীর স্বাধীনতা থাকবে; আরও থাকবে আমাদের মৌলিক অধিকারের স্বাধীনতা। কিন্তু কই? সেদিন তো আমরা সেটা দেখিনি? একই ভূখণ্ডে আমরা বসবাস করি। একই দেশের আমরা নাগরিক এবং একই চেতনাকে আমরা ধারণ করি। তারপরও কেন বৌদ্ধদের ওপর এ আঘাত? আমাদের সংবিধান বলে ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার।’
আমরা তো কেউ ধর্মের বাইরে নই। আমরা জানি ধর্মের গৌরব, ধর্মের তাৎপর্য ও ধর্মের অনুশাসন সুমহান। ধর্ম কাউকে আঘাত দেয় না, ধর্ম মানবতাকে খণ্ডিত করে না। ধর্মীয় দৃষ্টিতে সব মানুষ সমান এবং সমভাবে মর্যাদাবান। সূর্যের আলো যেমন সমভাবে পৃথিবীর বুকে পতিত হয়, ধর্মের মানবিক আলোও তেমন। এটাই ধর্মের মহিমা, এটাই ধর্মের শাশ্বত রূপ।
এই তো শারদীয় পূজার পর আসবে আমাদের ঈদুল আজহা। এরপর আসবে বৌদ্ধদের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎসব শুভ প্রবারণা। আমাদের ধর্মের এ সংস্কৃতির মেলবন্ধন আজকের নয়, আবহমানকালের। এজন্যই আমরা গর্ব করি। তাই আমরা আজ সব ভেদাভেদ ভুলে যেতে চাই। আমরা আগের সেই শান্তির বাতায়নে ফিরে যেতে চাই। সব ধরনের ভয়ভীতি কাটিয়ে উঠতে চাই। দুঃখ-বেদনা প্রশমিত করতে চাই। আমরা আবার ফিরে পেতে চাই আমাদের সেই হারানো গৌরব আর হারানো সম্প্রীতির ঐতিহ্যকে। সদাশয় সরকারের কাছে আমাদের শুধু দাবি ছিল ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও সত্য উদ্ঘাটন করা। নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা। কিন্তু এখনও তা হয়নি। কেন হয়নি তা জানি না। তবে এ দায়িত্ব বর্তমান সরকারের। আমরা
প্রার্থনা করি, সবার মনে বিবেকবোধ জাগ্রত হোক। রামু, উখিয়া ও পটিয়াবাসীর সব দুঃখ, ব্যথা প্রশমিত হোক। আমাদের দেশসহ সমগ্র বিশ্বে সহিংসতা দূর হোক। বিশ্বে শান্তি বিরাজ করুক।
সুত্র
©somewhere in net ltd.