নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লিন্ক সহ পোষ্টের বাহবা/দায়, মূল লেখকের।
তিন-চার দিন ধরে একটা খবরের পুনরাবৃত্তির দাপটে কান ঝালাপালা হয়ে গিয়েছিল। বৃহস্পতিবার (২৩.১০.১৪) সন্ধ্যার খবর হলো, গোলাম আযম মর মর অবস্থায় পেঁৗছেছেন। তাকে আইসিইউতে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রাখা হয়েছে। এই খবরটা টিভি স্ক্রলে গেছে। প্রতি ঘণ্টার সংবাদেও বলা হয়েছে বেশ গুরুত্ব দিয়ে। ফেসবুক খুলে দেখি, মৃত্যুমুখী গোলাম আযমের প্রতি কটুভাষায় মন্তব্যের ছড়াছড়ি। কেউ বলেছে, তার লাশ পাঠিয়ে দেয়া হোক পাকিস্তানে। এ দেশে তার কবর হবে না। কেউবা অনেক অসম্মানের শব্দ লিখেছে ফেসবুকের ক্যানভাসে। এমন অবস্থার মধ্যেই মারা গেলেন গোলাম আযম বৃহস্পতিবার রাতেই। হরির লুট যেমনভাবে মানুষ হুড়মুড়িয়ে খুঁটে তোলে, তেমনিভাবে ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং প্রিন্ট মিডিয়ার লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ল খবরটার প্রতি। মনে হলো নক্ষত্র পতন হয়েছে রাজ্যে। খবরটা প্রচার না করলেই নয়।
বয়সী মানুষ আমি। হই হুল্লোড়ে বা কোনো ডামাডোলে যাই-ই না বলতে গেলে। সন্ধ্যা বেলায় দুই-তিন ঘণ্টা কাটাই টিভি দেখে। কখনো খবর, কখনো অন্য অনুষ্ঠান দেখি রিমোটের বোতাম টিপে টিপে। ওটাই আমার বিনোদন। বিশ্রামও বটে। সেটাও ব্যাহত হলো। মনে হলো, এত তোলপাড় ওঠানো হচ্ছে কেন একটা প্রমাণিত এবং আমজনতার রায়ে ধিকৃত মানুষটাকে নিয়ে? হাসপাতালে অপরিমিত নানা পদের মানুষ ভিড় করছে, সেটাও দেখাল টিভির সংবাদকর্মীরা। কিন্তু কেন এসব হচ্ছে, তা বুঝতে পারলাম না। এতই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কি এটা? নাকি শুধুই চাকরি? টিভির ফিলার বা সময় কাটানোর মসলা জোগাড়ের ধুম? কৌতূহল হলো রাত ১২টার খবরের জন্য। প্রথম যে দুই-তিন মিনিটে কয়েকটা টিভি চ্যানেল দেখলাম, প্রত্যেকটাতেই গোলাম আযমের মৃত্যুর খবর জানালো। তার সঙ্গে হাসপাতালের ছবিও। আমি বুঝতেই পারলাম না, ঘটনাটা কী? গোলাম আযমের মৃত্যুর খবরটা এত মহাখবর হয়ে উঠল কেন? তার মৃত্যুই তো সবাই চেয়েছিল।
পরদিন, অর্থাৎ শুক্রবারেও (২৪.১০.১৪) গোলামময় বহু চ্যানেলের খবর। তার জানাজা নিয়ে কথা। তাকে হিমঘরে না রেখে বাড়ির সামনে অ্যাম্বুলেন্সে রাখা হয়েছে, সে খবর। তার প্রবাসী ছেলেরা আসবে বাবাকে শেষবারের মতো দেখতে, সে খবর। প্রত্যেকটা প্রাইম নিউজের লিড নিউজ হিসেবেই মোটামুটি এগুলো পরিবেশন করা হলো। তার সংক্ষিপ্ত কর্মজীবন, পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য, টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করা, শান্তি কমিটি এবং রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা সম্পর্কেও প্রচার করা হলো। অনেকের কাছেই বহুদিনের জানা খবর। দৈনিক পত্রিকার অনেকগুলোতে যে আট-দশটা আমি দেখেছি, তাতে গোলাম আযমের পাক পবিত্র বড় ছবি (?) ছাপিয়ে প্রথম পৃষ্ঠায় ফলাও করা খবর। দেখে মনে হলো, কেউ তাকে চেনে না, দেখেওনি কেউ আগে এবং খবরটা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে ছবিসহ সেটা জানাতেই হবে দেশবাসীকে। পাশাপাশি কত হাস্যকর আস্ফালনের মন্তব্য। বিশেষ করে গণজাগরণ মঞ্চের নেতা তো জানালেন, এমন মৃত্যু হতাশাব্যঞ্জক। যেন তার মত না নিয়েই ঘটে গেল ঘটনাটা! বেরিয়ে গেল স্রষ্টার হাত ফসকে মানুষটা।
শনিবারের (২৫.১০.১৪) খবর জানাজাসংক্রান্ত। বায়তুল মোকাররমের জাতীয় মসজিদে গোলাম আযমের জানাজা পড়তে দেয়া হবে কিনা? কে পড়াবেন জানাজা? পক্ষ-বিপক্ষের বহু মন্তব্য এবং প্রস্তুতির খবর জানা গেল প্রিন্ট মিডিয়াতেও। কিছু একটু হৈচৈ, প্রতিবাদ, বিপরীতমুখী কথা ইত্যাদি বলেছে বাক্যবণিকরা। কিন্তু তার পরও সে কাজটা হয়ে গেল সুষ্ঠুভাবে, সরকারি পাহারায়। সেটা ভালো কাজই ছিল। আসলে তার কপালটাই ভালো। প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়া তাকে দেশে আনেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদ তার লালন-পালন করেন, দেশনেত্রী হাসিনা সরকার তার চিকিৎসা দেয়াসহ তাকে জানাজা পর্যন্ত সেবাদান ও রক্ষণাবেক্ষণ করল।
একজন সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীর এতটা প্রাপ্তি কেউ ভাবতে পেরেছিল কি? বোধহয় গোলাম আযম নিজেও না। বিশাল প্রচার, ব্যাপক আয়োজন, দেশের মাটিতে, যে মাটিকে তিনি নিজের ভাবতে পারেননি কখনো, সেখানে সসম্মানে দাফনও হলো। জানাজার প্যানোরামিক ছবিও ছিল দেখার মতো। বুদ্বুদের মতো দেখা গেল অগুনতি মানুষের মাথা। কোনো গোলমাল নেই, ককটেল ছোড়াছুড়ি নেই, শৃঙ্খলায় সজ্জিত জমায়েত, কজন মানুষের ভাগ্যে জোটে এমন শান-শওকতের শেষ যাত্রা?
বলতে গেলে গোলাম আযম যা যা চেয়েছিলেন, তার সবই পেলেন। প্রথম, তিনি ফাঁসিতে মরতে চাননি। বহু বছর ধরে বহু মানুষ এবং সংগঠন তার ফাঁসি চাইলেও সেটা হয়নি। সাজাপ্রাপ্ত অবস্থায় তার সঙ্গে সরকারের আচরণিক যে সৌজন্য এবং উচ্চতা তিনি চেয়েছিলেন (মনে মনে), তাও পেয়েছেন। উত্তম চিকিৎসাসেবা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা সবারই থাকে, কিন্তু রায়প্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী সেটা নাও পেতে পারে, সেটাও পেয়েছেন। বায়তুল মোকাররম মসজিদে জানাজা পড়ানো হোক, চেয়েছিলেন, হলো সেটাও। দেশেই পারিবারিক জমিতে দাফনের বাসনা ছিল। নির্বিবাদে কার্যকর হলো সেটাও। কোনোটাই ঠেকিয়ে রাখতে পারল না কেউ। কপাল ছাড়া আর কী বলা যায়?
গোলাম আযমের যে ছেলে জানাজা পড়াল, তার কথাবার্তা যথেষ্ট সংযত এবং শালীন। সে তো দেশেই লেখাপড়া করেছে। চাকরি করেছে বাংলাদেশ আর্মিতে। যুদ্ধাপরাধীর ছেলে আর্মিতে চাকরি করে, সেটা তো জানতামই না। মগবাজারে ব্যাপক জায়গাজুড়ে তাদের ঘরবাড়ি। একজন খাঁটি যুদ্ধাপরাধীর এত জায়গা-জমি বহাল থাকল কীভাবে? তার বিরুদ্ধে ঘাদানির (ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি) আগুনঝরা আন্দোলনের কথা তো ভুলিনি আমরা! সবাই তার ফাঁসি চেয়েছে। দাহ করেছে তার কুশপত্তলি। কেউ তো বলেনি, এ দেশের জমিনে তার হক নেই। তার ভূমি সম্পত্তি সরকারকে বাজেয়াপ্ত করতে হবে? বেশ নিরাপদে সন্তান-সন্তুতি এবং স্থাবর-অবস্থাবর সম্পত্তি দখলে রেখে দীর্ঘ জীবনযাপন করেই গেলেন তিনি। আমরা আগেও নিজের হাত কামড়েছি, এখনো কামড়াচ্ছি। এখন ভোঁতা মুখ থোঁতা করে বসে আছি।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, একজন সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীর ক্যারিশমা কোথায়? তবে কি আন্দোলনে ত্রুটি ছিল? নিশ্চয়ই তাই। আন্দোলনকারীরা কি প্রকৃত অর্থে গোলাম আযমের সাজা চায়নি? বাধা ছিল কোথায়? আন্দোলনের প্রক্রিয়ায়, না দর্শনে? কোথাও তো ছিলই ত্রুটি। কিছু মানুষ তাকে সুফি মনে করত, এটাও তো সত্য। পত্র-পত্রিকার বরাতেই জানা গেছে এসব খবর। আহাম্মকের মতো প্রশ্ন করতে ইচ্ছা হয়, সত্যিই কি আধ্যাত্মিক কোনো ব্যাপার-স্যাপার ছিল গোলাম আযমের? সব যুক্তি যখন হার মানে, তখন মানুষ অবোধ বিশ্বাস বা অতিলৌকিকের ম্যাজিক নিয়ে কথা বলে। এখনো বলছে কেউ কেউ। অবশ্যই তারা অতি সাধারণ মানুষ। মোটকথা কিছু মানুষ এখনো ঘটনাগুলো মেলাতে পারছে না। তাতেই বা কি আসে যায়? গোলাম আযম তো বিজয়ের ডঙ্কা বাজিয়ে চলেই গেছেন। তার শেষকৃত্যের আচার-অনুষ্ঠানও হয়েছে জাঁকজমকের সঙ্গে। এসব তো আমাদেরই ব্যর্থতার লজ্জা! আর তাই আমরা যা চাই, তা হয় না অনেক সময়।
তবে আমরা এখন ব্যর্থতার সঙ্গেই বসবাস করি। কোনো দুর্নীতিরই বিচার করতে পারি না। পারি না ভালো কাজের জন্য মানুষকে পুরস্কৃত করতে। অভ্যাসবশে গালাগালি করি যখন তখন যাকে তাকে, আবার গলাগলিও চলি তাদেরই সঙ্গে। এই দ্বিচারণ এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট দ্বান্দ্বিকতায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল আমাদের সুস্থ ন্যায়পর এবং স্বস্তিলগ্ন জীবনের সব স্বপ্ন। চুরি, খুনখারাবি, ব্যভিচার, ফাঁকি, আত্মবঞ্চনা আর সার্বিক অকর্মণ্যতার জগদ্দলে আধমরা হয়ে বেঁচে থাকছি আমরা। অথচ কী নেই এই সোনার দেশে? সাধারণ মানুষ সৎ এবং শ্রমসহিষ্ণু। গ্রামীণ মানুষ রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে খেয়ে না খেয়ে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে। তাই আমরা ভাত-মাছ-মুরগি-সবজি খাই। চর্বচোষ্য ভোজনের ঢেঁকুর তুলি। মাটিঘেঁষা মানুষের শ্রম এবং উৎপাদন ব্যয়ের কথা না ভেবে সস্তায় খাবার পেতে চাই। এতে যে ওদের বঞ্চনা আর দারিদ্র বাড়বে, সে কথাটা মোটেই ভাবি না। অর্থ হলো এই যে, আমরা নিজেরই দেশের কর্মী দরিদ্র এবং শ্রমসহিষ্ণু আপন মানুষকে ভালোবাসিনা। ভাবিনা ওদের সুখ-দুঃখের কথা। তাই তো? নিশ্চয় তাই। সে কারণে যত আপ্তবাক্যই আমরা আওড়াই না কেন, কোনোটাই কথা নয়। সবই শেষমেশ হয়ে যায় বাক্যবণিকের বাণিজ্য কথা।
ঠিক একই কারণে গোলাম আযমকে নিয়ে যে কোটি কোটি ক্রোধোন্মত্ত শব্দ যুগ যুগ ধরে বর্ষিত হয়েছে, তা যতটা কার্যকর হওয়ার কথা ছিল, সেটা হয়নি। লাখ লাখ মানুষ মিছিল মিটিং করে যে অযুত ঘণ্টা শ্রম ঢেলেছে, তার যতটা সুফল পাওয়া উচিত ছিল, সেটা পাওয়া যায়নি। কথা আছে, সোনারের ঠুক ঠুক, কামারের এক ঘা। সেই ঘা দিলেন স্বয়ং স্রষ্টা।
সুত্র
©somewhere in net ltd.