নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পেশাদারিত্ব বনাম মানবিকতা কোনটা আগে। পেশাদারিত্ব না মানবিকতা। কিছু কিছু পেশা আছে যেখানে নাকি সেই পেশার মানুষদের হরহামেশাই এই ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। তেমনি একটি পেশা ফটো সাংবাদিকতা। যেখানে টাইমিংটা খুব জরুরি। একটু সময়ের এদিক সেদিকের ফলে খুব ভাল একটা ফটো মিস হতে পারে। আবার ঠিক উল্টোটাও। খুব ভাল টাইমিং এর কারনে হয়ে যেতে পারে খুব ভাল একটা ছবি, হয়তবা তা সারা বিশ্বের মানুষের নজর কাড়ে। এবং অনেক সময় বিভিন্ন পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হয়। ফটোগ্রাফার সবার কাছে বাহ বা পায়। একটা ভাল ছবি একটা শিল্পও বটে তবে...
তবে টা শুরু করার আগে খুব সমসাময়িক এবং খুব এর সাথে প্রাসঙ্গিক একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। ঘটনার সময়কাল ১৫ এপ্রিল, ২০১৭। স্থান উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার রাশিদিন এলাকা। ৭৫টি বাসের একটি কনভয় দাঁড়িয়ে আছে। সিরিয়ার আসাদ সরকার ও বিদ্রোহীদের মধ্যে বোঝাপড়া হয়েছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত সাধারণ নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়া হবে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরে কোনও আশ্রয়ে। সেই আশায় বাসে চড়ে আলেপ্পোর কাছে রাশিদিনে জড়ো হয়েছিলেন কেফ্রায়া ও আল-ফোয়ার বাসিন্দারা। ওই বাসগুলিতে চাপিয়েই সরানো হচ্ছিল আপাতত বিদ্রোহীদের দখলে থাকা দু’টি গ্রামের শিয়া মতাবলম্বী গ্রামবাসীদের। সরকারপন্থীদের দখলে থাকা এলাকায় বিদ্রোহী এবং বিদ্রোহীদের এলাকায় থাকা সরকারপন্থী মানুষজনদের স্থানান্তরের কাজ শুরু হয়েছিল। আলেপ্পোয় ঢোকার মুখে শহরের অদূরে দাঁড়িয়েছিল ওই কনভয়। সেই সময়ই বাস থেকে নেমে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করছিলেন যাত্রীরা।
কাছেই ছিল চিপসের একটি দোকান। সেখানেই পরিবারের সঙ্গে দাঁড়িয়েছিল ছোট্ট একটি ছেলে। হঠাৎই তীব্র শব্দে বিস্ফোরণ। চিত্রসাংবাদিক এবিডি আলকাদর হাবাক সেখানে গিয়েছিলেন ছবি তুলতে। একজন চিত্র সাংবাদিক হিসেবে। কিছুটা সখের বশে ছবি তুলতে গিয়ে হয়তবা অনেকটা পেটের দায়ে ছবি তোলা। সেইসময় তাঁর সামনেও প্রশ্নটা আসলো ছবি তুলবেন নাকি মানুষ বাঁচাবেন। কিন্তু সিরিয়ার চিত্রসাংবাদিক এবিডি আলকাদর হাবাক সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেননি। ভুলে গেলেন পেশাদারিত্ব। সকলেই খবর সংগ্রহে, ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু মানবিকতার দায় উপেক্ষা করতে পারেননি আলকাদের। মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেন ঝাঁপিয়ে পড়ার। ততক্ষণে আশপাশের পরিবেশটা যেন নরক। বোমা, রক্ত, শিশুদের চিৎকার, মায়ের বুক ফাটা কান্না...।
শেষ চেষ্টা করলেন বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোকে উদ্ধার করার। পুরোটা সফল হলেন না। যে ছোট ছেলেটিকে নরকযন্ত্রণা থেকে উদ্ধার করলেন, বিস্ফোরণের ভয়াবহতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে ততক্ষণে নিষ্প্রাণ সেই খুদে শরীর। তাকে নামিয়ে রেখে ছুটে গেলেন তালগোল পাকিয়ে যাওয়া বাসের মধ্যে আটকে পড়া অন্য একটি শিশুর দিকে।
‘‘ও আমার হাত ধরল। আমার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। তখনও ধুকপুক করছিল ও। আমি অ্যাম্বুল্যান্স অবধি পৌঁছে দিয়েছিলাম ওকে’’— সংবাদ সংস্থাকে এমনই জানালেন আলকাদর।
কিন্তু প্রথম শিশুটির করুণ পরিনতির কথা ভুলতে পারেননি আলকাদের। শিশুর মৃতদেহ সামনে রেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। (সূত্রঃ আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯ এপ্রিল)
প্রশ্ন হল আলকাদের কি পেশাদারিত্ব ভুলে গিয়েছিলেন। আমার মনে হয় না। কারণ পৃথিবীতে আমরা যা করছি তা সবই মানুষের জন্য। বেঁচে থাকার জন্য। আমদের পরবর্তী প্রজন্মকে আরেক ধাপ এগিয়ে দিয়ে যাবার জন্য।আলকাদের কয়জন শিশুকে রক্ষা করতে পেরেছিল তা সে নিজেও জানে না। যদি সেটা একজনও হয় তাই বা কম কি। পৃথিবীর সব কয়টা ভাল ফটোর মূল্যও সেই একটি শিশুর প্রানের দামের কাছে কিছুই না। অথবা অন্য দিকে বলতে গেলে একটি প্রান বাঁচানোর চেয়ে বড় কোন পেশা বা বড় কোন শিল্প আছে কি না আমার জানা নেই। আমার মনে হয় আলকাদের বড় পেশাদারিত্বের কাজটিই করেছে।
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে তাহলে আলকাদেরর ফটো তুলে যে সাংবাদিক আলকাদেরকে আমাদের সামনে আনল তাঁর অবাদান কম কিসে। তা না হলে তো আমরা আল কাদেরের কথা জানতে পেতাম না। আমি বলি কি তারচেয়ে যদি এমন একটা খবর পেতাম যে ওই ফটো সাংবাদিকের প্রচেষ্টায় অথবা অন্য কোন মানুষের প্রচেষ্টায় আরও একটি শিশু অথবা মানুষ অর্থাৎ আরও একটি প্রাণ রক্ষা পেয়েছে সেই সংবাদটা কি আরও বেশি সুখকর হত না?
যদিও সবচেয়ে বড় প্রহসন সিরিয়া সহ সারা পৃথিবীতে যে যুদ্ধ হচ্ছে যে যুদ্ধে হাজার হাজার শিশু মারা যাচ্ছে তা আমরা যারা সুসভ্য মানুষ হিসেবে নিজেদেরকে দাবি করি তাদেরই সৃষ্টি। এই যুদ্ধ না থাকলে তো মানুষ বাঁচানোর প্রশ্নই আসত না। প্রশ্ন আসত না নৃশংস পেশাদারিত্বের অথবা এমন কোন পুরস্কারপ্রাপ্ত ফটোর যার মূল্য কোন নিষ্পাপ শিশু তাঁর ছিন্নভিন্ন শরীর দিয়ে মিটিয়ে দিয়েছে।
©somewhere in net ltd.