![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ছোটবেলায় আমরা প্রায় সকলেই একটি বিষয়ের সাথে কমবেশি পরিচিত ছিলাম। তখন কিছু ফেরিওয়ালা পুরোনো ব্যবহৃত বোতল, জুতো, কাপড় এসবের পরিবর্তে “কটকটি” নামক একধরণের মিষ্টিজাতীয় বস্তু বিক্রি করতো। তখন হয়ত আমরা চিন্তা করে দেখিনি যে ঐ পুরোনো, অব্যবহৃত সামগ্রীগুলো সংগ্রহ করার পেছনে কি কারণ ছিল? এখনকার দিনে সেই “কটকটি” বিক্রেতাদের দেখা না গেলেও পুরোনো অব্যবহৃত দ্রব্যসামগ্রী সংগ্রহ করতে এখনো বহুলোককেই দেখা যায়। তবে এখন তারা টাকার বিনিময়ে এগুলো কিনে থাকে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে সংগ্রহ করে আনা এসব পুরোনো জিনিসগুলো তারা যেসব দোকানে বিক্রি করে সেগুলোই “ভাঙ্গারী”র দোকান বলে পরিচিত।
এই ব্যবসা বাংলাদেশে কখন থেকে শুরু হয়েছে, কীভাবে ও কাদের মাধ্যমে এর যাত্রা শুরু, এ সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায় নি। মূলত দোকানের মালিক তার অধীনস্থ কিছু কর্মচারী অথবা পথশিশুদের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থান থেকে টাকার বিনিময়ে এই পুরোনো অব্যবহৃত দ্রব্যসামগ্রী সংগ্রহ করে থাকেন। এরপর তিনি সংগৃহীত দ্রব্যগুলো বিভিন্ন শিল্পকারখানায় বেশি দামে বিক্রয় করেন।
সংগৃহীত দ্রব্যাদির ধরনঃ
পথশিশু বা কর্মচারীরা বিভিন্ন ধরণের পুরোনো অব্যবহৃত দ্রব্যসামগ্রী সংগ্রহ করে যেমন, প্লাস্টিক বোতল, পলিথিন, রাবার, কাগজ , লোহার তৈরি সামগ্রী, পুরোনো টিন, নষ্ট হওয়া লোহার তৈরি যন্ত্রাংশ,নষ্ট হওয়া বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি, গৃহনির্মাণ সামগ্রী, গ্লাস, কাগজের বাক্স, রাবার, নারিকেল ওষুধের অ্যালুমিনিয়াম প্যাকেটসহ আরও নানাধরণের জিনিসপত্র সংগ্রহ করে। কিছু কিছু ভাঙ্গারীর দোকানে বিভিন্ন রকমের দ্রব্যাদির বেচাকেনা হয়, আবার কোন কোন দোকানে শুধুমাত্র একটি দ্রব্যের বেচাকেনা হয়।
এই ব্যবসায়ে আকৃষ্ট হবার প্রধান কারণঃ
লোকবল খুব বেশি প্রয়োজন না হওয়ায় এই ব্যবসায় লাভের সম্ভাবনা অধিক। এছাড়াও সংগৃহীত দ্রব্যাদি পচনশীল নয় বলে অনেকদিন এগুলো সংরক্ষণ করা যায় যা এই ব্যবসার একটি অন্যতম সুবিধা।
পুরোনো অব্যবহৃত জিনিসপত্র সংগ্রহ, বাছাই ও পৃথকীকরন, ওজন, প্যাকিং এবং পরিবহনঃ
এটি মূলত একটি পাইকারি ব্যবসা। এই ব্যবসায় কেজি বা মণ হিসেবে দ্রব্যাদি বেচাকেনা হয়ে থাকে। একটি সাধারণ ভাঙ্গারীর দোকানে সংঘঠিত প্রক্রিয়াগুলো হল –
সংগ্রহ - একটি ভাঙ্গারীর দোকানে পুরোনো, অব্যবহৃত সামগ্রীগুলো সংগ্রহ করার জন্য গড়ে ১০ থেকে ১৫ জন নিয়োজিত থাকে। তারা বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন ধরণের দ্রব্যাদি সংগ্রহ করে থাকে।
বাছাই ও পৃথকীকরন - একটি ভাঙ্গারীর দোকানে সংগৃহীত দ্রব্যাদির বাছাইকরণের জন্য গড়ে ২ থেকে ৫ জন নিয়োজিত থাকে। এর মাধ্যমে সংগৃহীত দ্রব্যগুলোর মধ্যে থেকে সর্বোৎকৃষ্ট মানসম্পন্ন দ্রব্য বিক্রির জন্য পৃথক ও বাছাই করা হয়।
ওজন – যেহেতু কেজি বা মণ হিসেবে পুরাতন এসব দ্রব্যাদি বেচাকেনা হয় তাই বাছাই ও পৃথকীকরণের পর দ্রব্যগুলোকে বড় নিক্তির সাহায্যে ওজন করে দাম নির্ধারণ করা হয়।
প্যাকিং – ওজন করে দাম নির্ধারণের পর সংগৃহীত দ্রব্যগুলোকে বড় পলিথিনের বস্তার মধ্যে চেপে প্রবেশ করানো হয়। ফলে একসাথে সর্বাধিক দ্রব্যাদি কারখানাগুলোতে পৌঁছানো যায়। ফলে পরিবহন খরচ বহুলাংশে কমে যায়।
পরিবহন - সংগৃহীত দ্রব্যাদি বাছাই ও পৃথকীকরণ, ওজন এবং প্যাকিং এর পর সেগুলো বিভিন্ন শিল্প কারখানায় বিক্রির জন্য যানবাহনযোগে পাঠানো হয়। এক্ষেত্রে ভ্যানগাড়ি অধিক ব্যবহৃত হয়। তবে বেশি মালামাল পরিবহনের ক্ষেত্রে পিকআপ ভ্যান বা ট্রাকের ব্যবস্থা করা।
অনেক সময় শিল্পকারখানাগুলো দোকান মালিকদের কাঁচামাল ক্রয় করার জন্য অগ্রিম টাকাও দিয়ে থাকে। বড় পরিসরের একটি ভাঙ্গারীর দোকানের সর্বোচ্চ মাসিক আয় এক - দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
ভাঙ্গারী ব্যবসার গুরুত্ব ও সম্ভাবনাঃ
ছোট পরিসরে হলেও এই ভাঙ্গারীর ব্যবসা আমাদের দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম। কারণ এর মাধ্যমে বিভিন্ন দ্রব্যাদির পুনঃব্যবহার ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ নিশ্চিত হচ্ছে। ফলে শিল্পকারখানাগুলো একদিকে যেমন কম খরচে কাঁচামালের সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারছে, ঠিক তেমনি থেকে দূরে থাকছে যা পরবর্তীতে দূষণের কারণ হতে পারতো। Waste Concern নামক একটি বেসরকারি সংস্থার গবেষণা সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ২০০৫ সালে বাংলাদেশে উৎপাদিত মোট কঠিন বর্জ্যের প্রায় ৫৭.৬৯ শতাংশ ভাঙ্গারী ব্যবসা, পথশিশুর কার্যক্রম এবং একই ধরণের উদ্যোগের মাধ্যমে পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ হয়েছে যার ফলে বছরে প্রায় ১৫.২৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সঞ্চয় হয়েছে। তাই এটা খুব সহজেই বলা যায়, ভাঙ্গারী ব্যবসার আর্থিক এবং পরিবেশগত উভয় ধরণের সুবিধাই রয়েছে। নিকট ভবিষ্যতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে বার্ষিক উৎপাদিত কঠিন বর্জ্যের পরিমাণ বাড়বে। তাই এই বর্ধিত বর্জ্য যদি সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করা যায় তবে ভাঙ্গারী ব্যবসা ও সংশ্লিষ্ট খাতগুলো হতে ভবিষ্যতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আর্থিক লাভের সম্ভাবনা রয়েছে।
ভাঙ্গারী ব্যবসার সুবিধা ও অসুবিধাঃ
সুবিধা - আজ থেকে ৫ বা ১০ বছর আগেও প্লাস্টিক, পলিথিন ও পুরাতন কাগজ আমাদের চারপাশের পরিবেশে যত্রতত্র ছুঁড়ে ফেলা হত যেগুলো পরিবেশ দূষিত করত। কিন্তু ভাঙ্গারী ব্যবসার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে পুরাতন প্লাস্টিক জাতীয় সামগ্রী ও প্লাস্টিক বোতলের প্রায় শতভাগই এখন পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ করা সম্ভব হচ্ছে। এমন অনেক পেপারমিল গড়ে উঠেছে যেগুলো ভাঙ্গারীর দোকানে প্রাপ্ত পুরাতন কাগজ ব্যবহার করে উন্নতমানের কাগজ তৈরি করছে। অর্থাৎ এই ব্যবসার মাধ্যমে একই সাথে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিলাভ ও পরিবেশ সংরক্ষণ করা সম্ভব। পথশিশু ও হতদরিদ্র কর্মচারীদের কর্মসংস্থান ও উপার্জনের নতুন দ্বার উন্মোচিত হচ্ছে।
অসুবিধা - যদিও এই ব্যবসার মাধ্যমে পথশিশুদের আর্থিক দিক হতে কিছুটা উপকার হচ্ছে, কিন্তু লভ্যাংশ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ভাঙ্গারী ব্যবসায়ী ও দোকান মালিকদের তুলনায় তারা খুব কম লাভবান হচ্ছে, অর্থাৎ তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। অথচ পথশিশু ও পুরোনো দ্রব্যাদি সংগ্রহকারীরাই এই ব্যবসার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সম্পাদন করে থাকে যার ফলে তারা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। অনেক সময় ভাঙ্গারী দোকানে চুরি করা জিনিসপত্রের কেনাবেচা হয়ে থাকে যা নীতিগতভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ এর ফলে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যহত হয়। ভাঙ্গারী ব্যবসার সাথে জড়িত বেশিরভাগ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানেরই ট্রেড লাইসেন্স নেই। যার ফলে কোন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান কোনরূপ প্রতারণার আশ্রয় নিলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়াও কষ্টকর হয়। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের এই বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ এই সম্ভাবনাময় ব্যবসাটির সম্প্রসারণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
পরিশেষে এটি বলা যায় যে, বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে যেখানে চাকুরীর অভাব এবং ব্যবসায় ক্রমহ্রাসমান মুনাফা দৃশ্যমান সেখানে ভাঙ্গারী নিঃসন্দেহে একটি লাভজনক ও পরিবেশবান্ধব ব্যবসা। তাই সরকার ও বিভিন্ন দেশি বিদেশি সহযোগী সংস্থাকে এই ব্যবসার সমৃদ্ধির জন্য এগিয়ে আসতে হবে। যেহেতু এই ব্যবসার পরিবেশগত সুবিধা রয়েছে তাই সরকার এই ব্যবসার প্রতি জনগণকে উৎসাহিত করার জন্য বিশেষ প্রণোদনার বা ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে পারে। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন ঋণদানকারী সংস্থাগুলো ভাঙ্গারী ব্যবসায়ীদের সহজ শর্তে ঋণদান করে এই ব্যবসার উন্নয়নে ভুমিকা রাখতে পারে। পাশাপাশি সরকার ও সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের এমন উপায় এবং পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে যাতে সঠিকপন্থায় এই ব্যবসার তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তবেই নিকট ভবিষ্যতে ভাঙ্গারী ব্যবসা এদেশের অর্থনীতির জন্য অধিক লাভজনক হতে পারবে।
©somewhere in net ltd.