![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
(১)
"রাহুল সাহেব, আপনাকে আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে।"
- ধন্যবাদ স্যার।
"আপনার একাডেমিক রেজাল্ট যদিও মোটামুটি মানের, তার উপর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়েছেন। কিন্তু আপনার আউট-নলেজ খুব প্রখর।"
- ওকে স্যার।
"বলুন, স্যালারি কত চান?" প্রশ্নকর্তার বয়স আমার থেকে দশ বছরের একটু বেশি হতে পারে। মুখ থেকে হাল্কা চুইংগামের গন্ধ আসছে।
- বিশ হাজার স্যার।
(ইন্টারভিউ বোর্ডের তিনজন মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। একজন নারী, দুজন পুরুষ। দুজন পুরুষের একজন সম্ভবত সাংঘাতিক বেঁটে, চেয়ারে বসে থাকায় শিউর বোঝা গেল না)
"আমাদের বাজেট অবশ্য ছিল দশ হাজার। শুরুতেই বিশ হাজার একটু বেশি হয়ে গেলো।"
- সেই মিরপুর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত যাওয়া আসা করা যথেষ্টই ঝামেলা স্যার। ট্রাফিক জ্যামেই দুইবারে চার ঘণ্টা চলে যাবে। আর ...
"কিন্তু আমাদের অন্যান্য ফ্যাসিলিটি ভালো" কড়া মেকআপ দেয়া ম্যাডামের কণ্ঠটা খুব মিষ্টি।
-সেটা কি রকম ম্যাডাম?
"আমাদের অফিসে কাজের ফাঁকে ফেসবুক আর শেয়ার মার্কেটের খবর দেখার জন্য ইন্টারনেট চালাতে পারবেন। মূল ডিউটি ঠিক থাকলেই হয়। লাঞ্চের ৩০% বিল আমরা দেই। বছরে দুটা ঈদ বোনাস। কেউ বিয়ে করলে আমরা একটা টেলিভিশন উপহার দেই। কেউ চাকুরী ছেড়ে দিতে চাইলে আমরা বেতন আটকিয়ে দেই না ........... "
- এক মিনিট! শেষের আগেরটা কি বললেন ম্যাডাম?
"কেউ চাকুরী ছেড়ে দিতে চাইলে আমরা বেতন আটকিয়ে দেই না"
- না, এর আগেরটা। বিয়ের ব্যাপারটা?
"কেউ বিয়ে করলে আমরা একটা টেলিভিশন উপহার দেই।" এবার বেঁটে স্যারের উত্তর। উনার মুখে কেমন খুশির ঝিলিক।
- আমার একটা প্রশ্ন ছিল, স্যার।
"নিশ্চয়ই বলেন"
- আমি যদি বিয়ে করার কিছুদিন পর বউকে ডিভোর্স দিয়ে আবার নতুন করে অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করি, তাহলে কি আপনারা আবার টেলিভিশন উপহার দিবেন? সারাজীবনে কয়বার এই সুযোগ পাওয়া যাবে?
"কি সাংঘাতিক পরিকল্পনা! ভাই, আপনার বাড়ি কি নোয়াখালী?"
(২)
"রাহুল সাহেব, আপনাকে আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে।"
- ধন্যবাদ স্যার।
"ঢাকায় আপনারা স্থায়ী। তাই না?' অফিসে এয়ার কন্ডিশনিং নেই। আসবাবপত্র কেমন যেন পুরনো। প্রশ্নকর্তা অফিসের জি.এম.। ভারী শরীর।
-জ্বি, স্যার।
"নিজেদের বাড়ি?" প্রশ্ন শুনে ভাবছি রিসিপশনিস্টের চাকুরীর জন্য বাড়ি দরকার কেন? অবশ্য আকালের দিনে যে চাকুরী পাই তাই লাভ।
- জ্বি, স্যার।
“এজন্য আপনাকে আরও বেশি ভালো লেগে গেলো। তবে আমাদের কোম্পানির নিয়ম হল, স্টাফরা অবশ্যই সিকিউরিটি মানি চাকুরী চলাকালীন সময়ে জমা রাখবে। কারন আমাদের পুরো অফিস জুরে মূল্যবান সব জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা।” আমি আবার-ও পুরাতন আসবাবপত্রের উপর নজর বুলালাম।
- তাই? তা আমার বেতন কত, আর সিকিউরিটি মানি কত?
"আপনাকে মাসে আট হাজার টাকা দিব, আর পাঁচ লাখ টাকা সিকিউরিটি মানি রাখতে হবে। এটা চাকুরী ছেড়ে দিলে ফেরত পাবেন। তবে তিন বছরের আগে চাকুরী ছাড়া যাবে না।"
- তাই? স্যার, এই সিকিউরিটি মানি রাখার জন্য আমি কি কোন ইন্টারেস্ট পাব?
"সেটা আমরা কেন দিব?" জি.এম. কেন যেন বিরক্ত হলেন।
- অনেক ব্যাংক বা ফিনানশিয়াল প্রতিষ্ঠান ১২% হারে ইন্টারেস্ট দেয়। পাঁচ লাখ টাকা ডিপোজিট করলে মাসে ইন্টারেস্ট পাব পাঁচ হাজার টাকা। আপনারা বেতন দিবেন আট হাজার। তাহলে সত্যিকারের বেতন হল মোটে তিন হাজার। তাই না স্যার?
"ভাই, এত বেশি কথা বলা স্টাফ আমার পছন্দ না। চাকুরী করলে করেন, না করলে না করেন। লাখ লাখ ছেলে মেয়ে বেকার। আমরা আপনার পায়ে ধরতেছি না।"
- আমিও চাকুরীর জন্য আপনার পায়ে ধরি নাই। আপনি কোন অপদার্থকে ধরে চাকুরী দিয়ে দেন। আল্লাহ হাফেজ।
(৩)
"রাহুল সাহেব, আপনাকে আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে।"
- ধন্যবাদ ম্যাডাম।
"শুধু মাত্র একটা জিনিস-ই বুঝতে পারছি না। আমরা বিজ্ঞপ্তিতে লিখেছিলাম দুজন বিখ্যাত মানুষের রেফারেন্স দিতে যারা আপনার আত্মীয় বা পরিচিত।" ইন্টারভিউ বোর্ডে তিনজন-ই নারী। তিনজনই উবু হয়ে আমার সিভি দেখছেন।
- আমি দিয়েছি তো। দুজন আত্মীয়ের নাম রেফারেন্সে দিয়েছি।
"হ্যাঁ। কিন্তু একজন শেখ হাসিনা, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, আরেকজন ডোনাল্ড ট্রাম্প, আমেরিকান রাষ্ট্রপতি। তারা আপনার আত্মীয়?"
-জ্বি।
"কিভাবে?"
- আমাদের সবার পূর্বপুরুষ তো আদম-হাওয়া। সেই হিসাবে সমগ্র মানবজাতি-ই আমার আত্মীয়। তাই শেখ হাসিনা আর ডোনাল্ড ট্রাম্প দুজনেই আমার আত্মীয়।
"আপনার স্মার্ট উত্তর খুব ভালো লেগেছে।" তিনজন-ই প্রথমে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। কথা বললেন মাঝেরজন। অন্য দুজন চুপ। শুধু মাঝের জনই কথা বলছেন। বয়স তিরিশের মত হবে। দেখতে যথেষ্ট সুন্দরী, তবে ভুরুটা মনে হয় প্লাক করা।
- জয়েন করছি কবে থেকে?
"শুধু ছোট্ট দুটা সমস্যা ছিল।"
- কি সমস্যা?
"আপনাকে সত্যিকারের কোন গুরুত্বপূর্ণ আত্মীয়ের রেফারেন্স দিতেই হবে, এটা খুব জরুরী। আপনার স্মার্ট উত্তরে কাজ হচ্ছে না। আর দ্বিতীয় সমস্যা হল, আমরা অভিজ্ঞতা ছাড়া নেই না। তাই আপনার চাকুরীটা হচ্ছে না।"
- সেটা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে লিখতে পারতেন। সেই মিরপুর থেকে আসা লাগত না। এখানে আসার পর রিসিপশনিস্ট প্রত্যেককে সিভিতে কলম দিয়ে দুজন বিখ্যাত মানুষের রেফারেন্স লিখে দিতে বলল। এতগুলো মানুষ বাইরে বসা। আর আমি বুঝতে পারছি না। এটা এন্ট্রি লেভেলের জব, এখানে অভিজ্ঞতা লাগবে কেন?
"কেন লাগবে না, সেটা শুনি!"
- যে জীবনে চাকুরী-ই করেনি, সে কিভাবে অভিজ্ঞতা অর্জন করবে? আর কেউ চাকুরী করে মিড-লেভেলে প্রমোশন পায়, বা অন্য কোথাও সুইচ করে, তখন অভিজ্ঞতা প্রয়োজন হয়। একদম জীবনের শুরুতেই অভিজ্ঞতা কিসের?
"অত কিছু বুঝি না। এটা আমার জীবনের পলিসি। আমি অভিজ্ঞতা ছাড়া আমার অফিসে কাউকে চাকুরী দিব না। এটাই ফাইনাল। এটা আমার বাবার কোম্পানি, আর আমি সি.ই.ও., তাই আমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারি।” বুঝা গেল এই মাঝেরজনই অফিসের টপ বস। পাশের দুইজন বয়সে বড় হলেও স্টাফ। এই টপ বসের কি বিয়ে হয়ে গিয়েছে? জানা দরকার।
- ও! তা ম্যাডাম, আপনি কি বিবাহিত?
"কেন?"
- আপনি কি আপনার জন্য অভিজ্ঞতা সম্পন্ন পাত্র খুজতেছেন? আগে দুই বা একবার বিয়ে করেছে এরকম কেউ? আমাদের এলাকার এরকম আছে একজন। ইলেকট্রিক মিস্ত্রি আক্তার। উনি তৃতীয় বিয়ের জন্য মেয়ে খুজতেছে। আমি কি উনাকে ফোন দিব?
"আপনি আজেবাজে কথা বলছেন কেন?"
- আজেবাজে কথা কখন বললাম? আমি আপনার ইচ্ছাকে সম্মান জানাচ্ছি। আপনি আপনার ছোটবোন, যদি থাকে আরকি, তাদের জন্যও বলতে পারেন। কিংবা ভবিষ্যতে মেয়ের মা হলে। ....
"আউট! বিদায় হন!"
- ওকে! বিদায়। তবে আমার সিভিতে আমার নাম্বার আছে। আমাদের এলাকার ইলেকট্রিক মিস্ত্রির সাথে বিয়েতে রাজি হলেই আমাকে ফোন দিবেন। বিনে পয়সায় ঘটকালি করে দিব।
(৪)
"রাহুল সাহেব, আপনাকে আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে।"
- ধন্যবাদ স্যার।
"তোমাকে তুমি করে বলি। সমস্যা হবে?"
- না স্যার।
"আর আমাদের অফিসে আমরা খুব লিবারেল। তুমি আমাকে 'স্যার' না, 'ভাইয়া' বলে ডেকো। আমাদের অফিসে এটাই নিয়ম।"
- জ্বি, স্যার! সরি। জ্বি, ভাইয়া।
"সরকারি বাঙলা কলেজ থেকে পড়াশুনা করেছ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রি আছে। খুব ভালো। তবে আমাদের এখানে আমরা আউটনলেজের সিরিয়াস মূল্য দেই। তোমার পত্রপত্রিকা পড়ার অভ্যাস আছে?"
- ছোটবেলা থেকেই পড়ি। আগে প্রিন্টের পত্রিকা পড়তাম। এখন অনলাইন সংস্করণে পড়ি।
"গুড! গল্পের বই পড়?'
- নিয়মিত পড়ি।
"এই মুহুর্তে কোনটা পড়ছ?
- হুমায়ুন আহমেদের প্রিয়তমেষু পড়ছি।
"কারা তোমার ফেভারিট লেখক?"
- হুমায়ুন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, কাজী আনোয়ার হোসেন, রকিব হাসান, এলিস্ট্যার ম্যাকলীন, রবার্ট লুডলাম, জেমস হেডলি চেজ, উইলবার স্মিথ, ক্লাইভ কাসলার, ফ্রেডরিক ফরসাইথ প্রমুখ।
"সাবাস। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দেনা পাওনা পড়েছ?"
- হ্যাঁ। পড়েছি।
"রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গুপ্তধন পড়েছ ?"
- হ্যাঁ। পড়েছি। ভাইয়া, আমি কিন্তু মারাত্মক পাঠক। বাংলা সাহিত্য আর ইংরেজি সাহিত্য আমি ধুয়ে খেয়ে ফেলছি। স্টুডেন্ট লাইফে বইয়ের ভাজে তিন গোয়েন্দা রেখে পড়তাম। এজন্য আমার একাডেমিক রেজাল্ট-ও সুবিধার না। আমিতো পারলে ল্যাট্রিনের ভিতর বসে গল্পের বই পড়ি। আমাদের বাসার বর্তমান ল্যাট্রিন নর্মাল মানের হওয়ায় সুবিধা করতে করতে পারছি না। তবে ভবিষ্যতে নিজের টাকায় বাড়ি বানালে সাইডে ফল্ডিং টেবিল বা হোল্ডার রাখার ব্যবস্থা করব। দশ-পনের মিনিট অপচয় করে লাভ কি? একদিকে কাজ-ও চলবে, অন্যদিকে বই-ও পড়া হবে।
"বহুদিন পড় একজন মনের মত মানুষ পাওয়া গেলো। এই রকম সিরিয়াস পাঠক আর দেখি নাই। আমিও সিরিয়াস পাঠক। ল্যাট্রিনের দরজায় আমি আগে এলজেব্রার সূত্র লটকিয়ে রেখেছিলাম। তুমি আর আমি তো পুরা ভাই ভাই। আচ্ছা আসো, আরেকটু ডিপ আলোচনায় যাই। উমম ............. তুমি টনি মরিসনের উপন্যাসের কিছু চরিত্র বিশ্লেষণ কর"
- ভাইয়া, মানে ....... আমি এই টনি না কি যেন বললেন, উনার নাম-ই শুনি নাই।
"তুমি একটু আগে বললা, ইংরেজি সাহিত্য ধুয়া খায়া ফেলছ। পারলে ল্যাট্রিনের ভিতরেও গল্পের বই পড়তে চাও। আর তুমি টনি মরিসনের নাম-ই শুনো নাই। মানে কি?"
- তো সমস্যা কি?
"উনি সাহিত্য নোবেল প্রাইজ পাওয়া, আর সমস্যা কি মানে?'
- আমি ব্যাখ্যা করে বলি। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি হল 'লাইব্রেরি অব কংগ্রেস', যেখানে বই আছে সাড়ে তিন কোটি। একজন মানুষ যদি জন্মের পর-ই কথা বলতে আর বই পড়তে শিখে যায়, তাহলে প্রতিদিন একটি বই পড়লে বছরে ৩৬৫টি বই পড়তে পারবে। ১০ বছরে ৩,৬৫০টি। যদি ১০০ বছর আয়ু হয়, তবে ৩৬,৫০০টি বই। প্রতিদিন ৩টি বই পড়লে এক লাখের একটু বেশি হবে। অর্থাৎ লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের সাড়ে তিন কোটি বইয়ের মধ্যে তিন কোটি ঊন-পঞ্চাশ লাখ বই পড়া সম্ভব হবে না। আপনি যার নাম বললেন, তার বই সেই তিন কোটি ঊন-পঞ্চাশ লাখ 'না পড়া বই' এর তালিকায় আছে।
(চারপাশে শুনশান নীরবতা। শুধু এয়ার কন্ডিশনারের হাল্কা ঝির ঝির আওয়াজ।)
#গল্প : রাহুলের ইন্টারভিউ
#লেখা : তাওহীদুর রহমান ডিয়ার
www.fb.com/tawhidurrahmandear
প্রথম প্রকাশ : ডিসেম্বর ২০১৯
২| ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ১১:০৯
কনফুসিয়াস বলেছেন: সব গুলোই ফাটিয়ে দিয়েছে ভাই।
ভালবাসা অফুরন্ত।
১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৩:৩৯
তাওহীদুর রহমান ডিয়ার বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ
৩| ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ সকাল ১১:৩১
নীল আকাশ বলেছেন: এভাবে এখন কারও আর চাকুরী হয় না।
১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৩:৪০
তাওহীদুর রহমান ডিয়ার বলেছেন: ভাই, এটা গল্প। জীবিত বা মৃত কারো সাথে সম্পর্ক নেই ;-)
©somewhere in net ltd.
১|
১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ৯:৫৮
রাজীব নুর বলেছেন: ইন্টারভিউতে কাজ হয় না। ক্ষমতাবান মামা চাচা থাকা দরকার।