![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি'র ২-৩টি বাক্য ব্যতীত আর কোন কথায় আমার কোন আপত্তি নেই। জামায়াত ইসলামীর ইতিহাস একজন আওয়ামীলীগের কাছে কি রকম জেনে নিতে পারেন। একটু বড় হলেও মাস্টারপিস এই লিখাটি।
গোলাম মাওলা রনি: জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী প্রায়ই তার ওয়াজ মাহফিলে কথাগুলো বলতেন। লক্ষ লক্ষ লোকের সমাবেশে সুন্দর করে বোঝাতেন- ইনসাফ ,ইন্তেহান ও শারীয়াহ আইন কাকে বলে? আমি তার অনেক মাহফিল শুনেছি। কখনো উপস্থিত থেকে শুনেছি, আবার কখনো ক্যাসেটে, সিডি, ডিভিডি বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে। ১৯৭৬ সালে আমি প্রথম তার মাহফিল শুনি ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলার কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে। অদ্ভুত প্রেক্ষাপটে মাহফিলটি আয়োজন করা হয়েছিল। মাঠটি ছিল কানায় কানায় পরিপূর্ণ। কয়েক দিন আগে ঐ মাঠে হাজী শরীয়াতুল্লাহর বংশধর পীর দুদুমিয়ার মাহফিল ছিল। আটরশি বিশ্ব জাকের মঞ্জিল তখন মাত্র গজিয়ে উঠছে। আটরশির কয়েকশ ভক্ত মাগরিব নামাজের আগে পীর দুদুমিয়ার মাহফিলটি ভেঙ্গে দেয়। পীর দুদুমিয়া সম্পর্কে আমাদের আত্মীয় হবার কারণে দাদার সঙ্গে আমিও সেখানে ছিলাম। মারামারি লাগলে দাদার সঙ্গে আমি পাল্লা দিয়ে ভোঁ দৌড় মেরে চম্পট মেরেছিলাম। এর কয়দিনপর দেখি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী নামের একজন ওয়াজেন সেখানে ওয়াজ করছেন।
সময়টি ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর এবং স্থানটি ছিল তাঁর জন্মভূমি ফরিদপুর জেলার একটি অঞ্চল। আমি তখন ১০/১২ বছরের বালক। সব মনে নেই তবে কিছু মনে আছে নিশ্চয়ই। বর্তমানে যুদ্ধাপরাধের আসামী অব্দুল কাদের মোল্লার বাড়ী সদরপুরে। এলাকার নিতান্ত দরিদ্র মানুষের সন্তান তিনি। পিতার নাম ঘনা মোল্লা। ১৯৮৬ সালের আগে আমরা এলাকাবাসী তাকে চিনতাম না। এরশাদ আমলে জামায়াতের পক্ষে মনোনয়ন নিয়ে তিনি সদরপুরে এম পি নির্বাচন করেছিলেন। এর আগে তার সম্পর্কে এলাকাবাসী কিছুই জানত না। যা হোক, এবার প্রসঙ্গে আসি। ১৯৭৬ সাল থেকে সাঈদী সাহেবের মাহফিল শুনে আসছি। জামায়াত যুদ্ধাপরাধ বা ৭১ সালে তার কর্মকা- সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। তার সাবলীল উপস্থাপনা, সুললিত কন্ঠ এবং বিষয় বস্তুর সঙ্গে মিল রেখে চটকদার উদাহরণ আমার মতো লক্ষ লক্ষ মানুষকে বিমোহিত করে রাখতো। মসলমান ছাড়াও হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান সহ উপজাতীয় লোকজনের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। ভারত থেকে অনেকে আসতেন বিশেষত চট্টগ্রামের প্যারেড ময়দানের বাৎসরিক মাহফিলে।
সাঈদী সাহেব মাহফিলে আমাদেরকে ইনসাফ, ইন্তেহান এবং শারীয়া আইন বুঝাতেন। ইসলামী আদালতের মাহাত্ম্য বর্ণনা করতেন। কেসাস বা হত্যার বদলে হত্যার যুক্তি তিনি অনেক হাদিস এবং কোরআনের আয়াতের তাফসীর করে বুঝিয়ে দিতেন। আমি বা আমার সাধারণ শিক্ষার অজস্র দর্শক শ্রোতা মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেখনে উপস্থিত হয়ে কেঁদে জারজার হয়ে যেতাম। উনার হুকুম মতো কখনো সুবাহানাল্লাহ কিংবা আলহামদুলিল্লাহ অথবা নাউজুবিল্লাহ বলতাম। মনে মনে আল্লাহর পেয়ারা বান্দা বা ওলি হবার স্বপ্ন দেখতাম। সেই ১২/১৩ বছর বয়সে আমার অবদমিত মনের আকাক্সক্ষা ছিল ওলি হয়ে বাতাসে হযরত সোলায়মান আঃ এর মতো উড়ে বেড়ানো কিংবা হযরত শাহজালাল রঃ এর মতো জায়নামাজ বিছিয়ে নদী পার হয়ে এক জনপদ থেকে আরেক জনপদে ঘুরে বেড়ানো। এভাবেই সেই ১৯৭৬ থেকে আজ অবধি চেষ্টা করছি। কিন্তু গত ৩৬ বছরে ও আমি বাতাসে উড়তে পারলাম না।
আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইদানিং জামায়াতের বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। জামায়াত কে পরাজিত করতে হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়কে কিছু বিষয় জানতে হবে। গবেষণা করতে হবে। তারপর অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে। জামায়াত নামক দলটি যে পরিকল্পনা করে গত প্রায় ৭০ বছর ধরে এগুচ্ছে, সেই অগ্রযাত্রাকে ধ্বংস করতে হলে অবশ্যই সঠিক পরিকল্পনা করতে হবে। হৃদয় দিয়ে চিন্তা না করে মস্তিষ্ক দিয়ে করতে হবে। রাজনৈতিক বক্তৃতা বা উল্লম্ফন না দিয়ে কাজ করতে হবে। আমার মনে হচ্ছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মারাত্মক ভ্রান্তিতে আছেন। তিনি জামায়াত সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রাখেন না। তার কথিত পান্ডিত্য ইনসাফ, ইন্তেহান ও শারীয়াহ আইনের জামায়াতী ব্যাখ্যার ধারের কাছেও পৌঁছতে পারেনি বলে আমি সন্দেহ করছি।
বাংলাদেশের জামায়াত কর্মীরা তাদের ভাববাদী নেতা হিসেবে মরহুম মাওলানা আবুল আলা মওদূদীকে মানে। মওদূদীর লেখা কোরআনের তাফসীর “তাফহীমুল কোরআন” বা অন্যান্য গ্রন্থ এদেশের জামায়াতীদের নিকট বাইবেলের মতো। তাদের মূল আদর্শ এসেছে সৌদি আরব থেকে। মাওলানা আবু ওয়াহাব নজদী, যিনি কিনা ১৭০৩ খ্রীস্টাব্দে বর্তমান সৌদি আরবের নজদ প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ২২ শে জুন ১৯৭২ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত লোহিত সাগরের তীরবর্তী আরব উপদ্বীপের সকল দেশে তার মতাদর্শ ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। বর্তমান সৌদিআরবে প্রতিষ্ঠিত রাজ বংশের সহযোগীতায় তার মতাদর্শ রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রহণ করা হয়েছিল এবং আজ অবধি সেভাবেই আছে। বর্তমান সৌদি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ আব্দুল আজিজের পিতা ইবনে সৌদের সঙ্গে তিনি আত্মীয়তা বন্ধন গড়ে তোলেন। উত্তর আরবের নজদ প্রদেশ সাকিনা আজকের সৌদি রাজধানী রিয়াদের কাছাকাছি ছিল এবং বিভিন্ন কারণে যে এলাকা অনাদী কাল থেকে বিতর্কিত সেখানেই ইবনে সৌদ পরিবারের আধিপত্য ছিল। দক্ষিণ আরব তথা মক্কা মদিনা এবং হাইলে তাদের চিরশত্রু আব্দুর রশিদ দস্তামের পরিবার যুগ যুগ ধরে শাসন করে আসছিল। মুসলমানদের সুদীর্ঘ ইতিহাসের প্রায় ১২০০ শত বছর ধরে ধর্মীয় নানা বিষয়ে উত্থাপিত বিতর্ক সমূহ নিষ্পত্তি হতো কোরআন,হাদিস,ইজমা ও কিয়াসের মাধ্যমে। যে সকল ধর্মবেত্তা গাউস কুতুব, অলি আল্লাহ এসব মীমাংসা করতেন তারা সকলেই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত এর অনুসারী বলে স্বীকৃত ছিলেন। এই মতাদর্শকে উপেক্ষা করে আবু ওয়াহাব নজদী যে নতুন মতবাদ চালু করলেন তা অতি অল্পকালের মধ্যেই আরব উপদ্বীপে ব্যাপক সাড়া ফেলল। বিশেষত নজদ প্রদেশে এই ভাবধারার অনুসারীরা এতই শক্তিকে রাজনীতিতে ব্যবহার করা শুরু করলেন। ১৭৪৪ সালে আব্দুল ওয়াহাব নজদীর সঙ্গে ইবনে সৌদের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এটি ছিল ধর্মীয় ও রাজসিক শক্তি ভাগাভাগি করে সমঝোতা। সে মতে, আব্দুল ওয়াহাবের সমর্থকরা ইবনে সৌদের প্রতিদ্বন্দ্বী এলাকায় ঢুকে পড়তো ধর্মের আচ্ছাদনে এবং সময়মতো রাজনৈতিক আক্রমণ করে বসতো। তাদের এই যুগপৎ আক্রমণের কারণে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ওহাবী মতবাদ ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। অন্যদিকে প্রতিটি জনপদে ইবনে সৌদদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হতে থাকে।
এবার আমি আবু ওয়াহাব নজদী এবং তার দর্শন সম্পর্কে কিছু বলছি, প্রথমত তিনি আরবের ঐতিহ্যবাহী অভিজাত বেদুইন পরিবারে জন্মগ্রহণ করে। তার গোষ্ঠীগত শক্তি ছিল প্রবল। অধিকন্ত তিনি ছিলেন সমসাময়িককালের অন্যতম লেখাপড়া জানা পন্ডিত ব্যক্তি। তার বংশ বনু তামিম গোত্র এবং তার গ্রাম উয়াইনা সমগ্র নজদ অঞ্চলে বিভিন্ন কারণে প্রসিদ্ধ লাভ করেছিল। তৎকালীন আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হানবালি স্কুল অব জুরিসপ্রুডেন্স থেকে তিনি শিক্ষা লাভ করেন হানবালি মুফতি ইবনে হামাদি। মদিনার বিখ্যাত মুহাদ্দিস মুহাম্মদ হায়াত আল সিন্ধির নিকট থেকেও তিনি বিদ্যা লাভ করেন। আরব উপদ্বীপ ছাড়াও তিনি ইরাক, ইরান ভ্রমণ করেন এবং ইরাকের বসরা নগরীর সবচেয়ে অভিজাত এবং ধনাঢ্য মহিলাকে বিয়ে করেন। কিতাব আত তোহিদ, ফাদাইল আল কোরআন সহ মোট ১৫ টি গ্রন্থ রচনা করেন।
আবু ওয়াহাব নজদী সম্পর্কে বিস্তারিত বলার মূল কারণ হলো তার দর্শণ সম্পর্কে একটি ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা। আমি বলতে চাচ্ছি সমসাময়িক শিক্ষা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তির সমন্বিত উদ্যোগে তিনি অতি সতর্কতার সঙ্গেই তার মতাদর্শ রচনা করেছিলেন। ইসলামের মূল আকিদা হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস ও আনুগত্য। আমাদের প্রথম ও প্রধান কালিমার ভাষ্য কিন্তু তাই বলে। অর্থাৎ সৃষ্টি জগৎ যতদিন থাকবে ততদিন পর্যন্ত রাসূলের (সাঃ) শ্রেষ্ঠত্ব, মহত্ব এবং আদর্শ স্বীকার করতে হবে। একই সঙ্গে রাসূলের (সাঃ) বংশধর (আহাল বাইত) ও তাঁর সাহাবীগণ সম্পর্কে কোনো কটুক্তি করা যাবে না এবং তাদের সম্পর্কে বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ ধারণা পোষণ করতে হবে। আবু ওয়াহাব নজদী মুসলমানদের বিশ্বাস ও আক্বীদার মূল জায়গাতেই আঘাত করলেন সংস্কার নাম দিয়ে। তার মতে, হুজুর (সাঃ) কেবল একজন সাধারণ মানুষ ছিলেন। আমাদের সঙ্গে তার কেবলমাত্র একটিই পার্থক্য- আর তা হলো, তিনি ওহী প্রাপ্ত হয়েছিলেন। বিভিন্ন জনসভায় আবু ওয়াহাব নজদী নিজরে হাতের লাঠিটি দেখিয়ে বলতেন যে, ‘আমার হাতের এই লাঠিটির যে ক্ষমতা রয়েছে, মৃত মুহাম্মদ (সাঃ) এর সেই ক্ষমতা নেই। তিনি সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কেও বিরূপ মন্তব্য করতেন। রাষ্ট্রশক্তির দূরন্ত প্রতাপে তার সমর্থকরা সারা আরব উপদ্বীপ জুড়ে শুরু করে ভয়াবহ তান্ডব। সাহাবাগণের কবর ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়। তাদের আক্রমণ থেকে হযরত ফাতেমা (রাঃ) -এর কবরও রক্ষা পায় নি। এভাবে ইসলামের মূল আক্বীদা থেকে বের হয়ে সৌদি আরবের মুসলমানরা আল্লাহ এবং তার রাসূল (সাঃ) এর পরিবর্তে রাষ্ট্রশক্তিকেইবড় প্রতিভূ মনে করে।
বৃটিশ ভারতে অনেক মুসলমান নেতৃবৃন্দ ওয়াহাবী মতাদর্শে দীক্ষিত হলেও কেউই এটিকে রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করতে পারেন নি কেবলমাত্র মাওলানা আবুল আলা মওদূদী ব্যতিরেকে। ১৯০৩ সালে ভারতের হায়দারাবাদ রাজ্যের আওরঙ্গবাদ নামক স্থানে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। প্রথমে মাদ্রাসা-ই-ফোরকানীয়াতে পড়াশুনা শেষ করে হায়দারাবাবাদের দারুল উলুমে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি জনাব মওদূদী তার কর্মজীবন শুরু করেছিলেন সাংবাদিকতার মাধ্যমে। তিনি মদীনা বাজনুর এবং আল জামীয়া দিল্লী পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। পেশা উপলক্ষ্যে তিনি উচ্চপদস্থ বৃটিশ রাজপুরুষদের সান্নিধ্য পান। এবং রাষ্ট্রশক্তির সহায়তায় (কিংস পার্টি) একটি রাজনৈতিক দল গঠন করার পরিকল্পনা করেন। তিনি ইন্দো-মার্কিন সহায়তায় এবং সৌদি সরকারের মদদপুষ্ট হয়ে ওয়াহাবী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৪১ সালে জামায়াতে ইসলামী নামক দলটি প্রতিষ্ঠা করেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, জনাব মওদূদীর বাবা পাক-ভারত উপমহাদেশের ইসলামী মতাদর্শ চিশতিয়া তরিকার ( খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি রহ. এর অনুসারী) পীর ছিলেন। শৈশব পর্যায়ে তিনি চিশতিয়া তরিকার শিক্ষায় বড় হচ্ছিলেন। ইসলামের মূল আক্বীদা অর্থ্যাৎ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অনুসারী ছিলেন। কিন্তু, পরিণত বয়সে কেবলমাত্র রাষ্ট্রশক্তি লাভের আশায় ওয়াহাবী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তার এই তৎপরতার পেছনে ছিল ইন্দো-মার্কিন ও সৌদি সরকারের আকুণ্ঠ সমর্থন এবং অঢেল অর্থ বিনিয়োগ। তৎকালীন বৃটিশ সরকার অকাতরে অর্থ বিনিয়োগ করেছে মুসলিম লীগকে বিপর্যস্ত করার জন্য। এভাবেই চলছিল দেশভাগের পূর্ব পর্যন্ত। মাওলানা মওদূদী তার শিক্ষা, প্রচন্ড সাংগঠনিক ক্ষমতা এবং অঢেল অর্থবলে পাকিস্তানের সিন্ধু, বেলুচিস্তান, পূর্ব বাংলা, হায়দারাবাদে শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলেন। দেশভাগের পর তিনি বৃটিশদের পরামর্শমতো ১৯৪৮ সালে ভারত থেকে পাকিস্তানে আগমন করেন।
পাকিস্তানে এসেই তিনি শুরু করেন তান্ডব। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তখন গভ: জেনারেল। কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম ঘোষণার দাবীতে তিনি যে জাতিগত দাঙ্গা বা সহিংসতা শুরু করেন তাতে প্রায় সোয়া লক্ষ কাদিয়ানী মতাদর্শের মানুষ খুন হয়। নব্য পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষে এই আঘাত সহ্য করা বড়ই কঠিন ছিল। তার মৃত্যু হয় ২২ শে সেপ্টেম্বর ১৯৭৯ সালে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের বফেলো নামক স্থানে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রতিটি সরকারের উপর ছিল তার অসীম প্রভাব এবং প্রতিটি সরকারের পতন হয়েছে তারই জন্য। জনাব মওদূদীর দর্শনের অন্যতম কয়েকটি মৌল ভিত্তি হলো:-
১.রাষ্ট্রীয়ভাবেশরীয়াহ আইনের বাস্তবায়ন ছাড়া মুসলিম রাষ্ট্র হতে পারে না।
২.রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ইসলামিক হতে হবে।
৩.মুসলমান রাষ্ট্র অমুসলিমদেরকে সীমিত আকারে অধিকার প্রদান করা হবে।
৪.ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে জিহাদ করতে হবে।
৫.নিজ দেশে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে একই ব্যবস্থা চালুর জন্য জেহাদ করতে হবে অথবা জেহাদে মদদ দিতে হবে।
আধুনিক বিশ্বের গণতন্ত্রকে যেভাবে সজ্ঞায়িত করা হয়েছে কিংবা দেশে দেশে যেভাবে গণতন্ত্র বাস্তবায়িত হচ্ছে তা জনাব মওদূদীর দর্শনের সম্পূর্ণ বিপরীত। কিন্তু তিনি সম্পূর্ণ সজ্ঞানে তার এই বিপরীত এবং প্রথা বিরুদ্ধ মতবাদকে বাস্তবায়ন করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। তার রাজনৈতিক দর্শন বাস্তবায়নের প্রধান কৌশল ছিল শৈশব থেকেই কর্মী বাছাই। সমাজের জনপ্রিয় এবং উল্লেখযোগ্য লোকদেরকে নিজের দলে ভেড়ানো এবং নিদেনপক্ষে জামাত সম্পর্কে যেন ভালো ধারণা পোষন করে সেই ব্যবস্থা করা। সর্বশেষ বিষয়টি হলো- সামর্থ্যবান জামাত কর্মীদের নিকট থেকে নিয়মিত অর্থ আদায় এবং তা দলের অভাবী কর্মীদের মধ্যে নিয়মিতভাবে বিতরণ। গত ৭০ বছর ধরে এভাবেই চলছে এবং যে যাই বলুক না কেনো, আজ পৃথিবীর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জামাতেরই রয়েছে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক ভিত্তি।
এবার আমি বাংলাদেশের জামাত সম্পর্কে কিছু বলছি, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্ব থেকে এদেশে জামাতের শক্তিশালী সংগঠন ছিল। ১৯৪৯ সালের দিকে অধ্যাপক গোলাম আজম যখন ছাত্র তখন তিনি জামাতে যোগদান করেন। তার জামাতে যোগদানের বিষয়টি কোনো আদর্শিক বিষয় ছিল না। কেবল অর্থনৈতিক কারণেই তিনি জামাতে যোগ দিয়েছিলেন বলে আমি শুনেছি। শুনেছি, কয়েকজন প্রতিথযশা বিখ্যাত ব্যক্তিদের নিকট থেকে। ভাষা আন্দোলনের প্রাণপুরুষ এবং তমদ্দুন মজলিশের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম আমাকে ঘটনাটি বলেছিলেন তার মৃত্যুর কয়েক বছর আগে। বাংলাদেশের সাংবাদিকতার আরেক লিজেন্ড প্রখ্যাত ভাষাসৈনিক অধ্যাপক আব্দুল গফুরও আমাকে প্রায় একই কথা বলেছিলেন- গ্রাম থেকে জনাব গোলাম আজম যখন ঢাকায় এলেন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন। তখন তার পরিবারে নিদারুণ অর্থ কষ্ট ছিল। প্রথম দিকে তিনি নিয়মিতভাবে তমুদ্দুন মজলিশে আসতেন এবং একনিষ্ঠভাবে কাজ করতেন। কয়েকদিন পর তনি প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম, অধ্যাপক শাহেদ আলীসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে প্রস্তাব করলেন যে, তিনি সার্বক্ষণিকভাবেতমুদ্দুন মজলিশে কাজ করতে চান। এবং এজন্য তিনি একটি মাসিক মাসোহারা দাবি করলেন। খুব সম্ভবত প্রতিমাসে ৩০ টাকা। এটি ছিল ১৯৮৮ সালের মাঝামাঝি সময়। তমুদ্দুন মজলিশ মূলত একটি অরাজনৈতিক সাংস্কৃতিক সংগঠন ছিল। মুসলমানদের তাহজিব তমুদ্দুন তথা সংস্কৃতির বিকাশ তথা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি নিয়ে কাজ করছিল। সাপ্তাহিক সৈনিক নামের একটি পত্রিকা তারা নিয়মিত প্রকাশ করতো। এবং ঐ সময়ে ‘সৈনিক’ই ছিল জনপ্রিয় পত্রিকা। তারপরও সংগঠনটির অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল ছিলনা। কারণ তারা গোলাম আজমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। এর কিছুদিন পরই জামায়াতে ইসলামী নামের দলটিতে যোগদান করেন। সম্ভবত মাসিক ভাতা ছিলো ৫০ টাকা। অধ্যাপক গোলাম আজমকে সেভাবে রিক্রুট করা হয়েছিল। একইভাবে জামায়াতে ইসলামীর লক্ষ লক্ষ কর্মী মাসিক মাসোহারা ভিত্তিতে সারাদেশে কাজ করছে।
১৯৭৪ থেকে ৭৫ সালের দিকে। যখন আমি খুব ছোট এবং প্রাইমারি স্কুলে যেতাম । তখন দেখতাম দাড়ি টুপি পরা ৩০-৪০ বছরের সৌম্য দর্শন কিছু লোক আমাদের স্কুলে আসত। তারা শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলত। এরপর কিছু লোক আমাদের স্কুলে আসত। তারা শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলত। এরপর ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণীর ছেলেদের সঙ্গে আলাদা মিটিং করতো। আবছা আবছা যতটুকু মনে করতে পরছি তা হলো, নামাজ পড়তে হবে। শিবির করতে হবে এবং বেহেশতে যেতে হবে। ইত্যাদি। ঐ সময় দেখতাম অসংখ্য পোস্টার দিয়ে আমার জম্মস্থান অর্থাৎ সদরপুর উপজেলার সকল হাঁট বাজার রঙ্গিন করে ফেলা হয়েছে। পোস্টারে লেখা থাকতো অধ্যাপক গোলাম আজমের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দাও। আমাদের এলাকায় আলতাফ মিয়া নামে জামায়াতের একজন স্থানীয় নেতা ছিলেন। তিনি মূলত সরকারি কর্মচারী ছিলেন। কাজ করতেন উপজেলা হেল্থ কমপ্লেক্সে। (তৎকালীন সময়ে থানা হাসপাতাল।) সেই ১৯৭৪-৭৫ সালে। সাইকেলে করে তিনি দিনরাত গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়াতেন। তার সাইকেলটি ছিল নতুন ও চকচকে। আমরা তার সাইকেল ও দাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতাম। সাঈদী সাহেবের মতো আলতাফ মিয়াও দাড়িতে খেজাব (রং) লাগাতেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্টের নির্মম হত্যাকান্ডের পর আলতাফ মিয়ার গতিবিধি আরও বেড়ে গেল। তিনি সাইকেলের পরিবর্তে চকচকে নতুন মটর সাইকেল পেলেন। আমাদের পুরো সদরপুর থানায় ঐ একটাই মটর সাইকেল ছিল। আমরা ছিলে পুলিরা তার মটর সাইকেলের পেছনে দৌঁড়াতাম । মটর সাইকেলের ধোঁয়া আমাদের বড়ই ভালো লাগতো। আমরা খিল খিল করে হাসতাম এবং ১০/১২ জন দল বেঁধে অনেকক্ষণ আলতাফ মিয়ার মটর সাইকেলের ধোঁয়া খাওয়ার জন্য দৌঁড়াতাম। এরই মধ্যে ১৯৭৬ সালের কোনো একদিন মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী দরপুরে ওয়াজ করতে এলেন।
স্বাধীনতার পর গত ৪০ বছরে জামাত নামক দলটি অত্যন্ত সুকৌশলে সারা দেশে লক্ষ লক্ষ কর্মী সৃষ্টি করেছে। এদের মধ্যে যেমন সাধারন খেটে খাওয়া মানুষ রয়েছে। তেমনি রয়েছে দেলোয়ার হোসেন সাঈদী ও শাহ আব্দুল হান্নানের মতো লোক। জামায়াতের সারা দেশের কর্মীরা একটি বিশ্বাস ও আদর্শের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ। তাদের এই বিশ্বাস ও আদর্শ প্রচলিত গণতন্ত্র এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ। কিন্তু এর ভয়াবহ দিক সর্ম্পকে আমরা খুব অল্প থেকেই জানি। জনাব সাঈদী এবং তার শত শত শিষ্য সামন্ত সুললিত কন্ঠে ওয়াজ ও তফসিরের নামে কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ সাধারণ মুসলিমকে ভারত বিদ্রোহী করে তুলেছে। তারা বর্তমান শাসক ও সরকার পদ্ধতি সর্ম্পকে সীমাহীন অপপ্রচার চালিয়ে আসছে। আমি, আমার পাঠক এবং মাননীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে অনুরোধ করবো ১৯৯৭ ও ১৯৯৮ সালে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত সাঈদী সাহেবের তাফসির মাহফিলের সিডি সংগ্রহ করে শোনার জন্য। ধর্মের নামে কিভাবে এতে সাম্প্রদায়িকতা উষ্কে দেয়া হয়েছে। কিভাবে ভারত বিদ্বেষী উস্কানীমূলক বক্তব্য দেয়া হয়েছে। এবং কিভাবে সরকার তথা রাষ্ট্রকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে মানুষকে বিদ্রোহ তথা জেহাদে প্রলুব্ধ করা হয়েছে তা বর্ণনা করার ভাষা আমার জানা নেই।
এবার পাদটিকায় শিরোনাম প্রসঙ্গে আসি। জামাত মনে করে একমাত্র তারাই এদেশে শাসন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে। আর সবাই জুলুম করছে। জুলুমকালীন এই সময়টাকে তারা ইন্তেহান বা আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা মনে করে। এজন্য তারা একটি ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ধৈর্য্য সহকারে দীর্ঘকাল অপেক্ষা করার জন্য প্রশিক্ষণ পেয়েছে। প্রশিক্ষণ পেয়েছে জিহাদ করার জন্য এবং প্রয়োজনে মৃত্যু বরণ করে শহীদ হওয়ার জন্য। জামাতের নেতৃবৃন্দরা জানেন সরকারী দপ্তরে তাদের কতজন কর্মী রয়েছে। তারা এও জানেন পুলিশ বিভাগে তাদের কতজন কর্মী রয়েছে। তাদের পদ কি, পদবি কি এবং বর্তমানে কোথায় পোস্টিং ইত্যাদি সকল তথ্যই তাদের জানা। অন্যদিকে আমি হলফ করে বলতে পারি যে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানেন না কয়জন বঙ্গবন্ধুর সৈনিক পুলিশে আছেন!
কাজেই জামাত দমন ও নির্মূল করার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হুমকিতে জামাত নেতারা দাঁত বের করে হাসেন। যেদিন মন্ত্রী হুমকী দেন সে দিনই বিপুল বিক্ষোভ নিয়ে পুলিশের প্রতি আক্রমণ করে বসে। কাজেই মন্ত্রীকে ইনসাফ এবং ইন্তেহান শিক্ষা নিয়ে তার আশে পাশে কর্মরত সত্যিকার বঙ্গবন্ধু প্রেমিক-কর্মকর্তাদের খুঁজে নিতে হবে। এবং যোগ্য ব্যক্তিকে যোগ্যস্থানে বসাতে হবে।
লেখক : সংসদ সদস্য ও সম্পাদক ডিফারেন্ট নিউজ
২| ১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ২:১৭
ইফতেখার ভূইয়া বলেছেন: ভাই ধৈয্যচ্যুত হয়ে গেল। পড়া শেষ হইলোনা। কপি পেস্ট করছেন না টাইপ?
৩| ১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ২:৩২
নিষ্কর্মা বলেছেন: রনি ভাইয়ের বিশ্লেষন চমৎকার।
৪| ১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ২:৩৩
সরোজ রিক্ত বলেছেন: খুব মনোযোগ দিয়ে পড়লাম। অনেক ভাল লাগলো।
৫| ১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ২:৪৩
আব্দুর রহ্মান বলেছেন: অসাধারন
৬| ১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সকাল ১০:৪০
মোঃ ওমর শরীফ বলেছেন: এত বড় লেখা।
৭| ১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সকাল ১১:৩২
Engr. Atiqur Rahman বলেছেন: অনেক সুন্দর লেখা, পুরো লেখাটাই পরলাম।
গো-আ এর তমুদ্দুন মজলিশ যোগদানের সময় মনেহয় এডিট করতে হবে,
১৯৮৮ কে ১৯৪৮ এ রিপ্লেস হবে।
ধন্যবাদ।+++++++++++++++++++++++++++
©somewhere in net ltd.
১|
১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ২:০৭
নীলকন্ঠ নিলু বলেছেন: " কাজেই মন্ত্রীকে ইনসাফ এবং ইন্তেহান শিক্ষা নিয়ে তার আশে পাশে কর্মরত
সত্যিকার বঙ্গবন্ধু প্রেমিক-কর্মকর্তাদের খুঁজে নিতে হবে।"
ফিচার লেখককে আমার বিনীত প্রশ্ন ঃ
বঙ্গবন্ধুর সব প্রেমিকরাই কি দেশ প্রেমিক?
বঙ্গবন্ধুর প্রেমিক কি মোস্তাক, না তাজুদ্দিন?
মোস্তাক, মান্নান, তাহের ঠাকুর, মোমেন এরাও বঙ্গবন্ধুর প্রেমিক ছিল,
কিন্তু দেশপ্রেমিক ছিল না। তাই আগামীতে বঙ্গবন্ধুর প্রেমিক নয়, প্রকৃত দেশপ্রেমিকরাই রাষ্ট্র পরিচালনা করবে।