নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

দ্য েস্লভ

দ্য েস্লভ › বিস্তারিত পোস্টঃ

এই দিনে পিতৃহারা হলাম

১৮ ই মে, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:২৭









আমার ছোটবেলার স্মৃতিচারনে আমি আমার পিতাকে বাঘের সাথে তুলনা করেছি। তিনি রাগী ছিলেন তবে বদরাগী নন। তার জিদ ছিল প্রবল। বিনা কারনে বা সামান্য কারনে রেগে গেছেন এটা কখনই দেখিনি। তিনি ধৈর্য্যশীল ছিলেন কিন্তু অন্যায় সহ্য করতেন না। তিনি ছিলেন সেই সকল লোকের মত যারা সৎ কাজে আদেশ এবং অসৎকাজে নিষেধ করতে কোনো কিছুর তোয়াক্কা করেনা। আমি দেখেছি যে সকল মানুষের ভয়ে অন্যরা তটস্থ থাকে সে সকল লোকদের অন্যায়ে তিনি তাদের মুখের সামনে প্রতিবাদ করেছেন,কৈফিয়ৎ নিয়েছেন এবং হুমকীও দিয়েছেন। কখনও কখনও তার আচরনে বাড়াবাড়ি মনে হলেও তিনি সত্যের পথে থেকে কাজগুলো করেছেন। তিনি অন্যায় করেননি তা নয়। তবে তার অনেক কাজ সত্যিই প্রশংসার দাবীদার।



তিনি গরিব,অসহায় মানুষদেরকে কখনই খালি হাতে ফেরাতেন না। ভিক্ষুকদেরকে পরিমানে বেশী ভিক্ষা দিতেন আর তাদেরকে সৎ উপদেশও দিতেন। অভাবী বা মিসকিনদের সহযোগীতার জন্যে তিনি অন্যদেরকে উপদেশ অথবা আদেশ দিতেন। তিনি তার কথামালার মাধ্যমে অন্যকে তেমন একটা মোটিভেট করতেন বলে দেখিনি। তার কথা আর কাজে আদেশ,নিষেধ,উপদেশের আধিক্য ছিল। কিন্তু তার আশপাশে মানুষ থাকত সর্বদা। তারা ছিল নিবেদিতপ্রাণ। আমার ধারনা মানুষ তার কাজের কারনে তাকে পছন্দ করত। তবে অনেকের মাঝে তাকে অনেক গল্প করতে দেখেছি। তার মধ্যে রসবোধও ছিল যথেষ্ট। রসবোধ না থাকলে তার আশপাশে মানুষ তেমন একটা থাকেনা। হুইল দিয়ে মৎস্য শিকার ছিল তার নেশা। একাজে তিনি অনেককে সাথে নিতেন এবং সর্বদা উৎস্যবমুখর পরিবেশে বিভিন্নস্থানে মৎস্য শিকার চলত।



তিনি ছিলেন ওয়াদা পালনে অনন্ন। কখনও কাওকে কোনো কথা দিলে তা তিনি রক্ষা করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতেন। ওয়াদা রক্ষা করা তার মর্যাদার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল। ওয়াদা খেলাপকারীর কোনো মর্যাদা নেই বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। কোনো মানুষের কারনে যদি তার ওয়াদা পালন করা সম্ভবপর না হত,তাহলে তার একহাত তিনি দেখে নিতেন। কারন সে তাকে অপমানিত করেছে। আমার পিতার যে গুনটি আমাকে মুগ্ধ করে,তা হল তিনি স্পষ্টভাষী। আমি লোকলজ্জার কারনে অনেক কিছু বলতে পারতাম না যদিও তা বলা উচিৎ। সেসব ক্ষেত্রে আমার পিতা ব্যতিক্রম। তিনি উচিৎ কথা স্পষ্ট করে বলে দিতেন,তাতে কে কি ভাবল এতে মোটেও চিন্তা করতেন না। আর মানুষ তাকে তার উন্নত ব্যক্তিত্যের কারনে সম্মান করত,একারনে তার কথার ওপর কথা বলার লোকের সংখ্যাও ছিল নগন্য। তিনি কাওকে ভয় করে কথা বলতেন না।



একবার এক রাজনৈতিক নেতা তাকে হত্যার জন্যে সন্ত্রাসী গ্র“প ভাড়া করেছে বলে জানতে পারলেন। তারপর সে নেতাকে একদিন তার সাগরেদদের সামনে জিজ্ঞেস করলেন(এটা সম্ভবত ১৯৯২/৯৩ সাল হবে), সন্ত্রাসীদেরকে কতটাকা দিয়েছ ? শুনলাম দু-লাখে বন্দোবস্ত হয়েছে। আমি কিছু লোককে চিনি যারা এর অর্ধেক টাকা নিয়েই কাজ সারে। আমার অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল যাচ্ছেনা। অর্ধেক টাকা আমাকে দিলে তো মরার পূর্বে বেশ কটা দিন ভালভাবে চলত। নেতা বিভিন্নভাবে কসম কেটে পুরো বিষয়টা অস্বীকার করলেন। এর কয়েকদিন পর আমি আর আমার ভাই ওপরের তলায় ঘুমাচ্ছিলাম। গভীর রাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল এবং শুনলাম জানালার পাশের নারকেল গাছে কেউ দা দিয়ে কোপ মারল। আমরা দুজনেই এরপর উঠলাম এবং দেখলাম একটা কালো হাত জানালার পাশ থেকে সরে গেল। সেসময়ে আমি অনেক ছোট ছিলাম তাই বুঝতে পারলাম না এটা কি। ভাই বলল এটা চোর। কিন্তু সে ঠিকই বুঝল ঘটনা কি। ...... পরে আমার আব্বা কিছু ব্যবস্থা নেয় এবং এ ঝামেলা মিটে যায়।



আমি যখন তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি তখন একবার একটা ঘটনা ঘটেছিল। একরাতে আমি,মা আর আমার চার বছরের বড় বোন একসাথে ঘুমাচ্ছিলাম। গভীর রাতে বাড়ির পেছনে অনেকগুলো মানুষের পায়ের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমার মা বলে উঠল-কিসের শব্দ এটা ? সে সময়ে আমাদের বাড়ির পেছনের পাশটায় পাচিল দেয়া ছিলনা,শুধু সামনের অংশে ছিল। আমার পিতা কখনই মনে করেননি যে,কেউ তাকে হুমকি বা ক্ষতি করার সাহস পাবে। সকলে তাকে সম্মান অথবা ভয় করত। কিছুক্ষন পর একদল লোক বড় গাছের কান্ড দিয়ে দরজায় প্রচন্ড আঘাত করল দুবার। দ্বিতীয় বারে দরজা ভেঙ্গে গেল। আমার আব্বা প্রস্তুতির কোনো সময়ই পেলেন না। অন্তত বিশ জন লোক ঘরে ঢুকে পড়ল এবং তারা রড দিয়ে আমার আব্বাকে পেটাতে থাকল। আমরা ছিলাম পাশের ঘরে। ভেতর দিয়ে আব্বার ঘরে ঢোকার জন্যে আরেকটা দরজা ছিল। গ্রামে দরজা লাগানো হত চৌকো শক্ত কাঠ দিয়ে। এটাকে আমরা হাক বলতাম। আমি আমার মা,বোনকে বললাম আমার পেছনে যাও,এভাবে হবেনা, এই বলে আমি সেই হাক মাথার ওপর তুলে বললাম-“এই তোদেরকে মেরে ফেলব,আমার আব্বাকে ছেড়ে দে এক্ষুনি।” হাক আমার হাতের তুলনায় বেশ মোটা ছিল,আমি সেটা ঠিকমত ধরতেও পারিনি। আমার মা হাতথেকে হাকটা কেড়ে নিল। তারা আমার দিকে তাকালো। সেসময় আমি কোনো কিছুর পরিনতি বুঝতাম না। তারা আমাকে কিছু বলল না।



তারা আমার আব্বাকে প্রচন্ড রকম পেটাতে থাকল। একজন রিভলবার বের করে দাড়িয়ে ছিল। আমার আব্বা তাদেরকে আলমারির চাবী দিয়ে দিল এবং তাকে না পেটাতে অনুরোধ করল। তাদেরকে সব টাকা পয়সা,গহনা নিয়ে যেতে বলল। কিন্তু তারা পেটানো থামালো না। তবে আলমারী খুলে টাকা পয়সা,গহনা নিল কিছু লোক। এবার তারা আমাদের ঘরে ঢুকে পড়ল। আমার আব্বা সে সময়েও আমাদের ব্যাপারে চিন্তিত হলেন এবং উচ্চস্বরে বললেন,ওদেরকে কেউ কিছু বলবে না। আমাকে যা খুশি কর।



সম্ভবত চারজন আমাদের ঘরে ঢুকল এবং কোথাও কোনো সম্পদ আছে কিনা খুজতে থাকল। আমার মাকে জিজ্ঞেস করল আরও কি আছে ? তিনি বললেন, যা ছিল সব নিয়েছ, চেক করে দ্যাখ কিছু আছে কিনা। তারা সবকিছু নছনছ করে খুঁজতে থাকল। এ সময়ে একজনের গামছার মুখোশ খুলে গেলে আমি তার চেহারা দেখি। সে লোকটিকে আমি পূর্বে কখনও আমাদের গ্রামে দেখেছি বলে মনে হল। এ ধারনা অবশ্য তখন করিনি। পরবর্তীতে তার চেহারা মনে রেখে ভাবতে ভাবতে এটা খেয়াল করি।



আমি সুযোগ বুঝে তাদের ফাঁক দিয়ে বাইরে বের হয়ে আসি এবং বাড়ির পেছনে অবস্থিত আমার ফুফার বাড়ি যাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু আমি দেখলাম বাড়ির বিভিন্ন কোনায় স্বশস্ত্র লোক দাড়িয়ে আছে। তারা আমাকে সোজা বাড়ির ভেতর ঢুকতে বলল। আমি বাড়ির ভেতর ঢুকে দেখলাম একজন চিকন ধরনের লোককে এক লাঠির বাড়ি দিয়ে উঠানে ফেলে দিল। তিনি উঠে দৌড়ে পালালেন। মূলত তিনি ছিলেন আমার ফুফা যিনি বাড়ির ভেতর হাঙ্গামা বুঝে দেখতে এসেছিনে। তিনি ভেবেছিলেন আব্বা আমার ভাইকে ধরে পেটাচ্ছে। কারন আব্বা আমার ভাইকে বিভিন্ন অপরাধে প্রতিনিয়ত পেটাত এবং তখন আশপাশের লোক এসে তাকে উদ্ধার করত।



আমি যখন বাড়ির উঠোনে তখন একটা বিরাট শব্দে বাড়ি কেপে উঠল। এরপর আমার ফুফা তার বাড়িতে গিয়ে বন্দুক দিয়ে কয়েকটা ফাকা ফায়ার করলেন। সন্ত্রাসীরা তাদের কাজও এসময়ে সেরে ফেলেছে। গুলির শব্দে তারা পালিয়ে গেল। আমার ভাই সে সময়ে কোথায় ছিল তা মনে করতে পারছিনা। তবে সম্ভবত সে রাতে সে বৈঠকখানায় ঘুমিয়েছিল এবং বোমা বিস্ফোরনের শব্দে উঠে যায়। আমি ঘরের ভেতর প্রবেশ করতে চাইলাম। কিন্তু প্রচন্ড কালো ধোয়ায় ঘর ভরে ছিল। আমি তারপরও প্রবেশ করলাম। দেখলাম আমার আব্বা খাটের নীচে মাথা খানিকটা ঢুকিয়ে পড়ে আছে। পুরো মেঝেতে রক্তের বন্যা। প্রচন্ড ধোয়ার কারনে কোনো কিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। আমি আমার আব্বার পা ধরে টান দিলাম কিন্তু তিনি খুব ভারী লোক ছিলেন তাই তাকে নড়াতে পারলাম না। দেখলাম আমার মায়ের দু-হাতে বোমার স্পি­ন্টার ঢুকেছে এবং আমার বোনের ওপরের ঠোটে একটি ঢুকেছে।



আমার আব্বাকে রড দিয়ে পচন্ড পেটানোর এক পর্যায়ে তারা রিভলবার দিয়ে গুলি ছুড়ে কিন্তু সেটা আকশ্মিকভাবে বিকল হয়ে যাওয়াতে গুলি বের হয়নি। এরপর দরজার কাছ থেকে তার দিকে একজন শক্তিশালী হাত বোমা ছুড়ে দিলে তিনি তা ক্যাচ ধরে খাটের ওপর ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেন অর্থাৎ আমার মা,বোন যেদিকে ছিল তার বিপরীত দিকে ,কিন্তু বোমাটি বিস্ফোরিত হলে তিনি দ্রুত খাটের নীচে চলে যেতে পারেননি। তার বড় দেহটি সেখানে ঢুকতও না। তার হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুল উড়ে গেল এবং অন্যটা ক্ষতিগ্রস্ত হল। বোমাটি তার দেহে বিস্ফোরিত হলে তিনিসহ আমার মা,বোন উড়ে যেত। এরপর অনেক তোলপাড় হয়েছিল। .......



আমার পিতার জীবন ছিল চম উত্থান পতনের। ছোটবেলায় স্কুল ফাঁকি দিতেন এবং আমার দাদী ছিল ভীষণ কড়া মেজাজের। দাদীর হাতে তিনি প্রতিনিয়ত মাইর খেতেন। আমার দাদা ছিল চরম শান্ত স্বভাবের। ক্লাশ ফাইভে পড়ার সময় স্কুলের শিক্ষকের মাথা ফাটিয়ে তিনি স্কুল ও দাদীর কাছ থেকে পালিয়ে যান। তার কোনো খোঁজ ছিলনা। পরে জানা গেল একটি স্থানে তিনি আস্তানা গেড়েছেন। সেখান থেকে পড়াশুনা করলেন। আর ইতিহাস সৃষ্টিকরা সব ঘটনার জন্ম দিলেন।



তিনি ছিলেন প্রচন্ড ডানপিঠে এবং স্বাধীনচেতা। গৃহশিক্ষকের সাথে নদীতে গোসল করতে গেলে ঘাটে বাধা নৌকা খুলে নিয়ে মাঝ নদীতে নৌকা চালাতেন। মাস্টার মশাই শত অনুনয় বিনয় করলেও তিনি বিকেলের আগে ঘাটে ভিড়তেন না। তার সম্পর্কে বিভিন্ন এলাকায় অনেক অতি রঞ্জিত গল্পও চালু হয়েছিল। তিনি ঘটনা ঘটাতে পছন্দ করতেন তাই কিছু রটেছিলও। অন্যায়ের প্রতিবাদে তিনি ছোটবেলা থেকেই স্বোচ্চার ছিলেন। কখনও কখনও সেটা বাড়াবাড়ি পর্যায়েও গেছে,এমনকি খুন খারাবীও হয়ে গেছে। নিজেও বহুবার মানুষের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন,মৃত্যুর মুখ থেকে বহুবার বেঁচে ফিরেছেন। পরবর্তীতে তিনি অফিসার হিসেবে পাকিস্থান আর্মীতে যোগদান করেন এবং খুব দ্রুত যোগ্যতার প্রমান দেন। বোধহয় এটাই ছিল তার আসল স্থান। ১৯৬৫ সালে ভারতের বিপক্ষে এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্থানের বিপক্ষে তিনি তার যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখেন।



ধর্মীয় বিধান খুব ভাল না জানলেও তিনি ছিলেন ধার্মিক। তাকে নামাজ কাজা করতে দেখিনি আমি। আর ছোটবেলায় সকালে তার কুরআন তিলাওয়াত শুনে ঘুম ভাঙত। মসজিদ,মাদ্রাসা,এতিমখানার সাথে তার সুসম্পর্ক ছিল। তার জীবনের শেষ দিকে তিনি বাড়ির পাশে একটি মসজিদ নির্মান করেন। সমাজের সকল শ্রেণী তাকে শ্রদ্ধা করত। নিজে ক্ষতি স্বীকার করেও তিনি অন্যের উপকার করেছেন। আইন আদালতে কাছের বা দূরের গ্রামের গরিব মানুষ অহরহ ঠকে যেত,কুটিল লোক কুটিল চালে কাওকে বিপদে ফেললে তারা আমাদের বাড়িতে ছুটে আসত। আমার পিতা তাদেরকে বরাবরই সহযোগীতা করেছে এবং কোনো বিনিময় গ্রহন করেননি। এমনকি গুড়ের ভাড়,মুরগী ইত্যাদী নিয়ে আসলেও তা তিনি গ্রহন করতে রাজি হতেন না। বলতেন,তুমি তোমার বাড়ির লোকদেরকে নিয়ে খাও ওতেই আমি খুশী। গ্রামের বিচার শালিসে তিনি ন্যায় বিচার করতেন এবং আপন-পর বিবেচনা না করেই ফয়সালা করতেন। তার ফয়সালাতে মানুষ খুশী হত এবং কেউ অভিযোগ করত না। চোর ধরা পড়লে পিটিয়ে তাদের কর্মসংস্থানের জন্যেও চেষ্টা করতেন। তিনি অন্যের অধিকারকে প্রাধান্য দিতেন।



পিতা/স্বামী হিসেবে তিনি সফল ছিলেন কিনা এটা প্রশ্ন সাপেক্ষ বিষয় হতে পারে। কারন তিনি আমাদের বিষয়গুলো খুব বেশী মনোযোগ দিয়ে দেখেছেন এমনটা বলা ঠিক হবে না। তিনি হঠাৎ হঠাৎ আমাদের ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতেন। আর নিয়ম কানুন লঙ্ঘিত হলে তিরষ্কার বা পেটানো হত। আদর ভালবাসা ছিলনা তা নয় তবে সেটার প্রকাশ ছিল ভিন্ন। তিনি আদর করে আমাদের ৬ ভাই বোনের কাওকে কাছে বসিয়েছেন সেটা দেখিনি,আমার ছোট বোনটি ছাড়া। আমরা তার কঠোরতা বেশী দেখতে পেতাম,যার কারনে তার সাথে আমাদের দূরত্ব তৈরী হয়েছিল। আমার ক্ষেত্রে সেটা এতটা বেশী ছিল যে,তার মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত তাকে আমি আব্বা সম্বোধন করে ডাকিনি। খুব ছোটবেলায় বোধহয় ডেকেছিলাম। তার ব্যাপারে আমার মধ্যে ভয় কাজ করত আর এ কারনে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। তাকে না ডাকলেও তার সাথে আমার কথা হত। বাড়িতে গেলে তিনি আমাকে ডাকতেন। তখন আমি দরজার আড়ালে গিয়ে দাড়াতাম,যাতে তিনি আমাকে দেখতে না পান। এরপর ওখান থেকেই আমাদের কথা হত। তিনি আমাকে মাঝে মাঝে দেখতে চাইতেন,তার পিতৃত্ববোধ বুঝতে পারলেও লজ্জা,সঙ্কোচ আমাকে বাধা দিত। তিনি আমাকে তখন দেখতেন যখন আমি চলমান। আমি কখনও তাকে বারান্দায় দেখলে তার সামনে দিয়ে ঘরে প্রবেশ করতে লজ্জা পেতাম। এমনকি মূল গেটের থেকে আড়চোখে দেখে নেওয়ার চেষ্টা করতাম তিনি আছেন কিনা। বারান্দায় বসে থাকলে রাস্তায় অপেক্ষা করতাম। তিনি বারান্দায় বসে থাকলে ঘর থেকে বের হতে কুন্ঠিত হতাম। কিছু জিজ্ঞেস করলে চমকে উঠতাম। তিনি জীবনে দুবার আমাকে পিটিয়েছেন সেটাও খুব ছোটবেলায়। তার সাথে দূরত্ব তৈরী হওয়ার ক্ষেত্রে এটা অজুহাত হতে পারেনা কিন্তু আমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক না থাকাটাই এর জন্যে দায়ী। এক্ষেত্রে তাকে পূর্বেই আগ্রহী হওয়া উচিৎ ছিল। অবশ্য তার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমি তাকে প্রচন্ড ভালবাসতাম কিন্তু কখনই তাকে তা বলার সুযোগ হয়নি। তিনি আমাকে অতিরিক্ত পছন্দ করতেন। আমার কোনো গুনের কথা মানুষকে বলে গর্ব অনুভব করতেন। কখনও কখনও আমরা একসাথে বাজার করতে যেতাম,অনেক সময় আমার ভাইও থাকত। কিন্তু আমি আগে কখনই কথা বলতাম না। তিনি শুরু করলে আমি শুধু উত্তর দিতাম। আমি বা আমরা হাটার সময় অবশ্যই তার পেছনে হাটতাম। আমরা কি কথা বলছি তা বোঝার জন্যে তিনি আস্তে হেটে আমাদের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করলে আমরা আরও আস্তে হেটে দূরত্ব বজার রাখতাম। প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া আর কোনো কথা তার সাথে হতনা। শেষের দিকে অবশ্য আমার ভাই তার সাথে খানিক গল্প গুজব করেছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও কিছু জিজ্ঞেস করত। এসব তিনি আবার বেশ গর্বভরে বলতেন। তার সাথে আমাদের তুলনা করে তিনি মাঝে মাঝে খোটাও দিতেন। আমরা বাজার করার পর নিয়ম ছিল বাজারের পাশেই নিশি কান্তের মিস্টির দোকানে সকালে নাস্তা করা এবং তা বাড়ির জন্যেও কিনে আনা। আমরা মূলত মাঝে মাঝে তার সাথে বাজারে যেতাম,নিয়মিত অবশ্যই নয়। আর আমাদেরকে সাথে নিতে চাইলে মায়ের মাধ্যমেই সাধারণত জাননে পারতাম।



আমার আব্বার সকালের পছন্দের খাবার ছিল লুচি,আলুর তরকারী,পরোটা সাথে খাসির নেহারী। দই-চিড়া,রসগোল্লা,পানতোয়া। কখনও কখনও কে কয়টা রসগোল্লা খেতে পারে তার প্রতিযোগীতা হত। আমার আব্বা আমাদের কয়েক জনের সম্মিলিত খাবারের চাইতে বেশী বা সমপরিমান খেতেন। তিনি অন্যকে খাওয়াতে পছন্দ করতেন। আমি অল্প খেলে তিনি বলতেন, না খেলে গায়ে শক্তি হয় ? আরও খা। আমার মনে পড়ছে একটি ঘটনা। তিনি চার কেজী রসগোল্লা একটি বড় গামলায় ঢাললেন,তারপর আমাকে পাশে বসতে বাধ্য করলেন। তার পাশে বসে আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল আর সেসময় তিনি আমার মুখে একটা একটা করে মিস্টি পুরে দিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকছিলেন। ৬টা খাওয়ার পর আমি আর নিতে পারলাম না। তিনি দশটার ব্যাপারে চাপাচাপি করতে থাকলেন। এরপর তিনি শুরু করলেন। তিনি রান্না-বান্না করতে পারতেন ভাল। আমাদেরকে মাঝে মাঝে রেধে খাওয়াতেন। তার মৃত্যুর কয়েক মাস পূর্বেও তিনি এক কুরবানীর সময় সবাইকে গরুর মাংসের ভুনা খাইয়েছেন। কুরবানীর দিন সকালে নাস্তার জন্যে মাংস কিনে আনা হত,আর গরু-খাসি জবাই হবার পর আমরা ৪০/৫০ কেজী মাংস নিয়ে বড় ডেগে রান্না করতাম। আত্মীয় স্বজন,বন্ধু-বান্ধব,প্রতিবেশী সকলে থাকত অমন্ত্রিত। আমার জন্যে কলিজাগুলো আলাদা করা হত। ছোটবেলা থেকে এই জিনিস আমার পছন্দ। মা এইটা ছোটছোট করে কেটে আলুর সাথে ভুনা করত। আব্বা প্রথমে কষানো মাংস খাওয়ার জন্যে গামলা নিয়ে আসতে বলত। বড় খুন্তির সাহায্যে মাংশ কষানোর একেক পর্বে তিনি সবাইকে সেটা খেতে বলতেন। এটার স্বাদ হত চমৎকার। তার কারনে ঈদের প্রতিটি মুহুর্ত প্রানচাঞ্চল্যে ভরা থাকত। একেক কাজ করার জন্যে একেক সময় নির্ধারিত ছিল। সেসময় তা না হলে তিনি হুঙ্কার ছাড়তেন বা উচ্চস্বরে নির্দেশনা দিতেন। ঈদটা যে একটা উৎসব ,এটা তার কারনেই মনে হত। এখন আর সেসব নিয়ক-কানুন বাধ্যবাদকতা নেই। ঈদ এখন আর সেভাবে নাড়া দেয়না। আমরা ইট-পাথরের শহর আমাদের অন্তরকে ইট পাথর বানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু দেশের এ মাথা থেকে ওমাথা এবং বিদেশ চষে বেড়ালেও আমার পিতার মধ্য থেকে সহজাত আবেগ নষ্ট হয়নি।



বরাবরই তিনি ছিলেন শারিরীকভাবে খুব শক্তিশালী কিন্তু ইচ্ছাকৃত অবসর নেওয়া পর খাবারের প্রতি তার ব্যপক ঝোক দেখা দেয় এবং তিনি শরীরে চর্বী বাধিয়ে ফেলেন। তিনি ছিলেন মাত্রাতিরিক্ত ভোজন রশিক। তার রোগ-ব্যধীও তেমন ছিলনা। এমনকি শেষ সময় পর্যন্ত তিনি খেয়েছেন। কোনো ডাক্তারের কোনো পরামর্শ তিনি কখনও মানেননি। এমনকি চর্বী,মিস্টি,মাংস হিসেব করে খেতে হবে মর্মে ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লিখলেও আমার বড় বোন সেটা ছিড়ে ফেলে নতুন করে লিখে দিতে বললেন, ‘এগুলো খাওয়াই যাবেনা’। কারন হিসেবে ডাক্তারকে বলেছিলেন, আব্বার ভাষায় অল্প খাওয়া যাবে মানে হল-এক কেজী খেতে হবে।



ডাক্তার আশঙ্কা করেছিলেন বহু পূর্বে দু®কৃতকারী কর্তৃক আহত হওয়ার পর হাসপাতালে যখন রক্ত দেওয়া হয়েছিল তখন হেপাটাইটিস সি রক্তে প্রবেশ করে থাকতে পারে। এরই ফলশ্র“তিতে এবং নিজের প্রতি প্রচন্ড অবহেলার কারনে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হন। শেষে সময় পর্যন্ত তার মাথার চুল পড়েনি,দৃষ্টিশক্তিও ভাল ছিল। এমনকি খেতেও পারতেন এবং সেসময়েও খাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বিধি নিষেধ মানেননি। অবশেষে তিনি বিছানায় চলে গেলেন। আমরা অনেক দেরীতে তার ব্যাধীর কথা বুঝতে পেরেছি। সিংগাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের সাথে কথা হল কিন্তু তিনি শারিরীকভাবে সেখানে যেতে সক্ষম হলেন না। খুব দ্রুত তার অবস্থার অবনতি ঘটল। ডাক্তার তাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন।



১৭ তারিখ রাতে আমরা মায়ের কাছ থেকে খবর পেলাম জরুরী ভিত্তিতে বাড়িতে আসার জন্যে। ভোর রাতে পৌঁছে গেলাম। সকল ভাইবোন আব্বার চারিপাশে বসলাম। আমার মা আমাকে বলল-একবার তাকে আব্বা বলে ডাক। তোর মুখ থেকে ডাক শোনার জন্যে জ্ঞান থাকা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে। কিন্তু আমি আমার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেও শব্দটি মুখ থেকে বের করতে পারলাম না। তার প্রতি আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে পারিনি,তাই আল্লাহর কাছে মাফ চাইতে থাকলাম। ফ্যানের বাতাসের পরও পাখা দিয়ে বাতাস করতে থাকলাম। ভাবতে থাকলাম কাছে এসে কখনও তাকে সেবা করার সাহস অর্জন করতে পারিনি আজ মৃত্যুপথযাত্রী পিতার শিয়রে দাড়িয়ে করা পাখার বাতাসে তার কি এসে যায় ! তারপরও পাখা চালাতে থাকলাম ডানহাত থেকে বাম হাতে। থামিনি আমি। ভাবছিলাম কিছুই তো করতে পারিনি আজ আমার শরীর যদি এ কাজটি করতে চরমভাবে অপারগ হয় তবুও শরীরকে কষ্ট দিয়ে এটি করে যাব। কিন্তু না, এখন আর তার এসবের প্রয়োজন নেই। পৃথিবীর প্রয়োজন থেকে তিনি উর্ধ্বে। সারারাত প্রচন্ড কষ্টের পর তিনি আমাদের দিকে প্রশান্তচিত্তে তাকালেন। তারপর তারপর স্থির হয়ে হাসলেন। এরপর স্থির হয়ে যাওয়া চোখ নিয়ে আবারও হাসলেন। মনে হল তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো শুভ সংবাদ পেয়েছেন। মনে হল শেষ দিনগুলোতে যে কষ্টভোগ করেছেন,হয়ত তার জন্যে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেছেন। তিনি মুখ দিয়ে দু-বার ঢেকুর তোলার মত করলেন এবং স্থির হয়ে গেলেন। আমি দোয়া করলাম-ইয়া আল্লাহ ! তাকে তুমি ক্ষমা কর ! তাকে তুমি শাস্তি দিওনা। তাকে জান্নাত দান কর ! সময়টি ছিল ২০১০ সালের ১৮ই মে ,সকাল ৯.৩০।



আমার পিতার জন্যে দোয়া করার অনুরোধ রইল। সু-মহান আল্লাহ যেন তাকে ক্ষমা করেন এবং জান্নাত দান করেন !

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৮ ই মে, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:৫৮

আয়রন ম্যান বলেছেন: পড়লাম। আপনার আব্বাকে আল্লাহ বেহেস্ত দান করুন সেই দোয়া করি।
কিন্তু আপনি এখানে মেশিনগানের ছবিটি কেন দিলেন?

২| ১৯ শে মে, ২০১৩ রাত ১:২১

কান্ডারি অথর্ব বলেছেন:

আপনার আব্বাকে আল্লাহ বেহেস্ত দান করুন সেই দোয়া করি। আমিন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.