নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

দ্য েস্লভ

দ্য েস্লভ › বিস্তারিত পোস্টঃ

"তোর সেই মোজাহার বুড়ো মরে গেছে"

০৮ ই অক্টোবর, ২০১৪ দুপুর ১২:৩০



মনে পড়ে তাকে আমি প্রথম দেখেছিলাম,যখন তিনি খোকন চাচার ঘরের চালে গোলপাতা লাগাচ্ছিলেন। খড় এবং গোলপাতার ঘরের চাল ছাওয়ার জন্যে তাকে ডাকত মানুষ। তিনি ছিলেন একজন দিনমজুর। কখনও অন্যের ক্ষেতে অল্প পারিশ্রমিকে কাজ করতেন,কখনও ঘরের চালে ছাউনির কাজ আর কখনও অন্যের ফরমায়েশ খাটা। এক ছেলে এবং দুই মেয়ের সংসার তার নুন আনতে পান্তা ফুরায় গতিতে এগুচ্ছিল। শত কষ্টেও সন্তানদেরকে লালন পালন করে যাচ্ছিলেন।সেখানে তার চেষ্টায় অন্তত ত্রুটি ছিলনা।

আমি মফস্বলের ছেলে্ ।এরাকায় কিছুটা গ্রাম এবং কিছুটা শহরের ছোয়া ছিল। তবে শিঘ্রই এলাকার অর্থনীতিতে পরিবর্তন আসে।লোকজন বেশী পরিমানে ব্যবসায়ে আত্মনিয়োগ করে এবং বিদেশ গমন করে। ফলস্রুতিতে এলাকার ছন,গোলপাতার ঘরগুলোও একতলা,দো-তলা দালানে পরিনত হয়। মোজাহারের পেটের অর্ধ্বাংশে লাথি পড়ে। পরবর্তীতে মানুষ ফসল ফলানোর দিকে ততটা আগ্রহি হয়নি,তা তেমন লাভজনক না হওয়ার কারনে। প্রতারক,জোচ্চর শ্রেনীর ব্যবসায়ীরা কৃষকের একমাত্র অবলম্বন তার ফসল নিয়ে ফড়িয়াবাজীতে লিপ্ত হওয়ায় তারা ফসল ফলিয়ে লাভ করতে হিমশিম খেয়েছে। বিষয়টি এখনও ব্যপকভাবে বলবৎ। কৃষির অবনতিতে মোজাহারের মত দিনমজুর শ্রেণীর লোকদের জীবন সংকীর্ণ হয়ে আসে।

এমনই এক সময় সম্ভবত: কারো চাল থেকে পড়ে গিয়ে বা অন্য কোনো কারনে মোজাহার পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন,তবে কিছুদিন পর চলনশক্তি ফিরে পান। একদা বলিষ্ঠ লোকটি সচল হলেও পূর্বের মত অবস্থা থাকেনা। কথা জড়িয়ে যায় এবং শরীর ব্যপক দূর্বল হয়ে পড়ে। হতে পারে সুচিকিৎস্যা হলে তার অবস্থার উন্নতি হত।

আমরা একই এলাকার মানুষ হলেও তার সম্পর্কে আমার জানাশোনা ছিলনা। আমার কৈশোর,যৗবন ছিল ঢাকা কেন্দ্রীক ,কিন্তু এলাকায় নিয়মিত যাতায়াত করতাম। দুরে অবস্থান করাটা তাকে না জানার কারন নয়,তার চাইতে দূরে অবস্থান করা মানুষদের খবর আমি ভালই জানতাম্ । মোজাহাররা তেমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নন ,সেটাই বোধহয় বেখবর হওয়ার প্রধান কারন।

তার সাথে আমার অতিত স্মৃতি থাকার খুব একটা কারন নেই। তিনি বয়ষ্ক লোক,এলাকায় হাটার সময়ও তিনি তেমন চোখে পড়েননি,পড়লেও কুশলাদি কখনও জিজ্ঞেস করা হয়নি। প্রশ্ন আসতে পারে, তাই যদি হয়,তাহলে তাকে নিয়ে এত প্যাচাল কেন ??

আসলে তার সম্পর্কে আমার সাধারন ধারনা থাকলেও তাকে ভাল করে চেনা হয় এক ছোট দোকানদারের মাধ্যমে। এক সন্ধ্যায় তাদের পাড়ার এই দোকানদারের সাথে গল্প করছিলাম বেশ কয়েক বছর পূর্বে। দোকানদার কথা প্রসঙ্গে বলল-মোজাহারকে চেনো ? বললাম হ্যা। তিনি বললেন-তার ছেলে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে,তার স্ত্রীও গালি দিয়ে বেরিয়ে যেতে বলেছে। প্রায়ই এমন হয়। লোকটাকে কখনও কখনও গলা ধাক্কা দিয়েও বের করে দেওয়া হয়। সে বেরিয়ে যায়,আবার ফিরেও আসে। তার কোনো পথ জানা নেই।

কোনো সন্তান তার পিতার সাথে এরকম আচরণ করতে পারে; সেটা জানা আমার কাছে বেশ নতুন ছিল। আমি জানতাম অনেক পিতা তার কু-পুত্রকে তাজ্য করেছে,বা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। কিন্তু একজন অক্ষম বুড়ো পিতাকে "ইনকাম করতে পারেনা, বসে বসে খায়" এই অজুহাতে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে,সেটা আমার কাছে অবাস্তব মনে হল।

কন্যাদের অনেক আগেই বিয়ে হয়েছে। বাজারে তার পুত্রের একটি চোটখাট ঘড়ির দোকান আছে,তা দিয়ে তাদের চলে যাওয়ার কথা। শুনলাম ময়লা-মলিন পোষাকে তার পুত্রের দোকানে একদিন চা খাওয়ার টাকা চাইতে গেলে,সে গালাগাল দিয়েছে। সামান্য কটা টাকা সে দেয়নি। পুত্রের বন্ধুরা যখন এই লোকটির পরিচয় জানতে চেয়েছে,তখন সে তাদেরকে বলেছে-"এই লোকটি আমাদের বাড়ির আশ্রিত"। মোজাহার পুত্রের দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে কেঁদে উঠেছিল,কিছুই বলেনি, অবশ্য সব কথা বলার শক্তি তার নেই। প্যারালাইজড হবার কারনে তার কথাও স্পষ্ট বোঝা যায় না।

তার পুত্রকে দেখতাম সাদা ধবধবে পোষাকে আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা ধরে বাজারে চলেছে, রাতে আবার নবাবী সুরতে বাড়ি ফিরত। তার পোষাক পরিচ্ছদ ছিল বেশ খুশবুদার। সম্ভবত বন্ধু-বান্ধবরাও বেশ উচু দরের ছিল। দিনমজুর পিতাকে পরিচয় দিলে বন্ধুদের কাছে ছোট হতে হবে, একারনে তাকে কখনই পিতা হিসেবে পরিচয় দিতনা। তবে সেদিনকার ঘটনা ছিল সরাসরি। আর সে তার পিতাকে তার দোকানের আশপাশে আসতে নিষেধ করেছিল।

অথচ এই দিনমজুর লোকটি কত কষ্টে তার সন্তানদের লালন-পালন করেছে ! হয়ত এই আশাও করেছিল,একদিন বড় হয়ে আমার পুত্র আমার দেখাশোনা করবে। পুত্রের বড় হওয়া সকল পিতাই আশা করে। মোজাহারও বুঝল তার পুত্র এখন আদেশ করার মত বড় হয়েছে। মোজাহার সেদিন যে কথাটা বলতে চেয়েও বলতে পারেনি,হয়ত সে কথাটা ছিল-"আমার শরীরের সকল শক্তি তোমার জন্যে খরচ করেছি,কাজের শক্তি থাকলে, নিশ্চয় তোমার মত পুত্রের পরিচয় আমিও দিতাম না"

দোকানদারকে বললাম,আমি এখনও ছাত্র,আমার যদি টাকা থাকত-তবে এরকম লোকদেরকে দেখাশুনা করতাম। আমি টাকা জমিয়ে বাড়িতে গিয়ে তা বন্ধুদের সাথে খরচ করতাম। আমার জমানো টাকার একটা অংশ মোজাহার বুড়োর নামে দোকানে রাখলাম। বললাম-এটা আপনি রাখেন,দোকানের জন্যে কেনাকাটা করেন,তাতে আপনারও লাভ হল। আর প্রতিদিন তাকে কলা,বিস্কুটসহ যা সে খেতে চায় তা দিবেন এবং হিসেব লিখে রাখবেন। পরবর্তীতে বাড়ি আসা পর্যন্ত বন্দোবস্ত করে আসতাম। এটা ছিল অপ্রতুল,কিন্তু আমারও উপায় ছিলনা্,তারও উপায় ছিলনা্।

লোকটির সাথে আমার কথা হয়নি। একদিন আমি রাস্তায় হাটছিলাম। দেখলাম রাস্তার মোড়ে ময়লা-মলিন পোষাকে,ছেড়া স্যান্ডেল পায়ে খুব উৎস্যুক দৃষ্টি নিয়ে মোজাহার চাচা দাড়িয়ে আছে। (চাচা শব্দটা এখনই তৈরী করলাম , বার বার নাম উচ্চারণ করছি এজন্যে।তাকে আমি কোনো কিছু বলে ডাকিনি,এমনিতেই কথা হয়েছে)। ফোকলা দাতে হেসে খানিকটা ভয়ে ভয়ে আমার হাতে হাত মেলালেন। বোধহয় এটাই প্রথম সাক্ষাৎ। কুশলাদি জানতে চাইলাম। আমার ভয় করছিল একারনে যে, এই লোকটির যে অভাব তা পুরণ করার ক্ষমতা আমার নেই, অথচ সে ভাবে-আমি ধনী মানুষ এবং তার সকল অভাব পুরনে সক্ষম। কথার শেষে তার আবদার শুনলাম-একটি স্যান্ডেল। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। দুজনে মসজিদের পানে ধীরে ধীরে চললাম।

আমি যতবার বাড়িতে গিয়েছি,ততবার তার খোঁজ -খবর নিতাম। প্রতিনিয়ত পরিবারের আপনজনদের কাছ থেকে অপমান আর কষ্ট নিয়ে লোকটার দিন পার হচ্ছিল। আমি তাকে দাওয়াত করে সবথেকে ভাল খাবার খাওয়াতাম। পাশে বসিয়ে তাকে যত্নকরে খাওয়াতাম। তার কি খেতে ভাল লাগে তা জেনে নিয়ে সেটা খাওয়াতাম্। কখনও বাজারের মিস্টির দোকানে নিয়ে যেতাম। হাটতে কষ্ট হয়,তাই এলাকার দুজন জুনিয়র ভাইকে বলতাম দুহাত ধরে তাকে নিয়ে চল। বুড়ো লোকটা আমাকে ভাই বলে সম্বোধন করত। প্রতি ঈদ এবং কোনো অনুষ্ঠানে তিনি ছিলেন আমার স্পেশাল মেহমান্ । আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই তার সাথে সুআচরন করতাম। যে লোক পরিবারের সঙ্গে থাকলে মনমরা হয়ে চুপ থাকত,সেই লোকটিই আমি বা আমাদের মধ্যে এসে হেসে গড়াগড়ি খেত। লোকটা আমাকে ব্যপক বিশ্বাস করত এবং ভালবাসত্। আমি দূর থেকে তার চোখের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট বুঝতাম সে চোখে আমার জন্যে ভালবাসা ঠাসা। এত ভালবাসার চাহনি সহ্য করতে না পেরে তার থেকে দূরে থাকতাম। তার সমস্ত আবদার ছিল আমাকে ঘিরে,আর আমি সঙ্গে সঙ্গে বলতাম-এটা ইনশাআল্লাহ হবে্ । কখনও বাড়িতে যেতে দেরি হলে অন্যদের কাছে জিজ্ঞেস করত,আমি কবে আসব।

আমেরিকা আসার পর তার কথা ভাবতাম, লোকটা কেমন আছে ? একদিন এলাকার এক ছোটভায়ের কাছে জানতে পারলাম সে অসুস্থ্য, আমাকে দেখতে চেয়েছে। সে অবশ্যই জানেনা,আমেরিকা কতদূর। ঢাকায় থাকলে হয়ত যেতাম্ । অসুস্থ্য লোকটি আপনজনদের পাশ থেকে আমাকে দেখতে চেয়েছে-এটা কি দুনিয়াতে আল্লাহ প্রদত্ত একটি বিশাল সম্মান নয় ? অবশ্যই আমার আল্লাহ মহান এবং অতি দয়ালু্। সেটা বুঝতে কষ্ট হয়না, যখন কোনো বাচ্চা তার মা'কে বলে-আমার স্লেভ কাকু তোমার চাইতেও ভাল !

ঈদে ফোন করলাম আমার ভাইকে। ভাই বলল-তোর সেই মোজাহার বুড়ো মরে গেছে। কথাটা শুনে কেমন যেন লাগল। কিন্তু সে তো তার মালিকের কাছে চলে গেছে। পৃথিবীতে যেসব লোক সবথেকে অনুল্লেখযোগ্য এবং যাদের সুপারিশ কারো কাছে গ্রহনযোগ্যতা পায়না, মোজাহার হলেন এমন একজন। পৃথিবীতে যেসব লোক মারাত্মক কষ্টে থেকেও আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে এবং হাসিখুশী থাকার চেষ্টা করে, মোজাহার হলেন তাদের একজন। যেসকল মানুষ পৃথিবীতে থাকলে মানব জাতির উপর রহমত বর্ষিত হয়, মোজাহার তাদের একজন।

যেসকল মানুষ দ্বারা আল্লাহ তার সুসজ্জিত জান্নাতকে ধন্য করবেন, মোজাহার যেন হয় তাদের একজন ! যেসকল মানুষদেরকে আল্লাহ ক্ষমা করেছেন এবং সম্মানে ভূষিত করেছেন,মোজাহার যেন হয় তাদেরই একজন। দূর থেকে আমি কল্পনায় সেই বুড়ো লোকটিকে দেখতে পাচ্ছি। এক হাস্যোজ্জ্বল মুখায়বয়বের অধিকারী লোকটি আমার কল্পনায় স্পস্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৮ ই অক্টোবর, ২০১৪ রাত ৯:১৫

অপূর্ণ রায়হান বলেছেন: মনটা খারাপ হয়ে গেলো লেখটা পড়ে :(

ভালো থাকবেন ভ্রাতা ।

০৯ ই অক্টোবর, ২০১৪ সকাল ৭:০০

দ্য েস্লভ বলেছেন: দোয়া করবেন ভ্রাতা

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.