![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ব্রিগেডিয়ার জেঃ (অব.) এমআর মজুমদার ১৯৭১ সালে চট্টগ্রামে অবস্থিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের কমাড্যান্ট ছিলেন। তখন তিনিই ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে জ্যেষ্ঠতম বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা। সে সময় অস্ত্রবাহী পাকিস্তানি জাহাজ এমভি সোয়াত চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করলে তিনি নানা কৌশলে এই জাহাজ থেকে অস্ত্র নামাতে দেননি। ২৭ মার্চ তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন করা হয়।
---
১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে থেকে ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ পর্যন্ত আমি চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের কমান্ড্যান্ট ও স্টেশন কমান্ডার ছিলাম। সে সময় আমি ছিলাম পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা। ১৯৭১ সালের ৪ মার্চ আমি চট্টগ্রামের সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হই। ফলে সার্বিকভাবে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের এম আর সিদ্দিকী, জহুর আহমদ চৌধুরী এবং এম এ হান্নানের মতো নেতাদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ গড়ে ওঠে। জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা, যেমন চিফ অব আর্মি স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ খানের সঙ্গেও আমার যোগাযোগ ছিল। কর্নেল ওসমানীকে আমি বহুদিন থেকেই চিনতাম। তিনি আমার ঘনিষ্ঠই ছিলেন। তিনি আমাকে শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগের অন্য বিশিষ্ট নেতাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।
৩ মার্চ সংসদের অধিবেশন বসার কথা ছিল। কিন্তু ইয়াহিয়া খান হঠাৎ করেই ১ মার্চ সেই অধিবেশন স্থগিত করেন। এতে সারা দেশে আগুন জ্বলে ওঠে। মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় নেমে আসে। ২ ও ৩ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্দয়ভাবে বেসামরিক মানুষকে গুলি করে হত্যা করে। এর ফলে শেখ মুজিব প্রকাশ্যেই দাবি করেন, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে। আর গোপনে তিনি খোন্দকার মোশতাক আহমদ, এম আর সিদ্দিকী ও জহুর আহমদ চৌধুরীকে আমার কাছে পাঠান। তাঁরা ৫ বা ৬ মার্চ রাত তিনটায় আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। সেই বৈঠকে আমি শেখ মুজিবের প্রতি আমার সমর্থন জানাই। পূর্ব পাকিস্তানে যে সে সময় আমরাই সামরিকভাবে শ্রেয়তর অবস্থায় ছিলাম, সে কথাও তাঁদের জানাই।
এর আগে ২ মার্চ চট্টগ্রাম বন্দরে পাকিস্তানি জাহাজ এমভি সোয়াত নোঙর করে। আমি জানতে পারি, এই জাহাজে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কোনো যাত্রী আসেনি। তার বদলে এতে করে সাত হাজার টন উন্নত অস্ত্র ও গোলাবারুদ আনা হয়েছে, যার লক্ষ্য বাঙালিদের বলপ্রয়োগে দমন করা। চট্টগ্রাম বন্দরের শ্রমিক সংঘের সভাপতি এম আর সিদ্দিকীকে আমি অনুরোধ করি, জাহাজটি থেকে যেন মাল নামানোর অনুমতি না দেওয়া হয়। আমি বললাম, ‘এই অস্ত্র আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হতে পারে।’ আমি ভাবলাম, আমরা যদি পুরো দেশটিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসি, তাহলে সেসব আপনা-আপনিই আমাদের কবজায় চলে আসবে।
আমি ২ মার্চ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সব চাপ উপেক্ষা করে এই জাহাজের অস্ত্র খালাস বন্ধ রাখি। সেনাপ্রধান জেনারেল হামিদ খান, টিক্কা খান, মিঠ্ঠা খানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমার ওপর চাপ দিয়েছেন। মিঠ্ঠা খান আমার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করে বললেন, ‘যেভাবেই হোক, দু–এক দিনের মধ্যে এই অস্ত্র খালাস করতেই হবে।’ আমি বললাম, ‘বিশেষজ্ঞের সহায়তা ছাড়া এই অস্ত্র নামাতে গেলে জাহাজে আগুন ধরে যেতে পারে।’ মিঠ্ঠা বললেন, ‘সারা দেশে যদি আগুন লেগে যায়, এমনকি কর্ণফুলী নদীও যদি রক্তে লাল হয়ে যায়, তাতেও আমার কিছু আসে-যায় না। আমি চাই, অস্ত্র খালাস করা হোক।’
আমি অস্ত্র নামাতে অস্বীকার করায় টিক্কা খান আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেন, ‘আপনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ অমান্য করেছেন। সোয়াতের অস্ত্র নামাতে অস্বীকার করে আপনি আওয়ামী লীগের অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থন দিয়েছেন।’ এরপর মিঠ্ঠা খান নৌবাহিনীর প্রধান ও কমোডর মমতাজের সঙ্গে দেখা করেন, এঁরা দুজনও আমার মতের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করলেন। কমোডর মমতাজ অবশ্য আশঙ্কা করছিলেন, পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। সে কারণে তিনি কোনো ঝুঁকি নেননি। তিনি মিঠ্ঠা খানকে বললেন, ‘স্যার, আমার বাহিনী বাণিজ্যিক জাহাজের কার্গো ওঠাতে-নামাতে পারে না। তাদের কারণে কোনো বিস্ফোরণ হলে তা বিপর্যয়কর হবে।’ মিঠ্ঠা খান আমার কথা বুঝতে পারলেন। তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি করাচি থেকে বাণিজ্যিক জাহাজ পরিচালনাকারী লোকদের নিয়ে আসতে পারব।’ তিনি সঙ্গে সঙ্গে করাচির সেনা সদর দপ্তরের সঙ্গে কথা বলে তাদের বাণিজ্যিক জাহাজ পরিচালনাকারীদের পাঠাতে বলেন।
আমি নানা অজুহাতে সোয়াতের অস্ত্র খালাস বন্ধ রাখি। টিক্কা খান আমাকে দিনে দু-তিনবার ফোন করে জিজ্ঞেস করতেন, ‘জাহাজের মাল নামানোর কী হলো?’ এর মধ্যে আমি এম আর সিদ্দিকীর সহায়তায় জাহাজের সব কর্মীকে নামিয়ে আনি। জাহাজটি ছিল বহির্নোঙরে।
ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পশ্চিমে যেতে প্রস্তুত ছিল, জিয়াউর রহমান ছিলেন এই রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন কমান্ড। একটা নিয়ম ছিল এই যে সেনাবাহিনীর কোনো দল পূর্ব থেকে পশ্চিমে বা পশ্চিম থেকে পূর্বে গেলে তাদের বিনা অস্ত্রে যেতে হতো। এই নিয়মের কারণে জিয়ার ব্যাটালিয়ন ইতিমধ্যে অস্ত্র সমর্পণ করেছিল। পরবর্তীকালে আমি তাদের ৩০০ রাইফেল ও ১০টি লাইট মেশিনগান দিই। যুদ্ধের সময় সেটাই ছিল তাদের মূল শক্তি।
২১ মার্চ সেনাপ্রধান জেনারেল হামিদ চট্টগ্রাম বন্দর সফর করেন। তিনি আমাকে বেলুচ রেজিমেন্টের কর্নেল ফাতেমির কাছে নিয়ে যান। তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘সোয়াত জাহাজের মাল কি খালাস করা হয়েছে?’ আমি জবাব দিই, ‘না।’ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুটেন্ট জেনারেলও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
বেলুচ রেজিমেন্টে যাওয়ার পর অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল বললেন, ‘মজুমদার, চলুন, অন্য ঘরে যাই। আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।’ আমার অনুপস্থিতিতে ফাতেমি ও জেনারেল হামিদ আধা ঘণ্টা কথা বললেন। সেখান থেকে আমরা নৌ সদর দপ্তরে যাই। জেনারেল হামিদ সেখানেও ২০-২৫ মিনিট কথা বলেন। এবারও আমার অগোচরে, যা তাঁরা আগেই পরিকল্পনা করে এসেছিলেন।
সেনাপ্রধানের গতিবিধি দেখে আমি বুঝতে পারলাম, তাঁরা ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে বাঙালিদের ওপর হামলার জন্য গোপনে পরিকল্পনা করছেন।
সেনাপ্রধান চলে যাওয়ার পর আমি আওয়ামী লীগের নেতা এম আর সিদ্দিকীকে ফোন করি। এরপর তিনি আমার বাসায় আসেন। আমি তাঁকে সব জানিয়ে অনুরোধ করি, তিনি যেন শেখ মুজিব ও কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে কথা বলেন। ‘আমাদের হাতে নষ্ট করার মতো সময় নেই...শিগগিরই কিছু ঘটবে...শেখ সাহেবকে বলুন, তিনি যেন আমাদের অনুমতি দেন। আমরা যদি সময় নষ্ট না করে এখনই অভিযানে নামি, তাহলে বিজয় অর্জন করা সহজ হবে।’
সিদ্দিকীর অনুরোধে আমি পুলিশের এসপিকে বলে তাঁর জন্য একটি গাড়ির ব্যবস্থা করি।
--
এম আর সিদ্দিকী শেখ মুজিবের সঙ্গে কথা বলতে ঢাকায় চলে যান। পরের দিন ফিরে এসে তিনি জানান, শেখ মুজিব বলেছেন, ‘ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে অবশ্যই ধৈর্য ধরতে হবে...রাজনৈতিক পর্যায়ে আলোচনা হচ্ছে। আলোচনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে ধৈর্য ধরতে হবে। সময়মতো আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলব।’ ওসমানী তাঁর কাছে জানতে চান, ‘আপনি ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন কীভাবে?’ শেখ মুজিব বলেন, ‘রেডিওতে বাংলা সম্প্রচার বন্ধ হয়ে গেলে বুঝবেন, আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। আমি তাঁর জন্য একটি বার্তা ধারণ করে যাব। জহুর আহমেদ চৌধুরীর মাধ্যমে তাঁর কাছে সেটা পাঠিয়ে দেব।’
২৫ মার্চ শেখ মুজিব গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাঁর ধারণ করা বার্তা চট্টগ্রামে পৌঁছেছিল, কিন্তু তখন আর আমি সেখানে ছিলাম না। ২৬ মার্চ আওয়ামী লীগের নেতা এম এ হান্নান রিকশায় মাইক লাগিয়ে চট্টগ্রাম শহরে সে বার্তা প্রচার করেন। সেই বিবৃতির ওপর ভিত্তি করেই জিয়াউর রহমান বেতার স্টেশন থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। বার্তাটি ধারণ করা হয়েছিল ২১ মার্চ।
পরবর্তী কয়েকটা দিন উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়। ২৪ মার্চ জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ও জেনারেল মিঠা খান দুটি হেলিকপ্টারে করে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে আসেন। তাঁরা আমাকে বলেন, সেদিন বিকেলবেলা প্রেসিডেন্ট একটি বৈঠক করবেন। ‘সব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বৈঠকে যোগ দিতে বলা হয়েছে। তাই আপনাকেও যেতে হবে।’
আমি বললাম, ‘চট্টগ্রামের পরিস্থিতি খুবই টানটান। বিশেষ করে বেসামরিক মানুষেরা খুব বিক্ষুব্ধ। আমি ঢাকায় গেলে এখানে সমস্যা হতে পারে।’ ঢাকার বৈঠকটি সম্পর্কে আমি সন্দিহান ছিলাম। তাই ক্যাপ্টেন আমিনকে (পরে মেজর জেনারেল) বললাম, ‘ওসমানীকে ফোন করে জেনে নাও, অর্থহীন এই সভায় যোগ দিতে আমি ঢাকায় যাব কি না।’
মিঠা খান বললেন, ‘আপনাকে যেতেই হবে। কারণ, প্রেসিডেন্ট সব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গেই কথা বলতে চান। প্রয়োজন হলে বৈঠকের পর আপনাকে আবার পাঠিয়ে দেওয়া হবে।’ দুর্ভাগ্যবশত আমি তাঁকে বিশ্বাস করেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম, তিনি যা বলছেন, তা সত্য হতে পারে। সে কারণে আমি হেলিকপ্টারে চেপে বসলাম। আমিন আমার সঙ্গেই ছিল।
হেলিকপ্টার ঢাকায় অবতরণ করার পর আমাকে ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাবের বাসভবনে নিয়ে যাওয়া হলো। তিনি ঢাকা শহরে অপারেশন সার্চলাইটের দায়িত্বে ছিলেন। আরবাব আমার পুরোনো বন্ধুদের একজন। আমি, আরবাব ও জিয়াউর রহমান ১৯৬০-৬২ সালে একত্রে কাজ করেছি। আরবাবের সঙ্গে সে সময় আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়।
আরবাবের বাসায় পৌঁছেই দেখি টেবিলে স্ন্যাকস রাখা। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আরবাব, ব্যাপারটা কী বলুন তো? আমাকে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট সব কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করতে চান। কিন্তু আমি তো কোনো প্রস্তুতি দেখছি না। আমাকে তাহলে এখানে আনা হয়েছে কেন?’
আরবাব বললেন, ‘মজুমদার, কাউকে বলবেন না। আপনাকে চট্টগ্রাম থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, আপনার জায়গায় ইতিমধ্যে ব্রিগেডিয়ার আনসারি দায়িত্ব বুঝে নিয়েছেন। আমাকে আপনার দেখভাল করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আপনাকে পশ্চিম পাকিস্তানে নতুন কোনো পোস্টিং দেওয়ার আগ পর্যন্ত আমার সঙ্গে থাকতে হবে।’ আরবাব আমাকে সবই বললেন, কিন্তু এই কথা গোপন রাখলেন যে আমাকে গৃহবন্দী করা হয়েছে।
বদলি ও স্থলাভিষিক্ত হওয়ার খবর শুনে আমি তো বিস্মিত। কারণ, আমার সঙ্গে এ নিয়ে কেউ কথাই বলেনি। আমি আরবাবকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমি কি আর চট্টগ্রামে যেতে পারব না?’ তিনি বললেন, ‘না।’
আমাকে সরিয়ে দেওয়ার পর ব্রিগেডিয়ার আনসারি সোয়াতের মাল খালাস করতে শুরু করেন। বাঙালি কর্মকর্তারাও এ কাজে হাত লাগান।
পরের দিন (২৫ মার্চ) দেখলাম, আরবাব তাঁর কাজে খুবই ব্যস্ত। তিনি এতই ব্যস্ত ছিলেন যে আমার সঙ্গে কথাই বলতে পারছিলেন না। তাঁর মনোভাব ও গতিবিধি দেখে আমার ভীতি আরও গাঢ় হলো। বিকেলবেলা তাঁর অনুপস্থিতিতে আমি তাঁর বাড়ি থেকে বেরিয়ে সরাসরি ধানমন্ডিতে আমার ভাই সাজ্জাদ আলী মজুমদারের বাড়িতে গেলাম। সেখান থেকে পুরো ব্যাপারটা কর্নেল ওসমানীকে ফোনে জানালাম। তিনি বললেন, ‘আমি শিগগিরই আসছি।’ আমার ভাবি তাজউদ্দীনকেও নিয়ে আসার জন্য তাঁর বাসায় গেলেন, কিন্তু তিনি সেখানে ছিলেন না।
ওসমানী এলেন। আমরা সেখানেই রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসলাম। তাঁকে বললাম, ‘আপনারা অনেক সময় নষ্ট করে ফেলেছেন। আমি তিনবার আপনাদের কাছে বার্তা পাঠিয়েছি—একবার এম আর সিদ্দিকী, একবার ক্যাপ্টেন আমিন, আরেকবার আমি নিজেই। কিন্তু আপনারা সাড়া দেননি। পাকিস্তানিরা আলোচনার নামে সময় পার করছে। এটা পরিষ্কার যে তারা আপস করবে না। আমি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানতে পেরেছি ও আপনাদের জানিয়েছি যে শেখ মুজিবের হাতে ওরা ক্ষমতা দেবে না। সেনাবাহিনী শিগগিরই অভিযানে নামবে। কয়েক দিন আগে অভিযানে নামলে সহজেই আমরা জিততে পারতাম। শেখ মুজিব অনুমতি দিলে এখনো কিছু করা সম্ভব।’ ওসমানী বললেন, ‘না, শেখ মুজিব তা চান না। তিনি রাজনৈতিক সংলাপের মধ্য দিয়ে সংকটের সমাধান চান।’ তিনি বললেন, ‘আপনারা বিদ্রোহ যে করতে চান, আপনাদের কাছে কি সেই অস্ত্র আছে?’
আমি পরিকল্পনার রূপরেখা পেশ করলাম। ‘বাঙালি সেনাদের যে শক্তি আছে তাতে তারা অবাঙালি ইউনিটের কাছ থেকে ম্যাগাজিন ছিনিয়ে নিতে পারবে, পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে পারে। তারা অবশ্যই আত্মসমর্পণ করবে। কারণ, তারা জানে, এ মুহূর্তে প্রতিরোধের চেষ্টা করলে মরতে হবে। তারা সেই ঝুঁকি নেওয়ার মতো অবস্থায় নেই।’
এরপর ওসমানী শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন, আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলেন, নিরাপত্তার কারণে আমাদের একসঙ্গে যাওয়া ঠিক হবে না। গোয়েন্দারা সব সময়ই শেখ মুজিবের বাড়ির ওপর নজর রাখছিল। ওসমানী একাই গেলেন। বললেন, শেখ মুজিবের সঙ্গে কথা বলে তিনি ফোনে আমাকে জানাবেন।
বিকেলবেলা আমি টানটান উত্তেজনার মধ্যে তাঁর ফোনের জন্য অপেক্ষা করি। রাত আটটার সময় ওসমানী ফোন করে জানালেন, ‘শেখ মুজিব এখনই ইয়াহিয়ার সঙ্গে একটি সমঝোতায় এসেছেন। তিনি আপনাকে ধৈর্য ধরতে বলেছেন।’
রাত সাড়ে ১১টার দিকে পুরো শহর বুলেট ও গুলির আগুনে জ্বলে ওঠে। বাড়ির ছাদে গিয়ে দেখি, পুরো শহরে আগুন জ্বলছে। পাকিস্তানি সেনারা নির্মমভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আমি আগেই সেটা ধারণা করেছিলাম।
পাকিস্তানে আড়াই বছর নির্জন কারাভোগ করে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসার পর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন আমাকে বলেছিলেন, সেদিন অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত সাড়ে আটটার দিকে ওসমানী তাঁর বাসা থেকেই আমাকে ফোন করেছিলেন।
---
পরবর্তী দিন আমি জানতে পারলাম, আমার পরিবারকে সেনানিবাসে ব্রিগেডিয়ার আনসারির বাড়িতে রাখা হয়েছিল। ২৬ মার্চ আমি সেনানিবাসে গেলে সেখানে কোনো পুরুষ মানুষকে পাইনি। তাঁরা অভিযানে ব্যস্ত ছিলেন। কোনো রকম বাধা ছাড়াই আমি আমার পরিবারকে শ্বশুরবাড়িতে রেখে আসি।
২৫ মার্চ রাতে আমার স্ত্রী চট্টগ্রাম সেনানিবাসে যে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিল, সে সম্পর্কে আমাকে বলল। পাকিস্তানি সেনারা কীভাবে ট্যাংক নিয়ে রাতের আঁধারে চট্টগ্রাম কেন্দ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিপুলসংখ্যক বাঙালি সেনাকে হত্যা করেছিল, সেটা শুনে আমি
প্রচণ্ড ধাক্কা পেয়েছিলাম। যাঁদের মধ্যে আমার অনুগত কর্মকর্তা কর্নেল এম আর সিদ্দিকীও ছিলেন, এসব দেখে আমার স্ত্রী ও সন্তানেরা হতবাক হয়ে গিয়েছিল।
আমার স্ত্রী সাদাত সুলতানা বলে, রাতে ঘুমানোর পর সে বাসার মধ্যে বুলেটের শব্দ শুনেছিল। ঘরের বাতি জ্বেলে দেখে, একটি বুলেট জানালা ভেদ করে দেয়ালে গিয়ে বিঁধেছে। খুব দ্রুতই আক্রমণ আরও তীব্র হয়, কেন্দ্রের মধ্যে ও আশপাশে সে ভারী বর্ষণের মতো বুলেটের শব্দ শুনতে পায়। সন্তানদের নিয়ে সে খাটের নিচে শুয়ে আত্মরক্ষা করে।
এক ঘণ্টা পর পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ থামলে আমার স্ত্রী কর্নেল ওসমানীকে ফোন করে, কিন্তু ওসমানীকে ফোনে না পেয়ে সে আবার আওয়ামী লীগ নেতা এম আর সিদ্দিকীকে ফোন করে। সে সিদ্দিকীকে অনুরোধ করে, তিনি যেন বেঙ্গল রেজিমেন্টের জিয়াউর রহমানকে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন, যাতে তিনি বেলুচ রেজিমেন্টের ওপর পাল্টা হামলা করতে পারেন। পরবর্তী সময়ে সে যখন ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে, তখন দেখে, ফোন ডেড।
পরের দিন বেশ সকালেই আমার কেন্দ্রের কর্নেল শিগির বাসভবনে গিয়ে আমার স্ত্রীকে বলেন, ঢাকায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হোন। আমার স্ত্রী যখন বলল, তাদের কীভাবে নিয়ে যাওয়া হবে। তখন তিনি বলেন, ঢাকা থেকে আসা একটি হেলিকপ্টার বেলুচ রেজিমেন্টে অপেক্ষা করছে। সে নগদ টাকা, গয়না ও বাচ্চাদের কাপড় নেওয়ার চেষ্টা করলেও কর্নেল শিগির তাতে বাদ সাধেন।
বেলুচ রেজিমেন্টে যাওয়ার পথে সে যা দেখল, তাতে তার গা শিউরে উঠল। সে দেখল, কেন্দ্র পর্যন্ত রাস্তার দুই ধারে সারি সারি বাঙালি সৈনিকদের মৃতদেহ পড়ে আছে। তাদের মধ্যে সে কর্নেল এম আর চৌধুরীর মৃতদেহও আবিষ্কার করল।
পরের দিন ২৭ মার্চ সকালে ফজরের নামাজ পড়ে আমি চট্টগ্রাম যাওয়ার লক্ষ্যে আমিনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ করেই দেখি, একটি সামরিক গাড়ি বাড়ির দিকে আসছে। আমি বাড়ির বাইরে গেলে দেখলাম, বহু সৈন্য বাড়িটিকে ঘিরে রেখেছে। তারা আমাকে বলল, ‘স্যার, আপনি কি ব্রিগেডিয়ার মজুমদার?’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ’।
তারা বলল, ‘আমরা টিক্কা খানের নির্দেশে আপনাকে সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়ার জন্য এখানে এসেছি।’
আমি তাদের সঙ্গে গেলাম। ২৭ মার্চ থেকে আমি কারাবন্দী হলাম। তারা সেনানিবাস এলাকায় একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে পরিবারসহ আমাকে বন্দী করে রাখল। আমরা সেখানে দুই দিন ছিলাম। তারা আমাদের বাড়ির বাইরে যেতে দেয়নি। আর এভাবেই আমার ও আমার পরিবারের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শুরু হয়।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানিরা আমাকে দুভাবে নির্যাতন করেছে। প্রথমত, তারা আমার বাড়ির জিনিসপত্র লুট করেছে ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করেছে। দ্বিতীয়ত, তারা আমার পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন ও অন্যদের নির্যাতন করেছে।
২৬ মার্চ সকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমার খোঁজে আমাদের শ্যামলীর বাড়িতে হানা দেয়। আমাকে না পেয়ে তারা বাড়ির ভৃত্য তাসিরকে ঘর থেকে বের করে জনসমক্ষে জবাই করে খুন করে। তারা ওর ছেলেকেও খুন করার চেষ্টা করে, কিন্তু সে বাড়ির ছাদে পানির ট্যাংকে লুকিয়ে পড়েছিল। সেনারা সিলেটের জকিগঞ্জে আমার ছোট বোনের স্বামী ও দুই ছেলেকে গ্রেপ্তার করে। সেনারা ওদের নিয়ে যাওয়ার সময় আমার বোন জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। সিলেটের একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে এই অভিঘাতে তার মৃত্যু হয়। সেনারা আমার বোনের বাড়িটিও জ্বালিয়ে দেয়।
ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে ২ ও ৩ মার্চ চট্টগ্রামের রেল কলোনি, ওয়্যারলেস কলোনি ও শের শাহ কলোনিতে বাঙালি ও বিহারিদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষের সময় কর্নেল ফাতেমির নেতৃত্বে পাঠান সেনারা বাঙালিদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। তারা হাজার হাজার নিরপরাধ বাঙালি নারী, পুরুষ ও শিশু হত্যা করে। তখন ফাতেমি ছিলেন চট্টগ্রামের সামরিক আইন প্রশাসক।
৪ মার্চ জেনারেল ইয়াকুব ফাতেমিকে সরিয়ে আমাকে ওই পদে বসান। দায়িত্ব নেওয়ার পর আমি রেলওয়েসহ বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করি। আমি দেখলাম, বাঙালিদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে ছাই করে দেওয়া হয়েছে, আর পাঠান সেনারা পোড়া বাড়িঘর পাহারা দিচ্ছে। ওই এলাকার প্রায় সব বাসিন্দাই ঘর ছেড়ে পালিয়েছে। আমি জানতে পারলাম, সেখানে অনেক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আর আহত ব্যক্তিদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজসহ অন্যান্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এরপর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখলাম, আগুনে পোড়া বহু রোগী সেখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন। হাসপাতালের নিবন্ধন বই পরীক্ষা করে দেখলাম, তাঁরা প্রায় সবাই বাঙালি।
যা হোক, ৩০ মার্চ মধ্যরাতে কারাগারে আমার কক্ষে কারা যেন কড়া নাড়ল। দরজা খুললে কেউ একজন বলল, ১৫ মিনিটের
মধ্যে প্রস্তুত হয়ে নিন, আপনাকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হবে। তখন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল, তার মধ্যেই ওরা আমাকে ঢাকা বিমানবন্দরে নিয়ে গেল।
করাচি বিমানবন্দরে নামার পর আমাদের মালির সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে এক রাত থাকার পর আমাদের খারিয়ান সেনানিবাসে নেওয়া হলো। ওখানে আমাদের এক পুরোনো রেস্টহাউসে রাখা হয়, জায়গাটা ছিল খারিয়া থেকে ১৪-১৫ মাইল দূরে। সেনা কর্তৃপক্ষ রেস্টহাউসটিকে কার্যত কারাগার বানিয়ে ফেলে। চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে তারা মেশিনগানধারী সেনাপাহারা বসায়। আমাকে পরিবারের কাছ থেকে আলাদা রাখা হয়। ওই ঘরে আসবাবও ছিল না। আমাকে বলা হলো, শুধু আপনার জন্যই এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। আপনার পরিবারের সদস্যরা এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যেতে পারবে, কিন্তু আপনি এই ঘরের বাইরে যেতে পারবেন না। আপনার পরিবারের ওপর এই বিধিনিষেধ নেই, তবে তারা এই বাড়ির সীমানাপ্রাচীরের বাইরে যেতে পারবে না।
---
আমাকে মেঝের ওপর শুতে হতো। ঘরে একটা দরজাবিহীন টয়লেট ছিল। দিনরাত ২৪ ঘণ্টা এক সেনাসদস্য আমাকে পাহারা দিত। এপ্রিল মাস থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত সেনা পাহারায় আমাকে ওখানে রাখা হয়। প্রতিদিন সকালে ওখান থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে ঝেলাম নামের এক জায়গায় জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য আমাকে নেওয়া হতো। জিজ্ঞাসাবাদের পর তারা আমাকে আবার রেস্টহাউসে নিয়ে আসত।
কখনো কখনো তারা আমাকে ২৪ ঘণ্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করত, কখনো কখনো টানা দুই দিন-রাত ধরে চলত জিজ্ঞাসাবাদ। যতক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ চলত, ততক্ষণ আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। তখন আমাকে খাবারও দেওয়া হতো না। তবে তারা আমাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করেনি।
যারা জিজ্ঞাসাবাদ করত, তারা আমাকে একই প্রশ্ন বারবার করত। তারা অভিযোগ করত, ‘শেখ মুজিব, কর্নেল ওসমানী ও আপনি দেশ ভাঙার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে বসে ষড়যন্ত্র করেছেন। আপনার ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার ছিল অভিযানের সদর দপ্তর।’ তাদের আরও অভিযোগ ছিল এ রকম, ‘আপনারা ছাত্র ও ইপিআরের সহায়তা নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের সব অস্ত্র কেড়ে নিতে চেয়েছিলেন। আপনি ভারত সীমান্তের সব খুঁটি সরিয়ে সেখান থেকে অস্ত্র আনতে চেয়েছিলেন। সে জন্য আপনি ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের একজন কমান্ডারের সঙ্গে খুলনায় বৈঠক করেছেন। আপনি পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডকে আপনার পরিকল্পনা জানিয়েছিলেন, তাদের সহায়তা চেয়েছিলেন। শুধু অস্ত্র ও গোলাবারুদ নয়, আপনি তাদের বলেছিলেন, আপনাদের ভারতে সামরিক প্রশিক্ষণের দরকার হবে। চট্টগ্রামের সব অবাঙালিকে গ্রেপ্তার করার পরিকল্পনা ছিল আপনার, আর প্রতিরোধ করলে তাদের আপনি হত্যাও করতেন।’
ইন্টার সার্ভিস ইনটেলিজেন্স (আইএসআই) ও পাকিস্তানি সেনা গোয়েন্দা সংস্থা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। আমি সব অভিযোগ মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিয়েছি। আগস্টের প্রথম সপ্তাহে কর্নেল আনজুম ও মোখতার আমাকে ঝেলামে নিয়ে যায়। তারা বলল, ‘কর্নেল ইয়াসিন নামের এক বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা আমাদের বলেছেন, আপনি শেখ মুজিবসহ অন্যান্য আওয়ামী নেতা ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডারের সঙ্গে দেখা করেছেন। ভারত কীভাবে আপনাদের সহায়তা করতে পারে, সে ব্যাপারে আপনি এসব বৈঠক করেছেন।’
একপর্যায়ে তারা বলে, ‘সেনাবাহিনী যেহেতু আপনার কাছ থেকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নিতে ব্যর্থ হয়েছে, সেহেতু আমরা আপনাকে বিশেষ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
পরদিন সকালে কয়েকটি সামরিক গাড়ি আমাকে ওই রেস্টহাউস থেকে লাহোরে বিশেষ পুলিশের সদর দপ্তরে নিয়ে যায়, যদিও আমার পরিবার ওখানেই থেকে যায়। সেনাবাহিনী আমাকে বিশেষ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে।
পুলিশের পরিদর্শক দুররানি আমাকে গ্রহণ করে মাটির নিচের কক্ষে আটকে রাখেন। তিনি আমাকে বলেন, ‘দুঃখিত ব্রিগেডিয়ার, আমরা আপনাকে মশারি, বালিশ ও বিছানার চাদর দিতে পারব না। এসব ছাড়াই আপনাকে এখানে থাকতে হবে।’
আমাকে যে ১২ নম্বর সেলে আটকে রাখা হয়েছিল, সেটা ছিল অনেকটা বাথরুমের মতো। এটা মূলত কারাবন্দীদের জন্যই বানানো হয়েছিল। সেখানে না ছিল কোনো জানালা, না ছিল পাখা ও ঘুলঘুলি। সেখানে উচ্চ পাওয়ারের একটি বাল্ব সব সময় জ্বালিয়ে রাখা হতো, এতে ঘরটি খুব গরম হয়ে যেত। সেখানে একটি কমোড ছিল। কিন্তু খাবারের ব্যবস্থা ছিল না ওখানে।
আমাকে সেলে বন্দী করার আগে কর্তৃপক্ষ আমার শার্ট ও প্যান্ট খুলে রেখে বন্দীর পোশাক পরতে দেয়। আমার সুটকেসে একটি ওজিফা (ধর্মীয় বই) ছিল। সেটা চাইলে ওরা আমাকে বলল, পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর দেওয়া হবে।
প্রথম দিন আমাকে খাবার দেওয়া হয়নি। পুলিশের পরিদর্শক দুররানি দ্বিতীয় দিন আমাকে দেখতে আসেন, কিন্তু সেদিন তিনি আমার সঙ্গে কথা বলেননি। রাতের বেলা এক সিপাহি তিনটি রুটিসহ এক বাটি সবজি নিয়ে আসেন। কিন্তু খেতে বসে দেখলাম, খাবারে এত ধুলাবালু রয়েছে যে মানুষের পক্ষে তা খাওয়া সম্ভব নয়। কিছুক্ষণ পর এক সিপাহি এসে থালাটা নিয়ে যায়। ফলে সারা রাত আমি না খেয়েই ছিলাম।
সকাল বেলা দুররানি বললেন, ‘খাবার খেয়েছেন?’
আমি বললাম, ‘না, খাইনি’।
তিনি বললেন, ‘কেন, আপনাকে খাবার দেয়নি’?
আমি বললাম, ‘আমার ক্ষুধা নেই,’ না খাওয়ার আসল কারণ তাকে খুলে বললাম না।
এরপর তিনি বললেন, ‘আপনাকে তো কিছু খেতে হবে, না খেলে আমরা কিছুই করতে পারব না। এর চেয়ে ভালো খাবার আমরা আপনাকে দিতে পারব না।’ তখন তিনি এক মগ চা ও একটি বড় রুটি আনার আদেশ দিলেন। দরজার নিচের জায়গাটা এত সরু ছিল যে সেখান দিয়ে মগটা ঢোকানো সম্ভব ছিল না, ফলে বাধ্য হয়ে দরজা খুলেই ওটা দিতে হলো।
এরপর বেলা ১১টার দিকে দুররানি দুজন সিপাহি নিয়ে এলেন। সিপাহি দুজন আমার হাত শক্ত করে ধরে ওপরে নিয়ে গেল, যে ঘরে সেনাবাহিনী আমাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছিল।
দুররানি অফিসের কর্তার ভঙ্গিতে উঁচু একটি চেয়ারে বসেন, আর আমি বসি একটা টুলের ওপর। শফি ও সাফদার কাজী নামের দুজন পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তাঁরা আমাকে অনেক প্রশ্ন করেন। তাঁরা বলেন, ‘আপনি চট্টগ্রামে অনেক অবাঙালিকে হত্যা করেছেন। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?’
আমি বললাম, ‘অবাঙালিদের আমি হত্যা করিনি। আমি চট্টগ্রামের সামরিক আইন প্রশাসক হওয়ার আগেই তারা মারা গেছে। আমার আগে কর্নেল ফাতেমি দায়িত্বে ছিলেন। তিনি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। সেনাবাহিনী অনেক বাঙালিকেও হত্যা করেছে। সে কারণে জেনারেল ইয়াকুব খান ফাতেমিকে সরিয়ে আমাকে ওই পদে বসান। তিনি টেলিফোনে আমাকে দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। আমি সামরিক আইন প্রশাসক হওয়ার পর কোনো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়নি।’
আমি যখন কথা বলছিলাম, তখন পুলিশ পরিদর্শক শফি লাফিয়ে উঠে আমাকে এত জোরে থাপ্পড় মারে যে আমি টুল থেকে পড়ে যাই। আমি মর্মাহত হই। আমি উঠে দাঁড়িয়ে উর্দু-ইংরেজি মিশিয়ে বলি, ‘তুমি আমার ছেলের বয়সী। আমার র্যা ঙ্ক ও বয়স খেয়াল করো, আল্লাহর দোহাই আমাকে মেরো না।’
তখন দুররানি আমাকে সেলে নিয়ে বলেন, ‘আমি দুঃখিত, কিছু মনে করবেন না।’ আমি শিশুর মতো কাঁদছিলাম। দুররানি বললেন, ‘উদ্বিগ্ন হবেন না, তারা ভবিষ্যতে এ কাজ আর করবে না।’
সেলে নিয়ে যাওয়ার পর আমি পবিত্র কোরআনের গুরুত্বপূর্ণ সূরা ইয়াসিন পড়তে শুরু করলাম। আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, কেউ সূরা ইয়াসিন পড়লে কেউ তাঁকে কখনো অপমান করবে না। সূরা পড়ার সময় আমি বারবার আমার মাথা দেয়ালে ঠুকে দিই। যা ঘটছিল আমি তা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমি কখনো কল্পনাই করিনি, পুলিশের একজন পরিদর্শক আমার মতো জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাকে থাপ্পড় মারতে পারে। এমনকি সেনা কর্মকর্তারাও তো এমন অসহিষ্ণুতা দেখায়নি।
---
আমি যখন চিন্তায় ডুবে ছিলাম, তখন দুররানি আবারও এলেন। তিনি আমাকে ওপরে নিয়ে গেলেন। সেখানে দেখলাম, ঘরের মধ্যে পাঁচ-ছয়জন মোটা মানুষ হয় দাঁড়িয়ে ছিল, নাহয় বসে ছিল। ওই ঘরে চেয়ার-টেবিল ছিল না। দুররানি শফিকে বললেন, ‘উনি কিছু স্বীকার না করলেও মারবে না।’ শফি রাগে চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘আপনি কী বলছেন? এই লোক চট্টগ্রামে আমাদের হাজার হাজার পাকিস্তানি ভাইকে হত্যা করেছে, না মারলে সে কিছু বলবে না। সে শেখ মুজিবের পক্ষ নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ছোটখাটো হলেও সে একটা অপরাধী। তাকে না মারলে আমি শান্তি পাব না।’
এরপর শফি ও কাজী আমাকে চড়-থাপ্পড় ও লাথি মারতে শুরু করে। তারা থামলে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষেরা ঘরে ঢোকে। তাদের হাতে দড়ি, থলে, ওয়াটার ব্যাগ ও হকিস্টিক ছিল। শফি ও কাজী এগিয়ে এসে আমাকে পিছমোড়া করে বাঁধার প্রস্তুতি নেয়।
হঠাৎ করেই দুররানি বলে ওঠেন, ‘মজুমদার তো হিন্দু নাম, দেখ, সে হিন্দু না মুসলমান।’ বলামাত্র সিপাহিরা আমাকে নগ্ন করে ফেলে, আমি কাঁদতে শুরু করি। দুররানিকে আমি বললাম, ‘ইন্সপেক্টর, আপনি বলেছিলেন আমাকে আর নির্যাতন সইতে হবে না। এর চেয়ে অমানবিক আর কী হতে পারে? আমি একজন বয়স্ক মানুষ। আমার চেহারা ও র্যাং কের দিকে খেয়াল করুন। আপনারা আমাকে সিপাহিদের সামনে নগ্ন করেছেন’, অপমানিত ও বেদনাক্লিষ্ট হয়ে আমি কাঁদতে থাকলাম।
দুররানি সিপাহিদের আমার কাপড় ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিলেন, এরপর আমাকে আবার সেলে নেওয়া হলো। ব্যথাটা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকল। আমার শরীর বেদনায় নীল হয়ে আসে। রাত যত বাড়তে থাকে, ততই আমার শরীরের ব্যথা বাড়তে থাকে। সেলে আমার মাথার ওপরে উচ্চ শক্তির বাল্ব জ্বালিয়ে রাখা হতো, ফলে রাতগুলো দুর্বিষহ হয়ে উঠত। সেল গনগনে চুলার মতো গরম হয়ে উঠত। সারা রাত আমি কাঁদতাম। একদিকে শারীরিক নির্যাতন, অন্যদিকে নগ্ন করা—এ দুইয়ে মিলে আমার নিদারুণ যন্ত্রণা হতো।
পরের দিন সকাল ১০টা–১১টায় আবার জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হলো। শফি ও দুররানি আমাকে বললেন, ‘গতকাল তো বললেন, আপনি এসবের কিছুই জানেন না। ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডারের সঙ্গে আপনি বৈঠক করেননি। কিন্তু কর্নেল ইয়াসিন আপনার সম্পর্কে আমাদের সব বলেছে।’
আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, ইয়াসিনকে আমার সামনে নিয়ে আসুন, আমি তাকে কিছু প্রশ্ন করব। তাহলে বুঝবেন, সে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছে। ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সঙ্গে আমার কোনো বৈঠক হয়নি।’ এরপর তাঁরা দুজনেই বেরিয়ে যান। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে তাঁরা বলেন, ‘ইয়াসিন কোরআন পড়ছে। সে কোরআন ছুঁয়ে বলেছে, তার কথা সত্য। কিন্তু সে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায় না।’ তখন আমি বললাম, ‘ঠিক আছে কোরআন নিয়ে আসুন, আমি কোরআন ছুঁয়ে বলব, সে মিথ্যাবাদী।’ জবাবে তাঁরা শুধু আগের কথারই পুনরাবৃত্তি করলেন, ‘ইয়াসিন কোরআন ছুঁয়ে বলেছে, সে মিথ্যা বলতে পারে না।’
হঠাৎ করেই শফি আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, অন্যরা আমাকে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে ফেলে। আমাকে বলির পাঁঠার মতো দুটি চেয়ারের মধ্যে বাঁধা হয়। এর মধ্যে তাঁরা আমার জামা ও প্যান্ট খুলে ফেলে। দুররানি একটি রডের মধ্যে তার পেঁচিয়ে নিলেন। দুটি চেয়ারের মধ্যে হকিস্টিক লাগানো ছিল, আমি তার ওপর ঝুলছিলাম। এরপর দুররানি নিজেই ওই রডটা আমার পায়ুপথে ঢুকিয়ে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া শুরু করেন। ওই যন্ত্রণা সহ্য করার মতো ছিল না, আমি প্রায় মূর্ছা যেতে বসেছিলাম। দুররানি বললেন, ‘আমরা আপনাকে দিয়ে যা বলাতে চাই তা না বললে আপনাকে ছাড়া হবে না।’
আমি বললাম, ‘দয়া করে আমাকে মেরেই ফেলুন, এই পাশবিক নির্যাতন করবেন না।’
এরপর তিনি উর্দুতে বললেন, ‘মরণে সে পেহেলে বহুত কুচ বাকি হ্যায়।’ অর্থাৎ মরণের আগে আরও অনেক কিছু বাকি আছে। এরপর আমাকে আবার সেলে পাঠানো হলো।
এই অমানুষিক নির্যাতন আরও কয়েক দিন চলে। একদিন দুপুরবেলা একটি চটের বস্তায় ভরে আমাকে আগস্ট মাসের গনগনে রোদের মধ্যে রাখা হলো। জিজ্ঞাসাবাদকারীরা আমার কাছ থেকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখে, আর আমিও সব অস্বীকার করে যেতে থাকি। একদিন আমাকে আবারও আরেকটি ঘরে নেওয়া হয়, আগে যে ঘরে আমাকে নির্যাতন করা হয়েছিল, ঠিক তার পাশেই। ঘরটি বৈদ্যুতিক সরঞ্জামে বোঝাই ছিল।
জিজ্ঞাসাবাদকারীরা আমাকে বলল, ‘বলুন, আপনার নেতা মুজিব ও পৃষ্ঠপোষক ওসমানীকে নিয়ে কী ষড়যন্ত্র করেছেন।’ প্রত্যাশিত উত্তর না পেয়ে তারা আমাকে উল্টো করে বেঁধে সিলিংয়ে ঝুলিয়ে দিল, এরপর ওয়াটার ব্যাগ ও পাটের রশি দিয়ে নির্মমভাবে পেটাতে শুরু করে। তারা এই কৌশল ব্যবহার করেছিল এটা নিশ্চিত করার জন্য যে মারের দাগ যাতে আমার শরীরে না পড়ে।
এতেও কোনো কাজ না হওয়ায় তারা আমাকে মাটিতে বসাল। আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, ‘দয়া করে আমাকে এক গ্লাস পানি দিন।’ এ কথা শুনে শফি প্যান্টের জিপার খুলে আমার মুখে প্রস্রাব করে দেয়, ‘ইয়ে লো পানি’, অর্থাৎ এই নাও পানি।
মেঝেতে আমি একা প্রস্রাবের মধ্যে শুয়ে থাকলাম। ১০ মিনিট পর জিজ্ঞাসাবাদকারীরা ফিরে এল। শফি আমাকে দাঁড় করিয়ে বলল, ‘তুমি কি মানুষ না অন্য কিছু। এত মার খাওয়ার পরও তুমি সত্য কথা বলছ না, কিন্তু তুমি কিছু না বলা পর্যন্ত তো এসব থামবে না।’
এরপর তারা আমার পা ওপরের দিকে টেনে একটি খাটিয়ার ওপর শোয়াল। আর দুররানি আমার ক্ষতবিক্ষত পায়ুপথে আবারও বৈদ্যুতিক শক দিল, যন্ত্রণায় আমি কঁকিয়ে উঠলাম। এদিকে এক সেনা আমার অণ্ডকোষে চাপ দেয়। এই দীর্ঘ যন্ত্রণা এত অসহ্য ছিল যে আমি শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিই, ‘নির্যাতন বন্ধ করুন, আপনারা যা চান, আমি তা-ই বলব।
---
দুররানি বলল, ‘বাহ্, আপনার হুঁশ ফিরেছে দেখছি, ঠিক আছে, উঠে দাঁড়ান।’ সেনারা একটি চেয়ার, টুল ও এক জগ পানি নিয়ে আসে, ওই পানি পান করে আমি তৃষ্ণা মেটাই। দুররানি বললেন, ‘আপনার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এসেছে সেগুলো লিখুন, তা না হলে কী পরিণতি হবে, সেটা তো দেখলেন।’ ছাদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে তিনি এ কথাটা বললেন, যেখান থেকে দড়ি, বৈদ্যুতিক তার ও নির্যাতনের উপকরণগুলো ঝুলছিল। ‘এসবই আপনার ওপর প্রয়োগ করা হবে, যদি নিজের ভালো চান, তাহলে যা বলা হচ্ছে তা-ই করুন।’
আমি বললাম, ‘আপনি লিখলেই ভালো হয়, আমি সই করে দেব।’ তিনি ভাবলেন, আমি হয়তো লিখতে পারব না অথবা আমি যদি লিখি তাহলে ঠিকমতো লিখব না, এতে মামলা দুর্বল হয়ে যাবে। তিনি আমার কথায় রাজি হন। এরপর তাঁরা আমার সঙ্গে যথাযথ ব্যবহার করতে শুরু করেন। এই প্রথমবারের মতো আমাকে ভাত-মাংস দেওয়া হলো। কিন্তু আমার শরীর বেদনায় নীল হয়ে গিয়েছিল, বিশেষ করে পায়ুপথ ও অণ্ডকোষে প্রচণ্ড ব্যথা ছিল। আমি দুররানিকে বললাম, ‘ভাই, আমার অবস্থা খুবই খারাপ, আমি প্রস্রাব করতে পারছি না।’
তিনি বললেন, ‘বিকেলবেলা আমরা আপনাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাব।’ দুর্গে একটি হাসপাতাল ছিল। চিকিৎসক আমার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখলেন, আমার পুরুষাঙ্গের ছিদ্র বন্ধ হয়ে গেছে, অণ্ডকোষ ফুলে গেছে আর পায়ুপথ সংক্রমিত হয়েছে। চিকিৎসক বললেন, ‘তাঁর অবস্থা খুবই খারাপ, তাঁকে এখানে রেখে চিকিৎসা দিতে হবে।’
দুররানি দ্বিমত করলেন, ‘তাঁকে এখানে রাখা সম্ভব নয়।’ এরপর চিকিৎসক দুররানিকে কিছু বললেন, যেটা আমি শুনতে পাইনি। তাঁর কথা শুনে দুররানি আমাকে হাসপাতালে রাখার ব্যাপারে আশ্বস্ত হলেন। রাতে আমাকে বেদনানাশক দেওয়া হলো। দুই-তিন দিন পর আমাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়া হলো।
জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্রে ফেরত আসার পর দুররানি বললেন, ‘আপনি ভালো ইংরেজি জানেন, আমি উর্দুতে বলব আপনি ইংরেজিতে লিখে নেবেন।’ এই পর্ব হয়ে গেলে তিনি বলেন, ‘এখানে যা লিখলেন, ম্যাজিস্ট্রেটদের সামনে তা-ই বলতে হবে, এরপর আপনি এটায় সই করবেন। আগামীকাল আপনাকে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নিয়ে যাব।’
পরবর্তী দিন দুররানি ও শফি গাড়িতে করে আমাকে লাহোরের এক ম্যাজিস্ট্রেটের চেম্বারে নিয়ে গেলেন। ম্যাজিস্ট্রেটের চেম্বারে প্রবেশ করার সময় নেমপ্লেটে তাঁর নাম দেখলাম ‘বাজওয়া’। তিনি আমাকে কোমল পানীয় দিলেন। তিনি আমাকে কিছু প্রশ্ন করলেন, যেমন আমি কোথা থেকে এসেছি, কোথায় পড়াশোনা করেছি ইত্যাদি। তাঁকে বললাম, ‘আমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক করেছি।’ তখন আমি তাঁকে বললাম, ‘ভাই, আপনি তো রাজনীতিক নন, ম্যাজিস্ট্রেট, একজন শিক্ষিত ব্যক্তি।’ আমার ভাইও একজন ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। আমি জানি, ম্যাজিস্ট্রেটরা নীতিমান মানুষ। পুলিশ যখন কাউকে নির্যাতন করার পর ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নিয়ে যায়, তখন সেই বন্দী আশা করেন, তিনি বিচার পাবেন, আর তিনি সঠিক বিবৃতিও দেওয়ার প্রত্যাশা করেন। আপনার কাছে আমার যে জবানবন্দি পেশ করা হয়েছে, সেটা আমার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নয়। পুলিশ আমাকে নির্মমভাবে নির্যাতন করে এতে সই করতে বাধ্য করেছে। সেনাবাহিনীর একজন কর্নেল ইয়াসিন মিথ্যা বিবৃতি দিয়েছে আর পুলিশ আমাকে সেটায় সই করতে বাধ্য করেছে। আমি আপনার সামনে অস্বীকার করছি, ওই বিবৃতি আমি দিইনি।’
ম্যাজিস্ট্রেট জবাব দিলেন, ‘ব্রিগেডিয়ার সাহেব, আপনি এখন সামরিক আইনের অধীনে আছেন। আর আপনি যদি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি অস্বীকার করেন, তাহলে পুলিশ আপনাকে আরও নির্মমভাবে নির্যাতন করতে পারে। এমনকি আপনাকে নির্যাতন করে মেরেও ফেলা হতে পারে। ফলে সবকিছু স্বীকার করে নেওয়াই ভালো।’
আমি বুঝলাম, এই ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ আসলে একই শ্রেণিভুক্ত। আমি বললাম, ‘আপনি যদি এ কথা বলেন, তাহলে আমি সই করব।’
এরপর আমাকে আবার পুলিশ সদর দপ্তরে ফেরত নিয়ে যাওয়া হয়। কয়েক দিন পর ব্রিগেডিয়ার এজাজ সেখানে আসেন। তিনি বলেন, স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে আপনার কোর্ট মার্শাল হবে। তিনি আসার আগে দুররানি আমাকে হুমকি দেন, আমি যেন এমন কিছু না বলি ও করি, যাতে তিনি বুঝতে পারেন, আমাকে নির্যাতন করা হয়েছে। আমাকে অন্তত ১০টি কনডেমড সেলে একাকী বন্দী রাখা হয়েছে। ফলে আমার খাওয়া-দাওয়া, ঘুম ও নামাজ অনিয়মিত হয়ে পড়ে। ভেবেছিলাম আমাকে হয়তো মেরে ফেলা হবে বা কোর্ট মার্শাল করা হবে।
মালাকান্দ দুর্গে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমি একদিকে জ্বরে ভুগছিলাম, অন্যদিকে পায়ুর সংক্রমণে। আমার মুখ ফুলে গিয়েছিল। শেষমেশ, চিকিৎসার জন্য আমাকে মারদান সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেই হাসপাতালের বিছানায় শুয়েই জানতে পারলাম, ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। ১৯৭২ সালের ১৫ জানুয়ারি পাকিস্তান আমাকে মুক্ত করে দেয়। সেখান থেকে আমি রাওয়ালপিন্ডির এক আত্মীয়ের বাড়িতে যাই। জানতে পারি, আমার পরিবারের সদস্যরা ঢাকায় চলে গেছে।
১৯৭২-এর মার্চে পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত ১৯৭১ সালের যুদ্ধ-বিষয়ক কমিশন আমাকে ডেকে পাঠায়। ১০ মার্চ আমি কমিশনের সামনে হাজির হই। আমি কমিশনের কাছে মৌখিক ও লিখিত বিবৃতি দিই, তাঁকে জানাই, পুলিশ নির্যাতন করে আমার কাছ থেকে ওই তথাকথিত বিবৃতি নিয়েছে। ফলে আমাকে আবারও গ্রেপ্তার করা হয়, সেখান থেকে আমার প্রত্যন্ত অঞ্চল দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানের ওয়ানা দুর্গে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, যেখানে আমাকে ১৯৭৩ সালের ৫ নভেম্বর পর্যন্ত একাকী বন্দী রাখা হয়। এরপর পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে বন্দী বিনিময় চুক্তির আলোকে ৬ নভেম্বর আমি বাংলাদেশে ফিরে আসি।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
(প্রথম আলোতে প্রকাশিত ধারাবাহিক থেকে সংকলিত)
ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদার (অব.): সাবেক সেনা কর্মকর্তা (১৯২২– ২০১১)
২৩ শে মার্চ, ২০১৬ দুপুর ১:৫৬
তিন বলেছেন: ধন্যবাদ
©somewhere in net ltd.
১|
২২ শে মার্চ, ২০১৬ রাত ১০:১৩
বিজন রয় বলেছেন: অনেক তথ্য।
শেষ করতে পারিনি।
ব্লগে স্বাগতম।
শুভব্লগিং।