![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ভালোবেসে খাই-দাই, ঘুরি
টোকন ঠাকুর
জনমানুষবিহীন অ্যান্টার্কটিকা নিয়ে আমি যতটুকু ভেবেছি, সত্যি যে, পেশা নিয়ে আমি তার অর্ধেকও ভাবিনি। পেশা-ভাবনা কেন যে ছিল না, জানি না। কি খেয়ে বাঁচব, কোথায় থাকব-- এ নিয়ে কখনই ভাবতে বসিনি। বন্ধুরা একে একে জীবিকায় মুখ গুঁজে হারিয়ে যাচ্ছে দেখে, গ্যাপ পূরণে আমার বন্ধু তালিকায় নতুন বন্ধু যোগ হয়। অনুজেরা বন্ধু হতে শুরু করে, তাদের সঙ্গে আড্ডা দিই। একদিন অনুজরাও ভাত খাবে বলে, বাড়িভাড়া দেবে বলে খুঁজতে থাকে পেশা, পেয়েও যায়। তারপর তারাও হারিয়ে যায় অফিস-পাড়ায়। সবুজ উদ্যান শূন্য থাকে না বেশিক্ষণ, চায়ের দোকানের বেঞ্চ ফাঁকা থাকে না, রাস্তায় লোক জোটেই জোটে-- ফলত, আমি আর পার্কের ঘাস ছেড়ে উঠতে পারি না, ফুটপাত ছেড়ে বেশি দূরে যেতে পারি না, যথাসম্ভব চা কিংবা দারুর দোকানের কাছে কাছে থাকি। ফলে, আমার যে একটা জীবিকা প্রয়োজন-- এ আর মনেই থাকে না। তাহলে, আমার কোনো পেশা নেই? তা বোধ হয় হলফ করে বলা যাবে না। একজন নাগরিকের অনেকগুলো শর্তই তো আমি মেনে আসছি। অর্থ খরচবহুল একটা মানবজীবনও আমি কাটিয়ে চলেছি। জাতিসংঘের সদস্য একটি রাজধানী শহরের বাসিন্দা আমি। বাড়িভাড়া দিতে হয়, কাঁচাবাজার যেতে হয়, রাস্তায় গাড়িতে উঠতে হয়, গায়ে পোশাক-আশাক পরতে হয়, শরীর বাগড়া দিলে ওষুধও কিনে খেতে হয়। পায়ে স্যান্ডেল জুতা পরতে হয়, আড্ডায় চা-সিগারেট-পানীয় ঢালতে হয় পেটে--সাকুল্যে একটা খরচবহুল জীবন। আমাকে এই জীবনটাকে দেখভাল করতে হয়। তারই প্রয়োজনে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি অনেকগুলো অপছন্দের চাকরি-চুকরি করেছি, অনেক প্রকার অফিসে গিয়েছি, অনাগ্রহেই গিয়েছি। ফলে একটা চাকরিও আমার ভালো লাগেনি। একটা চাকরিকেও আমি ভালোবাসতে পারিনি, ভালোবাসা তো দূরের কথা, সামান্য কোনও টানও নেই আমার কোনো চাকরিকে ঘিরে। তাই চাকরিতে আমি বেশ কিছু বছর অবস্থান করলেও চাকরি আমার পেশা হয়ে ওঠেনি, হোক এমনটি আমি নিজেও কখনো চাইনি। আরে বাবা, বেঁচে থাকবার জন্য এই প্রতিদিন রুটিন করে যাওয়া-আসা, এ কেমন কথা? এ কেমন জীবন!!
বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা অবস্থাতেই আমার টুকটাক ইনকাম শুরু হয়ে যায়। তবে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের ধ্রুপদী পেশা ‘টিউশনি’ আমিও করেছি। সেটা ঢাকা শহরে। যদিও সে সময় টিউশনি করাও আমার পছন্দের ছিল না। দায়ে পড়ে করেছি। ঢাকার কমলাপুর, সিদ্ধেশ্বরী ও আদাবর এই তিন জায়গায় আমি ছাত্র পড়িয়েছি। কমলাপুরে ছিলাম ড্রইং টিচার, চারুকলায় পড়ার সুবাদে; আদাবরে পড়াতাম উচ্চ মাধ্যমিক বাংলা এবং সিদ্ধেশ্বরীতে পড়াতাম এক এসএসসি পরীক্ষার্থীর সব সাবজেক্ট। আদাবর ও সিদ্ধেশ্বরীর টিউশনি জুটিয়ে দিয়েছিল জহির হাসান। জহির কবি, রসায়নের ছাত্র। জহির বহির্বিশ্বের শিল্পসাহিত্যের দাঢ্য পাঠক এবং নানান দেশের সিনেমার প্রতিও ওর নেশা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বঙ্গবন্ধু হলে দীর্ঘ ছয় মাস আমি জহিরের সিটেই ঘুমোতাম থাকতাম। জহির আমার প্রকৃত বন্ধুদের একজন। তাই উড়নচণ্ডি জীবনে দুইটা টিউশনি জুটিয়ে দিয়ে আমাকে উপার্জনক্ষম হয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল কবি জহির হাসান। আর চারুকলায় পড়ার কারণে ‘খ্যাপ’ মারতাম দল বেঁধে-- সেও কিছু উপার্জন ছিল। ‘খ্যাপ’ বলতে সেদিন সবাই বুঝত বিয়ে বাড়িতে আল্পনা, কোনো অফিস ডেকোরেশনের সৌন্দর্য বাড়ানো বা এই ধরনের আর কি। তো মনে আছে, একবার প্রাইড টেক্সটাইলসের থানের উপর ফ্রি হ্যান্ড ডিজাইন করার কাজ পেলাম আমরা কয়বন্ধু। ফ্যাক্টরি খিলগাঁও। প্রত্যেক শাড়িতে ডিজাইন কমপ্লিট করলে দুইশ টাকা, হয়তো আমরা সারাদিন করতাম প্রত্যেকে ৯ কি দশ বা এগারোটা শাড়ি। টাকা পাচ্ছিলাম দুই হাজার বা তারও বেশি। মাসখানেকে ইনকাম হলো প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকার কাছাকাছি। মিড-নাইনটিজের চারুকলার স্টুডেন্ট হিসেবে তখন হলে থাকা জীবন-- পঞ্চাশ হাজার টাকা মাসে মানে তো বিরাট কিছু। সেই বিরাট কিছু করলাম মাস তিনেক। উপার্জন করেছি, সঞ্চয় করিনি। সঞ্চয়ে মন নেই আমার। তাই কুলি-মজুরির শ্রমিকের মতোন দিনের উপার্জনের টাকা সেই দিনই রাত নাগাদ উড়িয়ে দিয়েছি। এর নাম জীবন, রাজকীয় নিঃসঙ্গতার জীবন। প্রচুর কবিতা লিখেছি, উপার্জন করেছিই হয়তো কবিতা লেখার জন্য। কবিতা লেখার জন্য ঢাকা থাকতে চেয়েছি। তাই একটা বাসাভাড়া নিয়েছি, মাসে মাসে বছরে বছরে বাড়িভাড়া, বুয়ার মাসোয়ারা, কাঁচাবাজারের জন্য খরচাপাতি করে গেছি। এতে বাংলা কবিতার কি উপকার করতে পেরেছি জানি না, আমার এরই মধ্যে দুইটা দশক গেছে। সেরা সময়। এই সময়টার দাম ত্রিশ কোটি বিলিয়ন মিলিয়ন ডলার। টাকায় এর হিসেবই হবে না।
গত দেড় দশকে আমি বিভিন্ন অফিসে চাকরি করেছি। ১৫ বছরে চাকরির সংখ্যা ১৯টা। সর্বোচ্চ সময় কোনো চাকরি করেছি দুই বছর দুমাস। কোনো চাকরি ছয় মাস, কোনোটার বয়স এক মাস, এক সপ্তাহ চাকরিও করেছি আমি। পোষায়নি। না আমাদের, না চাকরির বাবাদের। আসলে আধুনিক পৃথিবীর এই চাকরি আমার ধাতে নেই। চাকর হতে ইচ্ছে করে না। লেগে যায়, বেধে যায়। তারপর অফিসিয়াল নিয়মকানুনের তার ছিঁড়ে যায়। তখন একটা বিচ্ছিরি পরিবেশ তৈরি হয় কিছুদিনের জন্য। চাপা উত্তেজনা আসে। সুতো একসময় ছেড়েই। হয় তাগো দ্বারা, না হয় আমি-ই ছিঁড়ে ফেলি। কিছুদিন ফের ডানা মেলে দিই, স্বাধীনতা উদযাপন করি। তারপর বাড়িভাড়া জমে যায়। আবার কিছু না কিছুর সন্ধানে, মূলত অর্থের সন্ধানে এদিকওদিক ঢুঁ মারি। জুটেও যায়। আবার মৌমাছি হই, মধু সংগ্রহের পেশায় বনে বনে ঘুরে বেড়াই, উড়ে বেড়াই...
বেশ কয়েকটা সংবাদপত্রে কাজ করেছি এ জীবনে। সাব-এডিটর অ্যাপ্রেনটিস দিয়ে শুরু, তারপর সাব-এডিটর, সিনিয়র সাব-এডিটর, ফিচার সম্পাদক, সহকারী সম্পাদক পদে পর্যন্ত কাজ করেছি। সাহিত্য সাময়িকী সম্পাদনাই ছিল সংবাদপত্রে আমার প্রথম বড় চাকরি। বড় আর কি, বড় কেরানি, বড় চাকর। খুব বড়ও না, আঙুলের সমান।
দৈনিকের সাহিত্য সম্পাদনার চাকরির সুবাদে সেই আমার ছাত্রজীবনেই আমি ঢাকার প্রায় সব কবি-সাহিত্যিককে তাদের কাছে থেকে দেখার সুযোগ পাই, আলাপেরও অন্তরঙ্গ সুযোগ হয়। সম্পর্ক হয়। সে সম্পর্ক একদিন ভেঙেও যায়। সম্পর্ক হওয়া একটা সম্পর্ক, সম্পর্ক ভেঙে যাওয়াও আরেক সম্পর্ক, তারপর ধীরে ধীরে ভাঙা সম্পর্কটা অন্য এক ‘চুপচাপ সম্পর্কে’ রূপ নিতে থাকে। লেখা আনতে যেতাম শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ থেকে হুমায়ুন আজাদ-- আহমদ ছফা বা ফরহাদ মজহার বা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী থেকে রশীদ করীম বা শওকত ওসমান পর্যন্ত। মোহাম্মদ রফিক, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, সেলিম আল দীন বা সেলিনা হোসেন কিংবা আবুল হোসেন, শহীদুল জহির, মামুন হুসাইন-- প্রায় সবাইকেই একধরনের ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্যেই পেয়ে যাই দ্রুত। এটা নিঃসন্দেহে সেই ‘সাহিত্য সম্পাদনা’র চাকরির ফল। ‘সুফল’ বলব কি?
কিছু এনজিওতে কাজ করেছি। সবই রুটি-রুজির তাগিদ, নগরে ভাড়া থাকবার বন্দোবস্ত। বেশিরভাগ চাকরিতে আমাকে তারা নিয়েছে খুব বড় মুখ করে, কিন্তু অচিরেই একদিন তিক্ততার মধ্য দিয়েই অবসান হয়েছে সেসব চাকুরেপনার। সত্যি, আমার বাবা সারাজীবন চাকরি করে এলেন এবং আমাদের তিন ভাইবোনকে মানুষ করলেন। বাবার সেই চাকরির উপর চড়েই আমার মা পুরো সংসারের টাল সামলানোর চেষ্টায় ব্যস্ত থাকলেন, কিন্তু চাকরি জিনিসটার প্রতি আমার চূড়ান্তভাবে ভীষণ অবজ্ঞাই তৈরি হয়ে গেল। অ্যাড এজেন্সিতে কাজ করেছি।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ঢাকা হেড কোয়ার্টারে ‘বিজয় কেতন’ বলে যে সামরিক জাদুঘরটি আছে, সেখানে আমি বেসামরিক চাকরি করেছি প্রায় চার মাস। সেই রুটি-বিড়ি-চা খাওয়ার নেশায়। একবাক্যে, বেঁচে থাকবার প্রয়োজনে। ‘বিজয় কেতন’-এ আমার কাজ ছিল, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ব্যারাক থেকে পালিয়ে যাওয়া ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সম্মুখ সমরের ইতিহাস সম্পাদনা করা। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমর হয়েছিল ১০৪টি। সেই ইতিহাস লেখা সামরিক কর্তাদের, আমার কাজ ছিল সেগুলো সম্পাদনা করে উন্নত জাতের টেক্সট হিসেবে প্রণয়ন করা। দুঃখের বিষয়, আমার সেই ৪ মাসের বেতন আমি রাগ করেই, না নিয়েই চলে আসি। প্রজেক্ট হিসাবে ৪ মাসের টাকা একসঙ্গে দেবার কথা ছিল। এক সামরিক কর্তার সঙ্গে দেশের পার্বত্য অঞ্চলের বিষয়-আশয় নিয়েই প্রথমত তর্কাতর্কির ফল হিসাবে আমি এ.এইচ.কিউ থেকে চলে আসি রাগ করে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দফতর আমার সে রাগ ভাঙায়নি। ফলে, বিজয় কেতন প্রজেক্টের কাজের টাকা টা আমি পাইনি। এই ভাবে, কয়েকটি সংবাদপত্রে অনেক টাকা বেতন আটকে পড়েছে, সে অবস্থায় চলে আসতে হয়েছে সেই কাগজ ছেড়ে। বেতন না নিয়েই। হয়তো ছ মাসের বেতন। ফলে, অর্থনীতির সেই চাপ আমাকে নিতে হয়েছে। তখন হয়তো কুঁকড়ে গেছি, দুমড়ে গেছি। মাসের পর মাস আবার পথে পথে হেঁটেছি, কারণ চাকরির প্রতি ঘৃণা ধরে গেছে। ব্যবসা যে করব, মূলধন তো আমার শরীরের অঙ্গ। এ দিয়ে ব্যবসা করব না আমি। কিন্তু সৃষ্টির নেশায় মাতাল থাকতেই ভালো লাগে। কবিতা লিখি, কবিতা এক অনবদ্য সৃষ্টি। স্বপ্ন দেখি, স্বপ্ন মানবজীবনের সবচেয়ে বড় প্রজেক্ট, এর ভেতর থেকে বেরুনো যায় না। বেরুবইবা কেন?
টেলিভিশনে কাজ করা, স্ক্রিপ্ট লেখা-- এগুলোও করি মাঝে মধ্যে। ঐ যে, রুটি-রুজি-বাড়িভাড়া আছে না? বেনসন কিনতে টাকা লাগে না? ভ্রমণের বাতিক আমার, অর্থ লাগে না?
এখন ছবি বানাচ্ছি। ছবি বানানো পেশা বটে তবে তা এখনো আমার জন্য এখনো নয়। ছবি বানানোটা আমার নেশার ব্যাপার। চরম নেশার চাপেই ছবি বানাতে উৎসাহী হয়ে পড়ি। সে নেশারই এক নাম ‘ব্ল্যাকআউট’। আমার প্রথম ছবি। নেশা এখন ‘কাটা’তে। ‘কাঁটা’ সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত ২০১৩ অর্থবছরে। মাত্র পঁয়ত্রিশ লাখ টাকা এমন কোনো টাকাও নয়। ‘কাঁটা’ বানাতে আরো অর্থ লাগবে। টাকা সংগ্রহের চাপে পেশার কথা আর মনে থাকে না। এ কেমন কথা? কথা না ইয়ার্কি? শুনেছি, আঁতুর র্যাঁবো নাকি পেশাকে ঘৃণা করতেন। আমি করি। দেখলাম তো, পেশাগত কারণে এক বন্ধু মনে করে সে বিশাল বটগাছ, কারণ সে অনেক টাকা কামাই করে। আরেক বন্ধু মনে করে, সে কম টাকা কামাই করে তাই সে বড়জোর একটা বদনা। সমাজের সে প্রয়োজন, তবে তা গৌন পর্যায়ের। পেশা মনে হয় মানুষকে ছোট-বড় করে দেয়। তাই হয়তো কারো পেশা জল্লাদগিরি, কেউ ডোম, কেউ মেথর, কেউ গভর্নর, কেউ খেয়াঘাটের মাঝি। কেউ সেনাপ্রধান, কেউ রিকশাচালক। পেশা বড় ভয়ানক এক খেলায় লেলিয়ে দেয় মানুষকে। আমাকে দিতে পারেনি। কারণ, ১৫ বছরে ১৯/২০টি চাকরি করে আমি এখন সর্বতোভাবে চাকরিকে ত্যাগ করেছি। চাকরি করার কালটুকু আমার জীবনের মাইনাস সময়। আবার এই প্রশ্নও করা যেতে পারে, যা করতে হয়েছে, তাই সত্য, কারণ তা ঘটেছে। তাহলে সত্যের অধিক আন কিইবা আছে?
তবে পত্রপত্রিকায় সাময়িকীতে ঈদ সংখ্যায় বা নানান বিশেষ সংখ্যায় লিখে চলেছি প্রায় দু’দশক। লিখে আমি টাকা পাই। কবিতার মতো সন্ধ্যার জোনাকিসদৃশ আলো থেকেও আমি টাকা কামাই করি, ধলেশ্বরীর ঢেউ গুনেও আমি চাল-ডাল কেনার পয়সা জুটিয়ে ফেলি। সুন্দরবনে গিয়ে, ‘ট্রেইল’ দেখে ঢাকায় ফিরতে না ফিরতেই দেখি, আমার পকেটে টাকা। এমনকি কোনো কোনো জোসনা রাতের বিষণ্ন ঈগলের উড়ে যাওয়া ডানায় আমি ডলার দেখেছি, পরিত্যক্ত রাজবাড়ির বারান্দায় ইউরো পড়ে থাকতে দেখি। কিন্তু সবই খরচ করে ফেলি। গ্রামের নদীপাড়ের মেলায়, নিজের বুকের মধ্যে উছলে ওঠা জ্বালায় বা বহ্নিশিখা উপজেলার স্মরণীকুসুম বালিকার জন্য মন ছটফট করে উঠলেই আমার খরচ বাড়ে। দেদারসে...
কবি বলতে যা বোঝা যায়, আধুনিক নগরজীবনে তার জীবনধারণ সম্ভব? আমি কবিজীবন বলে কোনো জীবনে বাস করি না। লিখি বটে। ইচ্ছে হয়, লিখি। হয়তো এ এক ধরনের চিন্তা-ভাষা-শব্দ-বাক্যের ফলাফল, অনেকটা না-পারা জীবনের মর্মলিপি লিখে যাওয়া আর কি... এর বেশি কোনো কিছু? কবির পেশা কী হতে পারে, এই সময়, এমন সেমন রাষ্ট্রে?
স্বপ্ন দেখা বা স্বপ্ন দেখানো কি কোনো পেশা-মর্যাদা পেতে পারে আজকের সমাজ-ব্যবস্থায়? যা পারি না, পারতে চাই, তার লিখিত রূপ কি কবিতা? যিনি লেখেন, তিনিই কি কবি? সাধু আর কবির মধ্যে পার্থক্য কি? এ রকম অসংখ্য প্রশ্নের মধ্যে মাথা রেখে ঘুমোতে যাই। ঘুম থেকে উঠেও দেখি, আবার ছুটে আসছে একটার পর একটা প্রশ্ন। কেন হঠাৎ আকাশে মেঘ জমা হয়? মেঘ দেখলেই মনটা কেন, কেমন যেন করে? আকাশ নামের যে শূন্যতা, তার শেষ কোথায়? দার্শনিক ও কবির মধ্যে কি কি পার্থক্য বিরাজমান, সেকালে, একালেও? মেয়েটি ওভাবে তাকাল কেন? সে কী চায়? সে কি একটি নিয়মবদ্ধ সমাজের নীতিগুলোকে অস্বীকার করতে চায়? অস্বীকার করতে চায়, কিন্তু পারে না, একদিন তার বিয়ে হয়ে যায়, সে কোথায় যায়? সে কি আর ফেরে কখনো? কত কত মেয়ে, কোথায় চলে গেল? কত কত যুবক, তারা স্রেফ ‘আদর্শ’ নামক এক গন্তব্যের দিকে যেতে যেতেই পথে হারিয়ে গেল? এত মানুষ জন্মাল, মরে গেল, তারা এক এক সময়ের মানুষ, সময় কি তাহলে? সময়ের গন্তব্য কোথায়? ইত্যাকার প্রশ্নের থোকা এসে দানা বাঁধে মনে। মনই-বা আবার কি? দেখলাম তো, কত মন মরে স্রেফ বালুচর হয়ে চিকচিক করছে নদীতীরে... আহারে, পাখির মনটা বুঝতেই পারেনি মানুষের জীবিকা একটা বড় ফ্যাক্টর। তাহলে পাখিমন পেয়ে আমার কী হলো? এই পৃথিবীতে জীবিকার পরিচয়েই বেশিরভাগ মানুষকে পরিচিতি বহন করতে হয়। জীবিকা হতে পারে সেক্স ওয়ার্ল্ডের ব্রোকার বা বেশ্যার দালাল, জীবিকা হতে পারে অধ্যাপনা। যেমন, মানুষের আদিমতম একটা জীবিকা হচ্ছে কৃষিকাজ বা খাদ্য উৎপাদন। কিন্তু ফুলের জীবিকা কি? মৌমাছির উৎপাদন প্রক্রিয়াটা কি ধরনের হয়ে থাকে? গোরখোদকের জীবিকা না হয় বোঝা গেল, বোঝা গেল কফিন বিক্রেতার জীবিকাও কিন্তু যে লোক মনে করে সৌন্দর্য অবলোকন ও পান করাই তার কাজ-- তার জীবিকা ধারণা শুধরে দেবে কে? ট্রেনে ট্রেনে দোতরা বাজিয়ে গান গেয়ে যাওয়া অন্ধ বাউলেরও কাঁচাবাজারে যেতে হয়, দরজিখানায় যেতে হয়, শরীরের মাপে পোশাক বানাতে হয়, সভ্য হতে হয়; দেখলাম তো, সভ্যতার নাম করেই পেশাজীবিতার তুমুল দাপট প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এ সময়, নব্বই ভাগ নিরক্ষর ও বংশ পরম্পরায় হাড়ের মধ্যেও ক্ষুধার্ত মানুষের এই দেশে আধুনিক কবিতার মতো লিখিত টেক্সটে একজন কবির জীবিকা-আখ্যান কতখানি ‘সমাজ-মনস্ক’ বা আলোচ্য হতে পারে? আশ্চর্য! পেশা এক অদ্ভুত ব্যবস্থা। এক লোক তার গাই গরুর দুধ বিক্রি করে ওষুধ কেনে, আবার গাঁজাও কেনে। গাঁজা বিক্রেতাও দুধ বিক্রেতার কাছ থেকে পাওয়া টাকায় দুধ কিনতে পারে, ওষুধও কিনতে পারে, চাল-ডাল-নুনও কিনতে পারে। পারে কি, কিনে থাকে। পেশা কি তাহলে পারস্পরিক বিনিময়?
ছোটবেলায় ভাবতাম, বড় হলে সিনেমা হলের গেইটম্যান হব। সেটা কেন ভাবতাম? পরে ভেবেছি, না, নাবিক হব। বন্দরে বন্দরে ঘুরে বেড়াব। সমুদ্রের জল ছুঁয়ে ভেসে যাব অজানা অজানা দেশে। পোর্ট কলোনি থেকে জাহাজ নোঙর গুটিয়ে অন্য দেশের দিকে মুখ ঘোরাবে। মাঝে মধ্যে, মাঝ-সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসে দিক হারিয়ে ভেসে যাব আরো দূর সমুদ্রের ভেতর, শঙ্কিত হয়ে পড়ব, বাঁচা-মরার লড়াই আছড়ে পড়বে ঢেউয়ের ওপর-- তারপর হয়তো আমরণ চেষ্টায় হঠাৎ একটা দ্বীপ দেখতে পাব। যেহেতু, ‘পৃথিবীতে নেই কোনো বিশুদ্ধ চাকরি’ বলেছিলেন শ্রী জীবনানন্দ দাশ, তাই হঠাৎ রাগ করে ছেড়ে দেব নাবিকের চাকরি, মনে হয়, যাই নড়াইলে যাই। রূপগঞ্জের পরে মাঝিমদিয়ায়, নিশিনাথতলা মন্দিরের পাশে একটা দেশী তেঁতুলের দোকান দিয়ে বসি। পাশেই ভিক্টোরিয়া কলেজ। কলেজের মেয়েরা অন্তত তেঁতুল কিনতে আসবেই আসবে। তখন আমি হব তেঁতুল বিক্রেতা, আর রাতে বাসায় ফিরে কবিতা লিখব। হয়তো কবিতার মধ্যে ঢুকে পড়বে তেঁতুলের আচার, ঘ্রাণ, কাব্যগ্রন্থের নামও এখন ঠিক করে ফেলতে পারি, ‘তেঁতুল, আছে বলেই।’ কী, কেমন হবে? কেমন হয়, এ জীবনে সত্যি সত্যি একজন তেঁতুল বিক্রেতা হলে, কলেজের পাশে দোকান দিলে? আরেকটি গোপন ইচ্ছা আমার মনে উঁকি দেয় মাঝে মধ্যে।
সে কারণে, মহিলা হোস্টেলের দারোয়ানদের আমি ঈর্ষা করি। ‘ঐ চাকরিটা পেলে এ জীবন বর্তে যেত,’ এ কথা কাউকে বলতে পারি না। কেন, ওটা কি একটা ভালো পেশা নয়? তাহলে আমি কেন ছাত্রীনিবাসের দারোয়ান হতে পারব না?
জীবিকা নিয়ে বহু তাত্ত্বিক, গুরু-গম্ভীর কথা থাকতে আমার মনে দারোয়ানের চিন্তা কেন আসে? আসলে আমি কি করব? এটা আমার দোষ? এই দোষের বিচার কি? মোটের ওপর, পেশার চিন্তায় আমি কোনো দিন সিরিয়াস ছিলাম না। চাকরি ধরলাম আর ছাড়লাম একটার পর একটা। এটাই এক মজা। মজাই পৃথিবী।
কবিতা লিখেছি, কবিতা লেখাই পেশা ছিল। ছবি বানাচ্ছি, ছবি বানানোই পেশা এখন। স্বপ্ন দেখব, স্বপ্ন দেখাই পেশা আমার। ভালোবাসব, ভালোবাসাটাই বাঁচা আমার। তাই, ভালোবেসে যাই, খাই।
শেষ কথা বলে কিছু নেই, তবু বলছি, মনের মধ্যে টান পড়ে, ভালোবাসার নেশা লাগে, কারণ, নেশাই আমার পেশা। আমার পেশাই হচ্ছে নেশা লাগা। এখন উঠছি, নেশা লেগেছে...
২০ জুলাই ২০১৩, ঢাকা
বণিকবার্তা-সিল্করুট-ঈদ সংখ্যা
©somewhere in net ltd.
১|
২০ শে আগস্ট, ২০১৩ বিকাল ৫:২৬
অলওয়েজ ড্রিম বলেছেন: আসলে সৃষ্টিশীল মানুষের এই এক সমস্যা। কাজ তার ভালও লাগে না আবার না করেও পারা যায় না। আর এই টানাপড়েনটা থাকা ভাল। সৃষ্টির প্রয়োজনেই। জীবনে এই সব হেপো থাকাটাও বৈচিত্রের খোঁজ দেয়।
ভাল থাকবেন সব সময়।