নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বিশেষভাবে তৈরী বিশেষত্বহীন এক যুবক

ইমরান হাসান তুহিন

ইমরান হাসান তুহিন › বিস্তারিত পোস্টঃ

টেলিকাইনেসিস

০৩ রা অক্টোবর, ২০১৬ সকাল ৯:৪৬

আমি যে দিন প্রথম মেসে উঠলাম, ফাহাদ ভাইকে প্রথম দেখি। অসম্ভব ফর্সা আর রোগা একজন মানুষ। আমাকে দেখে মুচকি হেসে বললেন,চা খাবা?
আমি বললাম,খাবো।ভাই হো হো করে হেসে চা বানাতে গেলেন।
প্রথম পরিচয়েই বুঝেছিলাম অসম্ভব ভালো একজন মানুষ তিনি।
.
শহরের রাস্তাঘাট কিছুই চিনি না। এমন অসংখ্যবার হয়েছে যে পথ ভুলে অন্যকোন জায়গায় চলে গিয়েছি।ভাইকে ফোন দিতেই তিনি বের হতেন আমাকে খুঁজে বের করতে। আমি প্রতিবারেই ভাবতাম তিনি বিরক্ত হবেন। কিন্তু প্রতিবারই আমাকে একটা হাসি মুখ দেখতে হয়েছে। একদিন তো বলেই ফেললাম, ভাই আমি এই যে পথ হারিয়ে ফেলি,আপনার বিরক্ত লাগে না?
তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিলেন, তোমার এই পথ হারানোটা আমার ভালো লাগে।
.
ভাইয়ের রুমমেট হওয়ার কারণে অনেক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তিনি রাত জেগে বিভিন্ন বই পড়তেন আর প্রচুর সিগ্রেট খেতেন। বিজ্ঞান,রাজনীতি,দর্শন,ধর্ম---সব ধরণের বিষয়ে তার ধারণা ছিল।তার সিগ্রেট এর ব্রাণ্ড ছিল ক্যাপস্টান।
.
গভীর রাতে ঘুমালেও তিনি ভোর বেলা উঠতেন। চা বানাতেন। আমি দেরীতে উঠতাম। দেখতাম আমার মাথার পাশের টেবিলে এককাপ চা রাখা। সেই ঠান্ডা চা খেয়েই আমার প্রতিটা দিন শুরু হতো।
তাকে আমি কখনো হাফ শার্ট পরতে দেখি নি।ফুল শার্ট পরতেন। অসংখ্য বার জিজ্ঞেস করেও এর কারণ জানতে পারি নি।
.
এক বছর একই রুমে থেকেও আমি ভাইয়ের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কিছু জানতে পারি নি। আমি শুধু জানতাম মাঝে মাঝে তিনি একটা মেয়ের সাথে কথা বলেন। মেয়েটার নাম ফারজানা। মেয়েটা ভাইয়ের বন্ধু, নাকি প্রেমিকা এটা কখনো জানা হয়নি।
.
একদিন গভীর রাতে বললেন, আমার একটা বোন ছিল। যমজ বোন।খুব ছোট বেলায় সে মারা যায়। তার নাম রানু। আজ তার মৃত্যুদিন।
আমি বললাম, আগে কখনো বলেন নাই কেন এটা?
উত্তরে তিনি কিছু বলেন নি।
.
আমি ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করলাম ফাহাদ ভাই প্রচুর ডিপ্রেশনে ভোগেন। কিন্তু কিসের জন্য এতো ডিপ্রেশন, কখনো কাউকে বলতেন না।
.
একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখলাম ফাহাদ ভাই রুমে নেই। তিন দিন কোন খোঁজ নেই। আমি অনেক দুশ্চিন্তায় ছিলাম। তিন দিন পরে গভীর রাতে তিনি ফিরলেন। আমি বললাম, ভাই কোথায় ছিলেন? কোন সমস্যা?
তিনি বললেন, এইতো ছিলাম। কোন সমস্যা নাই।
.
আমি সেদিন যথেষ্ট বিরক্ত হলাম। ভাইয়ের সাথে কথা বার্তা খুব কম হতো শেষের দিকে। একদিন খেয়াল করলাম তিনি সারাদিন “টেলিকাইনেসিস” এর উপর লেখা বই পড়ছেন। আর তা প্রাকটিস করছেন।
.
টেলিকাইনেসিস হলো মানসিক শক্তি ব্যবহার করে কোন বস্তুকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া। আমার বিষয়টা যথেষ্ট হাস্যকর মনে হলো। আমি দেখতাম ঘণ্টার পর পর ঘণ্টা তিনি এই চেষ্টা করেই যাছেন...
.
আমি ভার্সিটির পাশে একটা সুন্দর বাসা পেলাম। ভাইকে বললাম, আমি সামনের মাসে চলে যাবো। তিনি কিছু বললেন না।
চলে যাওয়ার আগের রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো। ফাহাদ ভাই তখনো জেগে। মুচকি হেসে বললেন,খুব করে চাইছিলাম যেন তোমার ঘুম ভাঙে। চা খাবা?
আমি বললাম,খাবো।
.
ভাই চা বানাতে গেলেন।সেদিনও শব্দ করে হাসলেন। কিন্তু সেই হাসির ভেতর এমন কিছু ছিল যা মন খারাপ করিয়ে দেয়।
.
চা খেতে খেতে সিগ্রেট ধরালেন। বললেন, চার বছর বয়সে মা আমাকে আর রানুকে রেখে চলে যায়। মায়ের চেহারা আমার মনে নেই। বাবা আমাদের দুই ভাইবোনকে নিয়ে হিমশিম খেতে থাকেন। আমি সুস্থ থাকলেও আমার বোন দিন দিন অসুস্থ হয়ে যেতে লাগলো।
রানু ছিল আমার খেলার সাথী। আমরা দুজন সারাদিন একসাথে থাকতাম। খেলা করতাম। রানুর মৃত্যু আমার শিশু মনে গভীর দাগ কাটে। ও মারা যাওয়ার পর আমি একা হয়ে গেলাম। আমি বড় হতে শুরু করলাম মায়ের প্রতি ঘৃণা আর বাবার প্রতি বিরূপ মনোভাব নিয়ে।কারণ আমি জানি ,রানুর মারা যাওয়ার পেছনে মায়ের চলে যাওয়া আর বাবার উদাসীনতা দায়ী।
.
এই পর্যন্ত বলে ভাই থামলেন। বললেন,যাই হোক কথাগুলো কেউ জানে না।
তোমাকে বললাম। কেন বললাম জানি না।
আমি বললাম, এখন আপনার মা বাবা কেমন আছেন?
ভাই বললেন, একমাস আগে বাবা মারা গেছেন। তিন দিন গ্রামে ছিলাম এই জন্য।
আমি বললাম, আর মা??
ফাহাদ ভাই ক্লান্ত কন্ঠে বললেন, তুমি ঘুমাও। অনেক রাত হলো।
.........
আমি মাঝে মাঝে ফাহাদ ভাইয়ের সাথে দেখা করতে যেতাম। যখনই যেতাম উনি চা বানিয়ে খাওয়াতেন। টেলিকাইনেসিস প্রাকটিস তখনো চলছে।একদিন বললাম, ভাই ফারজানা আপু কেমন আছেন?
উনি বললেন, ফারজানা নামের কেউ কখনো ছিল না।
............
তারপর অনেক দিন পেরিয়ে গেছে।আমি এখন শহরের রাস্তাঘাট চিনে গেছি। এখন আর পথ হারাই না। মাঝে মাঝে রাস্তায় চলার পথে কেউ যখন বলে, ভাই নিউমার্কেট যাবো কত নম্বর বাসে?? ফার্মগেট এখান থেকে কত দূর??---- ফাহাদ ভাইয়ের কথা মনে পড়ে যায়।
.
ফাহাদ ভাই আজ কোথায় আছেন, কেমন আছেন---জানি না।তবে আমার এটা ভাবতে ভালো লাগে যে, ফাহাদ ভাই টেলিকাইনেসিস রপ্ত করে ফেলেছেন। আর সেটা অবাক হয়ে দেখছে একটা মেয়ে। মেয়েটার নাম ফারজানা।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.