নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বাংলাদেশে প্রাদেশিক সরকার পদ্ধতির পরিকল্পনা------হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান, সাবেক ফল রাষ্ট্রপতি পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও জাতীয় পার্টি

মনিরুল ইসলাম মিলন

মনিরুল ইসলাম মিলন প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি জাতীয় পার্টি

মনিরুল ইসলাম মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

গ্রামীণ ব্যাংকের অকথিত ইতিকথা ----হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ

০৬ ই আগস্ট, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:০৩

গ্রামীণ ব্যাংকের অকথিত ইতিকথা ----হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ



গ্রামীণ ব্যাংক। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিমন্ডলের মধ্যে একটি বহুল আলোচিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান। শুধু দেশেই নয়- দেশের সীমানা পেরিয়ে এই ব্যাংক এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং সমাদৃত একটি প্রতিষ্ঠান। অথচ খুব কম লোকই জানেন, এই প্রতিষ্ঠানের জন্মকথা।



১৯৮৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বর এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে এই গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্বে এটাই ছিল প্রথম আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প। ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার সময়ই বলে দেয়- এটা ছিল আমার সরকারেরই কৃতিত্ব। অবশ্য খুব স্বচ্ছন্দ্যে এবং অনায়াসে অধ্যাদেশটি জারি করে আমি গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। বড় বড় ব্যাংকার এবং আমলাদের আপত্তিরমুখে পড়তে হয়েছিল সেদিন। তাদের বক্তব্য ছিল- ক্ষুদ্রঋণ প্রদানের জন্য এরকম একটি পৃথক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার ধারণা অযৌক্তিক। কিন্তু আমি সেদিন কোনো যুক্তি শুনতে যাইনি। আমার জীবনে অনেক ঘটনার জন্য মাঝে-মধ্যে আমি দুঃখবোধ অনুভব করি, কিন্তু এখনো মনে করি- জীবনে যত ভালো কাজ করেছি তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজটি হচ্ছে- গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ জারি করে এই প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠা করা।



সম্প্রতি অধ্যাপিকা আয়শা আখতার মুনিমের ইন্তেকালের খবরটা শুনে তার স্মৃতিকথা স্মরণ করতে গিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্পের এই জন্মকথা মনে পড়ে গেল। অধ্যাপিকা আয়শা আখতার ছিলেন মরহুম জেনারেল এমএ মুনিমের সহধর্মিণী। জেনারেল মুনিম বিভিন্ন মেয়াদে আমার সরকারের পূর্ত, কৃষি এবং অর্থমন্ত্রী ছিলেন। তার স্ত্রী আয়শা আখতার দীর্ঘদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপিকা ছিলেন।



আমার যতদূর মনে পড়ে সেই তারিখটা ছিল ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহের কোনো একদিন। সেদিন আমি গলফ খেলে ফিরছিলাম। আমার এপিএস মেজর শাহাবাব আমাকে জানালো যে, জেনারেল মুনিম আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। সেদিন আমার বসার কক্ষে জেনারেল মুনিম এবং তার স্ত্রী আয়শা আখতারকে দেখে একটু অবাক হলাম। কারণ জেনারেল মুনিম সস্ত্রীক এলেন কেন। সেসময় প্রায় একঘণ্টা তাদের সঙ্গে আমি কথা বলেছিলাম। ওই সময় তারা উভয়ে আমাকে বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্পের কথা বোঝালেন। বিষয়টি আমি অনুধাবন করতে পারলাম এবং আমার কাছে এটা অত্যন্ত কার্যকারী একটা প্রকল্প বলে মনে হলো। জেনারেল মুনিম এবং তার স্ত্রী চলে যাওয়ার সময় এ সম্পর্কিত বেশকিছু তথ্যসম্বলিত কাগজপত্র পড়ে দেখার জন্য আমার কাছে রেখে গেলেন।



অধ্যাপিকা আয়শা গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্প সম্পর্কে যে ব্যাখ্যা এবং ধারণা আমাকে দিয়েছিলেন, আমি তা এক বাক্যে গ্রহণ করেছিলাম। আজ আমার বিস্ময় লাগে সেদিন যদি মুনিম দম্পতি ওইভাবে আমাকে বোঝাতে না পারতেন তাহলে হয়তো এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হত না।



গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্প বাস্তবায়নে জেনারেল মুনিম সবসময় আমার পাশে ছিলেন। তিনি প্রথমে আমার পূর্ত এবং তারপর কৃষিমন্ত্রী ছিলেন। সেসময় তাকে যতদূর সম্ভব স্বল্পসময়ের মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংকের সদর দফতর স্থাপনের জন্য জায়গা বরাদ্দের নির্দেশ দিয়েছিলাম। তখন মীরপুরে গ্রামীণ ব্যাংকের সদর দফতরের জন্য জায়গা বরাদ্দ করা হয়। পরে তিনি কৃষিমন্ত্রী হিসেবে পটুয়াখালী এবং রাজশাহীতে গ্রামীণ ব্যাংকের জন্য জায়গা বরাদ্দ করেন। ’৮৪ থেকে ’৮৮ সালের মধ্যে আমি বিভিন্ন জেলায় গ্রামীণ ব্যাংকের অনেকগুলো শাখা পরিদর্শন করেছিলাম। তখন অশেষ ধন্যবাদ জানিয়েছি জেনারেল মুনিমকে এই প্রকল্পের প্রস্তাবনার জন্য।



গ্রামীণ ব্যাংকের শাখাগুলো পরিদর্শনকালে আমি দেখেছি- ব্যাংকের কর্মচারীরা অত্যন্ত নিবেদিত, কর্মঠ ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন এবং তারা সবাই প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে এসে গ্রামীণ ব্যাংকে যোগদান করেছেন। এসব কর্মচারীদের অনেক জায়গায় ছুটির দিনেও কাজ করতে দেখেছি। একদিন একটি শাখায় দেখেছি- সেখানে রান্নার বড় বড় হাঁড়ি-পাতিল রয়েছে। এর কারণ জানতে চাইলে ব্যাংক ম্যানেজার জানালেন যে, তাদের শাখার প্রায়ই মহিলা ঋণগ্রহণকারীদের কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। তাদের খাওয়ানোর জন্য ডেকোরেটর থেকে হাঁড়ি-ডেকচি ভাড়া করে আনা হয়।



সারাদেশে গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম সম্প্রসারণের জন্য আমার সরকার অর্থ-সম্পদ বরাদ্দ করেছিলেন। আমার যতদূর মনে পড়ে, গ্রামীণ ব্যাংকের জন্য আমি সুইডেন, নরওয়ে এবং কানাডা থেকেও তহবিল সংগ্রহ করেছি। বিশ্বে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ইতিহাসে গ্রামীণ ব্যাংকই প্রথম ব্যাংক- যে ব্যাংক মূলত গরিব মহিলাদের জন্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এই ব্যাংকে বাংলাদেশ সরকারের শেয়ার ছিল ৭৫ শতাংশ এবং আমার শাসনামলেই ব্যাংকের সাফল্যে সরকারের শেয়ার ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়।



এটা ছিল আমার জীবনের সবচে সুখের ও আনন্দের খবর- যখন আমি শুনেছিলাম ২০০৬ সালে ড. ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংক নোবেল পুরস্কার লাভ করেছে। এখানে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি দৈনিক আমাদের সময়ের সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খানের কথা। গ্রামীণ ব্যাংক নোবেল পুরস্কার লাভ করার পর যখন দেশজুড়ে হইচই তখন ভুলেও স্মরণ করা হচ্ছিল না- এই ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠায় আমার ভূমিকার কথা। সেই সময় নাঈমুল ইসলাম তার পত্রিকায় সঠিক তথ্যটি তুলে ধরেছিলেন। যা-ই হোক- আমি আশা করি গ্রামীণ ব্যাংকের সাফল্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। গরিব জনগণ বিশেষ করে গরিব মহিলা যারা কঠোর পরিশ্রম করে অথচ কোনো স্বীকৃতি পায় না- তাদের প্রতি গ্রামীণ ব্যাংকের সাহায্য-সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।



গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে এত কথা বললেও বাস্তবিকভাবে আমি জেনারেল মুনিম দম্পতি সম্পর্কেই কথাগুলো বলতে চাই। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই গ্রামীণ ব্যাংকের এই কাহিনী এখানে স্মরণ করছি। তাদের প্রেরণা ছাড়া এই গ্রামীণ ব্যাংক কোনোদিন প্রতিষ্ঠিত হত না। কারণ, তারাই আমাকে গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্পের ধারণা দিয়েছিলেন। অনেকেই গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব গ্রহণ করতে চান কিন্তু কখনোই জেনারেল মুনিম এবং তার স্ত্রী অধ্যাপক আয়শা আখতার এই কৃতিত্বের দাবি করেননি। অথচ তারাই ছিলেন এর প্রবক্তা। আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি তাদের অবদানের কথা। যারা সবসময় এ ব্যাপারে প্রচারবিমুখ থেকে গেছেন।



আমি ক্ষমতা গ্রহণের এক বছরের মাথায় ১৯৮৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বর গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ জারি করেছিলাম। সেই সময়টা ছিল আমার জন্য সবচে ব্যস্ততম সময়। এই ব্যাংকের প্রতিষ্ঠা এবং সম্প্রসারণের জন্য ১৯৮৩ এবং ১৯৯০ সালে প্রায় একশ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং নামমাত্র ১ শতাংশ সুদে তহবিল বরাদ্দ করেছিলাম। এই ব্যাংক থেকে ৯ থেকে ১০ শতাংশ সুদে গরিব মানুষের মধ্যে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করেছিলাম। ১৯৯২ সালের মধ্যে ব্যাংকের সম্প্রসারণ কাজ সমাপ্ত হওয়া পর্যন্ত আমি এই সুদের হার নির্ধারণ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমি ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার পর গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার ২০ শতাংশ পর্যন্ত উন্নীত করা হয়। আমি সবসময় চেষ্টা করেছি- সরকার বিশেষ করে অর্থ মন্ত্রণালয় যেন গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনায় অহেতুক হস্তক্ষেপ না করে।



গ্রামীণ ব্যাংকের অধ্যাদেশটি আইন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে পাওয়া যাচ্ছে। বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, সেই ওয়েবসাইটে অধ্যাদেশ থেকে আমার নামটি মুছে দেয়া হয়েছে। অথচ এই অধ্যাদেশে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার আইনগত ব্যাখ্যা রয়েছে এবং সেখানে আমার স্বাক্ষরও ছিল। তবে চূড়ান্তভাবে দেশবাসী বিচার-বিবেচনা করবেন এবং জানবেন কীভাবে এবং কার হাতে এই গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশ এবং বিশ্বের অপরাপর দেশের জনগণও জানবেন আমার সরকারের আমলে প্রতিষ্ঠিত সেই গ্রামীণ ব্যাংক- দারিদ্র্যবিমোচনে কী ভূমিকা রেখে যাচ্ছে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.