নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মাতাল ঋত্বিক আমি, প্রেমকথা আমার ঋগ্বেদ

আরণ্যক রাখাল

মাতাল ঋত্বিক আমি, প্রেমকথা আমার ঋগ্বেদ

আরণ্যক রাখাল › বিস্তারিত পোস্টঃ

পাহাড়ের সীমানাঃ কিছু এলেবেলে ভাবনা

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৯ ভোর ৪:২৩


“এই নদীটার নাম ধলাই।”
অটোর ড্রাইভার স্বপ্রণোদিত হয়ে জানালেন। ছিপছিপে নদীটা- বাঁক নেই, প্রতিবেশির ‘চোখে পড়ে কিন্তু মনে পড়ে না’ মেয়ের মতো বয়ে চলেছে গ্রামগুলোর পাশ দিয়ে। পাড়ার কিছু মেয়ের পিছনে কোনদিন ছেলেরা লাইন মারে না, সুন্দরীদের ভিড়ে দেখে না তাকে কেউ, কাঁপা কাঁপা হাতে চিঠি দিয়ে যায় না কোন কিশোর, আচমকা কোনদিন শোনা যায়, বিয়ে হয়ে গেছে মেয়েটির! ধলাই যেন সেই ‘থেকেও না থাকা’ সাধারণ মেয়েটির মতো। তার দুকূল ছাপিয়ে দেয়া ঢেউ নেই- অন্তত এখন তাই মনে হচ্ছে, রুপ নেই কাছে টানার, শুধু বয়েই চলেছে অস্তিত্বের জানান না দিয়ে। তবুও দেখার চোখ থাকলে, নজরে পড়ে, মেয়েটি হাসলে ঠোঁটের উপরের দ্বীপের মত তিলটা কেঁপে ওঠে, একটা টোল পড়তে পড়তেও পড়ে না- নদীটার ঠিক উপরেই নীল অখণ্ড আকাশে সাদা সাদা তুলো মেঘ!
নদীর পাশ দিয়েই রাস্তা। ধলাই হঠাত বাঁক নিয়ে একদিকে চলে গেল, আমাদের অটো চলল সোজা রাস্তায়।
অটোওয়ালা বললেন, “নদীটা কিন্তু ভারতে চলে গেছে। বর্ডারের উপরেই ত্রিপুরা!”
সোহেল একটা সিগারেট জ্বালানোর চেষ্টা করছিল। হিলহিল করে বাতাস আসছে বলে পারছে না। অটোওয়ালাকে স্লো করতে বললাম। সিগারেটটা জ্বালিয়ে সোহেল বলল, “এখানকার মানুষগুলা একটু অন্যরকম। এখানে কোন উপজাতিটাতি আছে নাকি?”
পাক্কা ট্যুর গাইডের মতো অটোওয়ালা বললেন, “রাস্তার দুইপাশে যে বাড়িগুলা দেখছেন, এগুলার মধ্যে কিছু বাড়ি মনিপুরীদের।”
জিজ্ঞেস করলাম, “এটা কি মনিপুরী গ্রাম?”
সবজান্তা ড্রাইভার বললেন, “আসলে হিন্দু গ্রাম। কিছু মনিপুরী আছে।”
পাহাড়ে আদিবাসী থাকাটাই স্বাভাবিক। ছোট বেলা থেকেই জানতাম, পাহাড়ে আদিবাসিরা থাকে- চাকমা মারমা, খাসিয়া, গারো। এখানে এসে বাঙালিদের দেখছি, এটাই বরং আশ্চর্য লাগছে! ছেলেবেলার সামাজিক বিজ্ঞান বই মেনে অবশ্য জীবন চলে না। পাহাড়গুলো এখন সেটলার আর ব্যবসায়ীদের দখলে। আসার পথে দেখলাম, কিছু পাহাড় কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা, সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষেধ করে সাইনবোর্ডও দেয়া আছে। অথচ আজন্ম জেনে এসেছি, সব পাহাড়ই আমার; যেখানে খুশি, যেটাতে খুশি ওঠা যায়! পার্বত্য চট্টোগ্রাম তো শাসন করছে আর্মিরা। ক্যাম্পাসে মাঝেমাঝেই আদিবাসীদের আন্দোলন করতে দেখি ধর্ষণ, গুম, খুনের প্রতিবাদে; এসবের বিচারটিচার হয় না। বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর বিচার করবে কে? সেনাবাহিনী যেদেশেরই হোক, হয়ত বর্বর, অন্তত ৩য় বিশ্বের কথা চিন্তা করলে একথা অকপটে বলা যায়। নইলে পাক আর্মির মত, বাংলাদেশি আর্মি পাহাড়িদের নির্যাতন করবে কেন, ধর্ষণ করবে কেন?
সোহেল একটা মনিপুরী মেয়ে দেখিয়ে বলল, “ফিগার দেখছিস? টপ! আদিবাসী মেয়ের সাথে প্রেম করার খুব শখ আমার, জানিস?”
রাস্তার দুধারের বাড়িগুলো ছিমছাম, একটু বেশিই নিচু। পরিষ্কারও। আমাদের ওদিকে, প্রতিটা বাড়ি ঘিরেই গাছ থাকে, এখানে সেসবের বালাই নেই। হিন্দুবাড়ি বলে তুলসীর গাছ নজরে পড়ছে বারবার। দেখে মনে হলো, এখানে মনিপুরীরা বাঙালিদের মতোই থাকে, থাকতে শিখেছে। কিছু বাড়ির সামনে বাঁধা আছে গরু। ন্যাংটা ছেলে মাটি খাচ্ছে, ঝিম মেরে অচল দোকানে বসে আছে পৈতেওয়ালা বামুন, কয়েকজন বাজারে যাচ্ছে গল্পেগল্পে। মাঝেমাঝেই চোখে পড়ছে মন্দির। মোড়ে মোড়ে সাইনবোর্ডে ট্যুরিস্ট পুলিশের নাম্বার দিয়ে দেয়া- যেকোন বিপদে যেন তাদের সহযোগিতা নেয়া হয়। হয়ত আগে খুব ডাকাতিটাকাতি হত, তাই এসবের ব্যবস্থা। এসব দেখতে দেখতেই পৌঁছে গেলাম মাধবপুর টিস্টেটে!
ভালুগাছ থেকে মাধবপুরের দূরত্ব খুব বেশি হলে হয়ত পাঁচ কিলো হবে। তাতেই ভাড়া প্রতিজনে ৫০। ট্যুরিস্টদের পকেট কাটতে দ্বিধা করে না কেউ। আমরা অবশ্য সে অর্থে ট্যুরিস্ট নই। দামি থ্রিকোয়ার্টার প্যান্ট, মাথায় হ্যাট, কাঁধে ডিএসএলআর- আমাদের নেই। আমরা ট্রেনে টিকিট না কেটে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসেছি, ভোরে ট্রেন শ্রীমঙ্গল স্টেশনে নামিয়ে দিলে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে অপেক্ষা করেছি সকাল হওয়ার। তারপর লাওয়াছড়া ইকো পার্কে কিছুক্ষণ কাঁটিয়ে বাসে এসেছি ভালুগাছ। সারারাতের জার্নি, মাত্রাতিরিক্ত সিগারেট আর প্লাটফর্মের ধুলোছাপা বেঞ্চে ঘণ্টাখানেক ঘুম- সব মিলিয়ে আমাদের চেহারা হয়েছে দেখার মতো। তাও শালারা কী করে বুঝল আমরা ট্যুরিস্ট, সেটা গবেষণার বিষয়।
মাধবপুর টি স্টেট ব্রিটিশ আমলের। তারাই আমাদের চা খাওয়া শেখাল আর এখন সকাল সন্ধ্যে চা ছাড়া আমাদের পোষাচ্ছে না! ব্রিটিশরা পাহাড়ের ঝাড় জঙ্গল সাফ করে বাগান বানানো শিখিয়েছে, পরে আমরা নিজেরাই সাফসুতরো করে জঙ্গল ধ্বংস করেছি! শ্রীমঙ্গলকে বলা হয় চায়ের রাজধানী- মানে এখানেই সবচেয়ে বেশি পাহাড় থেকে প্রাকৃতিক সম্পদ বিনাশ করা হয়েছে!
ঢুকতে আমাদের ২০ টাকা চাঁদা দিতে হলো। কোন টিকিট নেই, দারোয়ান নেই- তাও কেন টাকা দিলাম, জানি না। যাকে টাকাটা দিলাম, সে ব্যাটার চেহারাটা গুন্ডামার্কা, ২০ টাকার নোটটা হাতে নিয়েই পকেটে চালান করে দিল।
বলল, “যান এখন, যত ইচ্ছে ঘুরুন। মেয়ে আছে নাকি সাথে? মেয়েদের নিয়ে ঝোপেঝাড়ে ঢুকবেন না আবার। কোন ইটিশবিটিশ সহ্য করব না! পাঁচটার আগেই ফিরবেন।”
আমরা পৌঁছার সাথেসাথেই একদল ছেলেমেয়েও এসে পৌঁছেছে, ওরা এসেছে ‘চাঁদের গাড়িতে’। আমাদের দুজনকে ওদের দলে ভেবেছে হয়ত। তাই মেয়েদের নিয়ে এমন ইঙ্গিত। ঢাকা থেকে শত মাইল দূরে বলে, চোটপাট করার সাহস পাইনি। ব্যাপারটা মারামারি পর্যন্ত গড়ালে কে বাঁচাবে!
প্রতিক্রিয়াশীল সমাজের বাইরে এসে, নিয়ম কানুন থেকে দূরে, উঁচুনিচু পাহাড় আর সবুজকে সাক্ষী মেনে কোন প্রেমিক যে তার প্রেমিকার ঠোঁটে চুমু এঁকে দেবে, তারও উপায় নেই। ইটিশবিটিশ ঠেকাতে এমন জাঁদরেল ভাইয়েরা আছে তো!
নতুন আসা ছেলেমেয়ের দলটা গটগট করে ঢুকে গেল, কেউ তাদের আটকাল না টাকার জন্য! আমরা দুজন যে স্ক্যামের শিকার, তাতে আর সন্দেহ রইল না।
মাধবপুর হ্রদ দেখার মত জায়গাই বটে। চারদিকে পাহাড়, তার গায়ে গায়ে চা বাগান, আর তার নিচেই হ্রদের স্বচ্ছ পানি। হ্রদটা মাঝেমাঝে হারিয়ে গিয়েছে পাহাড়ের আড়ালে, কিছুদূর পর দেখা দিয়েছে আবার। এটা বোধহয় চা পাতা তোলার সিজন নয়, কাঁধে বিশাল ঝুড়ি নিয়ে কাউকে পাতা ছিড়তে দেখলাম না। চা গাছের মাঝখান দিয়ে পায়ে চলার পথ পাহাড়ে উঠে গেছে। তেমন একটা পথ বেয়েই উঠলাম উপরে। পাহাড়িদের ফিগার এত ভাল কেন, বুঝলাম। অভিকর্ষের বাঁধা ঠেলে উপরে উঠলে মেদ গলতে বাধ্য। ক্যাম্পাসের অনেক উপজাতি বন্ধুকেই মোটা, ভুঁড়িওয়ালা দেখেছি। অথচ এখানে তেমন একজনও নেই- আদিবাসী কি বাঙ্গালী। সমতলই তাদের মেদ আর ভুঁড়ি উপহার দিয়েছে।
উঁচু পাহাড় থেকে নিচের লেকটাকে একটা বিশাল দীঘি বলেই মনে হয়। তাতে লাল শাপলার পাশ দিয়ে সাঁতরে যাচ্ছে একদল পাতিহাঁস। তপ্ত সূর্যের ঝিলিকে হ্রদের সোনালী স্থির পানিতে মাথা ছুঁইয়ে আবার উড়ে যাচ্ছে মাছরাঙ্গা। পাহাড়ের চূড়ায় হাওয়ার সাথে পাতা ঝড়ার শব্দ নৈঃশব্দ্যকে করেছে গাঢ়তর- হঠাত মানুষের গলা বাজের মতোই মনে হয়।
পাহাড়ের শেষ নেই যেন, ঘন জঙ্গল আর লাল মাটি নিয়ে তারা যেন লীন হয়ে গেছে দিগন্তে। বর্ষা শেষের তপ্ত রোদে ঝাঁঝাঁ করছে আকাশটাও। তুলোমেঘ ফুঁড়ে আচমকা হাওয়ায় ডানা মেলে দিচ্ছে চিল।
“এসব জায়গা মেয়ে ছাড়া কি জমে? কত ঝোপ। একটায় দুম করে ঢুকে পড়লে, কোন শালা বুঝতে পারবে না। কাপলদের জন্য সেই একটা প্লেস!”
এমন স্বর্গীয় পরিবেশে সোহেল একথা বলবে, ভাবতেই পারিনি। শকুন যত উপরেই উড়ুক, চোখ থাকে মরা গরুর দিকে। ব্যাপারটা তাই!
আমরা একটা বটগাছের নিচে বসে পড়লাম। বললাম, “গফ নিয়ে এলে কী ট্রেনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আসতে পারবি? ট্রেনের টিকিট কাটতে হবে- যাওয়া আসা, ভাল রেস্টুরেন্টে খাওয়া! মেলা খরচ। তার চেয়ে হোটেলে যাওয়াই তো ভাল। সেইফও!”
সোহেল লেকের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তাও একটা ব্যাপার থাকে। পাহাড় জঙ্গলের একটা বুনো আদিম ভাব আছে। সেটা তুই হোটেল রুমে পাবি?”
কথা বাড়ালাম না। বাগানে ঢোকার মুখেই শুধু একটা দোকান আছে, ভিতরে এলে আর কিছুই পাওয়া যায় না। তাই সেখানেই কয়েকটা সিগারেট কিনে নিয়েছি। তারই একটা ধরালাম। দুপুরের রোদ ঝরা পাতায় পড়লে কড়া একটা গন্ধ আসে। সেই গন্ধের সাথে সিগারেটের গন্ধ মিলে মাথাটা হালকা করে দিল।
সোহেল চায়ের কয়েকটা পাতা মুখে পুরে ‘থু! তিতা’ বলে ফেলে দিল।
ওর দেখাদেখি, চায়ের কয়েকটা কচি পাতা মুখে পুরে চিবোতে শুরু করলাম আমিও। বিশ্রি স্বাদ। এমন মাল থেকে কী করে ওমন চা হয় কে জানে। ভেবেছিলাম, সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ব্যাগে কিছু কচি পাতা নিয়ে গিয়ে কাঁচা পাতার চা বানিয়ে খাব। তার ইচ্ছে আর রইল না। ঘুরতে এসে, চা পাতা চুরি করতে চেয়েছি বলে নিজেকে ধিক্কারও জানালাম!
“বাবুলোগ, আপনারা ঘুরতে আয়ছেন?”
বাবুলোক? এমন সম্বোধন বাপের জন্মে শুনিনি। দেখলাম এক বৃদ্ধ কুঁজো হয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের দিকে আসছেন।
সোহেল বলল, “হ্যাঁ। ঘুরতে। অনেকেই তো আসে দেখতে না?”
“বহুত লোক আসে!!”
তারপর আমার সিগারেটের দিকে তাকিয়ে বললেন, “হামাকে একটু দিবেন? খাইনা বুহুতদিন!”
সিগারেট চাইলে আমি কাউকে ফেরাই না। দিলাম। বৃদ্ধ অশীতিপর- বসলেন আমাদের পাশে। ছেড়া একটা গেঞ্জি আর রংচঙে লুঙ্গি পরনে। গালের হাড় মুখের চামড়া ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে যেন।
বৃদ্ধ বেশ আয়েশ করে টান দিলেন কয়েকটা। “সিগারেট খাইতে পারি না। পয়সা হয় না!”
এর জবাবে কিছু বলা যায় না। চুপ করে রইলাম। এমন মরমর বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে থাকার চেয়ে পাহাড়ের দিকে নজর দেয়া ভাল। সেদিকেই মন দিলাম। আকাশ থেকে বৃষ্টির মত নামছে রোদ, ধুয়ে দিচ্ছে সবুজ পাতায় ছাওয়া পাহাড়গুলো। আমাদের সামনের একটা মরা নিম গাছে একটা কাঠঠোকরা খটখট শব্দে গর্ত করছে। কয়েকটা টিয়া ক্যাঁচক্যাঁচ করছে ছাতিম গাছটার ডালে। সুন্দরী নারীর কর্কশ স্বরের মতই চমক জাগায় টিয়ার ডাক- এত সুন্দর পাখির এমন ডাক হয় কীকরে?
সোহেল বৃদ্ধের সাথে কথা চালিয়েই যাচ্ছে। “আপনার ছেলে মেয়ে নেই?”
বৃদ্ধ ভাঙ্গা গলায় বললেন, “একটা ছেলে আছে। ইন্ডিয়ায় থাকে। ওর খোঁজ খবর জানি না। আমি এই বাগানে কাজ করি। ১০২ টাকা মাহিনা। আমার বেটিও কাজ করে!”
“ছেলে খোঁজ নেয় না?”
“ও কাকাদের সাথে থাকে। আমরা এখানে। আগে আসত, এখন বর্ডার কড়া। ভিসা লাগে। টাকা কোথায়? ১০২ টাকা মাহিনা মাত্র আমার!”
বৃদ্ধ কি বারবার নিজের কম মাইনের কথা বলে আমাদের কাছে সাহায্য চাওয়ার ফন্দি এটেছেন? হতে পারে। দারিদ্র মানুষকে অনেক নিচে নামিয়ে দেয়। তবে আমাদের নিজেদেরই পকেটের অবস্থা বেহাল। বৃদ্ধ এসব বলে খামোখা নিজের শক্তি ব্যয় করছেন।
“১০২ টাকা বেতন মাত্র! এত কম বেতন কেন?”
“জানি না।”, বৃদ্ধ সোহেলের প্রশ্নের চাইতে সিগারেটের প্রতিই আগ্রহী বেশি।
“যারা চা পাতা তোলে, তাদের বেতন কত?”
“২৩ কেজি কাঁচা পাতা তুললে মাইনা ১০২ টাকা। বেশি তুললে প্রতি কেজি জইন্যে ৪ টাকা বাড়ে!”
“সবাই ২৩ কেজি তুললে পারে?”
“২৩ কেজি তোলা যায় না। ১৭/১৮ কেজির বেশি কেউ পারে না!”
“ছেলে টাকা দেয় না?”
“ঐ তো বললাম, এখন আর আসতি পারে না। আগে আসত চুপচুপ করে!”
সোহেল আরেকটা সিগারেট জ্বালায়। তারপর প্রশ্ন করে, “আপনারা কি আগে ভারতে ছিলেন?”
বৃদ্ধের সিগারেটটি ফুরিয়েছে। এখন তিনি লোভী চোখে তাকিয়ে আছেন সোহেলের মুখের দিকে।
“হ্যাঁ। হামার আসল বাড়ি বর্ডারের ঐপারে ছিল। আগে তো বর্ডার এত কড়াকড়ি ছিল না। খুব যাওয়া আসা করতাম। এখন আর দেয় না। আমার বাপ দাদারা উত্তরপ্রদেশে ছিল আর হামি এখন বাংলাদেশে!”
সোহেলের হাত থেকে সিগারেটটা নিয়ে বৃদ্ধকে দিলাম। এখানে বসে বসে গল্প করতে আসিনি আমরা। কত কিছু দেখার বাঁকি এখনো।
লেকের উপরের পাহাড়শ্রেণি ধরে হাঁটতে লাগলাম আমরা। লেকের জলে মধ্যযৌবনের সূর্য পাহাড়ে কিম্ভূত ছায়া ফেলেছে। যেখানে চা বাগান শেষ হয়েছে, সেখান থেকেই শুরু জঙ্গল। কত ফুল, ফার্ন আর পাখি- কোনটারই নাম জানি না। যারা বোটানিতে আন্ডারগ্রাড করছে, তারা জানে এসব উদ্ভিতের নাম? হয়ত বিভূতিভূষণ জানতেন। হাজার বছর ধরে একটুএকটু করে মাথাচাড়া দিয়েছে এসব পাহাড়; অথচ আমরা চাইলে এক্সক্যাভেটর লাগিয়ে একদিনেই ধ্বংস করে দিতে পারি এসব। দিচ্ছিও- পাহাড় কেটে বাড়ি, রিসোর্ট বানানো হচ্ছে হরহামেশাই। মানবজাতির মত ক্ষতিকর কোন প্রাণী হয়ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে নেই। পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্বই বিপন্ন করছে প্রকৃতিকে।
গোলগাল মুখের একজন ছিপ ফেলে মাছ ধরছিলেন লেকে। লোকটাকে দেখে মনিপুরী মনে হলো। কেন জানি না, জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা ভাই, এখানে মহুয়া পাওয়া যায়?”
লোকটা ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকাল। মনিপুরীরা বাংলা বোঝে না নাকি? মহুয়ার কথাটা আবার বলতে হলো। মহুয়ার বদলে এবার ‘মউয়া’ বললাম। জবাবে বললেন, “আমি জানি না এসব!”
পাহাড়ে আসার পর থেকেই মহুয়ার কথাটা বারবার মনে পড়ছে। কে যেন বলেছিল, এসব জায়গায় মহুয়া খুব সহজলভ্য। সুনীলের লেখায় মহুয়ার কথা খুব পড়েছিও। অবশ্য মহুয়া মাদকের মধ্যে পড়ে কিনা জানি না। মাদক হলে তো দিনদুপুরে যেখানে সেখানে পাওয়া কিংবা খাওয়া যাবে না। তবে পাহাড়ের চূড়ায় কোন এক বৃহত গাছের ছায়ায় বসে মহুয়ায় নেশায় বুঁদ হতে আপত্তি নেই, বেআইনি হলেও। প্রতিদিন তো আর নেশা করছি না, এক আধদিন ঘুরতে এসে নেশা করলে কিছু হয় না। কিন্তু ব্যাটা আমাদের মহুয়ার খোঁজ দেবে কি, গুরুত্বই দিল না। সে একমনে তাকিয়ে আছে ঢেউহীন শান্ত জলে অনড় ছিপের ফলতেটার দিকে!
“লেকে মাছ ধরা নিষেধ। তাও ধরছেন যে? কেউ কিছু বলে না?”, লোকটা গুরুত্ব দিচ্ছে না বলে ক্ষ্যাপাতে বললাম কথাটা।
“লেক কী কারো বাপের? আমার ইচ্ছা, আমি মাছ ধরব!”
সোহেল হঠাত দূরের পাহাড়গুলোর দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করে বলল, “আচ্ছা, ঐ পাহাড়গুলা কি ভারতের?”
লোকটা কথাটার মুখে জবাব দিল না, শুধু হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
লোকটাকে আর কিছু না জিজ্ঞেস করে, আবার উঠতে শুরু করলাম পাহাড়ে। কে জানে ওর বাঙ্গালীবিদ্বেষ আছে কিনা!
পাহাড়ের অর্ধেক উঠেছি, হঠাত জোরাল বাঁশির শব্দ! এমন পরিবেশে পাখির ডাক শুনলে চমকে উঠতে হয়, সেখানে বাঁশির কর্কশ ধ্বনি! গা শিউড়ে উঠেছিল। পাহাড়ের উপর থেকে কয়েকজন হন্তদন্ত উর্দিওয়ালা লাঠি নিয়ে দৌড়ে আসছে আমাদের দিকেই! আর বাঁশি ফুঁকছে আমাদের কাছ থেকে ঢোকার সময় ২০ টাকা নেয়া সেই লোকটি! ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম সেখানেই। আমরা কোন অপরাধ করিনি তো? সেই যে কয়েকটা চাপাতা মুখে পুরেছিলাম, সেটা কেউ দেখে ফেলে এদের খবর দিয়েছে কী? ওটা আবার কোন অপরাধ নাকি? আমাদের সাথে মেয়েও নেই যে ইটিশপিটিশ করব! তাহলে?
চমক ভাঙার আগেই মোষের মত ছুটতে ছুটতে লোকগুলো আমাদের পেরিয়ে গেল। নিচে তাকিয়ে দেখি, সেই মনিপুরী ছিপ ফেলেই পালাচ্ছে জঙ্গলের দিকে! লোকগুলো তবে, আমাদের ধরতে আসেনি!
ঘটনার আকস্মিকতায় বসে পড়লাম সেখানেই!
লোকটা মাছ ধরছিল নিষেধ জেনেও। যদিও নিষেধ থাকার কথা নয়। বাংলাদেশের কোন নদীতেই মাছ ধরা নিষেধ নয়। নদীর মত হ্রদটাও প্রাকৃতিক। পাহাড়ের ঢাল বেঁয়ে নেমে যাওয়া পানিতেই হয়ত এটা সৃষ্ট। তারপরও সেখানে ছিপ ফেললে, বাঁশি ফুঁকে পাহারাদার দৌড়ে আসে কেন? পাহাড়গুলো যেমন দখল করেছে চা ব্যবসায়ীরা, লেকটাও তবে তাদের মতো কেউ ডেকে নিয়েছে? টাকা থাকলে তবে হ্রদের মালিকও হওয়া যায়? এই পাহাড়ের কাঁচা সবুজ টিয়া, লজ্জাবতী আর বুনো ফুলগুলোর মালিকও কি তারা?
ব্যবসায়ীরা সমতলের মত পাহাড়ও কব্জা করে বসে আছে। তারা পাহাড় কাটছে, চা বাগান বানিয়ে অমানবিক পারিশ্রমিকে লোক খাটাচ্ছে, দখল করছে প্রাকৃতিক সম্পদ, আদিবাসীদের অধিকার তো দিচ্ছেই না, বরং উর্দিওয়ালা লেলিয়ে তাড়া করছে তাদের। অথচ তাদের অত্যাচারে আদিবাসীরা রুখে দাঁড়ালেই, রাষ্ট্র লেলিয়ে দেবে সেনাবাহিনী, যেমনটা করা হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে।
অদ্ভুত এক সামন্ততান্ত্রিক সমাজে বাস করি আমরা। অতীতের জমিদারদের মত আমাদের পিঠে চাবুক চালাচ্ছে কর্পোরেট কম্পানিগুলো।
পাহাড়ে উঠে দূরের সেই পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হলো, হয়ত অকারণেই, দেশ একটা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান মাত্র, দেশপ্রেম জিনিসটাও পুরা মেকি। কাঁটাতার দিয়ে আলাদা করা ত্রিপুরার কিংবা আসামের- কোন রাজ্য আমি জানি না, ঐ পাহাড়গুলোতে আমার অধিকার নেই। সেখানে যেতে হলে, রাষ্ট্র নামক বড়বাবুর হুকুম নিতে হবে। অথচ মানুষ নিজেকে গর্ব ভরে স্বাধীন দাবি করে। জন্মসূত্রে পাওয়া ধর্মের মত দেশটাও কি চাপিয়ে দেয়া নয়? “এইটা হইল তোর গণ্ডি- এর বাইরে যাইতে পারবি না” টাইপের শিকল কি নয় এই কাঁটাতার?
বৃদ্ধটির কথা মনে পড়ল। তার ছেলে ভারতেই রয়ে গেছে। তিনি কি জানেন, কতগুলো সাম্প্রদায়িক ষাঁড় দ্বিজাতিতত্বে বিশ্বাস করত বলে, নিজ সন্তানের মুখ পর্যন্ত তিনি দেখতে পারছেন না আজ? সেই কাঁচা সবুজ রঙ্গের টিয়া পাখিটিও একটু উত্তরে উড়ে গিয়ে বর্ডার পেরুলেই, তার সবুজ আমার নয়, তাকে দেখা অধিকার নেই আমার। ‘শ্বশুরবাড়ি চলে যাওয়া’ সাধারণ মেয়েটির মত ধলাইও চলে গেছে অন্য দেশে। তার পাড়ের চিকচিক বালি আর তার জলে তুলোতুলো মেঘ আর নীল আকাশের ছায়া আর আমার নয়, আমার নয় তার তীরে জন্মানো কাশফুলগুলো।
রাষ্ট্র এক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান- আর এর কলাকুশলীরা নির্ধারণ করে আমাদের স্বাধীনতা, সীমা আর প্রেম। রাজনীতিবিদেরাই ঠিক করে দেয়, আমরা কোথায় যেতে পারব আর কোথায় নয়, ঠিক কোন ভূখণ্ডকে ভালবাসব আর কোন ভূখণ্ড হবে আমাদের শত্রু!
হয়ত এসব অকারণ ভাবছি। এমন মুক্ত পরিবেশে এলে সবার একটু জীবন নিয়ে চিন্তা আসে- সবাই কবি কিংবা অহিংসবাদী হয়ে যায়; আমাকেও হয়ত ‘ভাবে’ পেয়েছে! হয়ত সেই বৃদ্ধ তার ছেলের কথা ভাবেনই না, দারিদ্র্যের কঠিন অন্ধকারে তিনি ভুলে গিয়েছেন ছেলের মুখের আদল আর তার কণ্ঠস্বর। আমিই হয়ত কাব্য করে মন ভেজাতে এসব ভাবছি। তেমন হলেই ভাল।

মন্তব্য ১৫ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (১৫) মন্তব্য লিখুন

১| ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ৯:০৩

স্বপ্নবাজ সৌরভ বলেছেন: এলোমেলো ভাবনা কিন্তু বেশ লাগলো।

০৫ ই নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১২:৫৭

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ পড়ার জন্য

২| ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ৯:১৯

রাজীব নুর বলেছেন: ধলাই নদীতে আমি গিয়েছি। খুব সুন্দর নদী।

০৫ ই নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১২:৫৯

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: নদীটার বেশির ভাগ অংশই ভারতে।

তারমানে, জায়গাগুলো আপনার অচেনা নয়

৩| ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১২:৫২

মোঃ ফখরুল ইসলাম ফখরুল বলেছেন: বেশ :D

০৫ ই নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১২:৫৯

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: ;)

৪| ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:৪২

ভুয়া মফিজ বলেছেন: মুগ্ধ হয়ে আপনার লেখাটা পড়লাম। ভাবনাগুলো মোটেই এলেবেলে মনে হলো না। :)

নদীর সাথে সাধারন মেয়ের তুলনা, একটা দেশের রাজনৈতিক সীমানা, প্রকৃতির বর্ণনা.......সবই দারুন! এমন লেখা পড়লে ভাবি, আমার ভিতর থেকে এমন লেখা বের হয় না কেন?

০৫ ই নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১:০০

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: আপনি আমার চেয়ে অনেক ভাল লেখেন, মফিজ ভাই

৫| ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৯ রাত ৮:১২

করুণাধারা বলেছেন: আপনি শব্দ দিয়ে চমৎকার ছবি আঁকতে পারেন, আবার একই সাথে মনের মধ্যে নানারকম ভাবনা ছড়িয়ে দিতে পারেন... একেবারে অন্যরকম লেখা। খুব ভালো লাগলো। লিখতে থাকুন এরকম।

০৫ ই নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১:০২

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।
আশা করি, নিয়মিতই লিখব

৬| ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১০:১১

মা.হাসান বলেছেন: সুন্দর লেখা। এরকম আরো লেখার অপেক্ষায় থাকবো।

০৫ ই নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১:০২

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে

৭| ০৫ ই নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১১:২৭

পূনেন্দু পাহাড়ি বলেছেন: যদি গল্প হয় তো সুন্দর, যদি বাস্তব হয় তো এখানে একটু কারেকশন আছে. মহিনা বলতে একদিন এর টাকা টা বুঝায়। আর চা বাগানে সাপ্তাহিক হারে টাকা দেয়া হয়। মানে বাগান অনুসারে সপ্তাহের বিভিন্ন দিনে টাকা দেওয়া হয়।বতমানের জীবন চাহিদার সাথে এর বিশাল ফারাক আছে। আরো একটা তথ্য, বিদেশি কম্পানীর বাগানগুলোতে জীবন একটু উন্নত কিন্তু অনান্য দেশীয় কোম্পানীর কতৃপক্ষ অনেক শক্ত। আমার জানা মতে মাত্র ৬ বাগানে সরকারী প্রাইমারি স্কুল আছে আর বাকিগুলো স্থানীয় পঙ্চায়েত, বাগান প্রধান দিয়ে স্কুল চালানো হয়। । আর গফ নিয়ে লাওয়াছড়া ইকো পার্কে যে সমস্যা টা হয় তা হলো ঝোপ ঝাড়ে প্রায় অন্তরঙ্গ মূহুর্ত ছেলেমেয়েদের দেখা যায়। বিষয়টা অন্যান্যদের জন্য আপত্তিকর। তবে শ্রীমঙ্গল হোটেল এ ঘোরাফিরাটা সহজ হবে।

০৬ ই নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১২:৩১

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: বাস্তব কথাই লিখেছি আসলে। আপনি ঠিক বলেছেন, মাহিনা বলতে ও দৈনিক রোজগারটাই বুঝিয়েছে। সেটাও কিন্তু আজকালকার হিসেবে অনেক কম। ১০২ টাকায় খাওয়া পরা সম্ভব বলে মনে হয় না।
চা শ্রমিকদের অবস্থাটা আসলেই শোচনীয়।
ধন্যবাদ পড়ে, সুন্দর মন্তব্যটা করার জন্য। শ্রীমঙ্গল পুরাটা ঘুরতে পারিনি, তবে পুরাটা ঘোরার ইচ্ছে আছে।

৮| ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১০:২৮

পূনেন্দু পাহাড়ি বলেছেন: নেমন্ত্রন্ন রইল। এবং শুভ কামনা। ( যদি চা বাগানের বিষয়ে ষ্টাডি করতে চান তো আমি আপনাকে হেল্প করতে পারি। )

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.