নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মাতাল ঋত্বিক আমি, প্রেমকথা আমার ঋগ্বেদ

আরণ্যক রাখাল

মাতাল ঋত্বিক আমি, প্রেমকথা আমার ঋগ্বেদ

আরণ্যক রাখাল › বিস্তারিত পোস্টঃ

একটি জীর্ণ জমিদার বাড়ি ও অবাস্তব কথোপকথন

১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ ভোর ৪:২৮


“না না, আজ আর নয়। কাল কাল! কাল আসুন।”
আমি মন্দিরের দরজায় টোকা মারতে, দরজাটা খুললেন যে ভদ্রলোক, তিনি বললেন কথাগুলো। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। আর কত দর্শনার্থী এসেছিল এই ‘প্রায় চোখে না পড়া’ মন্দিরে যে আজকের জন্য তিনি কাউকে ঢুকতে দেবেন না? মন্দির মসজিদে কি একসেস লিমিট থাকে?
বললাম, “আমি অনেক দূর থেকে এসেছি। একটু…”
ভদ্রলোক হাত দেখিয়ে থামিয়ে দিলেন আমাকে। বললেন, “প্রতিদিন আসে ভাই আপনার মত অনেক লোক। আমিও তো একটা মানুষ নাকি?”
ভদ্রলোক আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।
শ্রীনগর বাজারে এসেছিলাম শ্যামসিদ্ধির মঠ দেখে ফিরে। এটা নাকি উপমহাদেশের সর্বোচ্চ মঠ- ঢাকার এত কাছাকাছি, দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। মঠ দেখে চক্কর দিয়ে দেখে নিচ্ছিলাম বাজারটা- মফঃস্বলের বাজার যেমন হয় তেমনি- অগোছালো, সরু সরু রাস্তা, দোকানগুলোতে এমন কিছুই নেই যা শহরের দোকানে পাওয়া যায় না, মাছি উড়ছে জিলিপির উপর- লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে, চায়ের দোকানুগুলোই যা একটু সরগরম। এলোমেলো হাঁটছিলাম বাজারের অলিগলি। মন্দিরটা চোখে পড়ল তখনই।
মসজিদের মিনারের মত একটা গম্বুজ মাথাচাড়া দিয়ে আছে আশপাশের টিনের বাড়িগুলো ছাড়িয়ে, গম্বুজের উপরে দাঁড়িয়ে আছে একটা ত্রিশূল। গম্বুজটা লালবাগ কেল্লার গম্বুজগুলোর মত, উপরের ত্রিশূলটা শুধু বাড়তি। গম্বুজের গায়ে বিভিন্ন কারুকাজ করা, দূর থেকে ঠিক চোখে পড়ে না, সেগুলো ভেঙ্গেও গেছে জায়গায় জায়গায়। এগুলোকেই কি পোড়ামাটির কাজ বলে? ছোট্ট একটা সাইনবোর্ডও টাঙ্গানো আছে, তাতে লেখাঃ “পরমারাধ্য স্বর্গীয় পিতৃদেব লালা জগদ্বন্ধু বসু মহোদয়ের ‘পবিত্র স্মৃতি মন্দির’ তদীয় শ্মশানোপরি ১৩০৯ সনে নির্মিত হইল”।
১৩০৯ বাংলা সনে নির্মিত হলে, এই মন্দিরের বয়স ১১৫ বছরেরও বেশি। এটা কি প্রত্নসম্পদের মধ্যে পড়ে না? পড়লে এর এই অবস্থা কেন? শ্রীনগরে আসার আগে, জায়গাটা নিয়ে বেশ ঘাঁটাঘাঁটি করেছিলাম, কোথাও তো দেখলাম না এর কথা!
মন্দিরের গা ঘেঁষেই টিনের বাড়ি, চত্বরটত্বর কিচ্ছু নেই- সামনেই কয়েকটা ঘর, গম্বুজটা উঁচু বলে নজরে পড়েছে, না হলে থেকে যেত পুরো আড়ালেই। মন্দিরের যেখানে সিঁড়ি হওয়া উচিত, তার উপরেও একটা ঘর; ফলে ভিতরে কোন ঠাকুর আছে কিনা বোঝা যায় না। মন্দিরটা তো একটা শ্মশানের উপর নির্মিত, সেই শ্মশানেই উপরেই এত লোক বাস করে আছে? এত পুরনো স্থাপত্য- সংরক্ষণের দায়িত্ব নেয়নি কেন সরকার?
এসব প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথায়। কিছু না ভেবেই মন্দিরের সিড়ির উপরের বাড়িটার দরজায় টোকা দিলাম। মন্দির যেহেতু ভাঙ্গেনি, তারমানে এখনো পূজাটুজা হয়, একটু দেখতে দিতে নিশ্চয়ই কারো আপত্তি থাকার কথা নয়।
টোকা মারার সাথে সাথেই দরজা খুললেন এক ভদ্রলোক, এই শীতের দুপুরেও গায়ে তার কিছু নেই। আমাকে দেখেই উপরের কথাগুলো বলে দরজা লাগিয়ে দিলেন দরাম করে!
তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম সেখানেই। এত পুরনো মন্দির, হোক তা অরক্ষিত- না দেখেই ফিরে যাব? আমাকে একটু দেখতে দিতে এই শালার সমস্যা কোথায়? টোকা দিলাম আবার। এবারও সাথে সাথেই খুলে গেল দরজা, যেন আমার টোকার জন্যই অপেক্ষা করে ছিলেন ভদ্রলোক।
“বাঙ্গালির এই এক সমস্যা। এক কথায় বোঝে না। তা আপনার সমস্যা কি? চুলকানি আছে?”, ভদ্রলোক- নাহ, একে আর ভদ্রলোক বলে মনে হচ্ছে না, টেকোশালা বললেন আমাকে, আগ্রাসীভাবে।
চুলকানি? আমার চুলকানি হতে যাবে কেন? আমাকে দেখে কি টেকোশালার চর্মরোগী মনে হচ্ছে?
“চুপ করে আছেন যে? কতদিনের খাউজানি? আগে ওষুধটষুধ খেয়েছেন?”, আবার বললেন আমাকে।
মেজাজটা বিগড়ে যাচ্ছে- তিনি না হয় মন্দিরেই থাকেন, আমি তার বাড়ির দরজায় টোকা মেরেছি, তাই বলে এভাবে অপমান করবেন? মানুষের তো স্বাভাবিক ভদ্রতাবোধ থাকে, এর মধ্যে দেখছি সেসবের কোন বালাই নেই! ভিক্ষুকও কোন বাড়িতে গেলে, এমন আচরণ পায় না। একা ঘুরতে এসেছি, সাথে দুতিনটা বন্ধু থাকলে দিতাম শালার তেলমাখা টাকে একটা চাটি।
মেজাজও পুরো বিগড়োবার আগেই, হঠাৎ, চোখ গেল আরেকটা সাইনবোর্ডে। সেখানে লেখা “এখানে চুলকানি খাউজানির বিনামূল্যে চিকিৎসা করা হয়”!
আচমকা ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল। টেকোশালা হয়ত এতক্ষণ একনাগাড়ে খাউজানির রোগী দেখছিলেন, দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে গেছেন। আমাকেও ভেবেছিলেন চর্মরোগী- তাই তাড়িয়ে দিচ্ছিলেন এমন করে!
বললাম, “আমি চুলকানি খাউজানির জন্য এখানে আসিনি। মন্দির দেখতে এসেছি!”
লোকটা কিছুক্ষণ আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন, যেন বোঝেননি আমার কথা। তারপর টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, “মন্দির দেখতে এসেছেন? আমি ভেবেছিলাম খাউজানি। তা এই মন্দির কী দেখবেন? দেখার তো কিছু নাই!”
টিনের দরজাটা খুলে দিলেন তিনি, ঢুকে পড়লাম সট করে, আবার না দরাম করে দরজা লাগিয়ে দেয়!
মন্দিরের উপরেই পুরো একটা সংসার পেতে ফেলেছেন তিনি। সিঁড়ির দুপাশে ছোটছোট দুটো ঘর, মন্দিরের বারান্দাই উঠান। এত অল্প জায়গায় এরা থাকে কী করে?
একটা মেয়ে উঠানে দাঁড়িয়ে কিছু করছিল, আমি ঢুকতেই চট করে চলে গেল ঘরে।
মন্দিরের ভেতরে আলো নেই, কোন বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত, দেখতে পেলাম না।
জিজ্ঞেস করলাম, “এই মন্দিরটা কে বানিয়েছিল?”
লোকটা আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। একেই বোধহয় শ্যেনদৃষ্টি বলে! উত্তর না দিয়ে আমাকেই উল্টো প্রশ্ন করলেন, “আপনি কি সরকারী লোক? জরিপ টরিপ করতে এসেছেন?”
লেও ঠ্যালা। বললাম, “না। আমি ঘুরতে এসেছি। সরকারের সাথে আমার বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই!”
আমি কথাটা বলতেই ভদ্রলোকের মুখচোখ স্বাভাবিক হয়ে এলো। সরকারকে ওর কেন এত ভয় কে জানে!
বললেন, “এটা বাবু রাজেন্দ্রকুমার বসু প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বেশি কিছু জানি না। আমি পূজা করি। থাকিও এখানে। আপনি বড় মন্দিরে যেতে পারেন। ওরা সব কিছু বলতে পারবে!”
অর্থাৎ আমি কিছু তোমাকে বলতে পারব না, বাবা। তুমি রাস্তা মাপো! বললাম, “বড় মন্দিরটা কোথায়?”
লোকটা রাস্তা দেখিয়ে আবার দরাম করে দরজা লাগিয়ে দিলেন।
লোকটার কথামত আবার গেলাম বাজারের দিকে। ‘বড় মন্দির’ খুঁজে পেতে সমস্যা হলো না। একজনকে জিজ্ঞেস করতেই দেখিয়ে দিল।

দুটো দোকানের মাঝে মন্দিরের গলি। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই, ভেতরে মন্দির আছে। মন্দিরের গলিটার চেয়ে পুরান ঢাকার দুটো বিল্ডিং এর মাঝের ফাঁকাও বেশি প্রশস্ত!
ঢুকতেই দেখলাম, দুজন বৃদ্ধা তরকারি কাটতে কাটতে গল্প করছেন, একটা বাচ্চা ছেলে দৌড়ে বেড়াচ্ছে চত্বর জুড়ে। আমি যে ঢুকেছি বুঝতে পারেননি তারা। আমি কি পায়ের শব্দ করে তাদের জানিয়ে দেব উপস্থিতি? জুতা পরে যে ঢুকলাম- রেগে গালাগাল করবেন না তো? এখানকার লোকের যা মেজাজ দেখলাম!
যে পিচ্চিটা দাপাদাপি করছিল, আমাকে একবার দেখে দৌড়ে চলে গেল বৃদ্ধাদের কাছে। কী যেন বলতেই বৃদ্ধারা মুখ তুলে তাকালেন আমার দিকে।
“কী বাবা, কী দরকার তোমার!”, বৃদ্ধাদের একজন বললেন আমাকে। বৃদ্ধার মুখের দিকে তাকিয়েই বিস্মিত হয়ে গেলাম আমি। এত মায়াময় মুখ হয় মানুষের! খুব সাধারণ শাড়ি বৃদ্ধার পরনে, ভেজা হাতে অর্ধেককাঁটা বাঁধাকপি- এই প্রতিনিয়তের মাঝেও তার মুখটা জ্বলজ্বলে ব্যতিক্রম। গোলগাল ফর্সা মুখটা বয়সের ভারে কুচকে যায়নি, শুধু চুলগুলো হয়ে গেছে বরফের মত সাদা। প্রথমবারের মত কোন বৃদ্ধাকে আমার সুন্দরী মনে হলো! জুতা পরে ঢুকে পড়েছি বলে যে ভয়টা ছিল, সে ভয় আর রইল না মনে। এই বৃদ্ধা আমাকে কোনদিন গালাগালি করবেন না, রাগ দেখাবেন না- যারা রাগ দেখায়, গালাগালি করে, তাদের মুখ এমন হতেই পারে না।
তারপরও যদি তিনি গালাগালি করেন, তবে সৌন্দর্যের প্রতি আমার আস্থাটাই হারিয়ে যাবে!
বললাম, “মন্দির দেখতে এসেছি। জুতা কি খুলব?”
বৃদ্ধা হেসে বললেন, “জুতা খুলতে হবে না। এটা তো চত্বর! আমরাও চটি পায়ে। সামনে যাও!”
মুখে হাসি আনার ব্যর্থ চেষ্টা করে এগিয়ে গেলাম মন্দিরের দিকে!
লম্বা বাঁধানো চত্বরটা পেরিয়ে মন্দির-পরিচিতিটা পড়তেই হতবাক হয়ে গেলাম আবারও। মন্দিরটা ১৭৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত!
প্রায় আড়াইশো বছরের পুরাতন মন্দির, তারপরও এর এই অবস্থা? রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রায় জীর্ণ- চারদিকে দোকান, আলো পর্যন্ত আসে না ভাল করে। এদেশের কোন পুরাতন মসজিদ কি আছে এমন জীর্ণ দশায়?
দেখার কিছুই নেই। মূল মন্দিরের ভেতরে আলো নেই এখানেও। বিগ্রহ দেখতে পারলাম না।
ফিরে এসে বসলাম বৃদ্ধার পাশে। তিনি বাচ্চাটার সাথে গল্প করতে করতে বাঁধাকপি কাঁটছিলেন।
জিজ্ঞেস করলাম, “কে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন? এখন এই অবস্থা কেন?”
মনে প্রশ্ন জেগে ছিল অনেক, হড়বড় করে সব করে ফেলতাম হয়ত। কিন্তু প্রথম প্রশ্নট শুনেই হাসলেন তিনি। ভোরের প্রথম সূর্যালোকের মত নির্মল সৌম্য তার হাসি। চুপ করে তাকিয়ে থাকতে হলো তার মুখের দিকে, মন্ত্রমুগ্ধের মত।
তিনি বললেন, “মন্দিরটা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাজেন্দ্র বাবুর বাবা। রাজেন্দ্রবাবুরা শ্রীনগরের জমিদার ছিলেন!”
কিন্তারগার্টেনের কথা মনে পড়ে গেল। কল্পনা ম্যাম সুর করে পড়াতেন আমাদের, অনেকটা মায়েদের মত, মায়েরা যখন গল্প শোনায় সন্তানকে, তখন তাদের গলায় এমন সুর গলে পড়ে। বৃদ্ধা আমাকে কথাগুলো বললেন বাচ্চাকে গল্প শোনানোর সুরেই।
প্রশ্ন করলাম, “ওরা এখন কোথায়? জমিদার বাড়িটা কোন দিকে?”
বললেন, “তারা কী আর আছে? সেই দেশভাগের পর চলে গেছেন। আর ফেরেননি। ওদের বাড়িটাও আর নেই। কিচ্ছু নেই। শুধু এই নাটমন্দিরট আছে। জমিদার বাড়ি ভেঙ্গে শ্রীনগর হাইস্কুল আর কলেজ হয়েছে। ওদের জমিতেই সব কিছু। কিন্তু কোথাও ওদের নাম নেই!”
কথাগুলো বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বৃদ্ধা। আমি শুধু সিনেমাতেই কোন বৃদ্ধাকে এভাবে কথা বলতে দেখেছি। আস্তেধীরে, প্রতিটা শব্দে গুরুত্ব দিয়ে বললেন তিনি।
জিজ্ঞেস করলাম, “ওদের বংশধরেরা কোথায়? আসেনা এখানে?”
বৃদ্ধা আবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওরা পশ্চিমবঙ্গে। রাজেন্দ্রবাবু তো অনেকদিন মারা গেছেন। ওর নাতি এসে কয়কবছর আগে দেখে গেছে। কী যেন নাম রাজেন্দ্রবাবুর নাতির? হ্যাঁ...মনে পড়েছে, খোকাবাবু। খোকা বাবু এসে কিছুদিন ছিলেন!”
জিজ্ঞেস করলাম, “জমিদার বাড়ির কিচ্ছুই কি বাঁকি নেই?”
পশ্চিম দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে তিনি বললেন, “ওদিকে যাও। একদম ভাঙ্গা কয়েকটা ঘর আছে। খুব দেখার ইচ্ছা করলে, দেখো!”
বিদায় নিলাম বৃদ্ধার কাছ থেকে। তিনি আবার বাচ্চাটার সাথে কথা বলতে শুরু করলেন। বৃদ্ধাকে আমার মনে থাকবে অনেক দিন।
ঠিকই বলেছিলেন তিনি। কিচ্ছু অবশিষ্ট নেই আর। শুধু কয়েকটা ঘরের কংকাল পড়ে আছে, ছাদ নেই। সেখানেও বসবাস করছে কয়েকটা পরিবার। এরা যে জমিদারের বংশধর না, তা বলাই বাহুল্য। এই ঘরগুলো নাটমন্দিরের পাশেই। দেখলাম, মন্দিরেও ছাদেও বাস করছে একটা পরিবার। লুঙ্গি, শাড়ি, একটা সাদা ছেড়া স্যান্ডগেঞ্জি মেলে দেয়া রোদে।
আচ্ছা, সেই যে খোকাবাবু এসেছিল, রাজেন্দ্রবাবুর নাতি- ও তো ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছিল দাদুর জমিদারির কথা। ওর মা হয়ত ওকে গল্প শোনাত ছোটবেলা থেকেই, বাংলাদেশের জমিদারি নিয়ে। বিরাট পুকুর, যতদূর চোখ যায় জমি, নাটমন্দির, হাজার হাজার প্রজা- আরো কত কী! খোকাবাবু যখন এলো এখানে বড় হয়ে, তখন এই ভাঙ্গা বাড়ি, জীর্ণ নাটমন্দির দেখে কেমন লেগেছিল তার? এখানে এখন তার দাদুকে কেউ চেনে না, কেউ জানে না তার কথা। এখানে এসে কি খোকাবাবুর মনে হয়েছিল, তার মা সব বানিয়ে বানিয়ে বলেছে? তাদের আসলে জমিদারিটারি ছিলই না?
কিংবা রেগে গিয়েছিল কি খোকাবাবু সেই রাজনীতিবিদদের উপর যারা ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ করে তাদের ভিটে ছাড়া করল? বাধ্য করল এমন জমিদারি ছেড়ে অন্য দেশে যেতে? পূর্বপুরুষের ভিটাতে আসতেও তাকে ভিসা করতে হলো, পার হতে হলো বর্ডার- এসবের জন্য কি কাউকে দায়ী করেছে সে? প্রচন্ড ক্ষোভে সেই রাজনীতিবিদদের গালি দেয়নি একবারও?
ভাঙ্গা বাড়িটার উঠোনে রোদে পিঠ দিয়ে বসেছিল এক যুবক। আমাকে দেখতেই উঠে দাঁড়াল। বলল, “দেখতে এসেছেন?”
হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লাম। জিজ্ঞেস করলাম, “সরকার এই বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ করছে না কেন?”
ছেলেটা জবাব দিল না সাথে সাথে। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই বাড়ি সংরক্ষণ করলে, আমাদের তো তাড়িয়ে দেবে। আমরা কোথায় যাব? আমাদের যে আর যাওয়ার জায়গা নেই!”
ছেলেটার প্রশ্নের জবাব দিতে না পেরে বেড়িয়ে এলাম বাইরে। এবারে বুঝলাম, সেই টেকো লোকটা কেন আমাকে সরকারি লোক ভেবে ভয় পেয়েছিল! ও হয়ত ভেবেছিল, আমি মাপজোক নিতে এসেছি। সেই গম্বুজওয়ালা মন্দির সংস্কার করলে, তাকেও ঘরছাড়া হতে হবে। সেই ভয়টাই ফুটে উঠেছিল ওর মুখে, শ্যেনদৃষ্টিতে।
একা একা ঘুরতে আসার সুবিধা অসুবিধা দুটোই আছে। সুবিধা হলো, যেখানে ইচ্ছে যাওয়া যায়, যা খুশী করা যায়। অসুবিধা হলো, কথা বলার মত পাওয়া যায় না কাউকে। যেহেতু একা এসেছি, কথা বলতে হবে তাই মনের সাথে। মনের সাথে কথা বলা শিখে গেলে, আর একা লাগে না কখনো।
মনকে বললাম, “দেখলি, বাংলাদেশের অবস্থা? এত পুরাতন জমিদার বাড়ি, মন্দির কোনটারই দেখভাল হচ্ছে না! ইতিহাস এভাবে চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে!”
মনের আরেক অংশ জবাব দিল, “এসব রোম্যান্টিক বালছাল ছাড়! জীবনে তো প্রচুর জমিদার বাড়ি দেখলি, কোনদিন জমিদারের কোন প্রজার বাড়ি দেখেছিস?”
বললাম, “না তো!”
মন জবাব দিল, “কোনদিন দেখবিও না। জমিদার শালারা প্রজাদের শোষণ করে করে মোটা থামের বাড়ি বানিয়েছে, বিশাল বিশাল পুকুর খুঁড়েছে, নাটমন্দির বানিয়েছে, বাবার শশ্মানের উপর মন্দির বানিয়েছে। সব গরীব লোকের টাকায়। এসব দেখে তুই শালা আহাউহু করছিস। ভাবছিস, দুইশো বছর আগের জীবন কত সুখের ছিল! গোয়ালভরা গরু, পুকুরভরা আম! হাতির দাঁতের গ্লাসে পানি খাওয়া যেত, কাসার প্লেটে ভাত! আহা! আরে বলদ, এসব ছিল জমিদারদের, রাজাদের! আর গরীবেরা খাবারের অভাবে মরত, ঠাণ্ডায় মরত। জমিদারের মোটা থাম- এখনো তাও টিকে আছে। রাজেন্দ্রবাবুর কোন প্রজার বাড়ি দেখাতে পারবি? পারবি না। আজ থেকে ২০০ বছর পর, তোর নিজের বাপের বানানো বাড়িটাও থাকবে না। তোর মত কেউ ঘুরতে ঘুরতে তোর খোঁজ চাইবে না। ওরা যাবে এখনকার শাসকদের বাড়ি। ওদের অট্টালিকা ঘুরে ওরা আহাউহু করবে। এরা যে কী পরিমাণ দুর্নীতি করে এমন আলিশান বাড়ি বানিয়েছে, সে সব তো তারা জানবে না! বলবে, আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম!”
বললাম, “কিন্তু ইতিহাস? এসব বাড়ি তো ইতিহাসের অংশ। সংরক্ষণ করতে হবে না?”
মন ঝাড়ি দিয়ে বলল, “রাখ শালা ইতিহাস। ইতিহাস শুধু জমিদারদেরই আছে? সাধারণ লোকেদের ইতিহাস নেই? জমিদারদের জীবন যাপনই ইতিহাস, গরীর প্রজাদের জীবন কোথায় তোর ইতিহাসে? বললাম তো, আজ থেকে ২০০ বছর পর বঙ্গভবন গণভবন লোকে ঘুরে ঘুরে দেখবে- তোর বাড়ি থাকবে না ঘুরে দেখার জন্য। তোর বাড়ি তোর আর অত মজবুতভাবে তৈরি করা নয়! তোর ভার্সিটির ভিসির বাড়িতেও লোকে যাবে, এদিকে তোরা যে বারান্দায় থাকিস কেউ জানবে না, মনে রাখবে না। জমিদার বাড়ি দেখলে আমাদের ভাল লাগে কেন জানিস? কারণ আমরা এসব দেখে নিজেদের জমিদারের জায়গায় কল্পনা করি। ভাবি, দুইশো পাঁচশো বছর আগে জন্মালে এই হাঁতির দাঁতের গ্লাসে আমি সুরা পান করতাম, এই হরিণের চামড়া দিয়ে বাঁধানো খাতায় আমি লিখতাম ইত্যাদি। কিন্তু যদি নিজেদের প্রজা হিসেবে কল্পনা করতাম, তাহলে কিন্তু এসব ভাল লাগত না। সাধারণ প্রজা হয়ে জন্মালে তো জমিদার বাড়িতে ঢোকার অনুমতিই পেতি না, বোকচো*! তুই চাইলেই বঙ্গভবন গণভবণে ঢুকতে পারবি?”
বললাম, “না পারব না। কিন্তু তাই বলে, চোখের সামনে এভাবে এসব ধ্বংস হওয়া দেখলে খারাপ লাগবে না?”
মন বলল, “নষ্ট হচ্ছে কৈ? ঐ তো ওরা আছে। ছেলেটা কী বলল, শুনলি না? ওদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। আমাদের মত সাধারণ মানুষের শোষণের টাকাতেই তো এসব জমিদার বাড়ি গড়ে উঠেছে। সেখানে এখন সাধারণ গৃহহীন মানুষ আছে, সাধারণ লোকের ছেলে মেয়েরাই সে জমিদার বাড়িতে স্থাপিত স্কুলে লেখাপড়া করছে। খারাপ কী? এটা হলো প্রকৃতির প্রতিশোধ!”
বললাম, “দেশভাগ না হলে কী ওরা এভাবে থাকতে পারত?”
মন বলল, “দেশভাগ না হলেও জমিদারি টিকত না। কটা প্রাচীন জমিদারি টিকে আছে এখন? যাদের দেখবি সব নব্যধনী!”
বললাম, “তাও, ঠিক মেনে নিতে পারছি না! ঐ রাজেন্দ্রবাবুর নাতি, খোকাবাবু, তার তো খারাপ লেগেছে এসব দেখে! দেশভাগ না হলে ও এসব পেত!"
মন বলল, “খারাপ লাগবে কেন শুনি? গরীব পরিবারে লোকে জন্মায় না? তারা আফসোস করে? ধর, দেশভাগ হয়নি, জমিদারিপ্রথাও আছে। রাজেন্দ্রবাবুর নাতি জমিদার হয়ে শাসন করছে। সারাদিন মদ বাইজি নিয়ে আছে- জোর করে মেয়েদের ধরে টরে নিয়ে আসছে। ব্যাপারটা খুব ভাল হত? জমিদার রাজারা তোর মত রোম্যান্টিক ছিল না, ওরা খাজনা না পেলে যাচ্ছেতাই রকমের অত্যাচার করত। বাড়ি মেয়েদের ধরে আনা তো সামান্য ব্যাপার! জমিদার বাড়ি দেখে নস্টালজিক বিলাস মূর্খরাই করে!”
বললাম, “তাও…”
মন ধমক দিয়ে বলব, “চুপ থাক, শালা। কথা না বলে রাস্তা দেখ!”
মনের আজ মেজাজ ভাল নেই, তাই কথা বন্ধ করে চুপচাপ হাঁটতে লাগলাম। পিছন ফিরতেই দেখলাম, সেই বৃদ্ধা বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে উঠছেন মন্দিরের ছাদে। বাচ্চাটা হাসছে খিলখিল করে।

মন্তব্য ১০ টি রেটিং +৫/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ সকাল ৯:২২

রাজীব নুর বলেছেন: এরকম বাড়ি বহু আছে। অযত্নে অবহেলায় পড়ে আছে।

১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:৫০

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: হুম। অনেক

২| ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ সকাল ১০:৫৭

বিজন রয় বলেছেন: ব্লগে কি মনে করে!!

বলি একটু বেশি বেশি আশা যায় না?

আশাকরি ভাল আছেন।
শুভকামনা রইল।

১২ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ১২:১০

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: আসছি মাঝেমাঝে। মন্তব্য করা হচ্ছে না, এই যা

৩| ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৩:৪০

চাঁদগাজী বলেছেন:


ব্গের পাঠকদের বুঝার চেষ্টা করেন, লেখার ষ্টাইল বদলান।

১২ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ১২:১১

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: পাঠকদের বুঝতে পারলে তো হতোই।
এভাবেই লিখি আপাতত, দেখা যাক, পাঠক আসে কি না!

৪| ১২ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ১:২৬

অপর্ণা মম্ময় বলেছেন: যাক তুমি তাইলে এখনো ব্লগিং করো??? গল্প ভাইবা পড়তে ঢুকলাম। পড়ার পর গল্প লাগে নাই। এমন বাড়ি রিসেন্ট দেইখা আসছ নাকি? আগের দিনের জমিদার বাড়ি দেখতে ভালই লাগে। কিন্তু শাসক আর শোষিত এই হিসাবটা বরাবরই ছিলো।

১২ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ১:৩৫

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: মাঝেমাঝে লিখছি। কী যে লিখছি, সে নিয়ে আর নাই বললাম।
আমারও লাগে ভালই। মাঝেমাঝে ঘুরে বেড়াই। ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতাগুলোই লিখে রাখছি আপাতত!

৫| ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১:৫৯

আর্কিওপটেরিক্স বলেছেন: সুখপাঠ্য লেখা :)

২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ দুপুর ২:৫৮

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: ধন্যবাদ পড়ার জন্য

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.