নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভোগাই

আদি - অনন্ত

ভোগাই

ধরণী চাহিছে শুধু হৃদয়ে হৃদয়।

ভোগাই › বিস্তারিত পোস্টঃ

উন্নত দেশ গঠনের পূর্বশর্ত - সবার জন্য শিক্ষা

১৬ ই মার্চ, ২০১৩ রাত ১২:৪৫

''তুমি কি লোক, তোমার নাম কি? তোমার বাড়ী কোথায়? তুমি কি পড়? তোমার হাতে কি পুথি?

আমি বামন, আমার নাম রামনাথ। আমার বাড়ী বালী। আমি য-ফলা পড়ি। আমার হাতে শিশু শিক্ষা।

তুমি কি করিতেছ? আজ পড়িতে যাইবে না? বসিয়া আছ কেন? কি ভাবিতেছ? তুমি কি ভয় পাইয়াছ? ভয় কি? আমার সহিত আইস।

অলস হইও না। খেলা করো না। বেলা হইল। পড়িতে চল। গৌণ কর কেন? কাপড় পড়। পুথি লও, পাঠশালায় চল। তেমার পুথির মলাট কোথায় গেল? গুরুমহাশয় দেখিলে রাগ করিবেন।

ভোর হইয়াছে। আর শুইয়া থাকিও না। এখন মুখ ধোও। ঘরের ভিতর আলো আসিয়াছে। পাঠের পুথি হাতে লও। আগে নূতন পাঠ শিক্ষা কর, পরে পুরাতন পাঠ একবার দেখ। পাঠের সময় ভাল বলিতে না পারিলে সহপাঠিরা উপহাস করিবে। গুরু মহাশয়ও ভালবাসিবেন না।“ - মদনমোহন তর্কালংকার এর শিশু শিক্ষা বো থেকে নেয়া।



স্বাধীনতার চার দশক পার হয়ে গেল। ইতিহাস সাক্ষী; সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোর কথা—সেই সংগ্রাম, সেই স্বপ্ন, বিজয় দিবসের সেই সূর্যোদয়। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা স্বপ্ন দেখেছিলেন, মানুষ প্রত্যাশায় বুক বেঁধেছিল—এত আত্মত্যাগ, এত রক্তদান বৃথা যাবে না, প্রতিষ্ঠিত হবে সোনার বাংলা। সবার জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য নিশ্চিত হবে; ঘরে ঘরে জ্বলবে শিক্ষার আলো, বঞ্চনা আর বৈষম্যের বেড়াজাল থেকে মুক্তি পাবে আপামর জনগোষ্ঠী।



চার দশক পর সেই খতিয়ান, সেই আত্মজিজ্ঞাসার স্থান থেকে মনে হচ্ছে, সবার জন্য শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনে হয়তো কিছু সাফল্য আছে, কিন্তু পথচলা এখনো অনেক বাকি। শিক্ষার গুণগত মানই শুধু নয়, ঢালাও বাণিজ্যিকীকরণ আর ক্রমবর্ধমান বৈষম্য শিক্ষাকে নিয়ে যাচ্ছে এমন একটি জায়গায়, যেখানে সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী হয়ে উঠছে অসহায়। সীমাহীন কোচিং-বাণিজ্য, মূলধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত দুর্বলতা, শিক্ষকদের বহুবিধ সমস্যা, শ্রেণীকক্ষে শিখন-শিক্ষণ প্রক্রিয়ার দুর্বলতা, শিক্ষা প্রশাসনের বহুমুখী অন্তরায়, শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তকে শিক্ষার্থীবান্ধব, যুগোপযোগী চিন্তা-চেতনার অভাব ইত্যাদি অসংখ্য সমস্যার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে আছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। তবে অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এ দেশের মানুষ দারিদ্র্যকে প্রতিনিয়ত আলিঙ্গন করলেও শিক্ষার চাহিদাকে তারা ঠিকই মেনে নিয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থার অনেক ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার প্রথম স্তর প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তি করছে সন্তানদের। বাবা-মা-অভিভাবকদের অদম্য স্পৃহার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নীতিনির্ধারকদের রাজনৈতিক অঙ্গীকার, সরকারের সহায়ক নীতিমালা। ৯০ শতাংশেরও অধিক শিশু আসছে প্রাথমিক বা সমমানের বিদ্যালয়গুলোতে—উন্নয়নশীল একটি দেশে এ এক অভাবিত অর্জন। অবিরাম জীবনসংগ্রামী এই বাংলার গণমানুষ এভাবে কত অসম্ভবকেই না সম্ভব করেছে। দরিদ্র, নিরক্ষর মানুষের এই দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় অর্জিত হয়েছে ছেলেমেয়ের সমতা; মূলধারার প্রাথমিক শিক্ষায়তনে শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও এসে গেছে নারী-পুরুষের সমান হার। স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টারা এমন একটি স্বপ্নই তো দেখেছিলেন—জ্ঞানের রাজ্যে নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্রনির্বিশেষে সবার বিচরণ হবে সুনিশ্চিত।



বিগত চার দশকে এ দেশের মানুষ কতবার কতভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে, তা শুধু ইতিহাসের নথি নয়, পরিসংখ্যানেরও বিষয়বস্তু হয়ে আছে। ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়, প্রচণ্ড জলোচ্ছ্বাস, ভয়ানক বন্যা-খরা-মঙ্গা একদিকে অগণিত মানুষকে করেছে সর্বস্বান্ত, অন্যদিকে যথারিতি দুর্নীতি, দুঃশাসন, শিক্ষা সংশ্লিষ্ট মহলের তদারকির অভাব। কিন্তু এত বিপর্যয়, এত ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যেও কখনো থেমে যায়নি এ দেশের মানুষের জীবন ও জীবিকার সংগ্রাম, জ্ঞানের আলোর সন্ধানে অবিরাম পথচলা। এর নিদর্শন আজ সর্বত্র দৃশ্যমান। ঢাকা নগরের সুরম্য অট্টালিকার পেছনে গড়ে ওঠা বস্তির উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্রে শিশু-কিশোরদের কলকাকলিতে মুখরিত শিক্ষায়তন, গ্রামের মেঠোপথে বইপুস্তক বুকে জড়িয়ে একঝাঁক কিশোরীর দ্রুত পদে স্কুলমুখে যাত্রা অথবা উপকূলের কোনো এক প্রত্যন্ত গ্রামে সাঁকো পেরিয়ে দূরের হাইস্কুলে সকাল-সন্ধ্যা কিশোর-কিশোরীদের যাতায়াতের দৃশ্য, কিংবা মহানগরের ভয়াবহ যানজটে আটকে পড়া কোনো এক স্কুলের তিন চাকার খাঁচাসদৃশ ভ্যানে গরমে-ক্লান্তিতে হাঁসফাঁস করা শিশুর দল—এসবই তো আজ আমাদের জীবনের প্রাত্যহিক চিত্র। নিত্যদিনের এই দৃশ্যই শুধু নয়, পরিসংখ্যানও বলছে, আমাদের জনমানুষের মনে শিক্ষার চাহিদা নিয়ে কোনো গলদ নেই, গলদ আছে অন্যত্র—শিক্ষার নিরবচ্ছিন্ন, যথাযথ সরবরাহে, গুণগত মানে।

বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী চার দশক আগে (১৯৭০) প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ৩০ হাজারের কম, এখন তা বেড়ে হয়েছে ৮২ হাজারেরও বেশি, ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাও বেড়েছে প্রায় চার গুণ। অভাবিত পরিবর্তন এসেছে নারীশিক্ষকের সংখ্যায়। ১৯৭০ সালে মূলধারার প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে তিন শতাংশেরও কম নারীশিক্ষকের স্থানে এখন আছেন প্রায় ৪৮ শতাংশ। স্কুলে ভর্তি হওয়া ছেলেমেয়ের সংখ্যা সমান সমান।



ইতিবাচক পরিবর্তন মাধ্যমিক স্তরেও দৃশ্যমান। ১৯৭০ সালের তুলনায় স্কুলের সংখ্যা বেড়েছে চার গুণেরও বেশি, তবে এর সিংহভাগই হচ্ছে বেসরকারি। সরকারি মাধ্যমিক স্কুলের সংখ্যা বেড়ে মাত্র দ্বিগুণ হয়েছে। নারীশিক্ষকের হার ৭ দশমিক ২ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ২৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। তবে অভাবনীয় পরিবর্তন এসেছে ছাত্রীসংখ্যার ক্ষেত্রে—মাধ্যমিক স্তরে বর্তমানে অর্ধেকেরও কিছু বেশি হচ্ছে মেয়েশিক্ষার্থী। ‘এডুকেশন ওয়াচ’ গবেষণার মাঠজরিপ থেকে জানা যায়, ষষ্ঠ শ্রেণীতে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের অংশগ্রহণ শতাংশ হারে যতখানি বেশি, দশম শ্রেণী সমাপ্ত করার আগে তারা ঝরে যায় ঠিক তত হারে। অংশগ্রহণের এই হার কমতে কমতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গিয়ে এক-চতুর্থাংশ হয়ে যায়। অবশ্য চিকিতসা বিজ্ঞান, প্রকৌশল, স্থাপত্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রধানত সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠীর মেয়েদের অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে বেশি। তবে শিক্ষার সব ধারায়, সর্বস্তরে ঝরে পড়ার প্রবণতা আমাদের সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থার একটি হতাশাব্যঞ্জক চিত্র। সরকারি-বেসরকারি তথ্য-উপাত্ত থেকে মোটা দাগে এটা আজ প্রতীয়মান হয়ে উঠেছে, প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হওয়া ১০০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩০ জনও উচ্চশিক্ষার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতে পারে না। যাঁরা কোনোক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ মাড়াতে পারেন, তাঁদের জন্য অপেক্ষা করে এক অবিশ্বাস্য জগত। তথাকথিত ছাত্রনেতাদের নিজ নিজ দল অথবা দলের ভেতরে উপদলের ওপর আধিপত্য বিস্তারের অসুস্থ প্রতিযোগিতা, সিট-বাণিজ্য, মাদক আর অস্ত্রের দাপটে জিম্মি হয়ে থাকে অধিকাংশ শিক্ষার্থী। উচ্চশিক্ষার সার্বিক পরিবেশ হয়ে ওঠে নেতিবাচক। নীতিনির্ধারণী মহলও আজ এসব রূঢ় বাস্তবতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। সময় হয়েছে বহুমুখী চিন্তা-ভাবনা করার, শিক্ষানীতি-২০১০, দিনবদলের সনদের সঙ্গে সমন্বিত করে তৈরি হওয়া ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, প্রাথমিক শিক্ষার সামগ্রিক উন্নয়নে প্রণীত হওয়া প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি-২-এর যথাযথ বাস্তবায়ন। সব শিশুকে স্কুলে আনা ও ঝরে পড়া রোধ করতে বহুমুখী কর্মসূচি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন থেকে শুরু করে উপবৃত্তি কর্মসূচি সম্প্রসারণ, যথাযথ শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শ্রেণীকক্ষে উন্নততর শিখন-শেখানো প্রক্রিয়া চালু, শিক্ষাক্রম পর্যালোচনা, পাঠ্যপুস্তকের পরিমার্জন, শিক্ষা প্রশাসনকে সুবিন্যস্তকরণ, শিক্ষার সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে অধিকতর বিনিয়োগ এখন সময়ের দাবি।



আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের সব অর্জনই ম্লান হয়ে যাবে, যদি আমরা সব মানবসন্তানের জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে না পারি। কিন্তু মানসম্মত শিক্ষার জন্য চাই মানসম্মত শিক্ষক। সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকারকে অভিবাদন জানিয়েছি, যখন দেখেছি সম্প্রতি প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় কোনো চাপের কাছে তারা নতি স্বীকার করেনি। যদি কখনো এ ধরনের অন্যায়, অনৈতিক চাপের কাছে জনগণের বিপুল ভোটে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার নতি স্বীকার করে, তাহলে যে দিনবদলের আশ্বাস দিয়ে ভোট অর্জন করা হয়েছিল, সেই আস্থা কি অবিচল থাকবে? আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠী ‘দরিদ্র, অক্ষরজ্ঞানহীন’ হতে পারে, কিন্তু হিসাব-নিকাশের পালা যখন আসে, তখন তারা কঠিন-কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করে না। ‘সবার জন্য শিক্ষা’র লক্ষ্য অর্জনের যেকোনো কৌশল, যেকোনো আয়োজন, যেকোনো বিনিয়োগও এ দেশের মানুষ সেই তুলাদণ্ডেই বিচার করবে। আমরা কি সে জন্য প্রস্তুত?

সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু ‘সবার জন্য শিক্ষা’র দাবিকে আমরা এখনো সর্বদলীয় মতৈক্যের স্থানে নিয়ে যেতে পারিনি। এ দায় কার? আমাদের সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠী, শিক্ষিত সমাজই বা এ ব্যাপারে কতটুকু সচেতন, কতখানি দায়িত্বশীল?

শিক্ষা মানুষ গড়ার হাতিয়ার—সেই শিক্ষা যেন এমন মানুষ তৈরি না করে, যা তাকে যেকোনো মানবসন্তানকে অবদমিত রাখার অথবা তার অধিকার হরণের পথ দেখায়। সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা চাই, আলোকিত মানুষ গড়ার শিক্ষা চাই—স্বাধীনতার চার দশক শেষ করে এই হোক আমাদের দিপ্ত অঙ্গীকার।



লেখা পড়া করে যেই। গড়ী ঘোড়া চড়ে সেই ॥

লেখা পড়া যেই জানে। সব লোক তারে মানে ॥

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.