![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বাংলার ইতিহাস জানতে গিয়ে মধ্যযুগের মুসলিম ঐতিহাসিক ছাড়া যাঁদের অবদান সর্বত্র বিরাজিত তাঁরা হলেন কতিপয় ইংরেজ মনীষী। ব্রিটিশ ভারতে সুপ্রীমকোর্টের অন্যতম বিচারপতি উইলিয়াম জোন্সের নেতৃত্বে ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দে ১৫ই জানুয়ারি এশিয়াটিক সোসাইটি স্থাপিত হয়। প্রাচীন ভারতের লুপ্তপ্রায় ইতিহাসের অনুসন্ধান করতে গিয়ে তারা খননকার্যে অর্থ যুগিয়েছে, ব্রাহ্মী ও খরোষ্টি ভাষায় লিখিত অভিলেখগুলির পাঠোদ্ধার করেছে, সভ্যতা ও ইতিহাসের উপাত্ত তুলে ধরেছে এবং ইতিহাসের ধারাবাহিকতার একটি কাঠামো সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছে। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম, মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে আবিষ্কৃত বা উন্মোচিত্ত আমাদের অতীত ইতিহাসকে জানার জন্য কিছুটা হলেও আমরা নিকটে পেয়েছি। বাংলার ইতিহাস অবশ্যই তাদের কাছে ঋণী।
আদি বাংলার সমসাময়িক কালের লেখা কোনো ইতিহাস আমাদের সামনে বর্তমান নেই, আর থাকার কথাও নয়।প্রাথমিকভাবে ভাষার ক্ষেত্রে ততটা অগ্রসর ছিল না, আর ভাষা যখন তৈরি হলো তখনও ইতিহাসের প্রয়োজন তেমন বোধ করেনি। এদেশের বনজঙ্গল পরিষ্কার করে যারা মানুষের বাসোপযোগী করেছে, অনাবাদী জমিকে আবাদ করে যারা মানুষের খাদ্য যুগিয়েছে, বিনা কারণেই যারা নিজেদের তৈরি করা বাড়ি-ঘর, জমি-জিরাত থেকে বারে বারে উচ্ছেদ হয়ে বন-জঙ্গলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে, তারা আজ সভ্য মানুষের ভাষায় উপজাতি, তারা নিমড়ববর্ণ, তাদের অনেকে অচ্ছুত।এদেশে মানব সভ্যতার ক্রমবর্ধমান অগ্রগতিতে তাদের কর্মের স্বীকৃতি তারা না পেলেও, সভ্য জগতের কাছে তারা দেশের আদিবাসী এবং এদেশের মাটির সন্তান এতটুকু সত্য স্বীকার করে নিতে দোষ কোথায়? তাদের আদিম অবস্থাকে পিছনে ফেলে সভ্যতার আলোর দিকে তাদেরকে এগিয়ে নিতে কোনো সাফল্যের হাত প্রসারিত না হলেও তাদের দুঃখ নেই, কিন্তু তাদেরকে উপজাতি বলে উপহাস করার অধিকার কারো কি আছে? যুগে যুগে ভূমিপুত্ররা শুধু আমাদের দেশে নয়, সব দেশে, সব কালেই, মুষ্ঠিমেয় আগন্তুকের কাছে পরাজিত হয়ে নিজেদের জায়গা জমি থেকে উৎখাত হয়েছে। এদেশে এসেছে দ্রাবিড়রা, জয় করেছে বাংলার সমতলভূমি। সঠিক প্রমাণ না থাকলেও অনুমান করা যায় কোনো এক সময়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ হয়েছিল। তারপর এসেছে মঙ্গোলীয় জাতিগোষ্ঠী, এসেছে আর্যাবর্তের সৌম্যকান্তি, সুন্দর দেহধারী, আধ্যাত্মিকতায় অগ্রসর আর্য জাতি। তাদের কাছেও বাংলাদেশের মিশ্ররক্তের ভূমিপুত্ররা শুধু নতিস্বীকার করেনি, তাদের দাসত্ব স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল। তারপর এসেছে শক, হুন। তারাও নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করে নিয়েছে।এরপর আসে আফগান, তুির্ক, ইরানি এবং মোঘলরা। এবার গৌরবোজ্জ্বল আর্যসহ ভূমিপুত্ররা তাদের পদানত হয়েছে। এসেছে ওলন্দাজ, ইংরেজ, ফরাসি। এভাবেই যুগের পর যুগ ধরে বিদেশীরা এসেছে এবং বাংলাদেশ জয় করেছে।ভূমিপুত্রদের পরাজয়ের ইতিহাস থেমে থাকেনি। তারপরও তারা টিকে আছে, ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে মুছে যায়নি, যেভাবে মুছে যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীরা, মুছে গেছে আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ান এবং দক্ষিণ আমেরিকার মায়া সভ্যতার অধিকারীরা। দেশের মাটিতে আজও যারা টিকে আছে সেই নির্যাতিত ভূমিপুত্রদের কথা জানতে চাই। যারা এদেশের আদিম অধিবাসী, জানতে চাই তাদের ইতিহাস; যাদের রক্ত আজও এদেশের মানুষের গায়ে প্রবাহিত জানতে চাই তাদের ইতিহাস, যাদের অবদানে নবাগতরা বাংলাদেশী হতে পেরেছে এবং এই দেশে নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছে।
তিন হাজার’ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে বাংলাদেশের ভূমিপুত্রদের সঠিক অবস্থা ও অবস্থান এখনও প্রায় অজ্ঞাত। এদেশের আদিবাসীদেরকে অস্ট্রোলাইড (Australoid) বা অস্ট্রিক (Austric) জাতির সঙ্গে রক্তসম্পর্কিত বলে পণ্ডিতব্যক্তিগণ ধারণা করেন এবং এ সম্পর্কে যথেষ্ট যুক্তিও রয়েছে। এ বিষয়ে সবাই প্রায় একই মতো পোষণ করেন। দ্রাবিড়দের এদেশে আগমনের পূর্বে বা তাদের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক গড়ে উঠার কালেও ভূমিপুত্রদের ভাষা এবং অক্ষর বা বর্ণমালা ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়, তবু তাদের পূর্বপুরুষ বা সমকালীন অবস্থা সম্পর্কে কোনো লিখিত তথ্য পাওয়া যায় না। সেজন্যই এদেশের আদি ইতিহাস জানার জন্য অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে আর্যদের লিখিত অবদানের উপর নির্ভর করতে হয়েছে, যারা কোনোদিনই এদেশের জনগণের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন ছিল না। আর্যরা তাদের রচিত দিব্যজ্ঞানে পরিপূর্ণ মূল্যবান গ্রন্থাদিতে বাংলাদেশে বসবাসকারীদেরকে অত্যন্ত ঘৃণা ও ক্ষোভের সঙ্গে উল্লেখ করেছে, কোনো কোনো সময় অতিরঞ্জিত ভাষায়, আবার কোনো কোনো সময় অস্বাভাবিক কল্পকাহিনীর মাধ্যমে। অবশ্য সে সময়কার লেখা কোনো গ্রন্থে সরাসরিভাবে বাংলার ইতিহাস লেখা হয়নি। তবুও কোনো কোনো বিষয়, বস্তু বা অঞ্চলের নাম-ধাম বা ঘটনা সম্পর্কে ইঙ্গিত বা অবস্থার পারিপার্শ্বিকতা বর্ণনা বা বক্তব্য পাওয়া যায়। এসব লেখাতেও বাংলার ভূমিপুত্রদের সম্পর্কে অতি নিকৃষ্ট ধরনের বক্তব্যই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উপস্থাপন করা হয়েছে যা হয়তো বাস্তবসম্মত বর্ণনা নাও হতে পারে।আর্যদের প্রায় গ্রন্থেই বাংলায় বসবাসকারী সমস্ত জনগোষ্ঠীকেই বর্ণ-সংকর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সংকর বর্ণের লোকদের সম্পর্কে আর্যদের ধারণা আমরা জানি- তাদের ধর্ম নেই, ধন নেই, মান নেই এবং অতীত ছিল না এবং ভবিষ্যতও থাকবে না। সংকর বর্ণ কিভাবে জন্ম হয়, এ বিষয়ে আর্যপুত্র মহাবীর অর্জুনের বক্তব্য গীতাতে খুব পরিষ্কারভাবে লিপিবদ্ধ আছে:
স্ত্রীষু দুষ্টাসু বার্ষ্ণেয় জায়তে বর্ণসঙ্করঃ॥৪০
সঙ্করো নরকায়ৈব কুলসড়বানাং কুলস্য চ।
পতন্তি পিতরো হ্যেষাং লুপ্তপিণ্ডোদ কক্রিয়াঃ॥৪১
দোষৈরেতৈঃ কুলসড়বানাং বর্ণসঙ্করকারকৈঃ।১
(অধর্মে পতিত কুলনারীগণ ব্যভিচারিণী হয়ে বর্ণ সংকর জন্ম দেয় এবং এদের দ্বারা কুলের নরকবাস হয়। কারণ, এরা শ্রাদ্ধ তর্পনাদি ত্যাগ করাতে পিতৃপুরুষ নরকে যায়)।
আর্যপুত্রদের উত্তরসুরী ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়, এমনকি বৈশ্যরাও যুগ যুগ ধরে বাংলার জাতিসত্ত্বার উদ্ভব ও পরিণতি ব্যভিচারিণী কর্তৃক জন্মজাত বর্ণ- সংকর বলে বিশ্বাস করেছেু বলেই বাঙালিদেরকে শূদ্র, নমঃশূদ্র ও অন্তজ হিসেবে বর্ণভুক্ত ও বর্ণ বহির্ভুত করেছে। একারণেই, বাংলার উচ্চবর্ণের ব্রাক্ষণ্যধর্মাবলম্বীরা নিজেদেরকে বাংলার আদিবাসী বলে পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করেছে আবার তেমনি, বাংলায় ধর্মান্তরিত অভিজাত শ্রেণীর মুসলমানরাও নিজেদেরকে বহিরাগত বলে পরিচয় দিয়েছে। একারণেই বোধ হয় সব ধর্ম ও বর্ণের সমন্বয়ে বাংলাদেশের ভিত্তিতে বাঙালির জাতীয়তাবাদ কখনো গড়ে উঠেনি। কারণ, যারাই সমাজ ও দেশ পরিচালনা করার সুযোগ পেয়েছে, তারা বাংলার সঙ্গে রক্ত সম্পর্ক খুঁজে পায়নি। আর রক্ত সম্পর্ক ছাড়া জাতীয়তাবাদের আসল ভিত্তি কখনও রচনা করা যায় না। এমনকি যেসব বাঙালিদের নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি তারা এখনও আর্য সামন্ততন্ত্রের এবং ব্রাহ্মণ্যবর্ণের প্রতিভু হিসেবে পরিচয় দিয়ে আদি ভূমিপুত্রদের স্পর্শ বাঁচিয়ে থাকতে অভিজাত্যবোধ করে।
এদেশে দ্রাবিড়দের বসতি স্থাপনের পরেও ভূমিপুত্রদের অবস্থার বিশেষ উন্নতি হয়েছে বা তাদের ভাষার শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। কালক্রমে বর্ণসংকর জাতিসত্তা হয়ে দাঁড়ায় সমতল ভূমিতে দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠী। কারণ, সমভূমির আদিবাসীদের সঙ্গে মিশে গিয়ে সৃষ্টি হয়েছে এক সংকর জাতিগোষ্ঠীর রক্তের ধারা, গড়ে উঠেছে নতুন কৃষ্টি ও সংস্কৃতি এবং উদ্ভব হয় ভূমিপুত্রদের চেয়ে অপেক্ষাকৃত উন্নততর সভ্যতার। দ্রাবিড় ভাষার সঙ্গে পরবর্তীকালে মিশে গেছে পালি ও প্রাকৃত এবং অনেক শব্দ ও পরিভাষা সংযুক্ত হয়েছে মঙ্গোলীয় জাতিগোষ্ঠী ও আদিবাসীদের ভাষা থেকে।
আবার ভূমিপুত্রদের ভাষা থেকে পালি ও প্রাকৃত ভাষা সমৃদ্ধ হয়েছে এ প্রমাণ পাওয়া যায়। একইভাবে অপভ্রংশ প্রাকৃত থেকে অভ্যুদয় ঘটে বাংলা ভাষার, জন্ম নিয়ে যতখানি সংস্কৃত ভাষা থেকে সমৃদ্ধ হয়েছে তার চেয়ে বেশি ঋণী ভূমিপুত্রদের ভাষার কাছে। এভাবেই স্তরে স্তরে পরিবর্তিত হয়ে মাত্র আট শত বছর পূর্বে বাংলা ভাষা তার নিজস্ব রূপ ও আকৃতি পেয়েছে। বৌদ্ধ পুরোহিতদের চর্যাপদকেই আদি বাংলার রূপ বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু তখনও বাংলা গদ্যের সুষ্ঠুরূপ প্রকাশ পায়নি। মাত্র চারশত বছর পূর্বে বাংলা গদ্যের প্র ম প্রকাশের নমুনা পাই; জনৈক ‘দোম আন্তেনিও রোজারিও’
১ শ্রীমদ্ভগবদগীতা সম্পাদিত গীতাশাস্ত্রী জগদীশচন্দ্র ঘোষ. পৃষ্ঠা- ১৫-১৬।
আদি বাংলার ইতিহাস (প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দ) ১ম পর্ব
২| ১৩ ই অক্টোবর, ২০১৩ সকাল ১১:৫৩
তৌফিক জোয়ার্দার বলেছেন: বেশ। একেএকে পড়ার ইচ্ছা আছে।
©somewhere in net ltd.
১|
০১ লা মে, ২০১৩ সকাল ৭:০১
বাংলার হাসান বলেছেন: অসাধারন কিছু ইতিহাস জানতে পারলাম। পরের পর্বের অপেক্ষায়